মাদানী শাইখের চোখে তাওয়াত-তাবলিগ ও বিশ্ব ইজতিমা

লিখেছেন লিখেছেন ভিনদেশী ২৬ জানুয়ারি, ২০১৪, ০৩:২০:১১ রাত

১৩৯৯ হিজরীর কথা। বিশ্ব ইজতিমা ঘনিয়ে এসেছে। দুনিয়ার মুসলমানদের দৃষ্টি ঢাকার দিকে। ঢাকা এয়ারপোর্টে ঘনঘন বিমান অবতরণ করছে। আসছে দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ব্যকুল হৃদয়ের মুমিনরা। উদ্দেশ্য তাদের একটাই ইজতিমায় অংশ গ্রহন করে জীবনের কিছু অমূল্য পাথেয় সংগ্রহ করা। সময় যতই ঘনিয়ে আসছে ততই বেড়ে যাচ্ছে মানুষের ভিড়। ঢাকা এখন পরিনত হয়েছে মানব সমুদ্রে। চারিদিকে মানুষ আর মানুষ।

আজ ১০॥২॥১৩৯৯ হিজরী। রোজ সোমবার। ভোরের অন্ধকার ভেদ করে পাকিস্তান এয়ার লাইন্সের আজকের ফ্লাইটটি পবিত্র মদিনা এয়ার পোর্ট থেকে উড়াল দেয় জেদ্দা অভিমুখে। ফ্লাইটে বিভিন্ন গন্তব্যের যাত্রীরা রয়েছে। তাদের মাঝে দু’জনের গন্তব্য পাকিস্তানের করাচি শহর। তাদের একজন শাইখ ড. মুহাম্মদ আমান জামী,মদীনা ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের হাদীস বিভাগের প্রধান। অন্যজন প্রখ্যাত মুহাদ্দিস শাইখ আব্দুল করীম মুরাদ,মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক এস্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক। সকাল সাড়ে ছয়টায় বিমান জেদ্দা এয়ার পোর্টে অবতরন করে।

অন্যান্যদের সাথে দুই শাইখও বিমান থেকে নামলেন। তাদের গন্তব্য করাচি। কর্তব্যরত অফিসারের সাথে কথা বলে জানা যায় যান্ত্রিক গোলযোগের কারনে বিমান অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য যাত্রা বিরতি করেছে! দুই শাইখের চোখে-মুখে গম্ভীর ভাব। তারা অপেক্ষা কক্ষে গিয়ে বসলেন।

যোহরের সময় হয়ে গেছে। এয়ার পোর্ট মসজিদে তারা নামাজ আদায় করে নিলেন। নামাযের পর কতৃপক্ষের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা করা খাবার গ্রহন করলেন। আবার শুরু হলো না জানা সময়ের জন্য অপেক্ষার প্রহর গুণা। দিন পেরিয়ে রাত এসে গেল। বিমানের কোন হদিস নেই! ইশার নামাযের পর বিমানের নতুন সময় ঘোষণা করা হল।

রাত এগারটার পর বিমান গন্তব্য উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। মধ্যরাতের পর করাচি এয়ার পোর্টে বিমান লেন্ড করে। হোটেলে পৌঁছে ফজরের নামায আদায় পূর্বক বিশ্রাম নিলেন। তাদের গন্তব্য এবার কাঙ্কিত ঢাকা অভিমূখে। ছোট একটি সমস্যা দেখা দিল। বিমান অফিসে যোগাযোগ করে জানা গেল জুমাবারের পূর্বে ঢাকার কোন ফ্লাইট নেই! এদিকে হাতে সময়ও কম। অন্যান্য ফ্লাইটের অফিসে যোগাযোগ করেও কোন সমাধান পাওয়া গেল না। শেষে সিদ্ধান্ত হল জুমাবার সফর হবে।

