ডঃ খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর স্যারঃ অবেলায় খসে যাওয়া এক নক্ষত্র

লিখেছেন লিখেছেন আল মাসুদ ১১ মে, ২০১৬, ১১:২৩:৫২ রাত

কিভাবে শুরু করব বুঝতে পারছি না। এলোমেলো ভাবনাগুলো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। মনটা এমনিতে খারাপ। বাংলাদেশ সময় সকাল ৮.৫০ মিনিটে নিজের ডিপার্টমেন্টের অফিসে যেয়ে ফেসবুক খুলে দুঃসংবাদটা দেখে মনটা আরো খারাপ হয়ে গেল। আমাদের সকলের প্রিয়, সদালাপী ডঃ খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর স্যার আর নেই। নিজের সামনে সব কিছু অন্ধকার মনে হলো। বিশ্বাস করতে পারছি না যে স্যার আর নেই। সঙ্গে সঙ্গে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়ার প্রফেসর ডঃ আব্দুর রহমান আনওয়ারী স্যারকে ফোন দিলাম। উনি বললেন, হ্যা যা শুনেছেন সত্যি শুনেছেন। কি বলব, কি করব, বুঝতে পারলাম না। মন থেকে তাঁর বিদায়টা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। নিজের আপনজন হারানোর বেদনায় স্যারের সাথে বিভিন্ন স্মৃতি হাতড়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে লাগলাম।

২০০৫-২০০৬ সালের দিকে এক ওয়াজ মাহফিলে প্রথম স্যারের কথা শুনি। পরে তাঁর লেখা “এহইয়াউস সুনান” ও “হাদীসের নামে জালিয়াতি” বই পড়ে তাঁর প্রতি আমার মুগদ্ধতা ও ভালবাসে বেড়ে যায়। সহজ-সরল কথায় যেকোন বিষয় বুঝানোর ক্ষেত্রে তাঁর কোন জুড়ি ছিলনা। ভাষার নিজস্বতা ও সরলতার কারণে অন্যদের থেকে খুব সহজে আলাদা করা যেত স্যারকে। ঢাবিতে আসার পরে প্রথম স্যারের সাথে দেখা কল্যানপুরের ফুরফুরা শরীফের দরগায়। সময়-অসময়ে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে স্যারকে ফোন করতাম। কখনো বিরক্ত হতেন না। সর্বশেষ স্যারের সাথে দেখা করি গত বছরের ১৩ই ডিসেম্বর ওনার আস-সুন্নাহ ট্রাস্টের অফিসে। আমার পিএইচডির বিষয় নির্ধারণ এবং সে সম্পর্কিত অনেক তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সাহায্য করলেন। অনেককে ফোনও করে দিলেন। নতুন স্টুডিওসহ ওনার অফিসের বিভিন্ন রুম ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালেন। অনেক স্বপ্নের কথা বললেন। বিশেষ করে বাইবেলের উপর লিখিত ৯০০ পৃষ্টার একটা বইয়ের কথা বললেন যা ফেব্রুয়ারীতে প্রকাশিত হবার কথা ছিল। ২৭শে ফেব্রুয়ারিতে স্যার আমাকে ফোন দিয়ে বললেন, তুমি দেশ থেকে যাবার আগে আমাকে কিছু বই সংগ্রহ করে দিবে। ২৯শে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকাতে এসে ফোন দিলাম কিন্তু ফুরফুরার মাহফিলে ব্যস্ত থাকার কারণে আর দেখা করা সম্ভব হয়নি। সর্বশেষ গত মাসে তাঁর তুরস্ক ভ্রমনের সময় কথা হয়। বললো, আমি দেশে গেলে কারো মাধ্যমে বইগুলো সংগ্রহ করে দিও। গতকাল (১০-০৫-২০১৬) আমার ছোই ভাইয়ের সাথে কথা বলে স্যারের নম্বর দিয়ে যোগাযোগ করে বইগুলো সংগ্রহ করে দিতে বললাম। কিন্তু স্যার আর সে সময় দিলেন না।

