টি-টোয়েন্টি ও লাখো কণ্ঠে জাতীয় সংগীতঃ সরকারি চাঁদাবজি বনাম জবাবদিহীতা

লিখেছেন লিখেছেন সিকদারমোহাম্মদ ১১ মার্চ, ২০১৪, ১০:২১:৫৪ সকাল

সিকদার মোহাম্মদঃ

রবিবার অনলাইন পোর্টালে একটি খবর পড়লাম তাহল ‌‌'টি-টোয়েন্টি ও লাখো কণ্ঠে জাতীয় সংগীত গাইতে অর্থমন্ত্রী ১০০ কোটি টাকা সংগ্রহ করবেন ।'

অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানান, ওই দুই আয়োজন সামনে রেখে ১০০ কোটি টাকার তহবিল সংগ্রহ করার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। কেননা, টি-টোয়েন্টির জন্য বরাদ্দ ৩৫ কোটি টাকার প্রায় পুরোটাই খরচ হয়ে গেছে। আর জাতীয় সংগীত গাওয়ার বিষয়ে কোনো বরাদ্দ নেই। তাই অর্থ চাই ।

তিনি আরো জানান, ওই তহবিলের অর্থ বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বিদ্যুৎ উত্পাদক কোম্পানি, মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানি ও বেসরকারি বড় বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর কাছ থেকে সংগ্রহ করা হবে।

সাংবাদিকদের সঙ্গে অর্থমন্ত্রী নাকি মজা করে বলেছেন, “আমি মাঝে মাঝেই চাঁদাটাদা তুলি। গতবার এক বৈঠকেই ৬০ কোটি টাকা তুলেছিলাম। এবার মানুষ বেশি, ব্যয়ও বেশি। তাই বিভিন্ন খাতের লোকদের সঙ্গে বৈঠক করলাম।”

এবার তহবিলে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা বাড়বে জানিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, “আগেরবার যাদের দুই-তিন কোটি টাকা দিতে হয়েছে, এবার দিতে হবে এক-দেড় কোটি টাকা।”

এরই মধ্যে বেশ কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অর্থমন্ত্রী বৈঠক করেছেন বলেও জানা গেছে।

তবে অর্থমন্ত্রী ১০০ কোটি টাকা ‘চাঁদা’ তুলছেন বলে যে খবর বেরিয়েছে, তার তীব্র নিন্দা জানিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এবং এ কার্যক্রম থেকে বিরত থাকতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।

সোমবার এক বিবৃতিতে টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক চাঁদা তোলার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতিতে বলেন, “দেশী ও বিদেশী বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ‘চাঁদা’ তোলার ব্যাপারে গণমাধ্যমের কাছে অর্থমন্ত্রীর ঘোষণা রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনায় নৈতিক অবক্ষয়ের উদ্বেগজনক দৃষ্টান্ত। নৈতিকতা বিবর্জিত এই অবস্থান ও বক্তব্যে পেশাদার চাঁদাবাজরাই শুধু উৎসাহিত হবেন না বরং এই জাতীয় চাঁদা প্রদানে বাধ্য ব্যবসায়ী মহল ক্ষমতার সঙ্গে যোগসাজসে অধিকতর দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে উঠবে এবং চূড়ান্ত বিবেচনায় এর বোঝা পড়বে জনগণের ওপর।” এবং চাঁদা তোলার এ ব্যবস্থা কে তারা অসাংবিধানিক বলেও আখ্যা দিয়েছেন ।

মজার বিষয় এর আগেও এধরণে কাজ মুহিত সাহেব করেছেন বলেও সাংবাদিকদের নিকট উল্লেখ করেছেন অথচ তা কোন খাতে ব্যয় করেছেন এবং এটা আদৌ নৈতিক হয়েছে কিনা তা তাৎক্ষনিকভাবে অর্থমন্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করা সাংবাদিকদের পেশাগতদায়িত্বের মধ্যে পড়ে কিনা তা আমার জানার বিষয় ছিল । কিন্তু কোন সাংবাদিক এ প্রশ্ন করেছেন বলে খবর প্রকাশিত হয়নি । তাহলে প্রশ্ন আসে সাংবাদিকদের মধ্যে কী নীতি জ্ঞান রোপ পেয়েছে? নাকি তারা প্রশ্ন করার সাহস রাখেননা? আর যদি তাদের জ্ঞানে এসে থাকা সত্বেও তারা যদি পেশাদারিত্ব সঠিকভাবে পালন না করে থাকেন তাহলে প্রশ্ন থেকেই যায় আমাদের দেশের বর্তমান সাংবাদিকতার মান কোথায় গিয়ে ঠেকেছে ?