আসরের পর বিমান ঢাকা উদ্দেশ্যে করাচি এয়ার পোর্ট ত্যাগ করল। প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টা পর ঢাকা এয়ার পোর্টে বিমান অবতরণ করে। এবার তল্লাশির পালা! গুরতর তল্লাশি চলছে!! একে একে যাত্রিদের লাগেজ তল্লাশি করা হচ্ছে। ভয়াবহ এক পরিবেশ! যখন দুই শাইখের পালা আসল কর্তব্যরত অফিসার শুধু চেকার গুরিয়ে তাদের ছেড়ে দিলেন! পরে জানা গেল ইজতিমায় অংশগ্রহনকারীদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে ছিল। আল্লাহ তা’য়ালার অশেষ শুকর যে কাজগুলো সহজে সামধান হয়ে গেল।

প্যাসেন্জার লাউঞ্চ ত্যাগ করেই টারমাকে কয়েক সুদানি ও পাকিস্তানি ভদ্রলোককে দেখা গেল। তারা এসেছে শাইখদের অভ্যর্থনা জানাতে। তারা দুই শাইখ ও ইজতিমায় অংশগ্রহনকারী অন্যান্য অতীথিদের নিকঠতম এক মসজিদে নিয়ে গেলেন। বিশ্রামের পর ইজতিমায় তাদের থাকার স্থান নির্ধারণ পূর্বক নিদ্রিষ্ট স্থানে তাদের নিয়ে যাওয়া হয়।



ফজরের নামাযের সময় হয়ে গেছে। তাই তারা দ্রুত নামাযের প্রস্তুতি নিলেন। একটু পর নামায শুরু হয়ে গেল। কিন্তু কোথাও কোন লাউডস্পিকারের ব্যবস্থা নেই। একটু পরপর মুকাব্বিরের ব্যবস্থা আছে। তাকবিরাতের সময় সবাই সমস্বরে আওয়াজ দেয় আর অন্যরা তাদের অনুসরণ করে! এ এক অপরূপ দৃশ্য! শাইখ মুহাম্মদের মনে বিষয়টি দাগ কাটে তিনি বলেন- ‘পরবর্তি সময়ে আমি দেখেছি,বয়ান ইত্যাদির সময় মাইক ব্যবহার করা হয় কিন্তু নামাযের সময় কেন এ ব্যবস্থা আমার বুঝে আসেনি। তবে মুকাব্বিরের বন্টন ও তাবু টানার দৃশ্যটি দেখার মত ছিল! যেন সময়ের ব্যবধান ভেদ করে আমরা ফিরে গেলাম ইসলামের প্রথম যুগে!’।

নামাযের পর মুসল্লিরা বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে সূর্যোদয় পযন্ত কোরআন মজীদের ছোট-ছোট সূরাগুলোর মুজাকারা করে। অতঃপর নাস্তা শেষে বয়ান শুরু হয়। আরবদের উদ্দেশ্যে শাইখ মুহাম্মদ উমর আরবিতে গুরুত্বপূর্ণ বয়ান রাখেন। তার বয়ানে দাওয়াত ও তাবলিগের বর্তমান বিশ্বব্যাপি হাল হাক্বিকত। জামাতে বের হওয়ার মূল উদ্দেশ্য। তার বয়ানের সারসংক্ষেপ ছিল;দা’য়ী ও মাদউ’ উভয়ের জন্য স্থান পরিবর্তণ করা আবশ্যক। কারণ,দ্বীনের রাস্তায় যারা বের হয় তাদের অধিকাংশই সাধারণ মুসলান,যাদের দ্বীন সম্পর্কে খুব বেশী একটা ধারণা নেই। এসব লোকদের আল্লাহ রাস্তায় বের করার উদ্দেশ্য হলো পরিবেশ ও স্থান পরিবর্তণের মাধ্যমে তাদের অন্তরে দ্বীন ও আমলের মুহাব্বত ফয়দা করা। কারণ, অভিজ্ঞতার ভিত্ত্বিতে দেখা যায়,সাধারণ মানুষের জীবনে দ্বীনি পরিবর্তণ ততক্ষণ পযন্ত আসে না যতক্ষণ তারা দুনিয়া ও দুনিয়ার মাশগালাকে পেছনে পেলে সৎ পরিবেশে দ্বীনের মেহনত না করে। মাওলানার বয়ানে ছিল তাবলীগ জামাত সম্পর্কে শাইখ মুহাম্মদের অন্তরে থাকা বহু প্রশ্নের উত্তর।

