নাগরিকত্ব মামলার রায়ে যুদ্ধাপরাধী নন, তাহলে কেন এই জঘন্য রাজনীতি?

লিখেছেন লিখেছেন রঙ্গিন স্বপ্ন ২৪ অক্টোবর, ২০১৭, ১১:৫৭:৫২ রাত



২৩ শে অক্টোবর অধ্যাপক গোলাম আযমের তৃতীয় মৃত্যু বার্ষিকী। ৩ বছর আগে এই দিনে কারারুদ্ধ অবস্থায় তিনি বিএসএমএমইউ (পিজি) হাসপাতালে ইন্তিকাল করেন। ৯০ বছর বয়সে যখন তিনি মৃত্যুবরন করেন তখন মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ট্রাইবুনাল তাঁকে ৯০ বছরের কারাদন্ড দিয়েছিল।

"মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যেসব বর্বরতার অভিযোগ রয়েছে, তা সংগঠনের সাথে অধ্যাপক গোলাম আযম কোনোভাবে সরাসরি জড়িত ছিলেন, এমন কোনো কিছু আমরা পাইনি।"

১৯৯৪ সালে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযমের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেয়ার বিষয়ে দেশের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়ে এ কথা উল্লেখ রয়েছে।

রায়ে আরো উল্লেখ করা হয়, ‘পাকিস্তানি আর্মি ও তাদের সহযোগী বাহিনী রাজাকার, আলবদর কিংবা আলশামসের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে যেসব বর্বরতার অভিযোগ রয়েছে, তার একটির সাথেও অধ্যাপক গোলাম আযমের সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই।’

আপিল বিভাগের তৎকালীন বিচারপতি হাবিবুর রহমান, বিচারপতি এ টি এম আফজাল, বিচারপতি মুস্তাফা কামাল ও বিচারপতি লতিফুর রহমান এ ঐতিহাসিক রায় দেন। এই চার খ্যাতিমান বিচারপতির সবাই পরে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির আসন অলঙ্কৃত করেন এবং তাদের মধ্যে বিচারপতি হাবিবুর রহমান ও বিচারপতি লতিফুর রহমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচিত হয়েছিলেন।

১৯৯৪ সালের ২২ জুন দেয়া ৫৪ পৃষ্ঠার রায়ে অধ্যাপক গোলাম আযম সম্পর্কে ১৯৭১ সালের অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে বিচারপতিদের করা মন্তব্য ছিল এ রকম : "There is nothing to directly implicate the petitioner (Golam Azam) in any of the atrocities alleged to have been perpetrated by the Pakistani Army or their associates the Rajakars, AL Badrs or the AL Shams. Except that the petitioner was hobnobbing with the Military Junta during the war of liberation, we do not find anything that the petitioner was in any way directly involved in perpetuating the alleged atrocities during the war of independence."

১৯৭৪ সালে আবুল মনসুর আহমেদ দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় লেখা এক কলামে লিখেছিলেন "১৯৭১ এ মুসলিম লীগ স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধীতা করেছিল রাজনৈতিক কারনে।সেটা কোন অপরাধ না। বাংলাদেশ সৃষ্টির পর তারা যদি বাংলাদেশ কে অস্বীকার করতো সেটা হোত রাষ্ট্রদ্রোহীতা- সেটা অপরাধ।

তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রজীবনে জনাব শেখ মুজিবুর রহমানের সম-সাময়িক ছিলেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামিলীগ গোলাম আজমের নেতৃত্বের দল জামায়াতে ইসলামির সাথে রাজনৈতিক কোয়ালিশন করে বি এন পির বিপক্ষে সংসদে জয়ী হয়ে আসে।

