"নিষ্পাপ প্রানের মৃত্যু"

লিখেছেন লিখেছেন সিয়াম মেহরাফ ০৫ আগস্ট, ২০১৬, ১০:১১:২৯ রাত

চারিদিকে ঝুমঝুম বর্ষা।সকাল হয়নি এখনো। সূর্য এখনো উঠেনি।উঠলেও এত তাড়াতাড়ি দেখা যাবেনা।মেঘে মেঘে ছেয়ে গেছে সব।হালকা হালকা আলো ফুটেছে চারিদিকে।একেকটা বাড়ি অনেক দূরে দূরে।বৃষ্টিতে এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়ির শব্দ শুনা যায়না।চালের উপর বৃষ্টির ঝুমঝুম আওয়াজে শব্দটা মিলিয়ে যায় কানে পৌঁছানোর আগেই।তবুও শুনা যাচ্ছে হালকা হালকা একটা কান্না মাখা সুর।এত ভোরে মসজিদের আজান ছাড়া আর চারিদিকে পাখির ডাক ছাড়া কিছুই শোনা যায়না।তবুও হঠাৎ কান্নার শব্দ ভেসে আসছে।ভেঙ্গে ভেঙ্গে সেটা কানে প্রবেশ করছে।সকাল ৮ টা হতে না হতেই রহিম মিয়ার বাড়ির সামনে ভিড় দেখা গেলো।এই গ্রাম্য অঞ্চলে গরীবের লিস্টের মধ্যে ইনিও রয়েছে।বুঝা গেল কান্নার শব্দটা এখান থেকেই আসছিল।

..

গত কয়েকটা দিন থেকেই রহিম মিয়ার ৩ মাসের মেয়েটা খুব অসুস্থ।বেশ ফুটফুটে চেহারার। রহিম মিয়া আর তার বউয়ের গায়ের কালো রংকে হার মানিয়ে যেন একটা পরীর মত ফর্সা মেয়ে হয়েছে তাদের।মেয়েটার চেহারা বেশ মায়াবী।রহিম মিয়া এই গ্রামের বাইরে ভ্যান চালায়।সেখান থেকে যা আসে তাই দিয়ে সংসার চলে তাদের।মেয়েটাকে কিছুদিন আগে পোলিও খাওয়াতে গেলে তার অবস্থা দেখে ওখানকার ডক্টরেরা বড় হসপিটালে নেয়ার জন্য বলে।রহিম মিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরে জানতে পারে তার সাধের মেয়ের হার্টে টিউমার হয়েছে এই ৩ মাস বয়সেই।টিউমার কি তা সে ঠিক জানেনা।তবে ভয়ানক বলেই ধরে নেয়।এটা সারাতে অপারেশন করতে হবে, সেখানে দরকার পড়বে ৩০ হাজার টাকা। যে দিনে ৬০০ টাকা আয় করলে সেটাও যেন অনেক।এর বেশি আয় হয়না তার।যা আয় করে তাই দিয়ে চলে যায়।জমাতে পারেনা।

...

গ্রামের নামকরা মেম্বার আর চেয়ারম্যানের কাছে গেলেও তারা উপহাস করে সেটাকে উড়িয়ে দেয়।অবশেষে টাকাটা আর যোগাড় হয়না।মেম্বার, চেয়ারম্যানেরা অনেককে অনেক টাকা ধার দেয়।কিন্তু দেয় চড়া সুদে।সবচেয়ে বেশি দেয় দোকানদারদের যাতে তারা ইন্টারেস্টগুলো পায়।এসব তার মাথায় আসেনা।একটাই চিন্তা কেবল।মেয়েটাকে সুস্থ করবে।দিন রাত খাটছে। কিছু কিছু জমাচ্ছে।মেয়েটাও দিন দিন অসুস্থ হয়ে পড়ছে আরো।এই বয়সে কেউ টিউমার নিয়ে চলতে পারেনা।মেয়েটা তবুও সহ্য করে যাচ্ছে সব।বলার মত ক্ষমতাও এখন তার হয়নি।রহিম মিয়ার স্ত্রীর নাম কামিনী।রহিম আর কামিনী এই দুটো নামের সাথে তাল মিলিয়ে তারা দুজন মেয়েটার নাম দিয়েছে রিনা।রহিমের "র" আর কামিনীর "ন" এই দুটো শব্দ দিয়ে রিনা নাম রেখেছে ভালবেসে।

...