পরামর্শ অনুযায়ী যোহরের পর মূল পেন্ডেলে ডক্টর শাইখ মুহাম্মদ জামীর বয়ানের ফায়সালা হয়। তিনি মানব জীবনে তাওহীদের গুরুত্বসহ বিভিন্ন বিষয়ে বয়ান রাখেন। যা অংশগ্রহনকারীদের বোঝার কল্যাণে বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করা হয়। পরদিন যোহরের পর শাইখ আব্দুল করীম মুরাদ ‘ইবাদতে তাওহীদের গুরুত্ব,আওলিয়াদের সম্মানে বাড়াবাড়ির পরিনতি ও কবরপূজা বিষয়ে’ বয়ান করেন। অন্যান্য বয়ানগুলোর বেশি ভাগ উর্দূ ভাষায় করা হয় যা আরবিসহ অন্যান্য ভাষায় অনুবাদ করা হয়।

এভাবে এক অভূতপূর্ব পরিবেশে মঙ্গলবার পযন্ত ইজতিমা চলতে থাকে। শেষ দিন দা’য়ীদের প্রতি গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনাসহ বহু প্রয়োজনিয় বিষয়ে আলোচনা হয়। যার সারসংক্ষেপ হযরত শাইখ মুহাম্মদের ভাষায়- ‘হাসি-কান্নার এক অপূর্ব পরিবেশে ইজতিমা চলতে থাকে। যা দেখে আল্লাহর পথে তাদের ভালবাসা,একনিষ্টতা ও উৎসর্গতা অনুমেয় হয়। যা ছিল তাদের ব্যপারে অজ্ঞ বা অজ্ঞতার ভানকারীদের বক্তবের সম্পূর্ণ বিপরিত একটি চিত্র। এ ক্ষেত্রে যা বিষেশভাবে লক্ষণীয় তা হলো। তাদের (তাওয়াত ও তাবলিগের সাথে সম্পৃক্তদের) মাঝে আল্লাহর রাস্তায় দাওয়াতের ক্ষেত্রে যে বিশেষ গুণটি পরিলক্ষিত হয় তা সাধারণত অন্যদের মাঝে দেখা যায় না। আর তা হলে,মানুষের কাছে দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছানোর ব্যপারে তাদের অসম ধৈর্য ও ভালবাসা। যা মূলত মায়ের ভালবাসার কথা স্বরণ করিয়ে দেয়। ফলে আল্লাহ তা’য়ালায় রহমতে তাদের একনিষ্ট চেষ্টায় বিভিন্ন দেশের হাজারো দ্বীনহারা মানব হিদায়তের সন্ধান পেয়েছে। যাদের প্রথম সারিতে রয়েছে আমাদের নব প্রজন্মের ঐসব যুবকরা যাদেরকে শিক্ষার নামে দ্বীন ও দাওয়াতহীন আমরা ইউরোপ-আমেরিকায় পাঠিয়েছি। আধুনিক সভ্যতার ধোঁকায় পড়ে তারা যখন দ্বীন হারানো পথে তখন আল্লাহ তা’য়ালা তাবলিগ জামাতের মাধ্যমে তাদের হিদায়াতের ব্যবস্থা করেছেন’।

