ভাস্কো দা গামার 'প্রাচ্যের জলপথ' আবিষ্কারের নেপথ্য কারিগরঃ আহমদ ইবনে মজিদ

লিখেছেন লিখেছেন বাধনহারা ০৪ আগস্ট, ২০১৫, ১২:৫১:৫৬ দুপুর

থ্রী ইডিয়টস দেখেছেন? কলেজের প্রথম দিন, ভাইরাস (ডিরেক্টর) ইনাগুরেটিং লেকচারে বলছিলেন, কেউ দ্বিতীয় স্থানধারীকে মনে রাখে না, সবাই প্রথমকেই মনে রাখে! তার এই দৃষ্টিভঙ্গি জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে ভূল প্রমানিত হলেও বাস্তবতা কিন্তু এটাই!

১৪৯৮ সালে ভাস্কো দা গামা ইউরোপ (লিসবন, পর্তুগাল) থেকে ভারতে (কালিকট, বিজাপুর) আসার জলপথ আবিষ্কার করে ইউরোপের বেনিয়াদের যেমন দক্ষিন এশিয়া ও দক্ষিন পূর্ব এশিয়ায় আসার পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন তেমনি এতদ্ব্যঞ্চলে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের যাত্রাও শুরু হয়েছিল এ আবিষ্কারের মধ্য দিয়েই। ইউরোপীয় জাতিসমুহ( প্রধানত, পর্তুগিজ, ডাচ, বৃটিশ, স্প্যানিশ) এ অঞ্চলসমুহে এসে বানিজ্য করেছে, ধর্ম প্রচার করেছে, দস্যুতা করেছে, শেষে সাম্রাজ্য স্থাপন করেছে অতঃপর, বিশ শতকের মাঝামাঝিতে জাতীয়তাবাদের উন্মেষের ধাক্কায় বিতাড়িত হয়েছে। ইউরোপীদের এতদ্ব্যঞ্চলে আগমন, বসতি স্থাপন, সাম্রাজ্য স্থাপনের ফলে একদিকে যেমন স্থানীয় সম্পদ ইউরোপে পাচার হয়েছে, পুজিপতিদের পকেট ফুলে উঠেছে ঠিক তেমনিভাবে, ইউরোপীয় শিক্ষাব্যবস্থা, সংস্কৃতি, সমাজব্যবস্থা, ধর্ম, দর্শন, রাজনীতি, বিচারব্যবস্থা এতদ্ব্যঞ্চলের সুপ্রাচীন ব্যবস্থাকে আমূল বদলে দিয়েছে। আজ আমরা যে সংস্কৃতি ও সমাজব্যবস্থায় বসবাস করি তা মূলত ঐ সাম্রাজ্যবাদেরই ফল।

বর্তমান ভারতীয়, ও দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় সমাজ-সংস্কৃতি প্রায় সম্পূর্নটাই ইউরোপীয়দের প্রভাবে প্রভাবিত। আর এই মহান কর্মযজ্ঞের মহানায়ক হলেন ভাস্কো দা গামা। যিনি ১৪৯৭ সালের ৮ জুলাই পর্তুগাল থেকে ১৭০ জন নাবিক ও চারটি নৌকা যাত্রা শুরু করেছিলেন এবং বার্থালোমিয় ডায়াজ কর্তৃক ১৪৮৭ সালে আবিষ্কৃত উত্তমাশা অন্তরীপ প্রদক্ষিন করে ৪ নভেম্বর আফ্রিকা উপকূলে অবতরন করেছিলেন। অতঃপর পুনরায় যাত্রা শুরু করে ১৬ ডিসেম্বর ১৪৮৭ সালে মোজাম্বিক ও ৭ এপ্রিল মোমবাসা অবতরন পূর্বক উত্তর দিকে যাত্রা অব্যাহত রেখে ২০ মে, ১৪৯৮ তারিখে ভারতের দক্ষিন উপকুল কালিকটের নিকটবর্তী কাপ্পাডু নামক স্থানে অবতরন করেন। ২০ মে, ১৪৯৮ সালে ভাস্কো দা গামার এই অবতরনের মধ্য দিয়ে যেমন ভারতে আধুনিকতার পথে যাত্রার শুভ সূচনা হয় তেমনি এই ঘটনা ইতিহাসে আরো এক দিক থেকে মহা প্রসিদ্ধ, ইহার কারিগরের কারনে। লোকমুখ বা ইতিহাসের পাতায় সর্বত্র ভাস্কো দা গামাকে ভারতে আসার জলপথের আবিষ্কারক বলা হলেও আরব বনিকরা এ পথে যাতায়াত ও বানিজ্য করতেন প্রায় সুপ্রাচীন কাল হইতে। আরব বন্দরসমুহ থেকে দক্ষিনে মোজাম্বিক, আফ্রিকা, মাদাগাস্কার, সোমালিয়া, কেনিয়ার বন্দর সমুহ ও পূর্ব দিকে ভারত, চাটগাও, জাভা, মালয়েশিয়া, চায়নার ক্যান্টনে আরব বনিকরা ছড়িয়ে পড়েছিলেন পৃথিবীর সর্বত্র।

