জীবনের অস্তাচলে সব বাবা-ই 'নিঃসঙ্গ', 'একা'
লিখেছেন লিখেছেন মুক্ত কন্ঠ ০৭ এপ্রিল, ২০১৪, ০৮:৫৬:৫৮ রাত
জীবনের অস্তাচলে সব বাবা-ই 'নিঃসঙ্গ', 'একা'
-সেলিম সামীর
খবরটা শুনে বুকটা ছাৎ করে উঠলো এক অনাখাঙ্খিত আশংকায়। তখন সবে মাত্র মসজিদে ঢুকেছি জোহরের নামাজ আদায়ের জন্য। সংবাদদাতা যদিও গুরুতর অসুস্থতার কথা বলেছে তবু কেন জানি মনটা কঠিন কিছু আঁচ করে নিচ্ছিল। প্রায় এক কিলোমিটার রাস্তা একপ্রকার দৌড়েই এগুচ্ছি। বাসার যত নিকটবর্তী হচ্ছি হার্টবিট তত বেশি বাড়ছে। বুকটা মুচড় দিয়ে উঠতে চাচ্ছে অজানা আশংকায়, চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। আর গজ পঞ্চাশেক রাস্তা। ততক্ষণে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। তপ্ত অশ্রু চোঁখ ফেটে বেরিয়ে এসেছে দুটি ধারায়।
বাসার প্রধান ফটক খোলা। বাসার সামনে অনেক মানুষ। সবার চেহারা বিষন্নতায় আচ্ছন্ন। বুকটা ধক করে উঠল। দেহ শিতল করা কি যেন কানের পাশ থেকে ঘাড় হয়ে পিঠের দিকে নামল। কলাপসিবল গেটটাও খোলা। ভিতরে কারো চাপা কান্নার আওয়াজ শুনা যাচ্ছে। বুঝলাম যে শংকায় আতংকিত ছিলাম সেটাই ঘটে গেছে। দ্রুত ভেতরে প্রবেশ করলাম। সোজা মা বাবার রুমে। এখানেও অনেক আত্বিয় স্বজন -প্রতিবেশি। খাটে প্রায় ছ'ফুট লম্বা একটা মানব দেহ চাদর দিয়ে ঢাকা। প্রচন্ড বেদনায় বুকটা মুচড় দিয়ে উঠল। প্রিয় বাবা শুয়ে আছেন। নিদ্রায় নয়, চির নিদ্রায়। বুকের ভেতর সাইক্লোন বয়ে যাচ্ছে। বেদনাগুলো বুকের প্রাচির ভেদ করে বাইরে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে, বাধ সাধছে পুরুষত্ববোধ। আমি একজন এডাল্ট! সেই বোধ। কারণ, পুরুষের নাকি কাঁদতে নেই।
ছোট আপু ও ছোট বোনকে খবর দিতে হবে। বড় আপু বাসায়ই ছিলেন। সিলেটে তখনও মোবাইল প্রযুক্তির আগমন ঘটেনি। ওদের এলাকায় টেলিফোনও নেই। তাই ঘরে বসে মুহুর্তেই খবর পৌছে দেয়ার সুযোগ ছিলনা। অনেকের প্রবল বাধা সত্বেও নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে রওয়ানা হলাম।
মায়ের কাছে শুনেছি, তরুণ ও যুব বয়সে বাবা এক বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী ছিলেন। দাদার ধন সম্পদ জমি-জমা, প্রভাব প্রতিপত্তির প্রাচুর্য ছিল। পারিবারিক এই প্রাচুর্যের সুবাদে বাবা স্বাধিনভাবে ঘুরে বেড়িয়েছেন। বাবার দৈহিক গঠন যেমন ছিল অসাধারণ তেমনি তার পোষাক পরিচ্ছেদ এবং চলনে বলনেও ছিল রুচিবোধ আর সৌখিনতার সংমিশ্রন। সঙ্গিতপ্রেমি বাবা কাধে গিটার ঝুলিয়ে ঘোড়ায় চড়ে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন গ্রামের পর গ্রাম। কখনও সুন্দর কোন প্রকৃতির সামনে এসে হঠাৎ থমকে দাড়িয়েছেন। গাছের ছায়ায় বসে গিটারের তারে তুলেছেন সুরের ঝংকার।