১৮ সফর ১৩৯৯ হিজরী মঙ্গলবার আখেরি মুনাজাতের মাধ্যমে বিশ্ব ইজতিমা শেষ হয়। শাইখ মুহাম্মদ জামী ও শাইখ আব্দুল কারীম মুরাদ পাকিস্তান হয়ে দেশে পিরেন। সাথে নিয়ে আসেন তাবলিগ জামাতের ব্যপারে এক সম্পূর্ণ নতুন চিত্র। যাতে রয়েছে নববী দাওয়াতের উত্তম দিক্ষা। দেশে পিরে শাইখ জামী সৌদি আরবের ততকালিন প্রধান আলিম ও মুফতি শাইখ আবদুল্লাহ বিন বাযসহ বহু আলিম-ওলামাদের কাছে চিঠি-পত্রের মাধ্যমে তাবলিগ জামাতের ব্যপারে নিম্নরূপ মত প্রকাশ করেন:

‘বিশ্বব্যাপি তাওয়াত ও তাবলীগের কাজে নিয়োজিত এ জামাতের আনুষ্ঠানিক কোন নাম নেই। যদিও তাদের তৎপরতার উপর ভিত্তি করে সাধারণ মানুষ তাকে জামাতুত তাবলীগ নামে অভিহিত করে থাকে। তাওয়াতের কাজে তাদের ব্যাপক অনুশিলনের ফলে তাদের মাঝে এমন দক্ষতা ও পরিপক্ষতা তৈরি,যার ফলে কোনরূপ বিরাগ ও কৃত্রিমতা ছাড়াই তারা নিজেদের সকল কাজের সুন্দর আন্জাম দিয়ে থাকে। তারা যে বিশ্বইজতিমার আয়োজন করে থাকে যদি কোন সরকারি কতৃপক্ষ তার আয়োজন করতো তাহলে ব্যাপক খরচ ও সময়ের প্রয়োজন হতো। অতচ তারা নিজেদের উদ্দেগ্যে সামান্য খরচের মাধ্যমে এত বিশাল এক ইজতিমার সুষ্ট আয়োজন করে থাকে। তাদের প্রত্যেকেই নিজেকে ইজতিমার উদ্দেগী মনে করে এবং প্রত্যেকে যার যার কাজ সুচারু রুপে আন্জাম দিয়ে থাকে। ফলে তাদের মাঝে আল্লাহর ওয়াস্তে ভালবাসার এক উত্তম পরিবেশ সৃষ্টি হয়।

উপরোক্ত আলোচনা ভিত্তিতে আমি মনে করি আমাদের প্রত্যেককেই নিম্নে উল্লেখিত বিষয়ে মনোযোগি হওয়া উচিত:

১. কার্যতভাবে তাদের সহযোগিতা করা যেন প্রত্যেকেই একে অন্যের দ্বারা উপকৃত হতে পারে।

২. আমাদের ছাত্রদের মাঝে তাদের তৎপরতা ছড়ানো। ছাত্ররা যেন তাদের কাছ থেকে দাওয়াতের অভিজ্ঞতা ও কাজের দক্ষতা অর্জন করতে পারে।

৩. মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ছাত্র-শিক্ষরা যেন তাদের সকল কর্ম-কান্ডে ব্যাপকভাবে অংশ নেয়। আল্লাহ তা’য়ালা আমাদের সকলকে খ্যাতি ও লোকদেখানো কাজ হতে বেচে থেকে তার সস্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কাজ করার তাওফীক দান করেন। আমীন।

শাইখ মুহাম্মদের এই আহবানের ফলে সৌদি আরবসহ আরব দুনিয়ার বহু আলিম-ওলামা তাবলিগ জামাতের সাথে সম্পৃক্ত হয়।

(১৩৯৯ হিজরীর ইজতিমা শেষে শাইখ জামীর তৈরিকৃত প্রতিবেদন অবলম্ভনে)

বিষয়: বিবিধ

১৫৫১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File