শিহাব আল-দীন আহম্মদ ইবনে মজিদ আল নজদি ছিলেন তখনকার সময়ের জগদ্বিখ্যাত নাবিক ও সমুদ্রবিজ্ঞানী। আরব নাবিকদের সমুদ্রে চরম খ্যাতি থাকলেও আহম্মদ ইবনে মজিদকে স্মরণ করা হয় সর্বকালের সেরা একজন নাবিক ও সমুদ্র বিশেষজ্ঞ হিসেবে। আফ্রিকা থেকে ভারত ও ভারত থেকে দক্ষিন পূর্ব এশিয়া ও চায়নার সমুদ্র পথ ছিল তার নখদর্পনে। তাকে স্মরন করা হয় “সমুদ্রের সিংহ” হিসেবে। তাঁর বিখ্যাত বই ‘কিতাব উল ফাওয়াইদ ফি উসুল ইল্ম আল বাহার ওয়া কাওয়াইদ’ বা ‘নৌবিদ্যার নীতি ও নিয়মের গুরুত্বপূর্ন তথ্যের বই’ ছিল নোউবিদ্যার বিশ্বকোষ। নোবিদ্যার ইতিহাস, মৌলিক নীতিমালা, কম্পাসের ব্যবহারবিধি, আফ্রিকা থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত বন্দর সমুহের দূরত্ব, চন্দ্রের অবস্থা, পালতোলার নিয়মসহ যাবতীয় তথ্য এ বইয়ে সন্নিবেশিত আছে।

১৪৯৮ সালে আফ্রিকা উপকূল থেকে পাল তুলে ভাস্কো দা গামা এমন একজন নাবিক বা পাইলট খুজছিলেন যে তাকে ভারত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে ভারত উপকূলে নিয়ে যেতে সক্ষম ছিল।

মোজাম্বিকে অবস্থানকালে স্থানীয় আরব বনিকদের সন্দেহ ও শত্রুতার মুখে পড়ে তাকে বিদায় নিতে হয়েছিল। মোমবাসা হয়ে ১৪ এপ্রিল যখন তিনি মালিন্দি পৌছেন তখন আহমদ ইবনে মজিদের খোঁজ পান এবং তাঁর সাহায্যের জন্য অনুরোধ করেন। আহমদ ইবনে মজিদ সে প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে, পথ দেখিয়ে ভাস্কো দা গামাকে ভারত উপকুলে নিয়ে আসেন। তাঁর এই কর্মের মাধ্যমে ভারতীয় উপকূলে মুসলিম বনিকদের প্রভাব খর্ব হতে শুরু করে। ইবনে মজিদের এই গুরুত্বপূর্ন অবদান ভূগোল ও সমুদ্রবিজ্ঞানকে অত্যন্ত উপকৃত করেছে।

আহমদ ইবনে মজিদের নাম এতটাই বিখ্যাত ছিল যে তাঁর মারা যাওয়ার ৩৫০ বছর পরেও স্যার রিচার্ড বার্টন ১৮৫৪ সালে, এডেন বন্দর থেকে রওনা দেয়ার সময় জেলেদেরকে তাঁর নামে প্রার্থনা করতে দেখেছেন। তাঁর সুনাম আছে এবং অক্ষত থাকবে। তিনি যখন মারা যান তখন আরব নৌ-জ্ঞান পর্তুগিজদের এবং পরবর্তীতে অন্যদের নিকট চলে যায়। কিন্তু এটা ঘটার পূর্বে আরবরা ভূগোল ও নৌচালনা বিদ্যায় অসামান্য অবদান রাখতে সক্ষম হয়।

ফিরে যাই সেই প্রথম লাইনে, পৃথিবীতে ২য় জনকে কেউ মনে রাখে না, সবাই প্রথমজনকে পুজা করে। ভারতে আসার জলপথের প্রসঙ্গ উঠলে খুব অল্পজনই জানেন এই মহান মুসলিম নাবিকের কথা, এমনকি ভাস্কো দা গামার সঙ্গে থাকা অন্যান্য পর্তুগীজ নাবিকরাও কেউ তাঁর নাম পর্যন্ত উল্লেখ করেন নি। কিন্তু ইতিহাস চলে তার নিজস্ব গতিতে। ক্ষমতা বা নাম কামানো তার লক্ষ্য নয়। সত্যকে সুন্দভাবে পরিস্ফুঠিত করাই ইতিহাসের কাজ। আর তাই আহমদ ইবনে মজিদ একজন বাস্তব হিরো, যিনি আফ্রিকা উপকূল থেকে ভারত উপকূলে আসার জলপথ আবিষ্কারে ভাস্কো দা গামাকে পথনির্দেশ করেছেন।

