আমাদের পূর্ব পুরুষদের শত্রু-মিত্র পর্ব ৩৫

লিখেছেন লিখেছেন আনিসুর রহমান ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ০৫:৫৪:০৯ সকাল

আমরা শ্রী চৈতন্য ও চান্দ কাজীর মধ্যেকার বিরোধ নিয়ে আলোচনা করছিলাম। সেখানে আমরা দেখে ছিলাম যে বিচক্ষণ কাজী সর্ব প্রকারের বিরোধকে এড়ানোর জন্য অভিযুক্ত শ্রী চৈতন্যের শিষ্যদের কোন ধরনের শাস্তি না দিলেও, জনস্বার্থে একজন বিচারক হিসাবে নুন্যতম দায়িত্ব পালনের অংশ হিসাবে তাদের নর্তন কুর্দন এবং উচ্চ স্বরে কিত্তন বন্ধ রাখার জন্য নির্দেশ দিয়ে ছিলেন। কিন্তু তা সত্বেও তার এই আদেশকে কেন্দ্র করে শ্রী চৈতন্য বিরোধকে উস্কে দেওয়ার জন্য বিশাল এক মশাল মিছিল নিয়ে কাজীর বাড়িতে যায় এবং পরিস্থিতির সুযোগ কাজে লাগিয়ে, সে যে হিন্দুদের ভগবান হড়ি (শ্রীকৃষ্ণ) তার স্বীকৃতি আদায় করে নেয়, চাঁন্দ কাজীর কাছ থেকে। তৎকালে কাজীর পদটি আজকের তুলনায় অনেক বেশী সস্মানিত পদ ছিল। চাঁন্দ কাজী একজন সস্মানিত ব্যাক্তি হিসাবে মুসলিম সমাজে তার যথেষ্ট প্রভাব ছিল তাতে কোন সন্দেহ থাকার কথা নয়, ফলে মুসলিম সমাজে এই ঘটনার যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়ে ছিল তাতেও সন্দেহ থাকার কথা নয়। সুতরাং এই ঘটনার পর নবদ্বিপে তার প্রতিক্রিয়া কী হয়ে ছিল তা জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্ত এই বিষয়ে উল্লেখ্যযোগ্য কোন তথ্য পাওয়া যায় না। তাই আমরা পূর্বের পদ্ধতি অনুসরণ করে সত্যকে উদ্ধারের চেস্টা করব। অর্থাৎ পূর্বে আমরা যেমন চান্দ কাজীর রায়েকে কেন্দ্র করে চাঁদ কাজীর কোর্টে কারা অর্থাৎ ব্রাহ্মন নাকি মুসলিম নাকি নবদ্বীপের সাধারন জনতা অভিযোগ এনেছিল এবং কী অভিযোগ এনেছিল তা আবিস্কার করে ছিলাম এখানেও আমরা তাই করব। অর্থাৎ ঘটনার পিছনের দিক থেকে শুরু করে সামনের দিকে আগাবো।

আমরা বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করি যে, এই ঘটনার পরপর মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্য নবদ্বিপ তথা বাংলাতে বৈষ্ণব ধর্ম প্রচারের দায়িত্ব তার শিষ্য প্রভু নিতাই নন্দের হাতে অর্পণ করে নবদ্বিপ ত্যাগ করেন। তার জীবন চরিত থেকে জানা যায় যে এই ঘটনার পর তিনি তার মাতা ও স্ত্রীকে কাঁদিয়ে কটোয়াতে যেয়ে কেশব ভারতীর অধীনে সন্ন্যাসীত্ব গ্রহণ করেন। তার সন্ন্যাসীত্ব গ্রহণের পর তিনি কটোয়া থেকে শান্তিপুরে অভিতা পণ্ডিতের সাথে সাক্ষাৎ করেন। শান্তিপুরে অভিতা পণ্ডিত তার বন্ধুদের আমন্ত্রণ জানায় এবং নবদ্বিপ থেকে শ্রী চৈতন্যের মাতা শচী দেবীকেও আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসে। সেখানে শ্রী চৈতন্যের সাথে মাতা শচী দেবীর সাক্ষাৎ ঘটে। তার মাতা অভিতা পণ্ডিত ও তার বদ্ধুদের সাথে শলা পরামর্শ শেষে চৈতন্যকে নবদ্বিপ ত্যাগ করত উড়িষ্যা রাজ্যের পুরী শহরে চলে যেতে অনুরোধ করলে, শ্রী চৈতন্য তা মেনে নিয়ে সেখান থেকে আর নবদ্বিপে না ফিরে তার নতুন আবাসস্থান নির্ধারণ করে উড়িষ্যা রাজ্যের পুরীতে। শ্রী চৈতন্য পুরিতে যেয়ে সেখানে কিছু দিন অবস্থান করে পুনঃরায় সাউথ ইন্ডিয়া সহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল ভ্রমণে বের হয়। প্রায় দুই বছর পর ভ্রমণ শেষে পুরীতে এসে স্থায়ী হয়। তার ৪৮ বছর বয়েসে মৃত্যু/ অদৃশ হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত এই পুরী ছিল তার স্থায়ী ঠিকানা।

এক্ষেত্রে আমার অনুমান যদি মিথ্যা না হয় তবে চান্দ কাজীর সাথে শ্রী চৈতন্যের বিরোধের ফলাফল স্বরূপ নবদ্বিপে বড় ধরনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া ঘটে ছিল বলেই শ্রী চৈতন্য কেশব ভারতীর অধীনে সন্ন্যাসীত্ব গ্রহণের কথা বলে মাতা ও স্ত্রীকে কাঁদিয়ে নবদ্বিপে থেকে কটোয়াতে চলে যায়। পরবতিতে শ্রী চৈতন্য নবদ্বিপে আর প্রত্যাবর্তন না করে, সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ্‌র রাজ্যের সীমানা অতিক্রম করে তার শত্রু রাজ্য উড়িষ্যার পুরীতে চলে যায়। উল্লেখ্য সুলতান হোসেন শাহ্‌ রাজ্য দখলের উদ্দেশ নিয়ে উড়িষ্যা আক্রমণ করলে উড়িষ্যার রাজা গজাপতি প্রাতাপারুদ্রা দেব তার সেই প্রচেষ্টাকে ব্যার্থ করে দেন এবং সুলতান হোসেন শাহ্‌র শাসনের পুরো সময় জুরে উড়িষ্যার সহিত বাংলার শত্রুতা মূলক সম্পর্ক বর্তমান ছিল।

সব কিছুকে বিবেচনায় রাখলে আমরা দেখব যে শ্রী চৈত্যনের বৈষ্ণব মুভমেন্টকে কেন্দ্র করে চান্দ কাজীর উপর সুলতান হোসেন শাহ্‌র যে কোন ধরনের নিপীড়ন নির্যাতনের অভিযোগ প্রমান করা ছিল জটিল কাজ। প্রথমত এই ঘটনার পর শ্রী চৈত্যন শুধু নবদ্বিপ নয় বরং হোসেন শাহ্‌র রাজ্যের সীমানা অতিক্রম করে তার শত্রু রাষ্ট্র উড়িষ্যার পুরীতে যেয়ে স্থায়ী হয়। ফলে চান্দ কাজীর পক্ষে সুলতান হোসেন শাহ্‌র বিরুদ্ধে অভিযোগ আনায়ন ও তা বিশ্বাস যোগ্য করা ছিল অসম্ভব কাজ। কেননা তার অভিযোগ সত্য বলে বিশ্বাস করাতে হ’লে তাকে নিন্মের প্রশ্নগুলর সমাধান বের করতে হত। এক, শ্রী চৈত্যনের বৈষ্ণব মুভমেন্টর পিছনে যদি সুলতানের মদদ থাকত তবে শ্রী চৈত্যন তার রাজ্য ছেড়ে চলে যাবে কেন? দুই, শ্রী চৈত্যনের বৈষ্ণব মুভমেন্টর পিছনে যদি তার হাত থাকত তবে কেন শ্রী চৈত্যন বাংলার সুলতানের শত্রু রাষ্ট্রে যাবে? তিন, সুলতান হোসেন শাহ্‌ একজন মুসলিম কিন্ত শ্রী চৈত্যন এবং উড়িষ্যার রাজা গজাপতি প্রাতাপারুদ্রা দেব উভয়েই হিন্দু, এক্ষেত্রে তার নয় বরং উড়িষ্যার রাজার মদদ থাকাটা বেশী যুক্তিযুক্ত! চার, এই ঘটনার পর যদিও শ্রী চৈত্যন উড়িষ্যার পুরীতে গিয়ে ছিল কিন্ত তখন সে সেখানে স্থায়ী হয়নি বরং অল্প সময় অবস্থান করে সে ভারত ভ্রমণে বের হয় এবং প্রায় দুই বছর পর সে উড়িষ্যার পুরীতে গিয়ে স্থায়ী ভাবে বসবাকস শুরু করে। পাচ----। এই ঘটনার পর শ্রী চৈত্যনের নবদ্বিপ ছেড়ে চলে যাওয়ার বিষয়ে ভক্তিবিন্দা ঠাকুর বলেন, “It was after this that some of the jealous and low minded Brahmins of Kulia picked up a quarrel with Mahaprabhu and collected a party to oppose Him. Nimai Pandit was naturally a soft hearted Person though strong in His principles. He declared that party feeling and sectarianism were the two great enemies of progress, and as long as He should continue to be an inhabitant of Nadia belonging to a certain family, His mission would not meet with complete success. He then resolved to be a citizen of the world by cutting off His connection with a particular family, caste and creed and with this resolution He embraced the position of a Sannyasi at Katoa under the guidance of Keshav Bharati of that town”. যদিও ভক্তিবিন্দা ঠাকুরের মতে ঐ ঘটনার পর শ্রী চৈত্যনের নবদ্বিপ ত্যাগ করার কারন ছিল নীচু মনের ব্রাহ্মনদের সাথে তার ঝগরা বিবাদ। কিন্তু তার আগ্রাসী ধর্ম প্রচার থেকে শুরু করে, কাজীর দরবারে অভিযোগ, কাজীর রায় ইত্যাদি ঘটনাগুল পরিষ্কার ভাবে নির্দেশ করছে, শ্রী চৈত্যনের নবদ্বিপ ত্যাগ করার প্রকৃত কারন কী ছিল এবং এখানে তা ব্যাখ্যার কোন অবকাশ নেই। ঐ ঘটনার পর শ্রী চৈত্যনের প্রতিটি পদক্ষেপ এরূপ ছিল যে, তাতে বুঝা যেত যে, শ্রী চৈত্যনের বৈষ্ণব মুভমেন্টর সাথে বাংলার সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ্‌র কোন যোগাযোগ নেই। কিন্ত তার জীবন চরিত ঘেটে দেখা যায় এর পরও বাংলার সুলতানের সাথে শ্রী চৈত্যনের যোগাযোগ ছিল।

চলবে---

------------------------------------------------------------------

*** এখানে শ্রী চৈত্যনের জীবন চরিত্রের কিছু আংশ নিয়ে আলোচনা করার উদ্দেশ্য এই ছিল না যে, শ্রী চৈতন্য এবং তার ভক্তদের হেয় প্রতিপন্ন করা বরং আমরা এখানে দায়ী ইল্লেলল্লাহ বা ইসলাম ধর্ম প্রচারক বনাম সুফী, পীর ফকীর সংক্রান্ত সত্যকে আবিষ্কারের জন্য তার জীবনে সাথে সম্পকিত অল্প কিছু ঘটনা নিয়ে আলোচনা করেছি মাত্র, যুক্তির মানদন্ডে। যেহেতু আমরা এখানে তার সম্পর্ণ জীবন চরিত্র নিয়ে আলোচনা করিনি তাই তার জীবনের অনেক আলৌকিক ঘটনা সহ বহু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার কথা এখানে উল্লেখ্য করিনি। যেমন সে জঙ্গল পথে পুরীতে যাওয়ার সময় তার সাথী হয়ে ছিল বালাভ্রাদ্রা নামক ব্যাক্তি। এই ব্যাক্তি তার অনেক আলৌকিক ঘটনার কথা বলেছ, যেমন সে নিজ চোখে দেখেছে শ্রী চৈতন্যের মুখে কৃষ্ণা নাম শুনে বনের বাঘ ও হাতী নেচেছে! উল্লেখ্য আমরা শ্রী চৈতন্যের জীবন চরিত্র আলোচনার শুরুতেই বলে ছিলাম যে তার পুরা জীবনটাই হল আলৌকিক ঘটনার সমাহার। একজন ধর্মীয় নেতা হিসাবে শ্রী চৈতন্যের মতবাদ/কাজের বিভিন্ন দিগ নিয়ে আলোচনা/সমালোচনা করা কোন ভাবেই তাকে অসস্মান করা নয়। একজন মানুষ হিসাবে এবং একজন ধর্মীয় নেতা হিসাবে আমরা তাকে সস্মান করি।

শ্রী চৈতন্যের জীবন চরিত্রের উপর আলোচনা আমরা আর বাড়াব না করন হল তার পূর্ণ জীবন বিতান্ত আলোচনা করা আমাদের উদ্দেশ্য ছিল না বরং সত্যকে আবিস্কার করা ছিল উদ্দেশ। সেই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তার জীবনের যে ঘটনাগুল জানা দরকার ছিল বলে মনে করেছি আমরা এখানে শুধু সেই অংশটুকুই আলোচনা করেছি মাত্র। তবে এখানে একটি কথা না বললেই নয় তা হল আমরা তার কথা বলতে যেয়ে বার বার এই শব্দ গুল “ তার মৃত্যূ/ অদৃশ্য” উল্লেখ্য করেছি। এর কারন হ’ল তার ৪৮ বছর বয়েসে এই পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার বিষয়েও দুই ধরনের তথ্য পাওয়া যায়।

হিন্দু ধর্ম বিশেষজ্ঞ শুভাহময় দাশ এর বর্ণনা অনুসারে পুরিতে কোন এক রাত্রে শ্রী চৈতন্য ধর্মীয় ভাবাবেগের বশে বাঙ্গ-পো-সাগরকে যমুনা ভেবে তাতে ঝাপ দেয়। অতঃপর সে ভাষতে ভাষতে জনৈক জেলের জালে ধরা পরে। প্রথমে জেলে বড় মাছ ধরা পড়েছে মনে করে জাল টেনে কাছে নিয়ে আসলে মানুষ দেখে ভয় পেয়ে সেখান থেকে চলে যায়। পরে শ্রী চৈতন্যের শিষ্যরা যারা তার খোঁজে ছিল খবর পেয়ে সেখানে এসে জাল থেকে তাকে উদ্ধার করে। লেখকের ভায্য অনুসারে জাল থেকে উদ্ধারের পর শ্রী চৈতন্যের জ্ঞান ফিরে এসে ছিল। শ্রী চৈতন্য মারা যাওয়ার পূর্ব মুহুতে, কলি যুগের সকলকে উঠতে, বসতে, চলতে ফিরতে সকল আবস্থায় শ্রী কৃষ্ণার নাম নেওয়ার জন্য উপদেশ দিয়ে যায়। আমরা জানি মৃত মানুষ পানিতে ভেষে উঠে কিন্ত চৈতন্যর জীবিত অবস্থায় ভেসে থাকাকে লেখক এখানে কোন আলৌকিক ঘটনা না বলে বলেছন, শ্রী চৈতন্যের কম আহার গ্রহণ ছিল এর কারন।

আরেক বর্ণনায় এসেছে শ্রী চৈতন্য তার ৪৮ বছর বয়সে পুরীর একটি মন্দিরে প্রবেশ করে এবং সেখান থেকে আর না ফিরে আদৃশ্য হয়ে যায়!

বিষয়: বিবিধ

১০৭৩ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

381989
২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ দুপুর ১২:১১
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File