হেফাজতে ইসলাম বনাম আমার স্মৃতিচারণ!
লিখেছেন লিখেছেন সন্ধাতারা ০৮ অক্টোবর, ২০১৮, ১১:০৩:৫২ রাত
লিখার প্রারম্ভে একটি বিষয় সুস্পষ্ট করে বলতে চাই, তা হল আমি একজন সাধারণ আম জনতা এবং কোন রাজনৈতিক দলের ছায়াতলে আশ্রিত বা সমর্থিত নই। হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা শাহ্ আহমেদ শফির একটি বক্তব্যকে ঘিরে অতি সম্প্রতি যে আলোচনা, সমালোচনা ও পর্যালোচনামূলক ব্যাখ্যা তুঙ্গে উঠেছে তারই প্রেক্ষিতে আমার ব্যক্তিগত কিছু অভিমত, অনুভূতি এবং স্মৃতিচারণ এখানে পেশ করার দুঃসাহস করছি। আমার লিখার উদ্দেশ্য কাউকে কটাক্ষ বা আঘাত করার জন্য নয় বরং সত্য উপলব্ধিকে হৃদয়ঙ্গম করা।
বিশ্বজুড়ে ৫ই মে ২০১৩ সালে সংঘটিত মতিঝিলের হৃদয়বিদারক কাহিনী সকলের কাছেই ছিল একটি অনাকাঙ্ক্ষিত অবিশ্বাস্য ঘটনার মত। ইতিহাসের পাতায় যা আজও জীবন্ত হয়ে আছে সেই অস্থির মুহূর্তগুলোর অসহায় করুণ আর্তনাদের রক্তাক্ত ছবি। ধর্মীয় লেবাসে নিথর হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লাশের চিত্র। সৃষ্টি হয় সেদিন নিজের দেশে ভাইয়ের হাতে ভাইদের নির্মম নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞের লোমহর্ষক কাহিনী। পরিকল্পিতভাবে আলোহীন করে অন্ধকারে জঘন্য নারকীয় কায়দায় এরূপ দানবীয় ঘটনা স্বাধীন বাংলাদেশের বুকে ইতিপূর্বে ঘটেছে কিনা আমার জানা নেই।
মতিঝিল চত্ত্বরের লাশগুলো আজও আহাজারি করে গগনবিদারী কান্নায়। শহীদি রক্তের সাথে কোনপ্রকার উপহাস অপমান কেউ মেনে নিলেও আমরা সাধারণ মানুষ তা কোনদিন মেনে নিতে পারব না। সেদিনের কালো রাত্রির নারকীয় ঘটনায় ঘরে না ফিরা কিছু পরিবারের সদস্যদের ভীতিকর পরিস্থিতি এখনও আমাকে ভীষণভাবে নাড়িয়ে দেয়। কাঁপিয়ে তোলে। আমার ছোট বোনের ব্যথিত ক্রন্দিত কণ্ঠ শুনে সেদিন আমিও দিশেহারা হয়ে যাই। খোঁজ নিয়ে ঘরে ঘরে সেসময় কিছু সন্ত্রাসী হুমকি দিয়ে বলেছিল, তারা যদি তাদের পরিবারের সদস্যদের না ফেরার কথা কাউকে জানায় তাহলে তাদেরকেও গুম করা হবে। ভীতিকর এই অসহনীয় অবস্থায় একই পরিবারের একাধিক সদস্য নিখোঁজ হওয়ার ঘটনার শোক তাদেরকে মনের মধ্যেই সেদিন সমাধিস্থ করে ছটফট করতে হয়েছিল।
বিবেকের যন্ত্রণায় সেদিন আমার বোনকে যৎসামান্য অর্থ যোগান দিয়েছিলাম শুধুমাত্র মজলুমদের সাথে সমব্যথী হওয়ার জন্য। এখানে বিষয়টি উল্লেখ করার উদ্দেশ্য এই নয় যে, নিজের দানকে অন্যের কাছে জাহির করা। আল্লাহ্ ভালো জানেন। বরং উল্লেখ করার কারণ হল সেদিন সর্বস্তরের মানুষ এমনকি একজন দিনমজুরও ক্ষুধার্ত পিপাসার্ত মানুষকে সাহায্য সহযোগিতা করার জন্য সাধ্যমত চেষ্টা করতে এগিয়ে এসেছিলেন তাদের মানবিক বিবেকবোধ থেকে। তাইতো বলতে ইচ্ছে করে স্বার্থপূর্ণ মোটা অঙ্কের কাছে ছোট ছোট হৃদ্যতাপূর্ণ দানগুলো কত দ্রুত দ্রবীভূত হয়ে যাচ্ছে। যদিও সেদিন আশায় বুক বেঁধে ছিলাম নিশ্চয়ই একদিন এই যন্ত্রণাবিদ্ধ পরিবারগুলো তাদের নুন্যতম সান্ত্বনাটুকু খুঁজে পাবেন ন্যায় বিচারের মাধ্যমে।
