কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণে ‘কনফিউজড’ প্রসিকিউটর !

লিখেছেন লিখেছেন সোহাগ ২৩ এপ্রিল, ২০১৩, ০৪:০০:১৩ বিকাল

গত বছরের ৪ জুন একাত্তরে হত্যা, গণহত্যা, নির্যাতন, দেশত্যাগে বাধ্য করাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের সাত ধরনের অভিযোগে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানকে অভিযুক্ত করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২।



এর প্রায় ১০ মাস পর একই ট্রাইব্যুনালে সেসব অভিযোগ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে প্রমাণ করতে গিয়ে ‘কনফিউজড’ (দ্বিধান্বিত) হলেন খোদ রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটর।

বুধবার বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-২ এ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের সময় প্রসিকিউটর এ কে এম সাইফুল ইসলাম ট্রাইব্যুনালের প্রশ্নের জবাবে ‘কনফিউজড’ বোধ করেন।

এছাড়া তাদেরই আনা (রাষ্ট্রপক্ষের) একজন সাক্ষীকে এ সময় তিনি নিজেই ‘পক্ষপাতদুষ্ট’ বলেও অভিযোগ করেন।

যুক্তি উপস্থাপনকালে কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে সাত নম্বর অভিযোগ প্রমাণের সময় সংশ্লিষ্ট তিনজন সাক্ষীর সাক্ষ্য ট্রাইব্যুনালকে পড়ে শোনান প্রসিকিউটর সাইফুল। অভিযোগে বর্ণিত ঘটনা ও সাক্ষীদের বর্ণনার তারিখের মিল না হওয়া এবং ঘটনার সময় সরাসরি কামারুজ্জামানকে না দেখার কারণে ট্রাইব্যুনাল দুজন সাক্ষীর বক্তব্যে বিশ্বাস (রিলাই) রাখতে পারেননি।

অন্য একজন সাক্ষীর বক্তব্য গ্রহণ করে ট্রাইব্যুনাল জানতে চান, মাত্র একজন সাক্ষীর সাক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে এ অভিযোগ গ্রহণ করার পক্ষে কোনো যুক্তি প্রসিকিউটরের আছে কিনা। এ সময় প্রসিকিউটর সাইফুল কাগজপত্র উল্টাতে থাকেন।

ট্রাইব্যুনালের বিচারক প্যানেলের সদস্য বিচারপতি মুজিবুর রহমান মিয়া খানিকটা বিরক্ত হয়ে এ সময় বলেন, ‘‘জানা থাকলে আপনি আগেই বলতেন।’’

এ সময় ‍অন্য বিচারপতি শাহিনুর ইসলাম আবারও একই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলে প্রসিকিউটর সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘‘আই অ্যাম কনফিউজড, মাই লর্ড।’’ তখন বিচারপতি শাহিনুর ইসলাম বলে ওঠেন, ‘‘আপনি কেন কনফিউজড হবেন!’’

এরপর তিনি নিজেই (বিচারপতি শাহিনুর) বলেন, ‘‘আপনি বলুন, সেটল জুরিস প্রুডেন্স অনুযায়ী বিশ্বাসযোগ্য হলে একজন সাক্ষীর সাক্ষ্য দিয়েই আসামিকে অভিযুক্ত করা যায়।’’

পেছনে বসা রাষ্ট্রপক্ষের অন্য প্রসিকিউটররাও এ সময় একই কথা বলতে থাকেন। সাইফুল ইসলামও তখন ‘‘ইয়েস, ইয়েস মাই লর্ড’’ বলে মাথা নাড়েন।

এ সময় ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান প্রসিকিউটরের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘‘আসামিপক্ষের সিনিয়র আইনজীবীরা ট্রাইব্যুনালের উপস্থিত নেই। তাদের একজন জুনিয়র নোট নিচ্ছেন। যাতে তারাও ভালোভাবে যুক্তিতর্ক করতে পারেন, সেজন্য আপনাদের ভুলগুলো আমরা তুলে ধরছি।’’

