আমাদের পূর্ব পুরুষদের শত্রু-মিত্র পর্ব ৩৭

লিখেছেন লিখেছেন আনিসুর রহমান ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১১:৪৯:২৫ সকাল

সুলতান আলাউদ্দিন হসেন শাহ মুসলিম সমাজে অভ্যন্তরে পৌত্তিলিকতার বিষবাস্প অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে ছিলেন বিভিন্ন ভাবে। এর মাঝে অন্যতম প্রধান যে পদ্ধতি তিনি অবলম্বন করেন তা ছিল শ্রী চৈতন্যর বৈষ্ণব মুভমেন্টের সাহায্য নিয়ে অর্ধেক অর্ধেক গুষ্ঠিগুল তৈরির জন্য পথ উন্মুক্ত করে দিয়ে তাওহীদবাদী মুসলিম সমাজের অভ্যন্তরে পৌত্তিলোকতার বিষবাস্প অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে দিয়ে। এই জন্যই আমরা দেখি যে শ্রী চৈতন্য অসামান্য মেধাবী পণ্ডিত ব্যাক্তি হওয়া সত্বেও নিজে কোন বই লিখে যাননি যাতে করে কুরআন বা হিন্দুদের বেদ-পুরানসহ যে কোন গ্রন্থের অনুসারীরা তার অনুসরণ করতে পারে আবার তাদের স্বধর্মও পালন করতে যেয়ে কোন ধরনের বিভ্রান্তিতে পতিত না হয়! এই জন্যই আমরা দেখি যে চৈতন্যর বৈষ্ণব মুভমেন্টের একে বারে শুরু থেকেই এর সাথে যেভাবেই হোকনা কেন মুসলমানদের যুক্ত করা হয়েছিল। বস্তুত শ্রী চৈতন্যর আবির্ভাব সম্পর্কে ড. আর এম দেবনাথ তার বঙ্গদেশে ধর্মীয় সমাজ- ইতিহাস ও বিবর্তন গ্রন্থের ৫৭ পৃষ্ঠায় যথারর্থই বলেছেন, “ ---- দেখা যাচ্ছে বখতিয়ার খলজির বঙ্গ বিজয়ের পর থেকে দুই-তিন শত বছরের মধ্যে জনগোষ্ঠির একটি বিরাট অংশ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে। এটা ব্রাহ্মান্যধর্মের প্রতি বিরাট চ্যালেঞ ছিল। ঐ সময়েই চৈতন্যর আবির্ভাব।”

এক্ষেত্রে শ্রী চৈতন্যর সাফল্য ছিল গর্ব করার মত; কেননা তার দেখানো পথকে অনুসরণ করে তার সমসাময়িক কাল থেকেই দ্রুত অর্ধেক অর্ধেক গুষ্ঠিগুলর উদ্ভব ঘটতে থাকে। যেমন শ্রী চৈতন্যের শিস্য নিতাই নন্দের ছেলের হাত ধরে সুত্রপাত ঘটে ‘বাউল সম্প্রদায়ের’। ড. আর এম দেবনাথ তার বঙ্গদেশে ধর্মীয় সমাজ- ইতিহাস ও বিবর্তন গ্রন্থের ৬০ পৃষ্ঠায় এই অর্ধেক অর্ধেক গুষ্ঠিগুলর সূত্রপাত সম্পর্কে বলেন,” --- বাংলায় যখন বৈষ্ণব ধর্মের আন্দোলনের সুত্রপাত হয় তখন একই সময়ে আরও নানা মত ও পন্থার ধর্মীয় সাধনার প্রসার ঘটে।”

এই অর্ধেক অর্ধেক গুষ্ঠিগুলর প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল বুদ্ধার অনুসারীদের ন্যায় সনাতন ধর্ম ত্যাগী মুসলিমদের পুনরায় সনাতন ধর্মে ফিরিয়ে আনার জন্য প্রথমিক ব্যাবস্থা হিসাবে তাদের তাওহীদের উপরে বিশ্বাসে চিড় ধরিয়ে পৌত্তলিক বিশ্বাসের দিকে নিয়ে যাওয়া। বর্তমানে এই অর্ধেক অর্ধেক গুষ্ঠিগুল কালের আবর্তে হাড়িয়ে গেছে। কিন্ত তারা যে কুলষিত দর্শনকে ফেলে রেখে গেছে তার রেশ আজও এই অঞ্চলের অনেক মুসলিমের তৌহিদ বিশ্বাসের সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। ফলে যখনই তাদের কাছে ইসলাম প্রচারক বা দায়ী ইল্লেলল্লাহ বা ইসলামী দল ইসলামের প্রকৃত চিত্র নিয়ে হাযির হয় তখনি তারা এর বিরোধীতা শুরু করে দেয় এবং এর পক্ষে শক্তি যোগায় তাদের অন্তরে লালিত ঐ কুলষিত বিশ্বাস। এর একটি বাস্তব উদাহরণ হল ঢকার শাহ্‌বাগের ঘটনা। তাই আজকে মুসলিম নামধারীদের ইসলাম বিরোধিতার কারনকে বুঝতে হলে সৃষ্ট এই অর্ধেক অর্ধেক গুষ্ঠিগুল সম্পর্কে ধারনা থাকাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই উদ্দেশ্যে নিন্মে এরূপ কয়েকটি সম্প্রদায়ের নাতি দীঘ বর্ণনা দেওয়া হল ড. আর এম দেবনাথের গ্রন্থ, ‘বঙ্গদেশে ধর্মীয় সমাজ- ইতিহাস ও বিবর্তন’ থেকেঃ---