মূল লেখাটি পড়ুন এখানে

ইতিহাস বিষয়ক এধরণের আরো লেখা পড়তে ঘুরে আসুন @@সমীক্ষণে@@

বিষয়: বিবিধ

১৬৫৯ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

333586
০৪ আগস্ট ২০১৫ দুপুর ০১:৪৪
নৈশ শিকারী লিখেছেন : ভালো লাগলো
333598
০৪ আগস্ট ২০১৫ দুপুর ০২:২১
নাবিক লিখেছেন : অনেক ইতিহাস জানলাম। সুন্দর পোস্ট।
333609
০৪ আগস্ট ২০১৫ দুপুর ০৩:০৯
হতভাগা লিখেছেন : আমার কাছে একটা জিনিস খুব খটকা লাগে -
কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করেছিলেন এটা আমরা জানতে পারি পাঠ্যপুস্তকে। এটা সম্ভবত ১৪৯০ সালের ঘটনা হবে ।

কলম্বাস আমেরিকাতে পা দেবার আগে কি সেখানে কোন মানুষই বসবাস করতো না ? শুনেছি যে রেড ইন্ডিয়ানরা আগে থেকেই সেখানে ছিল । তাহলে তো কলম্বাসের আগেই তারা আমেরিকায় গিয়েছিল ।

তাদেরকে কেন আমেরিকার আবিষ্কারক বলা হয় না ?
০৫ আগস্ট ২০১৫ রাত ০২:৪২
275871
দ্য স্লেভ লিখেছেন : ১৪৯২ সালে কলম্বাস আমেরিকা আসে। আর এর অনেক শতাব্দী আগে থেকে আরবদের সাথে এখানে ব্যবসা হত। কলম্বাস তার ডায়েরীতে কিউবার উপকূলে একটি মসজিদ দেখেছেন বলেও উল্লেখ করেন। কলম্বাস কিভাবে আমেরিকার আবিষ্কারক হয় এটা একটা বিশ্ময়!!
333628
০৪ আগস্ট ২০১৫ বিকাল ০৪:০৭
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : সুন্দর পোষ্টটির জন্য অনেক ধন্যবাদ। আহমদ ইবনে মজিদ এই পথের চার্ট ও প্রয়নন করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে মিশরে ফিরআউনের আমলেই উত্তর আফ্রিকা থেকে আটলান্টিক উপকূল হয়ে দক্ষিন আফ্রিকার শেষপ্রান্তে নেীচলাচল এর প্রমান আছে। দিয়াজ বা ভাস্কো ডা গামা নতুন কিছু আবিস্কার করেননি। বরং ইউরোপিয় জলদস্যুতার ই প্রসার ঘটিয়েছেন।
333674
০৪ আগস্ট ২০১৫ সন্ধ্যা ০৭:০১
মিনহাজুল ইসলাম মোহাম্মদ মাছুম লিখেছেন : শিহাব আল-দীন আহম্মদ ইবনে মজিদ আল নজদি ছিলেন তখনকার সময়ের জগদ্বিখ্যাত নাবিক ও সমুদ্রবিজ্ঞানী।
-বিজ্ঞানে মুসলমানদের কত অবদান? আমরা জানি না!..অনেক ধন্যবাদ..
333700
০৪ আগস্ট ২০১৫ রাত ০৯:১৮
আবু জারীর লিখেছেন : আহমদ ইবনে মজিদ একজন বাস্তব হিরো, যিনি আফ্রিকা উপকূল থেকে ভারত উপকূলে আসার জলপথ আবিষ্কারে ভাস্কো দা গামাকে পথনির্দেশ করেছেন।

মুসলমানদের এমন অনেক কৃতিত্বই এভাবে ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে দেয়ার ব্যর্থ হয়েছে এবং হচ্ছে।

ধন্যবাদ।
333766
০৫ আগস্ট ২০১৫ রাত ০২:৪৪
দ্য স্লেভ লিখেছেন : জাজাকাল্লাহ খায়রান। দারুন ইতিহাস জানলাম...সম্ভবত কলম্বাস মহিউদ্দীন রইসের সমুদ্র পথের চিত্র অনুসরন করেছিলো...ভুলে গেছি অনেকটা

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File