ব্যক্তি হিসেবে স্যার ছিলেন খোদাভীরু, অমায়িক, নির্লোভ, প্রচারবিমুখ, সদালাপী, সদা হাস্যজ্জ্বল, নির্ঝঞ্জাটে ও বিনয়ী। খুব সহজে যে কারো আপন করে নিতে পারতেন। যেকোন বিষয় আলোচনা করার ক্ষেত্রে বিতর্ক এড়িয়ে চলতেন। কারো প্রতি বিদ্বেষী না হয়ে খুব সহজ-সরল ভাষায় যা সত্য তাই বলতেন। আলোচনা ও বিশ্লেষনের ক্ষেত্রে পারিপ্বার্শিক অবস্থার উপর খেয়াল রাখতেন। কারো অবদানকে কখনো খাটো করে দেখতেন না। সবার অবদানের প্রতি ছিলেন খুবই শ্রদ্ধাশীল। তবে সমালোচনার ক্ষেত্রে ছিলেন যৌক্তিক এবং দল নিরপেক্ষ। বাংলাদেশে সুন্নাহর পুর্জাগরণ ও বিদআতের মুলোৎপাঠনে স্যারের ভূমিকা ও অবদান অনস্বীকার্য। এজন্য একটি শ্রেণী স্যারের প্রতি বিরাগভাজন ছিলেন।

বাংলাদেশের ইসলামপন্ত্রীদের এ ক্রান্তিলগ্নে ডঃ খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর স্যারের চলে যাওয়া বড় একটা ধাক্কা ও অপূরনীয় ক্ষতি। আগামী কয়েক দশকে হয়তো তাঁর এ অভাব পূরণ হবে না। তাঁর বিদায়ের মধ্য দিয়ে বাংলার আকাশ থেকে দীপ্তমান এক তারকার অন্তর্ধান হল। কোন রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ততা না থাকলেও দল-মত নির্বিশেষে সকলের প্রিয় ছিলেন তিনি।

ছাত্রজীবন থেকে স্যার দাওয়াতী কাজের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। দেশে আসার পরে আস-সুন্নাহ ট্রাস্টের মাধ্যমে সুন্নাহর পুনর্জাগরনের পাশাপাশি মিশনারী কার্যক্রমের বিপরীতে কাজ শুরু করেন। বিশেষ করে দাঈ তৈরি (ওনার ট্রাস্টের অধিনে দাঈদের প্রশিক্ষণের জন্য একটা ডিপ্লোমা কোর্স চালু করেন) করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ইসলামের বাণী প্রচারে উদ্বুদ্ধ করতেন। যারা অন্য ধর্ম গ্রহণ করেছে তাদেরকে নিজ ধর্মে ফিরে আসার আহবান জানাতেন।

বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে দল-মত নির্বিশেষে সকল আলেম সমাজের ঐক্য এখন সময়ের দাবি। আর এই ঐক্য প্রতিষ্ঠায় দরকার ছিল একজন হক্কানী আলেম যিনি দল-মতের উর্দ্ধে ওঠে সকলকে একই প্লাটফর্মে আনতে সক্ষম। আর জ্ঞান-গরিমা, আমল-আখলাক্ব, ভারসাম্যপূর্ণ কথা ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নেওয়ার অন্যতম যোগ্য ব্যক্তি ছিলেন স্যার। দেশে অনেক জ্ঞানী-গুনী আলেম থাকলেও রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা ও বিভিন্ন কারণে বিতর্কিত কিন্তু সর্বদিক (ইলম-আমল) থেকে সর্বমহলে স্যারের ব্যক্তিত্ব ছিল প্রশংসনীয়।

স্যারের ব্যক্তিত্ব ও কর্মযজ্ঞ নিয়ে এত অল্প পরিসরে লেখা সম্ভব নয়। শুধু স্যারকে এটুকু বলতে চা্ই, অনেক অবেলায় আমাদেরকে অভিভাবকহীন করে চলে গেলেন আপনি। চারদিকে ইসলাম বিদ্বেষীদের আস্ফলণ আর হুংকারের মাঝে আপনার মত দক্ষ নাবিকের বড্ড দরকার ছিল। আপনার অল্পদিনের কর্মযজ্ঞের কারণে আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন চিরদিন।