অথচ যারা বুকের ধন হারিয়ে আজও আশা নিরাশায় প্রহর গুনছেন নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন তাদের সাথে শ্রদ্ধেয় শফী সাহেবের এ কেমন বিচার? মর্মান্তিক শহীদি মৃত্যুর পরেও ব্যঙ্গ বিদ্রূপাত্মক আর গর্হিত গঞ্জনা থেকে যাঁরা রেহাই পাননি তাঁদেরকে তিনি কি জবাব দিবেন? শব দেহগুলো রঙ মেখে শুয়ে ছিল বলে উপহাস করা হয়েছিল! আপনার নিজের একাধিক সন্তানকে যদি একই ময়দানে এরূপ নির্মম নির্দয়ভাবে কেউ হত্যা করতো তাহলে আপনি কি সেই হত্যাকারীকে এভাবে গদগদ হয়ে প্রশংসা করতে পারতেন? পার্থিব তুচ্ছ স্বার্থের মোহে? মোটা অঙ্কের টাকা আর সনদের বিনিময়ে? দুর্দশাগ্রস্ত জাতির এ এক চরম দুর্ভাগ্যই বটে!
একদা এক আরব কবি ভিক্ষুকদেরকে অভিসম্পাতের সুরে খেদোক্তি করে বলেছিলেন- ভিক্ষুকদের আল্লাহ্ সর্বনাশ করুণ, যার চিন্তা ও দুশ্চিন্তা হল এক টুকরো রুটি আর একখণ্ড কাপড়। তাইতো আজ সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে সাংবাদিক থেকে বুদ্ধিজীবী, লেখক থেকে রাজনীতিবিদ, দার্শনিক থেকে ধর্মবিদ, বিচারপতি ও পুঁজিপতি সকলেরই একই চিন্তা ক্ষমতার মসনদ, প্রাপ্তি সোনা চাঁদি, মোটা অঙ্কের উপহার, রুটি আর কাপড়। শুধুমাত্র প্রাপ্তিতে ব্যাপ্তিতে, আকারে প্রকারে ও অলংকারে কিছু ভিন্নতা এই আর কি! যদিও প্রতিটি অযৌক্তিক অযাচিত কর্মের পেছনে থাকে কিছু চাটুকারি কৌশল আর যুক্তি! পারস্পারিক আদান প্রদান, জাগতিক স্বার্থ ও বস্তুগত লাভ যেখানে মুখ্য সেখানে চারিত্রিক দৃঢ়তা, পারস্পারিক বিশ্বস্ততা এবং ধর্মীয় গুণ সম্পন্ন যোগ্যতার প্রশ্ন সত্যিই অবান্তর।
অথচ ইতিহাসে বহু ঘটনা আছে যেখানে কঠিন ঝড়ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ মুহূর্তেও দ্বীনের ধারক বাহক ও রক্ষকগণ আলোর মিনার হয়ে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। অবিচলিত ছিলেন। কঠিন প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও ভোগবাদীতা ও বস্তুবাদিতাকে ছুঁড়ে ফেলে ঈমান ও বিশ্বাসের ভীতটুকুকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরেছিলেন। ধর্মপ্রেম ও আল্লাহ্মুখিতা তাঁদেরকে চুম্বকের আকর্ষণের মত টেনে রাখতো। সাহস মনোবল, উদ্যম কর্মশক্তি, জড় জীবনের ভোগ তাঁদের ঈমানকে কলুষিত বা প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারেনি।
