অতিপ্রাকৃত অভিজ্ঞতা (??) - মাখন মামার পাহাড় অভিযান।

লিখেছেন লিখেছেন মাটিরলাঠি ১২ জুন, ২০১৪, ১১:২৪:১৮ সকাল



সাল ১৯৮৮-৮৯। একটি ওষুধের দোকান। তার মাঝখানে একটি টেবিল। এরই একপাশে বসতেন ডাক্তার দাদা। যখন রোগীর ভীড় বেড়ে যেতো, তখন বুঝা যেতোনা কে দোকানের কর্মচারী, কে রোগী। মহিলা রোগী এলে পিছনে একটি রুম ছিল সেখানে দেখতেন। রোগী দেখার চেয়ে উনি আড্ডা দিতে ভালো বাসতেন। আর এই আড্ডার লোভে আমরা ভীড় করতাম তার চেম্বারে, যদি একে চেম্বার বলা যায়। তখন আমি নতুন সদস্য। আর এখানেই পরিচয় হয় বিখ্যাত মাখন মামার সঙ্গে। রিটায়ার্ড পারসন। আসাম সরকারের কর্মচারী ছিলেন। ফরেস্ট অফিসার। রোগীর ভীড় বেশী হলে আমরা বাইরে রাস্তার পাশে বেঞ্চ-টুল নিয়ে বসতাম আর তখন আসরের মধ্যমণি মাখন মামা। তার বিচিত্র কর্মজীবন ও অভিজ্ঞতার ঝুলিও বিচিত্র। তবে মামা সবসময় দিতে পারতেন না।

একদিন ডাক্তার দাদা কলে গেছেন। আমাদের অধিবেশন চলছে। কি ভাবে যেন টপিকস উঠল অতিপ্রাকৃত অভিজ্ঞতা। আলোচনার ফাকেই মাখন মামা তার একটি অভিজ্ঞতা বললেন। শুনুন তার জবানীতেইঃ

“আমি তখন আসাম ফরেস্ট বিভাগে জব করছি। সেখানে একটি লেক ছিল। লেকটির তিন দিকেই খাড়া খাড়া পাহাড়, দক্ষিণ দিকে তেমন পাহাড় নাই। লেকটির উত্তর দিকের পাহাড় একেবারে খাড়া উঠে গেছে। পাহাড়ের শীর্ষ থেকে একটু নীচে পাহাড়ের দেয়ালে ভেন্টিলেটরের মত চারকোনা একটা জানালা দেখা যায়। লোকজনের বিশ্বাস ওটা একটা পাহাড়ী গুহার মুখ। ভিতরে একজন ঋষি বাস করেন ও তিনি সেখানে সাধনা করছেন আর উনি কখনো বাইরে আসেন না। উনি সেখানে গেলেন কি ভাবে আর খাওয়া দাওয়া করেন কি ভাবে, আর লোকজন তার ব্যাপারে জানল কি ভাবে -এ সব প্রশ্নের উত্তরে জনগণ নীরব।

দিনে দিনে আরো অনেক কথা তার সম্বন্ধে শুনতে শুনতে একসময় বিরক্ত ও কৌতূহলী হয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম ওই গুহার মধ্যে যাব। সিদ্ধান্ত হলো - পাহাড়ের মাথা থেকে রশি ও লোহার শিকল ঝুলিয়ে ভিতরে প্রবেশ করব, আমি একাই প্রবেশ করব, অন্য কেউ আমার সঙ্গী হতে রাজী হলো না। অনেকে ভয় পেলেন, প্রায় সবাই নিষেধ করলেন যেতে, তবে সবাই একমত, ওখানে গেলে আমার ক্ষতি হবে। পুরো বিষয়টিকে মানুষের কুবিশ্বাস বলে উড়িয়ে দিয়ে একদিন চারটি হাতি, জনা দশেক কর্মচারী, মাল-সামান, লোহার শিকল, খাবার, বন্দুক ও একটি রিভলবার নিয়ে রওনা দিলাম। লেকটি উত্তর দক্ষিণে ৪/৫ মাইল লম্বা হলেও, যেহেতু আমরা পূর্বদিকের দুর্গম পাহাড়ী পথ দিয়ে ঘুরেফিরে উত্তরের পাহাড়ে যাচ্ছি, আমাদের প্রায় ১৫/১৬ মাইল দীর্ঘ পথ যেতে হবে।



আমরা যতই আগাতে থাকলাম, পাহাড়ের গায়ের জানালাটি বড় হতে লাগলো, এভাবে দুই দিন চলার পর তৃতীয় দিন যখন উত্তরের পাহাড়ের চুড়ায় ঠিক জানালাটার উপরে পৌছালাম, তখন জানালাটার আরো বড় হয়ে গেছে, দশ ফুট বাই দশ ফুট একটি পাহাড়ী গুহার মুখ। কোমড়ে ও শরীরে দড়ি ও শিকল পেঁচিয়ে নিলাম, দড়ি ও শিকলের অন্য প্রান্ত আমার লোকেরা ও হাতি টেনে ধরে থাকল। আর একটি দড়ি মাথায় একটি ঘণ্টা বাধা হলো, অন্য প্রান্ত আমার হাতে থাকল, ভিতরে ঢুকার পর যদি কোন বিপদ হয়, ঘণ্টা বাজালে তারা আমাকে টেনে তুলবে।