বিষয়: বিবিধ

৩৬৮৬ বার পঠিত, ১৮ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

368758
১১ মে ২০১৬ রাত ১১:৫২
অয়েজ কুরুনী আল বিরুনী লিখেছেন : ভালো মানুষগুলি একেএকে চলে যাচ্ছেন। আল্লাহ তায়ালা স্যারকে কবুল করুন।
১১ মে ২০১৬ রাত ১১:৫৯
306063
আল মাসুদ লিখেছেন : আমীন। স্যারকে ভূলতেই পারছি না। শেষ কথাগুলো কানে বাজতেছে।
368759
১১ মে ২০১৬ রাত ১১:৫৩
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : এই সময়ে তার মত ব্যাক্তিত্বর এই ভাবে ইন্তেকাল সন্দেহর সৃষ্টি করে। এই দেশে আলিমদের মতভেদ কে যারা জিইয়ে রাখতে চায় তাদের জন্য এটা সুবিধা।
১২ মে ২০১৬ রাত ১২:০০
306064
আল মাসুদ লিখেছেন : আল্লাহ ভাল জানে। তবে আলেমদের ঐক্যের জন্য তাঁর মত আলেম দরকার।
368783
১২ মে ২০১৬ রাত ০১:২৩
আমীর আজম লিখেছেন : স্যারের এক্সিডেন্টের ধরণ ও সময়টা (ব্যাখার দাবি রাখে) এ সমস্ত চিন্তা করতে বাধ্য করেছে।
১৫ মে ২০১৬ দুপুর ০১:৫২
306367
আল মাসুদ লিখেছেন : ALLAH KNOWS WELL.
368791
১২ মে ২০১৬ রাত ০৪:৪০
শেখের পোলা লিখেছেন : সত্যটা আল্লাহই জানেন। তার ইচ্ছাই বান্দার ইচ্ছা। ইন্না-----রাজেউন।
১২ মে ২০১৬ সকাল ০৫:৫৩
306085
আল মাসুদ লিখেছেন : ঠিক বলেছেন।
368800
১২ মে ২০১৬ সকাল ০৭:৫৬
বিবর্ন সন্ধা লিখেছেন : আসসালামু আলাইকুম

কিছু ক্ষতি
ক্ষতি ই থেকে যায়,
সেই ক্ষতিপূরণ আর হয় না।
১২ মে ২০১৬ সকাল ০৮:০৭
306100
আল মাসুদ লিখেছেন : ওয়ালাইকুমুচ্ছালাম। ঠিক বলেছেন। এই ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা অসম্ভব।
368803
১২ মে ২০১৬ সকাল ০৮:২৬
হতভাগা লিখেছেন : আল্লাহ উনাকে জান্নাত নসীব করুন - আমিন।

ইসলামিক টিভিতে প্রথম উনাকে দেখি । উনার বলার ধরন ছিল খুবই সহজ ও সরল যেটা মনে ধরত।
১২ মে ২০১৬ বিকাল ০৫:৫৯
306160
আল মাসুদ লিখেছেন : ওনার ভাষার নিজস্বতা ও সরলতা অন্যদের থেকে ওনাকে আলাদা করেছে।
368862
১২ মে ২০১৬ সন্ধ্যা ০৬:৪৮
মোহাম্মদ লোকমান লিখেছেন : আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ওনার সমস্ত ভুল ত্রুটি ক্ষমা করে দিয়ে জান্নাতের মেহমান বানিয়ে নিন।
১২ মে ২০১৬ সন্ধ্যা ০৭:০৪
306166
আল মাসুদ লিখেছেন : আমীন।
368868
১২ মে ২০১৬ সন্ধ্যা ০৭:৪৮
আবু জান্নাত লিখেছেন : ওনার মাগফিরাত কামনা করছি।
১২ মে ২০১৬ রাত ০৯:৩৫
306177
আল মাসুদ লিখেছেন : আমীন। আল্লাহ ওনাকে জান্নাত দান করুক।
368925
১৩ মে ২০১৬ সকাল ১১:২১
দ্য স্লেভ লিখেছেন : উনি এক অসাধারন আলেম। নিরপেক্ষভাবে বলতে পারে এবং তা গ্রহনযোগ্য হতে পারে এমন আলেম এর সংখ্যা কম,আবার তাদের বক্তব্যও প্রখর নয়। অনেক ক্ষতি হল। এখন বাতিলপন্থীরা হয়ত বেশ খুশী
১৩ মে ২০১৬ সন্ধ্যা ০৬:২৭
306234
আল মাসুদ লিখেছেন : ঠিক কথা বলেছেন ভাই।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File