বুধবার তৃতীয় দিনের মতো রাষ্ট্রপক্ষের এ যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে অভিযুক্ত কামারুজ্জামানের অনুরোধে আগামী রোববার ৩১ মার্চ পর্যন্ত মুলতবি করেন ট্রাইব্যুনাল। এ তিন দিনের যুক্তিতর্কে সাক্ষীদের সাক্ষ্য-প্রমাণ ও ডকুমেন্টের ভিত্তিতে কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে আনীত ৭টি অভিযোগের বিষয়ে যুক্তিতর্কসহ যুক্তিতর্কের সার-সংক্ষেপ উপস্থাপন শেষ করেছেন রাষ্ট্রপক্ষের চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু, প্রসিকিউটর এ কে এম সাইফুল ইসলাম ও নুরজাহান বেগম মুক্তা। আর আগামী রোববার আইনি পয়েন্টে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করবেন রাষ্ট্রপক্ষ।

বুধবার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে তৃতীয় দিনের মতো যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু করেন প্রসিকিউটর সাইফুল ইসলাম। তবে হরতাল থাকায় আসামিপক্ষের সিনিয়র আইনজীবীরা উপস্থিত ছিলেন না। তাদের জুনিয়র এম এম শাহীন উপস্থিত থেকে যুক্তিতর্কের বিভিন্ন বিষয় নোট নেন।

কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগুলোর পক্ষে সাক্ষীদের সাক্ষ্য তুলে ধরে প্রসিকিউটর সাইফুল ইসলাম ট্রাইব্যুনালে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করতে থাকেন।

চার নম্বর অভিযোগের (মুক্তিযোদ্ধা গোলাম রসুল হত্যা) পক্ষে যুক্তি দেওয়ার সময় সাক্ষীদের সাক্ষ্যে আসা পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা মেজর রিয়াদ বাংলা বলতে পারতেন কিনা প্রশ্ন করেন ট্রাইব্যুনালের বিচারপতি ওবায়দুল হাসান।

এ সময় প্রসিকিউটর সাইফুল সঠিক উত্তর না দিতে পারলে পিছনে বসে থাকা প্রসিকিউটর হায়দার আলী সাহায্য করে বলেন, ‘‘প্রসিকিউশনের ১৪ নম্বর সাক্ষী মুজিবুর রহমান পানু তার সাক্ষ্যে বলেছেন, মেজর রিয়াদ কিছু কিছু বাংলা বলতেন।’’

এ পর্যায়ে কাঠগড়ায় বসে থাকা আসামি কামারুজ্জামান ট্রাইব্যুনালের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তার কোনো সিনিয়র আইনজীবী নেই উল্লেখ করে যুক্তিতর্ক মুলতবির অনুরোধ জানান। ট্রাইব্যুনাল বলেন, ‘‘অসুবিধা নেই। আপনার আইনজীবীদের জুনিয়র নোট নিচ্ছেন।’’

তবে বিকাল তিনটায় কামারুজ্জামান দাঁড়িয়ে আবার একই আবেদন জানালে ৩১ মার্চ রোববার পর্যন্ত এ মামলার যুক্তিতর্ক উপস্থাপন মুলতবি করেন ট্রাইব্যুনাল। একই সঙ্গে পরবর্তি যে কোনো হরতালেও তার সিনিয়র আইনজীবীদেরকে ট্রাইব্যুনালে আসতে অনুরোধ করার জন্য কামারুজ্জামানকে বলেন।

অভিযোগে বর্ণিত মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফাকে ধরে নিয়ে যাওয়া ও মেরে ফেলার বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের দুই সাক্ষীর দেওয়া সাক্ষ্যের মধ্যে মিল না পাওয়ায় ট্রাইব্যুনাল প্রশ্ন করলে সাইফুল বলেন, ‘‘অনেকদিন আগের ঘটনা। কামারুজ্জামান সে সময় উপস্থিত ছিলেন কিনা এটাই মুখ্য, ধরার উপায় বা সময় নয়।’’

পাঁচ নম্বর অভিযোগ প্রমাণের সময় সাইফুল ইসলাম রাষ্ট্রপক্ষের সাত নম্বর সাক্ষী লিয়াকত আলীকে ‘পক্ষপাতদুষ্ট’ বলে অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, ‘‘সাক্ষী ভয় পেয়ে ট্রাইব্যুনালে কামারুজ্জামানকে চিহ্নিত করেননি।’’

এ সময় ট্রাইব্যুনাল আপত্তি জানিয়ে বলেন, ‘‘সেটা ট্রাইব্যুনাল শুনবেন না। আপনি এর আগে আপনার এ সাক্ষীকে বৈরি ঘোষণা করেননি কেন? এসব আর্গুমেন্ট গ্রহণ করলে একজন আসামিকে একবার না, এক হাজার বার ফাঁসি দিতে হবে।’’