পরিবার থেকে আর্থিক ডিমান্ড না থাকা সত্বেও এবং নিজের পেশা হিসেবে না নিয়েও সম্পুর্ণ সখের বশে ভর্তি হন আনসার বাহিনীতে। অতঃপর অনিয়মিত সদস্য হিসেবে ভর্তি হন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইপিআর তথা ইষ্ট পাকিস্তান রেজিমেন্টে। তারপর ১৯৭১ সালের মার্চের কোন এক রাতে পরিবারের সবার অজান্তে চলে যান মহান মুক্তিযুদ্ধে। সুনামগঞ্জের তাহিরপুর এলাকায় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেন। যুদ্ধের পুরোটা সময়ে মাত্র দুই তিনবার বাড়িতে এসে দেখা করেই আবার চলে যান।
স্বাধীনতার কয়েক বছরের মাথায় দাদার সম্পত্তির প্রাচুর্যে ভাটা পড়ে। জায়গা জমি ও ছোট চাচার একটি মামলা চালাতে গিয়ে অনেক জায়গা সম্পদ হারাতে হয়। বাবা চাচা প্রত্যেকের নিজের সংসার বড় হতে থাকলে আর্থিক চাহিদাও বাড়তে থাকে। বাবা বিদেশ চলে যান। বাবা তার জীবনের দীর্ঘ পচিশ বছর প্রবাসে কাটিয়ে দেন স্ত্রী-সন্তানদের মুখে হাসি ফুটাবার জন্য। আমার বয়সের যেটুকু সময় বাবাকে পেয়েছি তার প্রায় পুরোটাই তিনি প্রবাসে ছিলেন। শৈশব থেকে কৈশোর পর্যন্ত কখনই বাবার ঘনিষ্ট সহচর্য, আদর-ভালবাসা পাইনি। পাওয়ার সুযোগ ছিলনা। তিন চার বছরে একবার কিছু দিনের জন্য দেশে এলেও এতে তেমন একটা প্রভাব পড়েনি। যে কারণে স্মৃতির ঝুলিতে বাবাকে নিয়ে সেরকম কোন সুখ-দুঃখের স্মৃতি স্নেহ ভালবাসা অথবা শাষন-বারণ চোঁখ রাঙ্গানির অভিজ্ঞতাও নেই। কিন্তু বাবা যে এত তাড়াতাড়ি এত নিরবে আমাদেরকে রেখে চলে যাবেন তা কখনও কল্পনাও করতে পারিনি। প্রবাস থেকে এসেছেন কয়দিন আর হল। স্বদেশের মাঠিতে আপন ঘরে শেষ নিঃশ্বাস নিবেন বলেই কি মায়ের বাধা সত্বেও দেশে চলে এসেছিলেন? জীবনের শেষ কয়েকটা দিন আপনজনদের মাঝে কাটাবেন বলেই কি?
ভাবতে ভাবতে চোঁখ ঝাপসা হয়ে এসেছিল। আমি যে গাড়ি ড্রাইভ করছি সেটা কয়েক মুহুর্তের জন্য ভুলেই গিয়েছিলাম। সামনের একটা গাড়ির সাথে ধাক্কা খেলাম। শেষ মুহুর্তে হার্ড ব্রেক কষলেও আমার গাড়ির সামনের কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হল। নেমে গিয়ে সামনের গাড়ির লোকদেরকে বল্লাম 'স্যরি', ভূল আমারই। আমার বাবার মৃত্যু সংবাদ নিয়ে যাচ্ছি। কি যেন ভেবে ওরা কিছুই বললো না। সম্ভবত আমার গালে লেপ্টে থাকা অশ্রুর ধারাটা তাদের দৃষ্টি এড়ায়নি।
বাবা চলে যাওয়ার আজ প্রায় তেরো বছর হয়ে গেল। আমি এখন ত্রিশ বছরের যুবক। যখনই বাবার কথা মনে পড়ে, বাবার কথা ভাবি, নিজেকে বড় অপরাধী মনে হয়। যে সৌখিন বাবা নিজের জীবনের অর্ধেকটা দুর প্রবাসে কাটিয়ে দিলেন আমাদের জন্য। আমাদের সুখের জন্য, শখের জন্য। নিজের শখ, সুখ, ইচ্ছে সবকিছুকে জলাঞ্জলি দিলেন ছেলে সন্তানদের ইচ্ছে আখাঙ্খা পূরণে, উজ্জল ভবিষ্যতের আশায়। সেই বাবাকে কিছুই দিতে পারিনি। আয় রোজগারতো নয়ই; একটু