সাথে দুটো টর্চ নিলাম। এরপর ধীরে ধীরে এসে জানালার নীচের প্লাটফর্মে দাঁড়ালাম। আমার একহাতে টর্চ, অন্য হাতে রিভলবার। ভিতরটা আসলেই পাহাড়ী গুহা, আর অন্ধকার, কিছুই দেখা যায় না। টর্চ জ্বালালাম, দেখলাম প্রচুর ঝুল, ময়লা, ধুলা, দেখে মনে হয় না এখানে কোন মানুষ থাকে বা মানুষ প্রবেশ করেছে। ভিতরে লাফ দিলাম। জুতো দুটো কয়েক ইঞ্চি ধুলায় দেবে গেলো। এক পা, এক পা করে আগাতে থাকলাম, একটু বাঁক নিয়ে টর্চ মারতেই দেখলাম একটা কয়েকফুট উঁচু পাথেরের প্লাটফর্ম, আর তার মধ্যে পদ্মাসনে দীর্ঘ জটাধারী দাড়ি গোঁফওলা এক সাধু বসে আছেন, পরনে শুধু একটি কাপড়ের নেংটি, চোখ দুটি বন্ধ, শরীর একেবারে শুকনা যাকে বলে অস্থিচর্মচার শুন্য, সারা শরীর ধুলা আর ঝুলে ভর্তি। কতদিন ধরে যে তিনি এভাবে বসে আছেন? সহসা সাধুটি দুচোখ খুলে আমার দিকে তাকালেন, তারপর একটা মৃদু হাসি দিয়ে ডান হাতটি খাড়া করে হাতের তালু আমার দিকে করে অভিবাদনের মতো করে তুললেন।

আমি সজোরে ঘণ্টা বাজিয়ে দিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলাম তার পর আর কিছু মনে নাই। আমাকে তাড়াতাড়ি করে উপরে তুলে ফেলল। জ্ঞান ফিরবার বেশ কিছুক্ষণ পর আমার সব কিছু মনে পড়ল। সকলে জানতে চাইলো আমি কি দেখেছি? কি ঘটেছিল। উত্তরে হাত তুলে বললাম, আছে! আর কিছু বললাম না। আমরা ফিরে আসলাম।”



এসময়ে ডাক্তার দাদা কল থেকে ফিরে আসলে সেদিনের মতো অধিবেশন মুলতবি হয়ে গেলো। একরাশ প্রশ্ন ও ভাবনা নিয়ে বাড়ী চলে আসলাম। বয়স অল্প হলেও এটা বুঝেছিলাম ইসলাম ও বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এটা সম্ভব নয়। এর অবশ্যই ব্যাখ্যা আছে, কি সেই ব্যাখ্যা আমাকে জানতে হবে।

Rolling Eyes

কয়েক দিন পর ডাক্তার দাদার সঙ্গে দেখা করে পুরো ঘটনাটা বললাম। উনি কিছুক্ষণ চুপ থেকে হেসে ফেললেন ও বললেন, “শুনো, উনার আরেক নাম হলো চাপামামা। উনি বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলতে পারেন। নূতন লোকদের দেখলে তার এই প্রতিভা বৃদ্ধি পায়। মাঝে মাঝে বাড়াবাড়ি করে ফেলেন, তখন আমরা সিগন্যাল দেই, তখন থেমে যান।" Time Out Time Out Time Out

শেষ কথাঃ অল্প বয়সে একটা চরম নির্দয় সত্য জেনেছিলাম, মানুষ বৃদ্ধ হলেও মিথ্যা কথা বলতে পারে। মধ্যমণি হতে চায়। সামান্য স্বার্থের চিন্তায়ে মানুষ মৃত্যুর চিন্তাকেও দূরে সরিয়ে রাখে।

[**ছবি নেট থেকে নেয়া]

বিষয়: বিবিধ

১৯৫৬ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

234108
১২ জুন ২০১৪ সকাল ১১:৩০
প্রেসিডেন্ট লিখেছেন : Big Grin Big Grin Big Grin
১২ জুন ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:২৮
180942
মাটিরলাঠি লিখেছেন : অনেক অনেক ধন্যবাদ। Good Luck Good Luck
234118
১২ জুন ২০১৪ সকাল ১১:৫৪
নজরুল ইসলাম টিপু লিখেছেন : আপনার শেষ কথায় যে বক্তব্য রেখেছেন, সেটাতে সকল কথা ফুটে উঠেছে। আগেকার সময়ে এ ধরনের চাচাবাজ মানুষের সংখ্যা বহু ছিল। মানুষের সময় ছিল আর সকলে এভাবেই আনন্দ ভাগাভাগি করত এখনতো ফেসবুক নিয়ে সময় কাটায়। অনেক ধন্যবাদ।
১২ জুন ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:২৯
180943
মাটিরলাঠি লিখেছেন : জ্বী ঠিক বলেছেন। অনেক অনেক ধন্যবাদ। Good Luck Good Luck
234155
১২ জুন ২০১৪ দুপুর ০১:০৪
১২ জুন ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:৩০
180946
মাটিরলাঠি লিখেছেন : জ্বী ভাই, সময় করে দেখে আসবো। অনেক অনেক ধন্যবাদ। Good Luck Good Luck
234156
১২ জুন ২০১৪ দুপুর ০১:০৫
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : চাপাবাজি হলেও এটা একটা আকর্ষনিয় গল্প তাতে তো কোন সন্দেহ নাই।
১২ জুন ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:৫৪
180974
মাটিরলাঠি লিখেছেন : দাদার বয়সী একলোক এভাবে মিথ্যা বলতে পারে, এটা বুঝবার, সহ্য করবার মতো বয়স ও অভিজ্ঞতা তখন আমার ছিল না।

অনেক অনেক ধন্যবাদ। Good Luck Good Luck

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File