১৬ই আগষ্ট। প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস।

লিখেছেন লিখেছেন রিদওয়ান কবির সবুজ ১৭ আগস্ট, ২০১৪, ০৭:৪৯:৩৭ সন্ধ্যা

১৫ই আগষ্ট নিয়ে টানাটানি করতে করতে আমরা ভুলে যাচ্ছি আরেকটি দিন কে। সেই দিনটি হলো ১৬ ই আগষ্ট। সেই দিনটিও আমাদের ইতিহাসের একটি রক্তাক্ত দিন। ১৯৪৬ সালের ১৬ ই আগষ্ট তৎকালিন বৃটিশ ভারতে মুসলিম জাতির অধিকার আদায় এর লক্ষে মুসলিম নেতারা ঘোষনা করেছিলেন ডিরেক্ট অ্যাকশন ডে বা প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস। আর সেই দিন তৎকালিন অবিভক্ত বাংলার রাজধানি কলকাতা শহর হয়ে উঠেছিল মুসলিম রক্তে রঞ্জিত। সেই দিনটি সংবাদ পত্রে বর্নিত হয়েছিল ”গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং” বলে। যদিও বলা হয় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সেইদিন ছিল মুসলিমদের হত্যা দিবস।

এই দিনটির একটু পুর্ব ইতিহাস রয়েছে। দ্বিতিয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর কিভাবে ভারতের স্বাধিনতা দেওয়া যায় সেই পরিকল্পনা করার উদ্দেশ্যে বৃটিশ মন্ত্রিসভার তিনজন সদস্য বানিজ্যমন্ত্রি ষ্ট্যাফোর্ড ক্রিপস,ভারত বিষয়ক মন্ত্রি লর্ড পেথিক লরেন্স এবং নেীবহর বিষয়ক মন্ত্রি এ বি আলেকজান্ডার কে নিয়ে গঠিত একটি মিশন ভারতে আসে। এই মিশন কে কেবিনেট মিশন বলা হয়। এই মিশন ১৯৪৬ সালের ১৫ ই মে তাদের পরিকল্পনা পেশ করে। তারা পাকিস্তান দাবি গ্রহন করার পরিবর্তে ভারত কে মুসলিম প্রধান উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর পুর্ব অঞ্চল এবং অবশিষ্ট অংশ কে নিয়ে তিনটি গ্রুপ গঠন করার এবং এই গ্রুপগুলির অধিনে প্রদেশগুলিকে সর্বোচ্চ সায়ত্বশাসন দিয়ে একটি কনফেডারেশন গঠন এর প্রস্তাব দেয়। মুসলিম লিগ ভারতের অখন্ডতা রেখেও পাকিস্তান দাবির মুল উদ্দেশ্য তথা মুসলিম প্রধান অঞ্চলগুলির পুর্ন সায়ত্বশাসন এর সুযোগ রয়েছে দেখে এই পরিকল্পনা গ্রহন করতে সম্মত হয়। একক শাসন ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেখে কংগ্রেস এই পরিকল্পনা গ্রহনে গড়িমসি করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত বৃটিশ চাপে সম্মতি দেয়। কিন্তু তাদের এই সম্মতি ছিল স্রেফ লোক দেখান। ১০ ই জুলাই জওহরলাল নেহেরু কংগ্রেস এর সভাপতি হিসেবে দায়িত্বগ্রহন করে সাংবাদিক দের মুখোমুখি হন। সেইদিন তিনি মনের অজান্তেই হয়তোবা কংগ্রেস এর উদ্দেশ্য প্রকাশ করে ফেলেন। তিনি সাংবাদিকদের বলে ফেলেন যে কংগ্রেস সাময়িকভাবে কেবিনেট মিশন পরিকল্পনা গ্রহন করছে। স্বাধিন গনপরিষদ এই পরিকল্পনা মানতে বাধ্য নয়। প্রকারান্তরে তিনি এই কথাই বলেন যে গ্রুপ ভিত্তিক প্রাদেশিক সর্বোচ্চ সায়ত্বশাসন মেনে নিতে তারা প্রস্তুত নন বরং ক্ষমতা পেলেই তারা তার পরিবর্তন করবে। এই সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর ১৯ শে জুলাই বোম্বেতে মুসলিম লিগ এর বিশেষ কাউন্সিল অধিবেশন বসে এবং সেই অধিবেশনে কেবিনেট মিশন পরিকল্পনা পুনবিবেচনা করে প্রত্যাখ্যান করা হয় এবং পাকিস্তান আদায় করার উদ্দেশ্যে ১৬ ই আগষ্ট ১৯৪৬ সাল সারা ভারতে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম এর ডাক দেওয়া হয়।

এসময় ভারতের প্রদেশগুলির মধ্যে কেবল পাঞ্জাব ও বাংলাতেই মুসলিম লিগ পুর্ন ক্ষমতায় ছিল। বাংলার তৎকালিন প্রধান মন্ত্রি হুসাইন শহিদ সুহরাওয়ার্দি ১৬ ই আগষ্ট ছুটি ঘোষনা করেন। এই দিন এর প্রধান কর্মসুচি ছিল কলকাতার ঐতিহাসিক ময়দানে মুসলিম লিগের সমাবেশ। এই দিন মুসলিম লিগ সংগঠন বা সরকারের কারই দাঙ্গা করার বা প্রতিরোধ করার কোন চিন্তা ছিলনা। কিন্তু কট্টর হিন্দুত্ববাদিরা এই দিন মুসলিম হত্যার জন্য পুর্ব প্রস্ততি নিয়ে রেখেছিল। জাতিয় অধ্যাপক সৈয়দ আলি আহসান তার ”যখন কলকাতায় ছিলাম” গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন তিনি তার কয়েকজন হিন্দু সহকর্মি থেকে কলকাতায় হিন্দু যুবকদের সংগঠিত হওয়ার খবর তাদের অজান্তে শুনে ফেলেন। তিনি তখন রেডিওতে কর্মরত ছিলেন। ১৫ই আগষ্ট ১৯৪৬ বিখ্যাত সাহিত্যিক ও রেডিও কর্মি নৃপেন্দ্র কৃষ্ন চট্যোপাধ্যায় তাকে ডেকে নিয়ে বলেন যে ১৬ আগষ্ট কলকতায় দাঙ্গা হবে এবং তিনি যেন কোথাও চলে যান। সরকারি ছুটি থাকায় কেবল মাত্র জরুরি কর্মি ছাড়া বাকিদের ছুটি ছিল। তিনি পরদিন সকালেই তার শশুড়ের কর্মস্থল হাওরার বাউরিয়াতে চলে যান। তার শশুড় ছিলেন সেই থানার ইনচার্জ। ১৬ ই আগষ্ট রাত্রে তিনি নিজ চোখে দেখেন গঙ্গার স্রোতে কলকাতা তেকে ভেসে আসছে কেবল মানুষের মৃতদেহ। যাদের প্রায় সকলেই মুসলিম।

১৬ই আগষ্ট মুসলিম লিগ কোনভাবেই এই জন্য প্রস্তত ছিলনা বা তাদের হিন্দু দের বিরুদ্ধে আক্রমন চালনর কোন পরিকল্পনাও ছিলনা। মুসলিম লিগের নেতাকর্মি সকলেই সেদিন সমাবেশ স্থলে গিয়েছিলেন। তৎকালিন মুসলিম লিগের সেক্রেটারি দার্শনিক আবুল হাশিম লিখেছেন কোন বিপদের সম্ভাবনা থাকলে তিনি তার দুই কিশোর পুত্রকে নিয়ে সেই সমাবেশে যেতেন না। সেই সমাবেশে খাজা নাজিমুদ্দিন কংগ্রেস ও হিন্দুদের বিরুদ্ধে কিছু বলতে চাইলেও আবুল হাসিম মুসলিম লিগ সেক্রেটারি হিসবে পরিস্কার করে বলেন যে এই আন্দোলন বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদিদের বিরুদ্ধে। সমাবেশ যখন চলছে তখনই কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মুসলিমদের উপর হামলার খবর আসতে থাকে। সুহরাওয়ার্দি সভার কাজ দ্রুত শেষ করেন এবং সকলকে সাবধানে নিজ ঘরে ফিরে যেতে বলেন। কিন্তু ততক্ষনে কোলকাতার অধিকাংশ মুসলিম এলাকা আক্রান্ত হয়ে গেছে। এই সব এলাকার পুরুষদের বেশিরভাগই তখন হয় কর্মক্ষেত্রে নয়তো সভায় উপস্থিত ছিলেন। সেই দিন থেকে শুরু করে ২০ আগস্ট পর্যন্ত কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় চলে রক্তের হোলি খেলা। হুসাইন শহিদ সুহরাওয়ার্দি প্রধানমন্ত্রি হিসেবে কঠোর পরিশ্রম করে এই দাঙ্গা প্রতিরোধের চেষ্টা করেন। কিন্তু তৎকালিন গভর্নর উইলিয়াম বারোজ এবং কলকাতা পুলিশ তাকে অনেক অসহযোগিতা করে। কলকাতা পুলিশে তখন মুসলিম ছিলেন মাত্র ৬৩ জন। সুহরাওয়ার্দি জরুরি ভিত্তিতে পাঞ্জাব থেকে বেশ কিছু মুসলিম পুলিশ আনেন এবং গভর্নর কে ২০ এ আগষ্ট সেনাবাহিনি মোতায়েন করতে রাজি করান। সেনাবাহিনি যাতে করে নিরপেক্ষভাবে কাজ করে সেই জন্য তিনি তার ভায়রা এবং সেসময় এর সিনিয়র মুসলিম অফিসার লেফটেনান্ট কর্নেল ইশফাকুল মজিদ কে ফোর্ট উইলিয়াম এ সহকারি এডজুটেন্ট হিসেবে নিয়োগ করার ব্যবস্থা করেন। তার কঠোর পরিশ্রম সত্বেয় এই দাঙ্গা বা হত্যাযজ্ঞে প্রায় ৪০-৫০ হাজার মানুষের জিবন নিভে যায়। ধ্বংস হয় কোটি টাকা মুল্যের সম্পদ।

সকল নিরপেক্ষ বিশ্লেষনেই দেখা যায় এই দাঙ্গার জন্য মুসলিম লিগ বা সুহরাওয়ার্দি বিন্দুমাত্র দায়ি ছিলেন না। কিন্তু ভারতিয় লেখক সাহিত্যিকদের অনেকেই এই জন্য মুসলিম লিগ কে একতরফা দায়ি করেন। কিন্তু মুসলিম লিগ সুস্পষ্টভাবেই বলেছিল তাদের সংগ্রাম বৃটিশদের বিরুদ্ধে। তথাপি সে সময় অনেক তথাকথিত হিন্দু ভদ্রলোকও এই জন্য মুসলিম দের দায়ি করেছেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এর অধ্যাপক এবং বিশিষ্ট ভারতিয় ইতিহাসবিদ তপন রায় চেীধুরি তার অভিজ্ঞতায় লিখেছেন সে সময় একটি হিন্দু সম্পাদিত পত্রিকা হিন্দুদের উপর মুসলিম দের আক্রমন এর কাল্পনিক কাহিনি ছেপে এই দাঙ্গা কে বিস্তৃত করেছিল। এই ভাবে এখনও এই দোষ চাপান হচ্ছে বিভিন্ন সাহিত্যে। এমনকি সে সময় সুহরাওয়ার্দির সহচর এবং মুসলিম ন্যাশনাল গার্ড এর নেতা শেখ মুজিবুর রহমান কেও এই দাঙ্গার জন্য দায়ি করা হয়েছিল!!

