আসেন দূর্নীতির কথা বলি ------------------------------
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ১৯ মে, ২০১৯, ১০:৩২:৫৭ রাত
আমি এক কালে ব্যবসায়ের সাথে জড়িত ছিলাম। সে সময়ে সরকারের মন্ত্রী,এমপীসহ সরকারী উচ্চপদস্ত কর্মকর্তাদের সাথে আমার জানাশোনা ছিলো। অল্প বয়সে এমন কিছু দৃশ্য দেখেছি যা অনেক বুড়োরাও দেখতে পায় না। সরকারী ও বেসরকারী উচ্চ পদস্থদের বহু গোপন মিটিংয়ের সাক্ষী ছিলাম। তাদের উদ্দেশ্য,আদর্শ,চিন্তা,চেতনা,কর্মকান্ড দেখে মুখে হাসি রেখে মনে মনে হতাশ হয়ে পড়তাম। এরপর বাস্তবে ভয়ঙ্কর সব কর্মকান্ড ঘটতে দেখে মনে হত এরা কখনও মরবে বলে বিশ্বাস করেনা। সরকারী দল ও বিরোধী দল সকলের ক্ষেত্রেই এরকম কিছু কমন বৈশিষ্ট্য দেখেছি যা কল্পনাও করা যায় না। মনে হত ,এদের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য হল জোর করে অন্যের চোখে হিরো সাজা, মানুষের প্রশংসা অর্জনের ভেতর দিয়ে পয়সা কামানো, প্রভাব পতিপত্তি ধরে রাখার জন্যে ন্যায়-অন্যায়কে বিবেচনা,পরোয়া না করা।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্যে রাশিয়ান এম.আই-১৭ ফাইটার হেলিকপ্টার, চায়নার তৈরী সমুদ্র সীমান্ত টহল দেওয়া বিশেষ বোট,টহল হেলিকপ্টার,রকেট লাঞ্চার,বিশেষ বিশেষ মেশিনগানের গুলি এবং সামরিক নানান সরঞ্জাম সরবরাহের জন্যে কাজ করছিলাম। এ সময়ে আমার যে অভিজ্ঞতাগুলো হয় তা আশাব্যঞ্জক নয়। প্রচুর লবিং গ্রুপকে মোবাবিলা করতে হয়। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী এবং বিগ শটগণ সামরিক বাহিনীর ভেতর ঢুকে ব্যবসা করতে গিয়ে উচ্চপদস্ত অফিসারদেরকে কলুষিত করা সর্বোচ্চ চেষ্টা অব্যাহত রাখে। অবসরপ্রাপ্ত হয়ে বহু অফিসার ব্যবসায়ের সাথে যুক্ত হয়ে লোভী হয়ে ওঠে। যদিও সামরিক অফিসাররা দূর্নীতে জড়াতে চাননা,তবুও তাদেরকে দিয়ে তদবীর করাতে কিছু গ্রুপ উঠে পড়ে লাগে। একটা বিষয় দেখেছিলাম, নীম্ন রেট দিয়ে কাজ পাওয়ার সম্ভাবনা কম। রাশিয়ান এম.আই-১৭ রিকন্ডিশন্ড হেলিকপ্টার নিয়ে যখন কাজ করছিলাম তখন দেখলাম এই জিনিস চায়নার নরিনকো বা অন্য কোম্পানী থেকে হেলিকপ্টার কেনার মত বিষয় নয়। এটার দেনদরবার আলাদা। রাশিয়ার সরকার-সামরিক বাহিনী এবং ক্রেতার ভেতর আরেকটি গ্রুপ কাজ করে। আর এই গ্রুপের বেশ প্রভাবশালী একটা অংশ হল রাশিয়া ও তুরষ্কের কিছু বিগ বস।