২০০১ সালের আগ পর্যন্ত তিনি ছিলেন নিছক স্বাধীনতা বিরোধী (!), বি এন পির সাথে জোট করার পর থেকে আওয়ামিলীগ ও বামরা ভোটে পরাজিত হয়। জামায়াতে ইসলামী রাজনীতিতে একটি অপ্রতিরোধ্য শক্তিতে রুপান্তরিত হয়, যা তাঁদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়।বাংলাদেশকে Constitutionally এবং Institutionally ধর্মহীন তথা ইসলামহীন হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় বড় ও একমাত্র বাঁধা হল এই জামায়াতে ইসলামী। তাই জামায়াতের কণ্ঠ রোধ এবং সৎ ও আদর্শ নির্ভর ইসলামী মতাদর্শে ঈর্ষান্বিত হয়ে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বশত গঠন করা হয় আওয়ামি- ট্রাইব্যুনাল। আর আদর্শবান নেতাদের বানানো হয় যুদ্ধাপরাধী। আর এ কাজটি করেছে ভারতের পরামর্শে। বিনিময়ে ভারত আওয়ামিলীগ কে অবৈধ উপায়ে ক্ষমতায় রাখার নিশ্চয়তা দেয়, যার প্রমাণ ৫ জানু ২০১৪, ১৫৩ আসনে বিনা নির্বাচনে ক্ষমতা পাওয়া। সেই থেকে ভারতের এমন কোন দেশবিরোধী দাবী নেই যা আওয়ামিলীগ করেনি। জামায়তের রাজনীতিকে আদর্শিক ভাবে মোকাবেলা করতে না পেরে , দলীয় সেবা-দাস বিচারপতিদের ( স্কাইপি কেলেঙ্কারি বিচারপতি নাসিম, আর সাম্প্রতিক দুর্নীতির দায়ে অপসারিত এস কে সিনহা) ব্যবহার করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনে রাজনৈতিক হীন উদ্দেশ্য হাসিল করেছে। অন্যায় খুন তথা ফাঁসির মাধ্যমে।

আর যে সমস্ত করণে তিনি দেশ ভাগের সময় ঐ নেতৃত্বকে মেনে নেন নি সেগুলোর অন্যতম ছিল- ভারত এই ছোট দেশের উপর করায়ত্ত করবে ও দেশের সার্বভৌমত্ব ভারতের কাছে নতজানু হয়ে থাকবে, যা ৪৩ বছরে বাস্তবে রুপ লাভ করেছে এবং তিনি নিজ চোক্ষে তা দেখেও গেলেন।

তিনি ১৯৭১ সালে প্রেডিক্ট করেছিলেন বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে আলাদা হলে পরে ভারতের দখলে চলে যাবে। তার সেই এনালাইসিস অনেক দিক থেকেই সঠিক ছিল। একজন রাজনীতিক এনালিস্ট বা নেতার জীবনে ৪৩ বছর আগে করা এনালাইসিস ৪৩ বছর পরে সঠিক হতে দেখার চাইতে গর্বের কোন বিষয় হয় না। সেই গর্বের অনুভুতিকে ইংরেজির পরিভাষায় বলে, "I told you so!"

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এর নজীর আছে, একই দেশ যখন ভাগ হয়, সবাই একপক্ষে - এক মতে আসতে পারেনা। বহ হিসেব বহু ফ্যাক্টর কাজ করে। রাজনৈতিক অমিল হয়।

দেশ ভাগের সময় " অবিভক্ত পাকিস্তানের সমর্থক" থাকা আর মানবতা বিরোধী অপরাধ এক নয়।একটি দেশ যখন ভাগ হয় তখন সবাই একই মতের একই প্লাটফর্মে একত্রিত হওয়াটা চিন্তা করা সহজ কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। মানবতা বিরোধী অপরাধ করেছিল পাকিস্তানি আর্মি ও তৎকালীন সরকার। কিন্তু ৭১ এর পরপরই স্বাধীন দেশে সেই যুদ্ধাপরাধী নেতাদের শেখ মুজিব সাহেব সংবর্ধনা দিয়েছিলেন। জামায়াত নেতারা যুদ্ধাপরাধ করেছেন এমন কোন প্রমাণ সরকার দিতে পারেনি।

এটি তৎকালীন অনেকের মত তাঁরও ছিল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। দেশ ভাগের সময় " ইউনাইটেড পাকিস্তানের সমর্থক" থাকা আর মানবতা বিরোধী অপরাধ এক নয়।একটি দেশ যখন ভাগ হয় তখন সবাই একই মতের একই প্লাটফর্মে একত্রিত হওয়াটা চিন্তা করা সহজ কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। মানবতা বিরোধী অপরাধ করেছিল পাকিস্তানি আর্মি ও তৎকালীন সরকার। কিন্তু ৭১ এর পরপরই স্বাধীন দেশে সেই যুদ্ধাপরাধী নেতাদের শেখ মুজিব সাহেব সংবর্ধনা দিয়েছিলেন। প্রফেসর গোলাম আজম যুদ্ধাপরাধ করেছেন এমন কোন প্রমাণ সরকার দিতে পারেনি।

