ডিজিটাল কৃতদাস

লিখেছেন লিখেছেন এলিট ০২ নভেম্বর, ২০১৬, ০৬:৩৩:২৯ সকাল



সৃস্টির শুরু থেকেই বিনিময় পদ্ধতি চালু আছে। একজন মানুষ কখনোই স্বয়ং সম্পুর্ন নয়। কোন কিছুর জন্য তাকে অবশ্যই অন্যের স্মরনাপন্ন হতে হয়। আর এখানেই আসে বিনিময়। যার যেটা লাগে, সে সেটা নেয়। এর বিনিময়ে যে জিনিসটা তার কাছে বেশী আছে, বা কম প্রয়োজনীয়, সেটা তাকে দেয়। এমন বিনিময় করতে করতে একদিন হয়ত মানুষ বুঝতে পারল, কিসের বিনিময় কি নিলে বা দিলে বিনিময়তা সঠিক হয়, এর একটা মাপকাঠি থাকা দরকার। এভাবেই মুদ্রা আবিস্কার হয়। প্রাথমিকভাবে মুদ্রা জিনিসটা স্বর্ন, রৌপ্য, তাম্র, বা অন্য কোন ধাতু দিয়ে বানানো হোত। এভাবে ধাতু দিয়ে বানানোর দুটি কারন আছে। এক, মুদ্রাটি দীর্ঘদিন টিকে থাকে। দুই, ওই মুদ্রাটির মুল্য ওই ধাতুর মুল্যের সমান। কালের বিবর্তনে, মুদ্রা এখন কাগজের হয়। সবচেয়ে বড় কথা হল, ওই কাগজের উপরে যা লেখা থাকে সেটাই ওই মুদ্রার মুল্য। এর পরে পর্যায়ক্রমে এসেছে আধুনিক অর্থনীতি।

বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে, বিশ্বের ৯০% সম্পদ আছে মাত্র ১০% লোকের হাতে। বিশ্বে প্রথম ৮০ জন ব্যাক্তির সম্পদ দিয়েই বিশ্বের দারিদ্রতা দূর করা সম্ভব। বিশ্বের প্রথম দশজন ধনীর সম্পদ কিছু অনুন্নত দেশের সম্পদের চেয়ে বেশী। আপনাদের পরিচিত ফেসবুকের(revenue) বাৎসরিক আয় ১৭ বিলিয়ন ডলার। বিশ্বে ২০ এরও অধিক দেশ আছে যার GDP (gross domestic product) ১৭ বিলিয়ন ডলারের নীচে। অর্থাৎ, ফেসবুক কম্পানীটি ২০টি দেশের প্রত্যেকটির চেয়ে বেশি ধনী। এ তো কিছুই নয়, এর চেয়ে অনেক বড় বড় ধনী কোম্পানি আছে। গুগল এর আয় ৭৫ বিলিয়ন ডলার। এপেল, টয়োটা ইত্যাদি কোম্পানীর বাৎসরিক আয় প্রায় ২৪০ বিলিয়ন ডলার। বেশীদুর যেতে হবে না, ভারতের টাটা কোম্পানীর বাতসরিক আয় ১০০ বিলিয়ন ডলারের উপরে। অর্থাৎ, টাটা কোম্পানীটি বিশ্বের অর্ধেকের বেশী দেশের চেয়ে ধনী। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী কোম্পানী Walmart (আমেরিকার সুপার মার্কেট চেইন) গত বছরে আয় করেছিল ৪৮২ বিলিয়ন ডলার। বিশ্বে মোট দেশের সংখ্যা ২০০ এর উপরে। তার মধ্যে মাত্র ২৩টি দেশ Walmart এর চেয়ে ধনী। এ তো গেল কোম্পানীর কথা। এখন ব্যাক্তির কথায় আসি। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যাক্তির তালিকায় সবচেয়ে বেশীবার যার নাম প্রথমে আসে, তিনি হলেন Microsoft এর বিল গেটস। তার বর্তমান সম্পদের পরিমান ৭৫ বিলিয়ন ডলার। সেরা দশজন ধনীর মধ্যে, এবছর দশম হয়েছেন L'Oreal (প্রসাধনী) এর লিলিয়ান বেটেনকোর্ট। ৯৪ বছর বয়সী এই নারীর সম্পদের পরিমান ৩৬ বিলিয়ন ডলার।

এবার বিপরীত চিত্র দেখি। না, মানুষের দুঃখ দুর্দশার কথা বর্ননা করে আপনার মনটা খারাপ করে দেব না। কোন দেশে কতজন মানুষ অনাহারে অথবা বিনা চিকিৎসায় মারা যায় সেসব সমীক্ষার কথা নাইবা বললাম। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির কাছে আমেরিকা দেশটি স্বর্গরাজ্য । সেখানে কেউ না খেয়ে মারা যায় না, কেউ বিনা চিকিৎসায় থাকে না। খাদ্যের প্রাচুর্যের কারনে আমেরিকাতে মানুষ মোটা হয়ে যাচ্ছে। এটাই তাদের সমস্যা। গড়ে প্রতি ৩ জনের একটি করে গাড়ি আছে। জনগনের সংখার চেয়ে ক্রেডিট কার্ডের সংখ্যা বেশী। এবার, এই স্বর্গের আসল সমস্যাটা বলব। আমেরিকার একজন মানুষের যদি কোন ঋণ না থাকে এবং তার পকেটে যদি মাত্র ১০ ডলার থাকে তাহলে সে বাকী ৭৫% আমেরিকানের চেয়ে বেশী ধনী। এই বাকী ৭৫% গরিব (!) মানুষের অধিকাংশেরই কিন্তু গাড়ী, বাড়ী, নারী, চাকুরী সবই আছে। আর সেই সাথে আছে, মাথায় বিশাল ঋনের বোঝা। সকল উন্নত দেশেরই, প্রায় একই অবস্থা। মানুষ ঋণ করে গাড়ী, বাড়ী, আসবাব পত্র, ইলেক্ট্রনিক ইত্যাদি সব কিছু কেনে। এর পরে সারা জীবন কাজ করে সেই ঋণ পরিশোধ করতে থাকে। ৭৫% সাধারন লোক যে ঋণ করে, সেই টাকা কোথা থেকে আসে? সেই টাকাটা আসে ধনী প্রতিষ্ঠান বা ব্যাবসায়ীর কাছ থেকে। তারা মানুষকে টাকা ধার দিয়ে বিলাসিতা করাচ্ছে, সেই সাথে টাকাটা সুদে আসলে আদায় করে নিচ্ছে। অর্থাৎ সব টাকার মালিক তারাই।

গুটি কয়েক লোক এভাবে সারা দেশের তথা বিশ্বের সকল অর্থ-সম্পদের মালিক হয়ে বসে আছে। প্রধানত, যে কারনে এই জিনিসটা সম্ভব হয়েছে তা হল কাগজের মুদ্রা, ব্যাংকিং ব্যাবস্থা ও সর্বপরি সুদ এর উপরে দাঁড়িয়ে থাকা আধুনিক অর্থনীতি। সেটা কেন এবং কিভাবে ? আগেই বলেছি, যখন ধাতুর মুদ্রা ছিল, তখন ওই মুদ্রার মুল্যটি ছিল ওই ধাতুর মুল্যের সমান। কিন্তু কাগজের নোটে কিন্তু তা হয় না। ওই কাগজে যা লেখা থাকে সেটাই ওই নোটের মুল্য। ধাতুর মুদ্রাতে এমন লিখে মুল্য নির্ধারন করা যেতো না। কাগজের মুদ্রার মুল কারিগর হল, ব্যাংক। আর মুদ্রাটি হল ব্যাঙ্কের একটি সার্টিফিকেট মাত্র। টাকার উপরে লেখা থাকে “বাংলাদেশ ব্যাংক - চাহিবা মাত্র এর বাহককে ১০০ টাকা দিতে বাধ্য থাকবে”। অর্থাৎ, ওই কাগজটি একটি সার্টিফিকেট যা আপনার ১০০ টাকার মালিক হবার প্রমানপত্র। আর এই সার্টিফিকেট জমা দিলে, ব্যাংক আপনাকে ১০০ টাকা দিবে। মুল কথা এটাই দাঁড়ালো, টাকাটি (মুল সম্পদ) ব্যাঙ্কে রয়েছে, আর আপনার কাছে আছে তার সার্টিফিকেট। ধাতুর মুদ্রাতে কিন্তু বাহকের নিজের কাছেই টাকা (সম্পদ) থাকতো। এর পরে টাকার আরো উন্নতি হয়েছে। এসেছে চেক বই, ক্রেডিট কার্ড, অনলাইন ব্যাংকিং ইত্যাদি। সবই কিন্তু ঘুরে ফিরে একই জিনিস, আপনার টাকা ব্যাঙ্কের কাছে থাকে আর আপনার কাছে থাকে তার প্রমানপত্র। নিজের টাকা অন্যের কাছে থাকার সুবিধার জন্যই একজন মানুষ বিলিয়ন ডলার এর মালিক হতে পেরেছে, পারছে। নইলে ৯৪ বছরের বুড়ীর পক্ষে ৩৬ বিলিয়ন ডলার সংরক্ষণ করার কোন সাধ্যই ছিল না।

ব্যঙ্ক এর কাজই হল একজনের টাকা জমা রেখে তা অন্যজনকে সুদে ধার দেওয়া। সেই সুদের একটা অংশ টাকা জমাদানকারীকে দেওয়া। ব্যাংক এর লোন, ক্রেডিট কার্ড ইত্যাদি সবই ওই সুদে টাকা ধার দেওয়া। সুদ জিনিসটা কি? সুদ হল, ধনীকে আরো ধনী এবং গরীবকে আরো গরীব বানানোর একটা অর্থনীতি। যা টাকা ধার দেয়, সে অবশ্যই ঋণ গ্রহনকারীর চেয়ে বেশি ধনী। সেই টাকা যখন টাকা ফেরত দেওয়া হয় তখন সব সময় বেশী দেওয়া হয়। অর্থাৎ, গরীবের কাছে থেকে বেশী টাকা নিয়ে ধনীরা নিজের সম্পদ বাড়িয়ে নিচ্ছে। এই ব্যাবস্থা চলতে চলতে একসময় ধনী অসম্ভব ধনী আর গরীব খুবই গরীব হতে বাধ্য। আর সেটাই হচ্ছে আমাদের চোখের সামনে। কে কার চেয়ে কি বেশী কিনতে পারে সেই প্রতিযোগীতা চলছে। আর সেসব কিনতেই ঋনের বোঝা ভারী হচ্ছে আর ঋণ ফেরত দিতে গিয়ে ধনীকে আরো ধনী বানিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সেই সাথে, ঋণ শোধ করতে আজীবন পরিশ্রম করে যেতে হচ্ছে। প্রাচীন কালে মানুষকে জোর করে, শেকল পরিয়ে কৃতদাস বানানো হোতো। আর এখন ওসব কিছুই করতে হয় না। এমনিতেই মানুষ কৃতদাসের মতন ঋনের ঘানি টানতে থাকে।

দ্রস্টব্যঃ ইসলামের জঘন্নতম কয়েকটি পাপের মধ্য একটা হল “সুদ”। ইসলামের অর্থনীতি ঠিক সুদের বিপরীত। ধনী ব্যাক্তি তার নিজের সম্পদ থেকে প্রতি বছরে একটি নির্দিস্ট সম্পদ গরিবকে (জাকাত) দেয়। অর্থাৎ, বছরে বছরে সম্পদ কমে। তাছাড়া, ইসলামের গণ্ডির ভেতরে থাকলে কেউই বিলিয়ন ডলারে মালিক হতে পারবে না, কেউই ঋণ এর বোঝা এমন ভারী করতে পারবে না যেন আজীবন শোধ করে যেতে হয়। সর্বপরি, মানুষকে অর্থনৈতিক কৃতদাস বানানোটা বন্ধ হোত। আর, দারিদ্রতা সমস্যা তো জানালা দিয়ে পালাতো।

আমার ফেসবুক ---------- এখানে



সুত্র ১ - http://statisticstimes.com/economy/countries-by-projected-gdp.php

সুত্র ২ - https://en.wikipedia.org/wiki/The_World%27s_Billionaires

বিষয়: বিবিধ

১৫৯৪ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

379365
০২ নভেম্বর ২০১৬ সকাল ০৯:৪৩
গাজী সালাউদ্দিন লিখেছেন : আলহামদুলিল্লাহ্‌, সীমিত আয় দিয়ে কিছুটা কষ্ট করে চললেও ঋণ করে লোক দেখানো হুডামি করতে আমি রাজী নই!
আপনার লেখাটা খুবই ভালো লেগেছে।
০২ নভেম্বর ২০১৬ রাত ১১:১১
314133
এলিট লিখেছেন : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। অনেক দিন পরে এসেও আপনাদের উতসাহ ঠিকই পাচ্ছি। জীবনটা আসলে অতটা কঠিন নয়। আমরা ওই লোক দেখানো ফুটানি করতে গিয়েই জীবনটাকে কঠিন করে ফেলি।
379385
০২ নভেম্বর ২০১৬ বিকাল ০৫:৩০
সন্ধাতারা লিখেছেন : আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতাহু পরম শ্রদ্ধেয় ভাইয়া।


সুদযুক্ত ও ঋণের বোঝা থেকে মানুষ নিষ্কৃতি লাভ করুক এবং এর ভয়াবহতা সম্পর্কে সজাগ হয়ে সুদ ও ঋণমুক্ত জীবন যাপনের পথ বেঁছে নিক এটাই প্রত্যাশা রইলো।


গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে লিখার জন্য জাজাকাল্লাহু খাইর।
০২ নভেম্বর ২০১৬ রাত ১১:১৪
314134
এলিট লিখেছেন : ওয়ালাইকুম আস সালাম। অনেক দিন পরে এসেও আপনাদের উতসাহ ঠিকই পাচ্ছি। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। মানুষ সুদ ও ঋণমুক্ত জীবন যাপনের পথ বেঁছে নিক। আমিন
379392
০২ নভেম্বর ২০১৬ বিকাল ০৫:৪০
স্বপন২ লিখেছেন : ভালো লাগলো / অনেক ধন্যবাদ /
379403
০২ নভেম্বর ২০১৬ রাত ১১:১৪
এলিট লিখেছেন : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File