এরা এশিয়া,আফ্রিকার গরিব,উন্নয়নশীল দেশের সরকারের লবিং গ্রুপগুলোর সাথে উষ্ণ সম্পর্ক রাখে। এরপর এদের মাধ্যমে লেনদেন হয় রাশিয়ার উক্ত ডিপার্টমেন্টের লোকদের। এরা কখনও পূর্বেই একটা পয়সা নেয় উঁচু প্রযুক্তির অস্ত্র বিক্রীতে রাশিয়াকে রাজি করাতে। কারন প্রত্যেক শক্তিশালী দেশেরই নিজস্ব কিছু নীতি রয়েছে,যা তাদের একান্ত নিরাপত্তা সম্পর্কিত। অনেক আধুনিক অস্ত্র উৎপাদক দেশগুলো বিক্রী করতে চায়না। তখন তাদেরকে নানানভাবে রাজি করাতে আরেকটি গ্রুপ কাজ করে। সফল হলে দুই দেশের উচ্চপদস্ত কর্মকর্তাদের ভেতর চুক্তি হয়। এর পূর্বেই দাম-দর,সরবরাহ,সার্ভিস সংক্রান্ত বিষয়গুলো নির্ধারিত হয়। তারপর জনগনের টাকার কিছু অংশ যায় উৎপাদকের পকেটে,কিছু অংশ যায় লবিং গ্রুপের পকেটে। আরও ভাগ আছে , যা দেশী ও বিদেশী। আমার মনে হয়েছিলো ,সামরিক বাহিনী নিজেরা উদ্যোগী হয়ে এসব জিনিস কিনলে ভালো হত। পুরো বিষয়টা সাশ্রয়ী হত। কিন্তু এসব বিষয়ে সরকারী নীতি এটাকে সমর্থন করেনা। আর সরকার তার এসব নীতি সংষ্কারও করবে বলে মনে হয়না। যাইহোক ওই লাইনে কিকআউট হয়েছিলাম।
সরকারের অন্য ডিপার্টমেন্টর বিষয়ে অভিজ্ঞতা অনেক বেশী ছিলো। সেনাবাহিনীর ভেতর তো কড়া নীতি নৈতিকতা রয়েছে,কিন্তু অন্য ডিপার্টমেন্টর ভেতর প্রকাশ্যে ডাকাতি হয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে অন্তর থেকে পছন্দ করি। বহু চড়াই উৎরায়ের পরও সরকারের এই ডিপার্টমেন্টটি মাথা উঁচু করে আছে। অন্য সব কটি ডিপার্টমেন্ট প্রকাশ্যে দূর্নীতিতে যুক্ত। এবং উচ্চ পদস্ত সরকারী কর্মকর্তাদের লজ্জা শরম নেই।
ধরুন জনগনকে বিতরনের জন্যে কম্বল কিনতে হবে, এরা রেট চাইবে। সেই কম্বল দেশী প্রতিষ্ঠানগুলো বানালেও ওরা ওদের থেকে নিবে না। আবার সরকারের খতের টাকা পকেটে নিয়ে সরকারী কর্মকর্তারা দর কষাকষি করে জিনিসটি কিনবে না। তারা বিদেশ থেকে কিনবে। তারা টেন্ডার আহবান করবে। সেসব টেন্ডারে অংশ নেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশ কিছু থাকবে সরকারের উচ্চ পদস্তদের আত্মীয়দের,বেনামে নিজেদের। আর যদি সেটা নাও থাকে, তবে টেন্ডারে অংশ নেওয়া লোকেরা ওদের কাছে গিয়ে বলবে, এতটাকা রেট দেব, এই অংশ আপনাদের,,এইটা আমার। ওভার ইনভয়েসিং এ এলসি যাবে, জিনিসের প্রকৃত দাম পাবে উৎপাদক কোম্পানী, বাকী টাকা বিদেশ থেকে হুন্ডিতে ঘুরিয়ে আনব। দর কষাকষির এক পর্যায়ে সরকারী কর্মকতারা বলে, ঠিক আছে কিন্তু আমরা বিদেশ গিয়ে টাকা নিতে পারব না, সমস্যা আছে। আপনি দেশ থেকেই অগ্রীম টাকা দিয়ে দিবেন, এর কাছে বা অমুক একাউন্টে পাঠাবেন। আর বিশাল অংক হলে বিদেশে ওদের বিভিন্ন একাউন্টে টাকা যায়। এভাবে টেন্ডার বাস্তবে ড্র হওয়ার বহু পূর্বেই কোনো কোম্পানী কাজ নিয়ে বসে থাকে।
