হাজি সেলিম বলল, "তোমরা ওকে মেরে ফেলেছো ওর পা দুটি কেটে নাওনি কেন?"

লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ আবদুর রহমান সিরাজী ২৮ অক্টোবর, ২০১৮, ০৯:৫৭:০৫ সকাল



২৮ অক্টোবর-২০০৬ আওয়ামী গুন্ডা বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে শহীদ হন জামায়াতের তৎকালীন লালবাগ থানার ৬৬ নং ওয়ার্ডের মিটফোর্ড ইউনিটের সভাপতি প্রিয় ভাই জসিম উদ্দিন। পিতা- আলহাজ্ব আবদুর রশিদ, স্থায়ী ঠিকানা- গজারিয়া, মুন্সীগঞ্জ, স্বপরিবারে বসবাস করতেন মিটফোর্ড রোডে।

আমি সে সময় ৬৭ নং ওয়ার্ডের মৌলভীবাজার ইউিনিটের সভাপতি। পাশাপাশি বাসা ও পাশাপশি ইউনিটের সভাপতি ও একই সাংগাঠনিক মান হওয়ায় আমরা সব প্রোগ্রামে একই সাথে আসা-যাওয়া করতাম, সেই সুবাদে জসিম ভাইয়ের সাথে ভাল হৃদ্যতা ছিল। তাছাড়া জসিম ভাই অনেক পরহেযগার, অমায়িক ব্যবহার আর মানুষের সাথে মেশার খুব ভাল গুন ছিল।

২৮ অক্টোবর-০৬ বিকাল ৪টায় আমাদের পল্টনে সমাবেশে যাওয়ার কথা কিন্তু ১২ টার টেলিভিশন সংবাদে শুনলাম পল্টনে মারামারি হচ্ছে। দ্রুত ওয়ার্ড সভাপতি রেহান ভাইকে ফোন দিলাম। উনি বললেন, জামায়াতের প্যান্ডেল বানানোর সময় আওয়ামী লীগ হামলা করেছে, আমাদের বেগম বাজারের সভাপতি জহির ভাই সহ অনেকেই আহত হয়েছে। উল্লেখ্য এই হামলাটা হয়েছিল, হাজি সেলিমের নেতৃত্বে লালবাগ থেকে যে মিছিল গিয়েছিল, সেই মিছিল থেকেই হামলা শুরু হয়েছিল। পরে জানতে পেরেছি হাজি সেলিম ২৮ অক্টোবরের সমাবেশকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রায় ৫০ হাজার লোক জড়ো করে লালবাগ-হাজারীবাগের বিভিন্ন স্থানে রেখেছিল। তাদের নিয়েই সকালে হাজী সেলিম পল্টনে হামলা করে। যাহোক, তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে জেলখানার সামনে থেকে রিক্সা নিয়ে গুলিস্থান আসলাম। আগুন সন্ত্রাসী আওয়ামী গুন্ডারা গুলিস্থান ও আশে-পাশের এলাকাকে নরকে পরিণত করেছে। চারিদিকে লোকশুণ্য, আগুন আর আগুন। আমরা পায়ে হেটে কাপ্তানবাজারের ভিতর দিয়ে বঙ্গভবনের দক্ষিন দিক দিয়ে শাপলা চত্বর হয়ে যখন দৈনিক বাংলার মোড়ে আসলাম তখন শিল্পী আবুল কাশেম ভাইয়ের কণ্ঠে শুনলাম মধুর গান, "এখানে কি নেই কেউ ওমরের মত আজ...."। শহিদী তামান্নায় ভিন্ন রকম শিহরণ। সমস্ত শরীরে উত্তেজন। ইতোমধ্যেই বায়তুল মোকারমের সামনে পৌছে গেছি। আমরা আজাদ প্রোডাক্টস এর গলি বরাবর। আর আওয়ামী-১৪ দলের সন্ত্রাসীরা পল্টন মোরে। আমরা কয়েকশ জামায়াত কর্মী অপরদিকে ওরা হাজার হাজার মানুষের জনসমুদ্র। বঙ্গবন্ধু এভিনিউ থেকে আওয়ামী নেতাদের উস্কানীমুলক বক্তব্য চলছে। আমার অবস্থান আজাদ প্রোডাক্টস এর উল্টাপাশে নির্মানাধীন র্যাংস ভবনের নিচে। বিকাল ৪.০০ টার দিকে আমীরে জামায়াত শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর বক্তব্য শুরু হলো। হঠাৎ র্যাংস ভবনের পশ্চীমের বিল্ডিং এর উপরে কিছু মানুষ দেখলাম। আমরা চিৎকার করে উঠেছি। এসময় আমাদের লক্ষ্য করে মুহুর্মুহ বোমা বর্ষন শুরু হলো। আমার চারপাশে ধোয়ায় অন্ধকার হয়ে গেল। বোমার স্পিলিন্টার থেকে বাচার জন্য রাস্তার ডিভাইডারের ওপারে চলে গেলাম। বোমার তেজ কমে আসলে আমরা ৫০-৬০ জন পল্টনে আওয়ামী গুন্ডাদের ধাওয়া করলাম। আমাদের হাতে বাঁশ-লাঠি আর ওদের ছুড়ে মারা ভাঙ্গা ইট। অপরদিকে বিভিন্ন অস্ত্রে সজ্জিত পূর্বপরিকল্পিত ১৪দলের গুন্ডাবাহিনী। আমাদের ধাওয়ায় আওয়ামী গুন্ডাবাহিনী ত্রিধাবিভক্ত হয়ে বিজয়নগর, প্রেসক্লাব আর মুক্তাঙ্গন এর দিকে পঙ্গপালের মত পালাতে লাগল। আমরা পল্টনমোড় দখলে নিলাম। কিছুক্ষন পর আবারও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দলের হামলা শুরু হলে। আমরাও পল্টন মোড়ে প্রতিরোধ গড়ে তুললাম। আমাদের ১টা ইটের বদলে শত শত ইট আমাদের দিকে ছুটে আসতে লাগল। পল্টন ছাড়তে মন চাচ্ছিল না। হাতের লাঠিটা নাক বরাবর ধরে আছি। গোটা শরীরে ইটের আঘাত লাগতেছে। ইটের আঘাতে লাঠিটাতে টুস, টাস শব্দ হচ্ছে। অবশেষে আমরা পিছু হঠতে শুরু করলাম। আমরা ১০-১২ জন মুল দল থেকে অনেক সামনে। ওদের রেড লাইন পল্টন মোড় আর আমাদের রেড লাইন আজাদপ্রোডাক্টস এর গলি বরাবর। মাঝে বাফার জোন। এবার আমি সামনে একা পড়ে গেছি। আমি রোড ডিভাইডারের উত্তেরের রাস্তায় পশ্চীম দিক থেকে আসা গুন্ডাবাহিনীকে সামলাচ্ছি আর পিছে হটছি। ইতোমধ্যেই রোডের দক্ষিনের দিক থেকে ১৪ দলের একটি গ্রুপ হামলা করল। শুরু হলো জীবন-মরণ লড়াই। ওরা ১৫-২০ জন লগি-বৈঠা দিয়ে মারতেছে আর আমি আমার লাঠি দিয়ে প্রতিরোধ করছি। আমার এ অবস্থা দেখে জীবনের ঝুকি নিয়ে বায়তুল মোকারমের সামনে থেকে আমাদের একটা গ্রুপ এসে আওয়ামী গ্রুপের উপর প্রচন্ড হামলা চালাল। তারা পালিয়ে গেল। আমি মুল সমাবেশে মিলিত হলাম। মোটামুটি সবাই আহত। এভাবে সন্ধা পর্যন্ত ধাওয়া-পাল্টার পর সন্ধায় বিজিবি এসে পল্টন ও বায়তুল মোকারম এলাকার কন্ট্রোল নিল।