(ক) দরবেশী সম্প্রদায়ঃ এই অর্ধেক অর্ধেক গুষ্ঠির মুল শিক্ষা হ’ল –“কেয়া হিন্দু কেয়া মুসলমান। মিলজুলকে কর সাইজীকো নাম।” এখানে সাইজী শব্দ দ্বারা সনাতন গোস্বামিকে বুঝাইতেছে। (পৃষ্ঠা ৮৯২)

(খ) রামবল্লভী সম্প্রদায়ঃ এই সম্প্রদায় জাতিভেদ অগ্রাহ্য করিয়াছেন; তা ছাড়া প্রায় এক শতাব্দী পূর্বে তাহারা সর্বধর্ম সমন্বয়ের কতকটা চেষ্টা করিয়া ছিলেন। তাহাদের একটা গান এইরূপ, কালী-কৃষ্ণ-গড-খোদা, কোন নামে নাহি বাধা-------। মন কালী-কৃষ্ণ-গড-খোদা বল রে।

(গ) কর্তাভজা সম্প্রদায়ঃ এই অর্ধেক অর্ধেক গুষ্ঠির প্রতিষ্ঠাতা হলেন আউল চাঁদ নামক একজন সাধু। কর্তাভজা সম্প্রদায়ের মতে শ্রী চৈতন্যই আউল চাঁদ রূপে পুনরায় জন্মগ্রহণ করেন। এই সম্প্রদায়ের জাতি ভেদ ছিল না। হিন্দু মুসলিম উভয়ই এক সাথে অন্নভোজন করত। গুরু সেবাই কর্তাভজা। --- সেন লিখেছেন ‘ এই দলে খ্রিষ্টান, মুসলমান ও হিন্দু আছে এবং যদিও নর নারীর অবাধ মিলনে কোন বাধা নেই তথাপি ইহাদের নীতি অতি উচ্চ!

(ঘ) সাহেবধনী সম্প্রদায়ঃ সহজিয়ারা মধ্যযুগে বেশ বড় একটি গুষ্ঠি ছিল। তাহাদের মাধ্যে অনেক দল/উপদল ছিল। --- ইহারা জাতিভেদ একে বারেই মানেন না। হিন্দু ও মুসলমান এক থালায় বসিয়া খায়।

এখানে আমরা দেখছি যে, অর্ধেক অর্ধেক গুষ্ঠিগুল ব্রাহ্মবাদ কতৃক সৃষ্ট ঘৃন বর্নভেদ প্রথাকে মানে না। তা সত্বেও তাদের প্রতি ব্রাহ্মবাদের পরোক্ষ সমর্থ থাকার কারন সম্ভবত এই যে, তারা সুলতান হোসেন শাহ্‌র কতৃক উদ্ভাবিত এই পদ্ধতি ভিন্ন অন্য কোন বিকল্প পদ্ধতি খুঁজে পেতে ব্যার্থ হয়, যার মাধ্যমে ইসলামের প্রভাব ও প্রসারকে রুদ্ধ করে দেওয়া যায়। একই সাথে সনাতন ধর্ম ত্যাগী বিরাট অংশকে পুনরায় সনাতন ধর্মে ফিরিয়ে আনা যায়। এখানে মজার বিষয় হ’ল এই অর্ধেক অর্ধেক গুষ্ঠিগুল ব্রাহ্মবাদ কতৃক সৃষ্ট ঘৃন বর্নভেদ প্রথাকে প্রত্যাখান করেছিল ঠিক কিন্তু তারা কখনই সমাজ সংস্কারের উদ্দেশ্য নিয়ে সমাজ থেকে এই ঘৃন বর্নভেদ প্রথাকে উচ্ছেদের জন্য সংগ্রাম করেনি; কিছু ভক্তিবাদী গান, আবেগী কথাবর্তা এবং প্রথার প্রচলন ছাড়া তেমন উল্লেখ্যযোগ্য কোন কাজ করে যায়নি তাদের মতবাদকে টিকিয়ে রাখার জন্য। অথচ তাদের সস্মুখে তখনও বাস্তব উদাহরণ হয়ে দাড়িয়ে ছিল ইসলাম প্রচারকদের সংগ্রামী চিত্র। তারা এই অঞ্চলের লোকদের কল্যাণের জন্য, ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য নিরলস ভাবে সংগ্রাম করে গেছে তাদের জান ও মালের দ্বারা।

সুলতান হোসেন শাহ্‌র কতৃক উদ্ভাবিত এই অর্ধেক অর্ধেক মতবাদ আজকেও আমাদের সমাজে কতখানি প্রভাব বিস্তার করে আছে তা বুঝার জন্য একটি কেসস্টাডি আলোচনা করা হল।

চলবে -----

বিষয়: বিবিধ

৯৮৭ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

382045
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ সকাল ১১:৪৬
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : ভালো লাগলো
০৩ মার্চ ২০১৭ সকাল ১০:১৫
315835
আনিসুর রহমান লিখেছেন : Thanks for visiting my blog and your comment

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File