এসব বিষয়ে তদবীর করতে করতে কখনও কখনও সরকারের ভেতর অনেকগুলো গ্রুপ চলে আসে এবং গোপনে দেখা করে টাকার ভাগ চায়। তখন তাদেরকে ম্যানেজ করতে গিয়ে প্রচুর পয়সা অগ্রীম খরচ হয় টেন্ডার পেতে চাওয়া কোম্পানীর। এত সব খরচ পোষানোর পর সরকারের শক্তিশালীরা যখন ওই কোম্পানীর উপর প্রবল সন্তুষ্ট হয়, তখন উক্ত টেন্ডার পাওয়া কোম্পানী খুশীর ঠেলায় একটা ৩০০টাকা মূল্যের বালিশের দামও ৬হাজার টাকা ধরে বসে এবং সেই বালিশ ৩ তলার উপর উঠাতে শ্রমিক মজুরী ধরে বসে ২ হাজার টাকা । যেহেতু দেখার কেউ নেই অথবা যারা ছিলো তারা পকেটের ভেতর, তাই এরা যা খুশী তা করতে পারে।
আপনারা যারা গত দুদিন আগের রূপপুর পারমানবিক কেন্দ্রের একটি সরকারী দরপত্র নিয়ে মহা তামাশায় মত্ত হয়ে আছেন, তাদের জানা উচিৎ, এটা স্রেফ একটা তুচ্ছ অংশ, যা আপনাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। এমন অনেক বিষয় আছে যা দেখলে আপনাদের ব্রেইন স্ট্রোক করতে পারে। আর এ কালচারটা কিন্তু নতুন না। এটা পূর্ব থেকেই চালু ছিলো, তবে কিছু কম আর বেশী। আপনারা রাজনীতির চালে এটাকে সরকারী অথবা বিরোধী বহু দোষে আখ্যায়িত করতে পারবেন, কিন্তু রাষ্ট্রের নাগরিকদের কাছে এটা হওয়া উচিৎ স্রেফ জনগনের পয়সা তসরুফ করা সংক্রান্ত বিষয়। হরিলুট বললেও কম বলা হবে। আর জনগণ যেটাকে নিয়ে হাসি তামাসা করছে,ওটা নিয়ে আসলে প্রতিবাদ হওয়া উচিৎ,টাকাটা আপনার। ট্যাক্স যেই প্রদান করুক না কেন, ওই টাকায় আপনার নায্য অংশ রয়েছে যা কিছু মানুষের পকেটে চলে যাচ্ছে। জনগনের জন্যে এটা একটা ভয়ঙ্কর বিষয়। বাজেটের কত শতাংশ প্রকৃতপক্ষে জনগনের কাছে সেবা আকারে যাচ্ছে আর কত শতাংশ লুটপাট হচ্ছে এটা জনগনের জানা জরুরী এবং হিসাব বুঝে নিতে অন্তত মৌখিকভাবে জোরালো প্রতিবাদ হওয়া জরুরী। ওরা জানে জনগণ দুদিন হাসাহাসি করে তৃতীয় দিনে আরেকটা ইস্যু নিয়ে হাসাহাসি,নাচানাচি করবে এবং পূর্বেরটা ভুলে যাবে। ফলে ওরা ওদের স্বার্থেই এই সিস্টেম চালু রাখবে এবং আরও জোরদার করবে। এদেশে অন্যায়ে প্রতিবাদের কথা উঠলে, এ ওর দিকে তাকায়,সে তার দিকে তাকায়, তারপর সকলে সকলের দিকে তাকিয়ে থেকে হোহো করে হেসে উঠে যার সে বাড়ি চলে যায়। হিরক রাজার দেশেও কখনও এরকম হয়নি।
বিষয়: বিবিধ
৭২৩ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মানুষ দেখতে চলো এবার যাদু ঘড়ে যাই সবাই।
মন্তব্য করতে লগইন করুন