যারা চাঁদা দিবেন তারা এই টাকা কড়ায় গন্ডায় উসুল করে নিবেন এটা বিচিত্র কিছু নয়, এবং তারা তা কোন পন্থায় করবেন তা হয়ত আমরা আম জনতা টেরই পাবো না,কারণ তারা সবাই ব্যবসায়ী , ব্যবসাই তাদের মূখ্য বিষয় । ব্যবসার কোন লভাংশ থেকেও তারা চাঁদা দেবেন বলে বিশ্বাস করা মুশকিল বরং তারা চেষ্টা করবে সরকার থেকে অবৈধ সুবিধা হাসিল করে যতটা লাভবান হওয়া যায়। আর সরকারই সে পথ বাতলে দিয়েছে । কারণ তারা যে খাতে অর্থ দেবে তা কোন মহৎ উদ্দেশ্যে বা স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে দেবেনা বরং একধরণের ভীতির কারণে দেবে ।আর এই পয়সা যেহেতু না দিয়ে উপায় নেই সেহেতু তারা একে এক ধরণের বিনিয়োগ হিসাবে নিয়ে পয়সা তোলা কৌশল গ্রহণ করবে, আর চূড়ান্ত বিবেচনায় মাসুল গুনতে হবে সাধারণ মানুষকে ।

এখন প্রশ্ন হলো যারা অর্থপ্রদান করবে তারা কিভাবে লাভবান হবার চেষ্টা করবে? এই ক্ষেত্রে সকল কোম্পানী সাধারণ ভাবে যেটা চেষ্টা করবে তাহল তাদের বাৎসরিক আয় বিবরণীতে কম আয় প্রদর্শন করে কর ফাঁকি দেবার চেষ্টা করবে । এতে রাষ্ট্র যথাযথ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হবে ।আর সরকারের ঘাটতি রাজস্ব আদায়ে ব্যক্তি শ্রেণীর উপর করের আওতা বাড়াতে চাইবে ।

মোবাইল কোম্পানীর ক্ষেত্রে তারা চেষ্টা করবে অবৈধ ভিওআইপি’র মাধ্যমে বাড়তি কিছু আয় করতে , বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের পাওয়ার প্লান্ট বন্ধ রেখেই বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রীডে সরবরাহের পয়সা গ্রহণ করবে আর যে তৈল তাদের সরবরাহ করা হবে তা চোরাবাজারে বিক্রি করে দেবে । ফল হিসাবে সাধারণ মানুষ ভোগ করবে লোডসেডিং যা বিগত সময় করে এসেছে । সরকার বলছে অত হাজার মেগওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে কিন্তু আম জনতা দেখছে লোডসেডিং এর প্রকৃতি একই আছে । এছাড়াও তারা বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য রেট কিঞ্চিৎ বাড়িয়ে নিতে সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করতে পারে । ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান প্রায় সবাই পুঁজি বাজারে তালিকাভূক্ত তাই তারা বিভিন্ন রেগুরেটর কর্তৃপক্ষ থেকে সরকারকে চাঁদা দেবার অজুহাতে অবৈধ সুবিধা আদায়ে তৎপর থাকবে । বিশেষকরে কোম্পানীর সাধারণ শেয়ার হোল্ডারদের ঠকিয়ে ডিরেক্টররা ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হবার চেষ্টা করবে ।অর্থ্যাৎ সব দিক থেকেই ক্ষতিগ্রস্তের তালিকায় দেশ ও তাঁর আমজনতা । তাহলে কেন এই অনৈতিক পন্থায় রাষ্ট্র অর্থ আদায় করছে যেখানে রাষ্ট্রের নিজেরই ক্ষতির কারণ নিজেই তৈরি করছে ?

যে সব কারণে এই অর্থ উত্তোলন করা হচ্ছে তার প্রতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলেই এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া যাবে ।

কিন্তু অর্থমন্ত্রীর নিজের ভাষায় তার ‘চাঁদা’ তোলার বিষয় কতটুকু ‘নৈতিক’ সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে । কিন্তু এবিষয় বিরোধীদলের পক্ষ থেকে জোড়ালো প্রতিবাদ আসার কথা ছিল । কিন্তু দু‘দিনেও তা না আসায় বুঝাগেল এধরণের অনৈতিক কাজে তাদের মতভিন্নতা নেই । তার মানে দাড়ায় সরকার ও বিরোধীদলের মাঝে কার্যক্ষেত্রে পার্থক্য খুবই কম ।