সহানুভূতি একটু সহমর্মিতাটুকুও দেখাতে পারিনি। বরং যখন যেটা প্রয়োজন চোঁখ বোজে ডিমান্ড করেছি, মাকে দিয়ে আদায় করে নিয়েছি। বাবা শুধু দিয়েই গেছেন, নেননি কিছুই। এখন বুঝতে পারি, পরিবারে একজন অক্ষম 'বাবা'র উপস্তিতিটাও আল্লাহর কত বড় নিয়ামত। বাবার জীবিত উপস্থিতিটাই পরিবারের মাঝে বিদ্যুৎ শক্তির মত একটা 'অদৃশ্য শক্তি'র যোগান দেয়। সন্তানদের জন্য একটা বিমুর্ত সাহসের প্রতিক, যা পাড়ায় মহল্লায় রাস্তা ঘাটে সন্তানরা বুকে বল নিয়ে চলতে সাহায্য করে। 'বাবা!' যেন এক বিশাল মহীরুহ, সকল ঝড়-ঝাপটা আর রৌদ্রের প্রচন্ড খরতাপ নিজে হজম করে যেমন আশ্রিতদের শান্তির পরশ বুলায়। এখন পদে পদে যখন বিপদ মুসিবতের সম্মুখীন হই, বুঝতে পারি, বাবার স্থানটা দুনিয়ার কাউকে দিয়েই পূরণ করার মত নয়।
বাবা যে রাতে প্রবাস জীবনের ল্যাটা চুকিয়ে দেশে ফিরলেন, বাবার আসার অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে আমি মায়ের সাথে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। একসময় আমার কর্ণ কুহরে বাবার ক্লান্ত কাতর সুর প্রবেশ করল। বাবা আমার নাম ধরে ডাকছেন। জীবন সংগ্রামে ক্লান্ত-শ্রান্ত বাবার সেকি করুণ সুর! ঘুম ভেঙ্গে গেল। এতক্ষন মনে হচ্ছিল আমি স্বপ্ন দেখছি। কিন্তু না আবারও সেই করুণ সুরের ডাক- 'ও সেলিম'! আমি লাফ দিয়ে উঠেছিলাম। আনন্দের সাথে মাকে জাগিয়ে তুলেছিলাম বাবা এসেছেন বলে। তারপর দৌড়ে গিয়েছিলাম গেট খুলতে।
সেদিনের সেই ডাকের করুণ সুরটি বুঝতে পেরেছিলাম। কিন্তু তার তাৎপর্য্য উপলব্ধি বা অনুধাবন করতে পারিনি। পারার ক্ষমতাও হয়ত ছিলনা। আজ বুঝতে পারি, জীবন যুদ্ধে লড়াই করতে করতে বাবা কতটা ক্লান্ত প্ররিশ্রান্ত ছিলেন। যে লড়াইয়ে তার কোন সহযোদ্ধা সমব্যাথি কেউ ছিলনা। 'সহযোদ্ধা' যাকে বলা যায় সেই মা-ও আমাদের জন্য, আমাদের প্রয়োজন মেটানোর জন্য বাবার সাথে সবসময় ঝগড়াই করে গেছেন। দেশে ফেরার পরও শান্তিতে ক'টা দিন কাটাতে পারেননি। প্রেসার ডায়াবেটিস নিয়েও দোকান খুলে বসে থাকতে হয়েছে। আমরা দোকানে গিয়ে বাবাকে সাহায্য সহযোগিতা করব তাও হয়নি। সুযোগ থাকলেও যাইনি। বাবা আমাদের কথা বললে মা ঝগড়া করেছেন আমাদের পড়া লেখার ক্ষতি হবে বলে । বুঝতে পারি, বাবা আজীবন আমাদের রুটি রুজি আর সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য ত্যাগ স্বীকার করে গেলেও তিনি কতটা অবহেলিত ছিলেন, আপনজনদের মাঝে থেকেও কতটা নিঃসঙ্গ, আপন ভূবনে তিনি কতটা একা।