সম্প্রতি স্কটল্যান্ডের ৫৫% মানুষ দেশ ভাগ না চেয়ে "নো" ভোট দিয়েছে, ৪৫% ইয়েস বলে ইংল্যান্ড থেকে আলাদা হতে চেয়েছিল। তাহলে কি "নো" ভোট প্রদানকারী সবাই রাজাকার? ঠিক একই রকম ঘটেছে উনার বেলায়ও। হ্যাঁ বলতে পারেন ইংল্যান্ড- স্কটল্যান্ড তো যুদ্ধও হয়নি, রেফারন্ডাম হয়েছে। হ্যাঁ, যুদ্ধ চাপিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী গণহত্যা আর যুদ্ধাপরাধ করেছে। একজন সিভিল লোক হয়ে গোলাম আযম বা জামায়াত নেতারা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করা সম্ভব নয়।

জনাব শেখ মুজিব যখন ইউনাটেড পাকিস্তানের বেশী ভোট পাওয়া সাপেক্ষে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জোড় দাবী উঠতে থাকে , ১৯৭০ সালের ১৭ ডিসে থেকে ১৯৭১ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্থানের শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য গণভোট অনুষ্ঠিত হয়।

১০ মার্চ ১৯৭১ সালে তৎকালীন দৈনিক আজাদ পত্রিকায় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবৃতি ছাপা হয়। তখন অধ্যাপক গোলাম আযম পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমীর। বিবৃতিতে তিনি অবিলম্বে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা জনাব শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবী জানান।

তিনি ৭১ এর আগে যেমন দেশের জন্য কাজ করেছেন। ১৯৪৬-৪৭ সেশনে তিনি ফজলুল হক মুসলিম হলের সাধারন সম্পাদক এবং ১৯৪৭Ñ৪৮ ও ১৯৪৮Ñ৪৯ সেশনে তিনি ডাকসুর নির্বাচিত সাধারন সম্পাদক ছিলেন। তিনি তৎকালীন তমদ্দুন মজলিশের একজন প্রভাবশালী নেতা ছিলেন। ডাকসুর সাধারন সম্পাদক থাকা অবস্থায় ১৯৪৮ সালের ২৭ নভেম্বর পাকিস্তানের তৎকালীনপ্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের সামনে বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা প্রদানের জন্য মানপত্র পেশ করেন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময় তিনি ১৯৫২ সালের ৬ মার্চ গ্রেফতার হন। পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলনেও তিনি সক্রিয় ছিলেন। ১৯৬৭ সালের জানুয়ারী মাসে পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট ( পিডিএম) গঠিত হলে তিনি পিডিএম এর পূর্ব পাকিস্তান শাখার সেক্রেটারী নির্বাচিত হন।

আর স্বাধীনতার পরেও তিনি দেশের স্বাধীনতা মেনে নিয়ে সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রাক্কালে যখন ক্ষমতা পালাবদল নিয়ে রাজনৈতিক সমস্যা তুঙ্গে ঠিক তখনই এই মহান নেতা- শ্রদ্ধেয় প্রফেসর গোলাম আজম স্যার স্বীয় প্রজ্ঞার মাধ্যমে কেয়ার টেকার সরকারের প্রস্তাব পেশ ও তার প্রয়োগ জাতিকে হাতে- কলমে দেখিয়ে গেলেন, যার মাধ্যমে গণতন্ত্র পেয়েছিল পূর্ণতা, রাজনীতি ফিরে পেয়েছিল তার নিজস্ব-চরিত্র; যার ফল জাতি পেয়েছে।

আজ জামায়াত শিবির দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষার অতন্ত্র প্রহরী।কিছুদিন আগে শাহজাহান উমর বীর প্রতীক এ বিষয়ে লিখেছেন। দেশ গঠনে আজ তাঁরা নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণেই আজ তাঁদের প্রতি এই আক্রোশ। হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি আজ যারা করছেন তাদের বরং উচিৎ ছিল দেশ গঠনে তাঁদের এই কাজের স্বীকৃতি দেওয়া। জাতীয় উন্নয়নে সম্পৃক্ত করা। দেশ আজ বিভক্ত। বর্তমান ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেশকে সিঙ্গাপুর বানাবার কথা বলে আসলে দেশকে সিরিয়া বানাতে যাচ্ছেন। এই দেশের ভবিষ্যৎ খুব একটা ভালো নয়, যদি তারা সত্যের কাছে ফিরে না আসে।

বিষয়: বিবিধ

১১১০ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

384285
২৫ অক্টোবর ২০১৭ রাত ১২:৪০
দিল মোহাম্মদ মামুন লিখেছেন : সুন্দর লিখাটির জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ, জাজাকাল্লাহ খায়ের

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File