এখন একটি প্রশ্ন আসতে পারে রাষ্ট্রের প্রয়োজনে রাষ্ট্র যা খুশি কি তাই করতে পারে? মানে যখন তখন যে কারো নিকট থেকে এ ধরণে টাকা আদায় করতে পারে ? এক বাক্যে সবাই বলবে না । কারণ সকল রাষ্ট্রকে বছরে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আয় ব্যয়ের একটি হিসাব জনসম্মুখে উত্থাপন করে হয় এবং সে অনুযায়ী আয় ও ব্যয় করে, আর যদি তার ব্যতয় ঘটে তবে তাও উত্থাপন করে দেশের সর্বোচ্চ পরিষদ কর্তৃক তা পাশ করিয়ে নিতে হয় ।আর এ জন্য বাজেট সম্পূরক বাজেট । বিশেষ করে রাষ্ট্রের যে সকল আয়ের খাত নির্ধারিত থাকে আর যাদের উপর তা প্রদান করার দায়িত্ব বর্তায় তারা তা না করলে তা রাষ্ট্রের আইন বিরুদ্ধ কাজ বলে বিবেচিত হয় । একে বলা হয় কর। কর প্রদানের বিনিময় রাষ্ট্র ঐ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে সকল ধরণের সুরক্ষা দেবার কথা অর্থ্যাৎ রাষ্ট্র নিজেতো বটেই বা অন্যকেউ যেন ঐ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য কোন উপায়ে অর্থ আদায় করতে না পারে তার নিশ্চয়তা বিধান করা রাষ্ট্রের পবিত্র দায়িত্ব । আর যারা রাষ্ট্র ক্ষমতা পরিচালনা করেন এর নিশ্চয়তা বিধান করা তাদের দায়িত্ব । যখন তারা ভ্রান্তনীতি দ্বার রাষ্ট্র পরিচালনা করেন তখন আমরা দোষ রাষ্ট্রকে দিই । অর্থমন্ত্রীর স্বঘোষিত ‘চাঁদাবাজি’ এই ভ্রান্তনীতিরই বহিঃপ্রকাশ ।

বস্তুত মানুষের মাঝে যখন জবাবদিহীতার অনূভুতি লুপ্ত হয়ে যায় তখন অন্যায় কাজকে আর অন্যায় বলে মনে হয়না । মূলত অনেক সমস্যার সাথে বাংলাদেশ নামক আমাদের প্রিয় দেশটির মানুষের মধ্যে জবাবদিহীতার অনূভুতির ঘাটতিপূরণ এখন সময়ে প্রয়োজন, যেমন সময়ের প্রয়োজন ছিল একটি মুক্তিযুদ্ধের আর তা আমাদের পূর্বপুরুষরা করে দেখিয়েছেন।

জবাবদিহীতার একটি উজ্জল দৃষ্টান্তের সকলের জানা একটি গল্প বলে শেষ করছি ।একবার একদেশের জনপ্রতিনিধিরা রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলাপ করছিলেন রাতের বেলা, কারণ দিনের পুরো সময় রাতের নেয়া সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কাটিয়ে দিতেন , সে সময় বিজলী বাতি আবিস্কার হয়নি, তাই কুপি জ্বালিয়েই রাষ্ট্রের বিষয় গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা চলছিল ।আলোচনা চলতে চলতে এক সময় জনপ্রতিনিধিদের পরস্পরিক ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ চলে আসে । বিষয়টা লক্ষ করে মজলিসের প্রধান জ্বলন্ত কুপিটি ফুঁৎকার দিয়ে নিভিয়ে দিলেন,উপস্থিত জনপ্রতিনিধিরা এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে মজলিস প্রধান কারণ ব্যখ্যা করে বলেন, আমরা রাষ্ট্রের পয়সায় আলোর ব্যবস্থা করে রাষ্ট্রের জন্য আলোচনা করছি কারো ব্যক্তিগত আলাপচারিতা রাষ্ট্রের পয়সায় কেনা তেলে জ্বালানো বাতির আলোতে চলতে পারেনা । এর জন্য আমাকে স্রষ্টার তোমাদের প্রধান হিসেবে জবাবদিহী করতে হবে ।

বিষয়: বিবিধ

১২৫৫ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

190356
১১ মার্চ ২০১৪ সকাল ১১:২৪
হতভাগা লিখেছেন : জাতীয় সংগীত গাইতে টাকা লাগবে কেন ? এটাতে তো সবারই স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ গ্রহনের কথা!




কুছ লোচা হ্যায় ইয়ার
190375
১১ মার্চ ২০১৪ সকাল ১১:৪৭
সজল আহমেদ লিখেছেন : চিন্তায় ফেলে দিলেন!
190426
১১ মার্চ ২০১৪ দুপুর ১২:৫৩
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : মানুষের গলায় গান গইতে লাগে ১০০ কোটি টাকা আ!!!!!!
190792
১১ মার্চ ২০১৪ রাত ০৯:০৫
শেখের পোলা লিখেছেন : কুঁজোর চিৎ হয়ে শুতে ইচ্ছে হয়েছে আরকি৷

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File