তাদের চারপাশে কেউ নেই সাহায্যের মত।মেয়ের অপারেশনের টাকা জমাতে লোকের দুয়ারে দুয়ারে গেলেও টাকা সবটা জমাতে পারছেনা।বাবা হয়েও সে কিছু করতে পারছেনা তার মেয়ের জন্য ব্যাপারটা তাকে বেশ অপরাধী বানাচ্ছে নিজের কাছেই।অবশেষে শহরের এক নামীদামী লোকের কাছ থেকে টাকা ধার আনতে গেলো।সেও সুদ নিবে।তবে কম।আগে মেয়ের চিকিৎসা করতে পারলে সব সে শোধ করে দিতে পারবে।রহিম মিয়া বৃষ্টিভেজা রাতে টাকাগুলো লুঙ্গির ভাঁজে নিয়ে ভ্যান চালিয়ে বাসায় ফিরছে। কালকেই তার মেয়েকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাবে।খুব ভাল লাগছে তার। তার মেয়ে আবারো সুস্থ হয়ে উঠবে এটা ভেবেই।

...

গ্রাম থেকে শহর অনেক দূরে।ফিরতে ফিরতে আজানের সময় হয়ে গেছে।বাসায় ফিরে দরজাটা ঠাকাচ্ছে।বউ এসে দরজা খুলে দিয়েই রহিম মিয়ার বুকে পড়ে কান্না শুরো করলো।ভিজে চুপচুপ হয়ে আছে রহিম মিয়া।বউয়ের কান্না দেখে আকাশ ভেঙ্গে পড়লো তার মাথায়! বউকে জিজ্ঞেস করলো -

-কি হইছে কইবা তো? কানতাছো ক্যা?

-আমাগো মাইয়া লাড়াচাড়া করতাছে না।শ্বাস ও করেনা।কি করতাম?

-কি কও তুমি? আমি ওর অপারেশন করামু দেইখা টাকা নিয়া আইসি।

.....

অবশেষে দৌডে মেয়ের কাছে গিয়ে দেখলো আসলেই সে শ্বাস করছেনা।দুজনেই অচেতন অবস্থায় কাঁদছে।গ্রামের মানুষেরা কান্নার শব্দ শুনে এসে গেছে আর ডাক্তার নিয়ে এসেছে।ডাক্তার এসে নিষ্ঠুরভাবে বলে দিল মেয়েটা আর নেই।মারা গেছে।রহিম মিয়া আর তার স্ত্রী অচেতন হয়ে কাঁদতেই রইলো।একটা জীবন এভাবেই শেষ হয়ে গেল..!!! নিজেকে ক্ষমা করতে পারছেনা রহিম।সে নিজেই টাকা জোগাড় করে তার মেয়ের চিকিৎসা করাতে পারলো না।মেয়ের মুখে বাবা ডাকটা শুনার আগেই চিরতরে না ফেরার দেশে চলে গেলো তার ছোট্ট তিনমাসের মেয়েটা। "রিনা,রিনা, কই মা তুই..!!" এগুলো বলে এখনো জোরে জোরে চিৎকার ভেসে আসে দুজন বাবা মায়ের।মাঝে মাঝেই সেই কান্নার শব্দের শ্রোতা হয় ঘরের বাইরের কুকুরগুলো।তারাও ঘেউ ঘেউ করে কাঁদতে বারন করে।তবুও বাবা মায়ের মন শোনেনা।তারা কেঁদেই যায়।কাঁদতেই থাকে..!!কেউ আসেনা কান্না থামাতে।মেয়েটার কান্নার শব্দও আর শুনেনা।হাহাকার করে কেবল মেয়েটার মুখের সেই কান্না আবার শুনবে বলে!!কিন্তু কান্না আর শুনা যায়না।অন্য ঘড় থেকেও কেউ ছুটে এসে বলেনা,"থামেন ভাই।দুয়া করেন মাইয়াডার লেইগা"...!! তারা কাঁদে আর মেয়ের জন্য দুয়া করে।এভাবেই চলে দিনগুলো।"রিনা মা তুই ভাল থাহিস,আল্লাহ আমার মাইয়াডারে তুমি ভাল রাইখো"..!!! এগুলো বলে বলে চোখের পানি ফেলতে থাকে দিন রাত..!!!

....

....

"নিষ্পাপ প্রানের মৃত্যু"

- সিয়াম মেহরাফ

বিষয়: বিবিধ

১০৭১ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

375929
০৫ আগস্ট ২০১৬ রাত ১১:৪৬
তোমার হৃদয় জুড়ে আমি লিখেছেন : খুব ভালো লাগলো পড়ে। ধন্যবাদ আপনাকে

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File