ইতোমধ্যে খবর পেলাম শহীদ জসিম উদ্দিন গুরুতর আহত। পল্টনে প্রিতম বিরিয়ানীর সামনে তাকে লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে মুমুর্ষ অবস্থায় ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হয়েছে। ছুটলাম ঢাকা মেডিকেলে। হাসপাতালের বেডে প্রিয়ভাই জসিম উদ্দিন 'আল্লাহ, আল্লাহ ' জপতেছে, কালেমা পড়তেছে। কিছুক্ষনের মধ্যেই প্রিয়ভাই আল্লাহর সার্ণিধ্যে চলে গেলেন। তাঁর লাশ নিয়ে হাসপাতালে হাজি সেলিমের নেতৃত্বে আওয়ামী গুন্ডাবাহিনী নোংরামি শুরু করল। একজন আওয়ামী লীগারকে শহীদ জসিমের বাবা বানিয়ে তাকে লাশ দেওয়ার জন্য বলা হলো। একজন নার্স শহীদ জসিমের পকেটের ভিজিটিং কার্ড দেখে তার বাবাকে ফোন করেছিল। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে শহীদ জসিমের বাবা হাসপাতালে এসে তার ছেলেকে নিয়ে নোংরামি করতে দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন। শহীদ জসিমের লাশ নিয়ে জামায়ত কর্মীদের সাথে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের ধ্বস্তাধ্বস্তি হচ্ছে। এমতাবস্থায় শহীদ জসিমের মুল বাবা আওয়ামী সমর্থক আলহাজ্ব আবদুর রশিদ সাহেবকে জিজ্ঞেস করল, "আপনার ছেলে কোন দল করত?" যখন শহীদ জসিমের বাবা বলল, "আমার ছেলে জামাত-শিবির করথ" তখন পাজি সেলিম অগ্নিশর্মা হয়ে গেলেন। হাজি সেলিম ওর গুন্ডা-পান্ডাদের বলল, "তোমরা ওকে (শহীদ জসিম কে) মেরে ফেলেছ ওর পা দুটি কেটে নাওনি কেন"? এরপর এই সন্ত্রাসীরা হাসপাতাল ত্যাগ করে আর আমরা শহীদ জসিমের লাশ বাসায় নিয়ে আসি।

বিষয়: বিবিধ

১৫৫০ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

386071
২৮ অক্টোবর ২০১৮ দুপুর ০২:৫২
ইয়াফি লিখেছেন : আল্লাহ এদিনের শহীদদের কবুল করে নিন!
386073
২৮ অক্টোবর ২০১৮ বিকাল ০৫:৫৩
386075
২৮ অক্টোবর ২০১৮ রাত ০৮:৪৪
শেখের পোলা লিখেছেন : হাজী সেলীম! হাজী নামের কলঙ্ক। আল্লাহ ওর জীববদ্দশায় দুপা কেটে দেখিয়েও দিতে পারেন তাতে কি হয়।
৩০ অক্টোবর ২০১৮ রাত ১০:২০
318051
মোহাম্মদ আবদুর রহমান সিরাজী লিখেছেন : ও এখন একটা বিকলাঙ্গ। কথা বলতে পারে না....

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File