বিবেকবান মানুষের কাছে দ্বীন ধর্ম ইজ্জত আব্রুর মতই মূল্যবান কোন মূল্যেই তা বিক্রীত হয়না। ভয় ভীতি, মৃত্যু, লোভ প্রলোভন কোন কিছুই তাঁদেরকে বিবেক বর্জিত করতে পারেনা। এমনকি কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে অনেকেই হাসিমুখে মৃত্যুবরণ করেছেন কিন্তু বিবেককে বিক্রি করেননি। একটি মিথ্যা বলাকে পছন্দ না করে ফাঁসির দড়ি গলে পড়েছেন।
এখানে তেমনি একজনের কাহিনী বিবৃত হল- ৫৭-এর বিদ্রোহে অংশ গ্রহণের অভিযোগে একদিন শায়খ রাযীউল্লাহ্ বাদায়ুনীকে বন্দী করে বিচারের কাঠগড়ায় উপস্থিত করা হল। কিন্তু সেই আদালতের বিচারক ছিলেন শায়খ রাযীউল্লাহ্ বাদায়ুনীর ছাত্র। বিচার কার্যের আগে বিচারক এক বন্ধু মারফত তাঁকে ইঙ্গিত দিলেন যে, তিনি যেন তাঁর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করেন। যার উপর ভিত্তি করে তিনি ফাঁসির দণ্ড থেকে মুক্তি পেতে পারেন। কিন্তু তিনি সেটা প্রত্যাখ্যান করে বললেন, যা সত্য তা আমি কীভাবে অস্বীকার করবো। ফলে ইংরেজ বিচারক সহানুভূতিশীল হলেও ফাঁসির আদেশ ঘোষণা করতে বাধ্য হলেন।
ফাঁসি কার্যকর করার পূর্ব মুহূর্তেও তাঁকে শেষবারের জন্য অনুরোধ করা হয় যাতে ফাঁসি কার্যকর করা রহিত হতে পারে। প্রতিত্তুরে শায়খ রাযীউল্লাহ্ বাদায়ুনী অসন্তুষ্ট হয়ে বললেন- তোমার কি ইচ্ছা যে একটি মিথ্যা দিয়ে আমি আমার সারা জীবনের অর্জন ধ্বংস করে ফেলি। নিজেই নিজের সর্বনাশ ডেকে আনি। এটাই সত্যি যে আমি বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেছিলাম। তুমি দ্বিধাহীনভাবে তোমার প্রতি আরোপিত দায়িত্ব সম্পাদন করতে পারো।
এরপর ফাঁসিকাষ্ঠে মৃত্যুবরণ করে তিনি ধর্মীয় মূল্যবোধের গৌরবোজ্জ্বল নজীর পেশ করে ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে রইলেন। ঈমান ধর্ম আর সত্যের প্রতি এই পরম নিষ্ঠা এবং অবিচলিত বিশ্বাস আজো মুসলিম উম্মাহর মনের মুকুরে সম্মানের মুকুট হয়ে দ্যুতি ছড়াচ্ছে।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ্ বলেন- তোমরা সুবিচার করো, সেটাই হল তাকওয়ার নিকটবর্তী, আর তোমরা আল্লাহ্কে ভয় করো। আর যখন কোন কথা বলবে তখন ইনসাফ রক্ষা করবে। যদিও তা আত্মীয়ের বিপক্ষে যায়।
পরিশেষে জানতে ইচ্ছে করে- যারা স্বজন হারিয়েছেন, চিরকালের জন্য বিকলাঙ্গ হয়েছেন, অবর্ণনীয় অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করেছেন, জেল জুলুমের স্বীকার হয়েছেন তাঁদের প্রতি আদৌ কি ইনসাফ রক্ষা করা হয়েছে?
বিষয়: বিবিধ
১১২৬ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন