বিপ্লবের সংজ্ঞা পরাজিতের বেলায় ভিন্ন!

লিখেছেন লিখেছেন স্বপ্নচারী মাঝি ২৮ নভেম্বর, ২০১৬, ০৩:১৫:৫১ রাত



কিউবার সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং কমিউনিস্ট বিপ্লবের নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো বিদায় নিয়েছেন। এ নিয়ে বাংলাদেশসহ বিশ্ব মিডিয়ার ঘুম হারাম। কেউ তাকে মহান বিপ্লবী নেতা বানাতে ব্যস্ত। কেউবা ব্যস্ত স্বৈরাচার কিংবা একনায়ক প্রমাণ করতে। ঘটনা অবশ্য দুটোই সত্য। প্রথমত: তার সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু জেনে নেয়া যাক।

পুরো নাম ফিদেল ক্যাষ্ট্রো আলেকজান্দ্রো রুজ। ফিদেল ক্যাষ্ট্রো নামেই পরিচিত। কিউবার দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ওরিয়েন্তে প্রদেশে ১৯২৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন। হাভানা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে পড়ার সময় তার রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। কালের পরিক্রমায় তিনি কিউবার রাজনীতিতে একজন বিখ্যাত ব্যক্তিতে পরিণত হন। ১৯৫৯ সাল থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত কিউবার প্রধানমন্ত্রী এবং ১৯৭৬ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি কিউবার কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম সেক্রেটারী হিসেবে ১৯৬১ সাল থেকে ২০০১ পর্যন্ত দ্বায়িত্ব পালন করেন। যদিও তখন এটি কমিউনিষ্ট পার্টি নামে ছিলো না। প্রথম দিকটায় নাম ছিলো ‘জুলাই টুয়েন্টিসিক্স মুভমেন্ট’।

মিডিয়া ও বিশ্বের কাছে বিপ্লবী হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ফিদেল ক্যাষ্ট্রোর ব্যাপারে আমার ন্যূনতম কোন হিংসা কিংবা রসিকতা করার ইচ্ছা আমার নেই। একজন বিপ্লবীকে বিপ্লবী বলতে কার্পণ্য থাকবে কেন? স্বৈরশাসন চালিয়েও যদি তিনি জনগণের মন জয় করতে পারেন তাতেও আমার কোন আপত্তি নেই। কিন্তু আপত্তি মিডিয়ার সেই প্রচারণায় যেখানে পরাজিত বিপ্লবীদের সন্ত্রাসী কিংবা জঙ্গী বলে প্রচার করা হয়। একই সামরিক উর্দি ফিদেলের গায়ে থাকলে তিনি হয়ে যান বিপ্লবী। আর সেই উর্দি যদি সাদ্দাম হোসেন, মুয়াম্মার গাদ্দাফী কিংবা কিম জন উন এর গায়ে থাকে তখন তারা আর বিপ্লবীর কাতারে থাকেন না। কেউ হয়ে যান স্বৈরশাসক, সেনাশাসক আর কেউবা ক্ষমতার দখলদার।

মাত্র ৩৩ বছর বয়সে ফিদেল ক্যাষ্ট্রো কিউবার তখনকার প্রেসিডেন্ট ফালজেন্সিও বাস্তিতাকে উৎখাত করে পাঁচ দশক ধরে ক্ষমতায় ছিলেন, পার করেছেন ১০ জন আমেরিকান প্রেসিডেন্টের শাসনকাল। মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন ‘মুক্তির একমাত্র পথ সশস্ত্র বিপ্লব’। প্রেসিডেন্ট বাস্তিতাকে উৎখাতের পেছনে ক্যাষ্ট্রোর যুক্তি ছিল তিনি আমেরিকার দালাল। আর তাই কিউবাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করার জন্য তাকে উৎখাত করতে তিনি ৮০ জন অনুচরকে নিয়ে ১৯৫৬ সালে মেক্সিকো থেকে কিউবায় প্রবেশ করেন। পথে সরকারি বাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হওয়ায় তারা মাত্র ১৬ জন আর ১২টি অস্ত্র নিয়ে সেখানে পৌঁছাতে পেরেছিলেন। যাদের মধ্যে আরেক বিপ্লবী এবং ফিদেলের অনুপস্থিতিতে ফিদেলের বাহিনীর একমাত্র কমান্ডার চে’ গুয়েভারাও ছিলেন। এই দলটিই পরবর্তীতে পরিচিত হয়ে ওঠে ‘জুলাই টুয়েন্টিসিক্স মুভমেন্ট’ নামে।

যাইহোক আমেরিকার রাহুগ্রাস থেকে জাতিকে মুক্ত করতে এরপর তারা যা করেছেন তা মূলত আজকের মিডিয়ার ভাষায় সন্ত্রাসী, বিচ্ছিন্নতাবাদী, জঙ্গিবাদ ছাড়া আর কিছুই নয়। সোজাকথা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তিনি অসম যুদ্ধে নেমেছিলেন। এবং শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হয়েছিলেন। তিন বছরের মাথায় মার্কিন মদদপুষ্ট ফালজেন্সিও বাস্তিতাকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করেছিলেন। বলা হয়ে থাকে ৬৩৮ বার তাকে হত্যার চেষ্টা করেছে মার্কিন সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা। কিন্তু তিনি বেঁচে গিয়েছেন। পরাজিত হয়েছে সকল হত্যাচেষ্টা। বিজয়ী বলেই তার গায়ের উর্দি আজ মিডিয়ার চোখে বিপ্লবীর পোষাক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

কিন্তু ফিদেল ক্যাষ্ট্রোর মতই সামরিক উর্দি গায়ে থাকার পর যারা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কন্ঠ উচ্চকিত করেছেন কিন্তু বিজয়ী হতে পারেননি, কিংবা বিজয়ের পরে ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে পরাজিত হয়েছেন তাদেরকে মিডিয়া বিপ্লবী হিসেবে দেখে না। সাদ্দাম হোসেন, মুয়াম্মার গাদ্দাফী তার উৎকৃষ্ট নমুনা। ফিদেল ক্যাষ্ট্রো কিউবাকে মার্কিন মুলুকের প্রভাবমূক্ত করতে পেরেছেন ঠিকই। কিউবাকে তিনি প্রথম বিশ্বের সমতুল্য শিক্ষার হার, অনন্য এক স্বাস্থ্যব্যবস্থা দিতে পারলেও অর্থনৈতিকভাবে দৃঢ় অবস্থানে দাঁড় করাতে পারেননি। কিন্তু সেদিক থেকে গাদ্দাফী কিংবা সাদ্দাম ছিলেন এগিয়ে। নিজেদের দেশকে গড়ে তুলেছিলেন স্বর্গরাজ্যের মত। কিন্তু বিপ্লবের সংজ্ঞা পরাজিতের বেলায় কেন নগ্নভাবে বদলে যায়? বিপ্লবী পরাজিত হলে কি তার বিপ্লবী জীবনটা অর্থহীন হয়ে যায়? জাতির জন্য তাদের ত্যাগ তিতীক্ষাগুলো কি মূল্যহীন হয়ে পড়ে? যদি তাই না হবে তবে মিডিয়ার কেন এই দ্বিমুখী আচরণ? কেন সে পরাজিতের পাশে না দাঁড়িয়ে সাম্রাজ্যবাদীদের হয়ে দালালীতে মগ্ন হয়? কেন তারা সাম্রাজ্যবাদীদের অন্যায় হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে আর বিপ্লবীদের পক্ষে সোচ্চার কন্ঠে আওয়াজ তুলতে পারে না?

গণমাধ্যম যূগ যূগ ধরে পশ্চিমাদের সাম্রাজ্যবাদ আর পেশীশক্তির পূজা করে মূলত নিজেদের গণমাধ্যম দাবি করার মত নৈতিকতা হারিয়ে ফেলেছে। গণমাধ্যমকে তাই গণমাধ্যম না বলে দালালমাধ্যম বলাই যুক্তিযুক্ত নয় কি! গণমানুষের কথা না বলে শোষকের পায়ে তৈল মর্দন করলে তাকে কিভাবে গণমাধ্যম বলা যেতে পারে?

বিষয়: রাজনীতি

১৩৫৬ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

380237
২৮ নভেম্বর ২০১৬ রাত ০৩:৪১
স্বপন২ লিখেছেন : চমৎকার





380240
২৮ নভেম্বর ২০১৬ দুপুর ১২:৩৮
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : চমৎকার লিখাটির জন্য ধন্যবাদ।
380258
২৯ নভেম্বর ২০১৬ সকাল ০৬:৩৭
মোঃ আনোয়ার হুসাইন লিখেছেন : ঠিক বলেছেন। গণমাধ্যম না বলে দালালমাধ্যম বলাই যুক্তিযুক্ত

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File