এই দিনটি নিয়ে কোন বিশেষ রচনা পত্রপত্রিকাতে চোখে পড়েনি আজকে। আমাদের ইতিহাস থেকে এই গুরুত্বপুর্ন দিনটি যেন হারিয়ে যাচ্ছে। এই ইতিহাস যেন আমরা না ভুলি সেই বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে।

এই দিনের ইতিহাস সম্পর্কে বিষদ জানতে নিচের বই গুলি পড়তে পারেন।

*ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম-মাওলানা আবুল কালাম আযাদ(ভারতিয় জাতিয় কংগ্রেস এর সভাপতি এবং স্বাধিন ভারতের প্রথম শিক্ষা মন্ত্রি)।

*আমার দেখা রাজনিতির পঞ্চাশ বছর-আবুল মনসুর আহমদ(সাহিত্যিক,সাংবাদিক, রাজনিতিবিদ, পাকিস্তান কেন্দ্রিয় সরকারের শিল্প ও বানিজ্য মন্ত্রি এবং অস্থায়ি প্রধানমন্ত্রি, আওয়ামি লিগ সভাপতি)।

*আমার জিবন ও বিভাগপূর্ব বাংলাদেশের রাজনিতি-আবুল হাশিম (দার্শনিক,রাজনিতিবিদ, বিভাগপুর্ব মুসলিম লিগের সেক্রেটারি,ইসলামিক একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা)।

*যখন কলকাতায় ছিলাম,জিবনের শিলান্যাস-সৈয়দ আলি আহসান(সাহিত্যিক, উপাচার্য এবং জাতিয় অধ্যাপক)।

*প্রিতি নিন সকলে,একজিবন এক ইতিহাস-সিরাজুর রহমান ( সাংবাদিক বিবিসি)

*বাঙ্গালনামা,রোমন্থন-তপন রায় চেীধুরি(ইতিহাসবিদ,অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এর এডহোমিনেম অধ্যাপক)।

*জিন্নাহ/পাকিস্তান/নতুন ভাবনা-শৈলেশ কুমার বন্দোপাধ্যায়(গান্ধিবাদি দার্শনিক ও প্রাক্তন কংগ্রেস নেতা)।

বিষয়: বিবিধ

২০২৪ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

255275
১৭ আগস্ট ২০১৪ রাত ০৮:০৮
নিউজ ওয়াচ লিখেছেন : ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ
১৮ আগস্ট ২০১৪ সকাল ১০:৪০
199132
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : আপনাকেও ধন্যবাদ।
255290
১৭ আগস্ট ২০১৪ রাত ০৯:০৩
বুড়া মিয়া লিখেছেন : এ এলাকার মুসলিমদের রক্তাক্ত ইতিহাস তুলে ধরায় অনেক ধন্যবাদ, অনেক কিছু জানলাম আপনার লেখায়।
১৮ আগস্ট ২০১৪ সকাল ১০:৪১
199133
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ সুন্দর মন্তব্যটির জন্য। এই ইতিহাস আমাদের জানা প্রয়োজন।
255332
১৮ আগস্ট ২০১৪ রাত ১২:০৪
গাজী সালাউদ্দিন লিখেছেন : আপনার অনুসন্ধানী মন আমাদের কেও উদ্ভুদ্ধ করছে মুসলমানদের সঠিক ইতিহাস জানার জানতে। অনেক ধন্যবাদ ব্যতিক্রমী কিন্তু অবশ্য প্রয়োজনীয় লিখা পোস্ট করার জন্য,
১৮ আগস্ট ২০১৪ সকাল ১০:৪২
199134
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : ধন্যবাদ সুন্দর মন্তব্যটির জন্য।
255446
১৮ আগস্ট ২০১৪ সকাল ১০:২৬
প্রেসিডেন্ট লিখেছেন : হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসকে তুলে আনার জন্য অনেক ধন্যবাদ। এ ধরনের লেখাকে স্টিকি করতে পারেন মডারেটর
১৮ আগস্ট ২০১৪ সকাল ১০:৪২
199135
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : ধন্যবাদ সুন্দর মন্তব্যটির জন্য।
260518
০১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ রাত ০৯:৫১
মোহাম্মদ লোকমান লিখেছেন : অনেক অজানা তথ্য সম্বলিত লেখাটির জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
০১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ রাত ১০:৩৭
204249
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : সুন্দর মন্তব্যটির জন্য আপনাকেও ধন্যবাদ।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File