একই অভিযোগের ক্ষেত্রে দুইজন সাক্ষীর দেওয়া সাক্ষ্যে ঘটনার দুই রকম তারিখ বলা হয়। সাক্ষী লিয়াকত আলী অভিযোগে বর্ণিত ঘটনার তারিখ উল্লেখ করলেও আসামি সনাক্তের সময় ‘সেই কামারুজ্জামান’কে চিহ্নিত না করায় তার বক্তব্যে রিলাই করতে পারেননি ট্রাইব্যুনাল। একই ভাবে আরেকজন সাক্ষী মুজিবুর রহমান পানুর বক্তব্যে এ অভিযোগের সঙ্গে আসামির সম্পৃক্ততা খানিকটা বোঝা গেলেও অভিযোগে বর্ণিত ঘটনার তারিখের সঙ্গে তার বর্ণিত তারিখ মেলেনি। ফলে এ সাক্ষীর ক্ষেত্রেও একই পথ বেছে নিতে হয় ট্রাইব্যুনালকে।

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘একজনকে বিশ্বাস করলে অন্যজনকে করা যায় না। সুতরাং কাটাকুটি।’’

কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে গঠিত ছয় নম্বর অভিযোগ(টুনু সহ ৫ জন হত্যা) প্রমাণের সময় একজন সাক্ষীর(হামিদুল হক) সাক্ষ্য তুলে ধরেন প্রসিকিউটর সাইফুল। তবে একই ভাবে অভিযোগে বর্ণিত ঘটনার তারিখ এবং সাক্ষীর বক্তব্য অনুযায়ী ঘটনার তারিখের মধ্যে মিল পাননি ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান আবারও বলেন, ‘‘এটা রিলাই করার মতো না।’’

তবে এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে প্রসিকিউটর সাইফুলের পর প্রসিকিউশন টিমের আরো অনেকে বক্তব্য রাখবেন বলে তারা টাইব্যুনালকে জানান।

এছাড়া কয়েকটি অভিযোগের ক্ষেত্রে সাইফুল ইসলাম ট্রাইব্যুনালকে বলেন, ‘‘আসামি কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে হত্যা, গণহত্যা, নির্যাতন, দেশত্যাগে বাধ্য করাসহ বেশ কয়েকটি মানবতাবিরোধী অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমানিত।’’

এদিকে, সাইফুল ইসলামের বক্তব্য শেষ হলে দুই মিনিটি সময় চেয়ে বক্তব্য রাখেন প্রসিকিউটর নুরজাহান বেগম মুক্তা। তিনি বলেন, ‘‘কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের যেসকল সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন তাদেরকে জেরা করার সময়ে আসামিপক্ষ প্রত্যেকটি অভিযোগ ধরে ধরে কামারুজ্জামান সেসব অপরাধ করেননি বলে কোনো সাজেশন (মতামত) দেননি। এটাই প্রমাণ করে যে, তিনি (কামারুজ্জামান) এসব অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।’

এ সময় ট্রাইব্যুনাল তাকে বলেন, ‘‘আসামিপক্ষ জেরা নাও করতে পারেন। সেক্ষেত্রে সাজেশন দেওয়াটা জরুরি নয়। তাছাড়া অনেক ক্ষেত্রেই তারা সাজেশন একবারেই দিয়েছেন।’’

‘‘প্রসিকিউশনের দায়িত্বই হল, আসামির বিরুদ্ধে তাদের আনা সকল অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করা’’- প্রসিকিউটর মুক্তার উদ্দেশ্যে বলেন ট্রাইব্যুনাল।

ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান আরো বলেন, ‘‘এখানেই আপনার শেষ আর্গুমেন্ট নয়। আরো অনেক আর্গুমেন্ট করবেন। সেখানে কি বলতে হয়, দায়িত্ব কতোটুকু তা জানতে হবে।’’

এরপর মুক্তাকে বসতে অনুরোধ করেন তিনি।

তবে তিনি দাঁড়ানোর আগে বিচারপতি শাহিনুর ইসলাম বলেন, ‘‘আপনি কিছু না বললেও আপনার নাম আমরা লিখে দেবো।’

সূত্রঃ

http://www.banglanews24.com/detailsnews.php?nssl=ef149aba940706f26588cf33df2d0f9e&nttl=27032013184752

বিষয়: বিবিধ

৯৮৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File