আমাদের ঘরে কখনোই টিভি আসেনি। বাবা সমসময় রেডিওতে বিশ্ব সংবাদ শুনার চেষ্ঠা করতেন। মনে পড়ে, বিবিসি ও ভয়েস অব আমেরিকার বিশেষ করে রাতের খবর আমাদের রুমে এসে আমাদের সঙ্গে বসে শুনতেন এবং সংবাদের উপর আলোচনা পর্যালোচনা করতেন। বাবা চাইলে রেডিওটা উনার রুমে নিয়ে শুনতে পারতেন, কিন্তু তা না করে এত লেট নাইটে আমাদের সাথে সংবাদ শুনতেন কেন? নিশ্চয়ই সন্তানদের সাথে রেডিও শুনার মধ্যে তিনি অন্যরকম বিনোদন বা সুখ উপভোগ করতেন। কিন্তু এখানেও আমরা তাকে বঞ্চিত করেছি। মায়ের কাছে নালিশ করেছি আমাদের ঘুমের ব্যাঘাত হচ্ছে বলে । এ নিয়ে বাবার সাথে মা অনেক ঝগড়া করেছেন। অবশেষে বাবা রাতের সংবাদ শুনা ছেড়ে দিয়েছিলেন।
যখন এসব ভাবি এবং চার পাশের বাবাদের কথা শুনি এবং দেখি তখন মনে হয়, পৃথিবীর বেশিরভাগ 'বাবা'ই জীবনের শেষ লগ্নে নিঃসঙ্গ, একাকী। আমি দেখি, ছেলে মেয়েরা যত বড় হতে থাকে, রঙ্গিন স্বপ্ন নিয়ে শুরু করা যুগল জীবনের সাথী প্রিয়তমা 'স্ত্রী'র কাছেও 'বাবা'দের গুরুত্ব কমতে থাকে। ছেলেমেয়েরা যখন বড় হয়ে যায় তখনও আমি দেখি, বাবাদেরকে হালের বলদ ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। পরিবারের সব প্রয়োজনের যোগান দেয়াই যেন বাবার একমাত্র কাজ। স্ত্রীর কাঠখোট্রা কথাবার্তা ছাড়া কোন শান্তনাদায়ক কথা ভাগ্যে জোটে না। ঘুমাবার বিছানাটা পর্যন্ত স্ত্রী থেকে পৃথক হয়ে যায়। আমি আরও দেখি, সন্তানরা যখন রোজগার হয়ে যায় তখন বাবারা যেন হয়ে যায় একটা বোঝা। আপন স্ত্রীদের কাছে বাবারা হয়ে যায় 'অচেনা মানুষ'। ঘুমাবার বিছানা শুধু আলগ নয় অনেক ক্ষেত্রে রুমও আলাদা হয়ে যায়। সন্তানরা মাকে যে মুল্যায়ন বা গুরুত্ব দেয় তার সিকিভাগও বাবারা পায় না। সময় কাটানোর জন্য পাড়া বা বাজারের দোকানের বেঞ্চে বসে অন্য কোন বাবা/বাবাদের সাথে গল্পগুজব অথবা মসজিদকে বেছে নিতে হয়। আপন ভুবনে সে হয়ে যায় সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ, সবাই থাকতেও যার কেউ নেই।
নিজেকে ক্ষমার অযোগ্য অপরাধী মনে হয় এজন্য যে, আমরা সবাই মিলে বাবাকে কতটা নিঃসঙ্গ করে দিয়েছিলাম। কতটা কষ্ট বুকে লুকিয়ে তিনি নিরবে নিভৃতে পরপারে চলে গেছেন। আমার কেন জানি মনে হয়, সবার অসহযোগিতা-অবমুল্যায়ন আর অবহেলার কারণেই আত্বাভিমানী বাবা আমাদের ছেড়ে আল্লাহর সানিধ্যে চলে গেছেন।
বাবা! আমাকে ক্ষমা করার কথা বলে তোমার মহান ব্যাক্তিত্বকে খাটো করতে চাই না। শুধু প্রভুর কাছে এই প্রার্থনা, হে রাহমানুর রাহীম! তোমার দয়া আর করুণার চাদরে বাবাকে ঢেকে নাও। আমীন!
বিষয়: Contest_father
৩৫৭৪ বার পঠিত, ১৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
অনেক সুন্দর হয়েছে ... অপূর্ব, চমৎকার
রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বাইয়ানি সাগিরা ।
জাযাকাল্লাহ খায়ের
ধন্যবাদ আপনাকে।
রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বাইয়ানি সাগিরা।
আল্লাহ আপনার বাবাকে বেহেশতে নসীব করুন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন