যেমন কর্ম তেমন ফল

লিখেছেন লিখেছেন আব্দুল্লাহশাহেদ ২১ নভেম্বর, ২০১৩, ০১:৪১:২৫ দুপুর

এই পৃথিবীর সকল বস্তু সৃষ্টি এবং তার পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় আল্লাহ তাআলার এমন কিছু নীতিমালা রয়েছে, যা অপরিবর্তনীয়। প্রকৃত জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান ঐ ব্যক্তি, যে আল্লাহ তাআলার এই অলংঘণীয় নীতিগুলোকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করে, মেনে নেয় এবং এর কোন বিরোধীতা করেনা। আল্লাহ তাআলার এই রীতি-নীতির অন্যতম একটি মূলনীতি হচ্ছে الجزاء من جنس العمل অর্থাৎ যেমন কর্ম তেমন ফল। সুতরাং যে ব্যক্তি যেমন কর্ম করবে, সে অনুরূপ ফলপ্রাপ্ত হবে। ভাল কাজ করলে ভাল পুরস্কার পাবে। আর বিপরীত করলে ফলও পাবে অনুরূপ। আল্লাহ তাঅলা বলেনঃ

وَجَزَاءُ سَيِّئَةٍ سَيِّئَةٌ مِثْلُهَا فَمَنْ عَفَا وَأَصْلَحَ فَأَجْرُهُ عَلَى اللَّهِ إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الظَّالِمِينَ

“আর মন্দের প্রতিফল তো অনুরূপ মন্দই। সুতরাং যে ক্ষমা করে ও আপোষ করে তার পুরস্কার আল্লাহ্র কাছে রয়েছে; নিশ্চয় তিনি অত্যাচারীদেরকে পছন্দ করেন না”। (সূরা শুরাঃ ৪০)

فَمَنْ يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ خَيْرًا يَرَهُ (৭) وَمَنْ يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ شَرًّا يَرَهُ

“অতঃপর কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করলে তা দেখতে পাবে এবং কেউ অণু পরিমাণ অপকর্ম করলে তাও দেখতে পাবে”। (সূরা যিলযালঃ ৭-৮)

সুতরাং যে আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি অনুগ্রহ করবে, আল্লাহও তার প্রতি অনুগ্রহ করবেন, যে ব্যক্তি মানুষকে ক্ষমা করবে, আল্লাহও তাকে ক্ষমা করবেন, যে ব্যক্তি মানুষের সাথে অহংকার করবে, আল্লাহ তাকে লাঞ্জিত করবেন, যে ব্যক্তি কোন অভাবীর অভাব পূরণ করবে, আল্লাহ তার দুনিয়া ও আখেরাতের অভাব পূরণ করবেন, যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের উপর থেকে দুনিয়ার কোন একটি কষ্ট দূর করবে, আল্লাহ তাআলা তার আখেরাতের একটি কষ্ট দূর করবেন, বান্দা যতক্ষণ তার ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণ করতে থাকে, আল্লাহ তাআলা ততক্ষণ তার প্রয়োজন পূরণ করতে থাকেন, যে ব্যক্তি তার আত্মীয়ের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখে, আল্লাহ তাআলা তার সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখেন, যে তার আত্মীয়ের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে, আল্লাহ তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে আশ্রয় নেয়, আল্লাহ তাকে আশ্রয় দান করেন, যে আল্লাহর স্মরণ থেকে বিমুখ হয়, আল্লাহ তার থেকে বিমুখ হন, বান্দা আল্লাহর নিকটবর্তী হলে আল্লাহও বান্দার নিকটবর্তী হন, যে আল্লাহর আনুগত্য থেকে দূরে সরে যায়, আল্লাহ তাকে দূরে সরিয়ে রাখেন, যে ব্যক্তি কোন ক্ষুধার্ত মুসলিমকে আহার করাবে, আল্লাহ তাকে বেহেশতের ফল দ্বারা পরিতৃপ্ত করবেন, যে ব্যক্তি কোন পিপাসিত মুসলিমকে পানি পান করাবে, আল্লাহ তাকে জান্নাতের পানীয় পান করাবেন, যে ব্যক্তি কোন মুসলিমকে সাহায্য করবে, আল্লাহ তাকে সাহায্য করবেন, আর যে ব্যক্তি তাকে পরিত্যাগ করবে, আল্লাহ তাকে পরিত্যাগ করবেন, যে ব্যক্তি মানুষের দোষ তালাশ করবে, আল্লাহ তার দোষগুলো মানুষের সামনে প্রকাশ করবেন এবং তাকে অপমানিত করবেন, যে ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইয়ের দোষ-ত্র“টি ঢেকে রাখবে, আল্লাহ তার দোষ-ত্র“টি গোপন রাখবেন।

ঠিক তেমনি যে ব্যক্তি মানুষের সাথে ভাল ব্যবহার করবে, মানুষও তার সাথে ভাল ব্যবহার করবে, যে মানুষকে ভালবাসবে আল্লাহও মানুষের অন্তরে তার প্রতি ভালবাসা স্থাপন করবেন। ফলে তারাও তাকে ভাল বাসবে। যে ব্যক্তি মানুষের সাথে খারাপ ও দুর্ব্যবহার করবে, সে অচিরেই এমন লোকের সম্মুখীন হবে, যারা তার সাথে অনুরূপ ব্যবহার করবে, যে ব্যক্তি তার প্রতিবেশীর অনুপস্থিতে প্রতিবেশীর স্ত্রী-পরিবারের হেফাজত করবে, প্রতিদান স্বরূপ সে যখন ঘরের বাইরে থাকবে প্রতিবেশীরাও বিপদাপদে তার স্ত্রী-সন্তানের হেফাজত করবে। বিপরীত করলে ফলাফলও সেরকমই হবে। অনুরূপ যে ব্যক্তি যৌবনে কারও এতীম, দুর্বল এবং অসহায় শিশুকে আশ্রয় দিবে, ঘটনাক্রমে সে যদি তার পরে স্বীয় সন্তানদেরকে শিশু ও অসহায় অবস্থায় রেখে যায়, তাহলে আল্লাহও প্রতিদান স্বরূপ তাঁর কোন বান্দার মাধ্যমে তার শিুশুদেরকে হেফাজত করবেন। এটিই মহা বিশ্বের মানব সমাজে আল্লাহর অন্যতম নীতি। বাস্তবতাও তার সাক্ষি। মানব সমাজে এর অগণিত দৃষ্টান্ত রয়েছে।

আমরা যদি এই মূলনীতিটি সবসময় সামনে রাখি, তাহলে আমরা সকল অন্যায় কাজ থেকে অতি সহজেই বাঁচতে পারবো। আমাদের স্মরণ রাখা দরকার যে, এই মূলনীতিটিই মানুষকে সৎ পথে পরিচালিত করার মূল চালিকা শক্তি এবং যাবতীয় জুলুম ও অন্যায়ের প্রতিরোধক।

একজন জালেম যখন এই মূলনীতিটি স্মরণ করবে যে, অচিরেই আল্লাহ তাকে জুলুমের প্রতিফল ভোগ করাবেন, তখন অবশ্যই সে জুলুম থেকে বিরত থাকবে এবং তাওবা করে আল্লাহর দিকে ফেরত আসবে। প্রখ্যাত তাবেয়ী সাঈদ বিন যুবায়ের (রঃ) এই মহা সত্যটির প্রতিই ইঙ্গিত করেছেন। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ যখন সাঈদকে হত্যা করার জন্য অগ্রসর হল, তখন সাঈদকে লক্ষ্য করে বললঃ হে সাঈদ! আমি তোমাকে কিভাবে হত্যা করব, তা তুমি নিজেই নির্বাচন কর। তখন তিনি বললেনঃ হে হাজ্জাজ! তুমি নিজেই তা নির্ধারণ কর। আল্লাহর শপথ! তুমি আমাকে যেভাবে হত্যা করবে, দুনিয়াতে অনুরূপ সাজা না পেলেও কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা তোমাকে সেভাবেই হত্যা করবেন।

আনাস বিন মালিক (রাঃ) বলেনঃ হুসাইনের মাথা যখন ইয়াযীদের সেনাপতি উবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদের এর কাছে নিয়ে যাওয়া হল তখন তিনি তাঁর মাথাকে একটি থালার মধ্যে রেখে একটি কাঠি হাতে নিয়ে তা নাকের ছিদ্র দিয়ে প্রবেশ করিয়ে নাড়াচাড়া করছিলেন এবং তাঁর সৌন্দর্য দেখে সম্ভবত বে-খেয়ালে কিছুটা বর্ণনাও করে ফেলেছিলেন। হাদীছের শেষের দিকে আনাস (রাঃ) বলেন: হুসাইন (রাঃ) ছিলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সবচেয়ে বেশী সাদৃশ্যপূর্ণ। (বুখারী)

অন্য বর্ণনায় আছে, আনাস (রাঃ) বলেনঃ আমি উবাইদুল্লাহকে বললাম, তোমার হাতের কাঠি হুসাইনের মাথা থেকে উঠিয়ে ফেল। কারণ আমি তোমার কাঠি রাখার স্থানে রাসূলের পবিত্র মুখ দিয়ে চুমু খেতে দেখেছি। এতে কাঠি সংকোচিত হয়ে গেল। (দেখুনঃ ফতহুল বারী ৭/৯৬)

এরপর কোথায় হুসাইনের কবর হয়েছে এবং তাঁর মাথা কোথায় গিয়েছে, তা সঠিক সূত্রের মাধ্যমে জানা যায় নি। প্রকৃত ও সঠিক জ্ঞান আল্লাহর নিকটেই। তবে “যেমন কর্ম তেমন ফল” এ কথার বাস্তবতা প্রমাণ করার জন্য এখানে ঘটনাটি বর্ণনা করা হল। পরবর্তীতে আল-আশতার নাখয়ীর হাতে উবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদ নির্মমভাবে নিহত হন। যখন তিনি নিহত হলেন তখন তার মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে মসজিদে রাখা হল। তখন দেখা গেল, একটি সাপ এসে তার মাথার চারপাশে ঘুরছে। পরিশেষে উবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদের নাকের ছিদ্র দিয়ে প্রবেশ করে মুখ দিয়ে বের হল। পুনরায় মুখ দিয়ে প্রবেশ করে নাকের ছিদ্র দিয়ে তিনবার বের হতে দেখা গেল। হুসাইনের সাথে তিনি যেমন আচরণ করেছিলেন, আল্লাহ তাআলা তার চেয়ে অধিক নিকৃষ্ট সাজা প্রদান করলেন। (দেখুন: তিরমিযী, ইয়াকুব বিন সুফীয়ান)

সুতরাং যেই জালেম মানুষকে অন্যায়ভাবে হত্যা করে, সে যদি এই প্রবাদ বাক্যটির উপর চিন্তা করত, بَشِّرِ الْقَاتِلَ بِالْقَتْلِ “হত্যাকারীকে হত্যার সুসংবাদ দান কর” তাহলে সে কাউকে হত্যা করার প্রতি অগ্রসর হতনা।

যেই পাপাচারী মানুষের মান-সম্মানে আঘাত করে এবং মুসলিম নারীদের সম্মান ও গৌরবের বস্তু নষ্ট করে, তার জেনে রাখা উচিৎ আল্লাহর ন্যায় বিচার থেকে সে কখনই অবশ্যই রেহাই পাবেনা। আল্লাহর সেই অলংঘনীয় বিধান তার ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন হবে। আল্লাহ তাআলা তার মা, বোন, স্ত্রী কিংবা কন্যার উপর তার মতই এমন একজন পাপিষ্টকে সক্ষম করবেন, যে তাদের সম্মান ও সতীত্ব নষ্ট করবে। ফলে সে তার মা-বোন ও স্ত্রী-কন্যার সাথে তাই করবে, যা করেছিল সে অন্যের মা-বোনের সাথে। তার ক্ষেত্রে আল্লাহর সেই নীতি অবশ্যই বাস্তবায়িত হবে, “যেমন কর্ম তেমন ফল”। আরবী কবি সত্যই বলেছেনঃ

لو كنت حراً من سلالة مـاجد ما كنت هتاكاً لحـرمـة مـسلم

من يَزن يُزن به ولو بجداره إن كنت يا هـذا لـبيـبـاً فافهم

من يزن في بيت بألفي درهم في بيـته يزنى بغـير الـدرهم

তুমি যদি সম্মানিত বংশের স্বাধীন পুরুষ হয়ে থাকো, তাহলে তুমি কখনই মুসলিমের (মুসলিম নারীর) সম্মান নষ্ট করবেনা। যে ব্যক্তি ব্যভিচার করবে, তার সাথেও তা করা হবে, তার সাথে করার সুযোগ না হলে তার ঘরের দেয়ালের সাথেই তা করা হবে। যে ব্যক্তি কারও ঘরে গিয়ে দুই হাজার দিরহামের (টাকার) বিনিময়ে কোন মহিলার সাথে যেনা করবে, তার (ঘরের মহিলাদের) সাথে বিনা পয়সাই তা করা হবে।

পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত যেসব জালেমের আগমণ ঘটেছে, তাদের পরিণতির দিকে তাকালে দেখা যায় আল্লাহ তাআলা তাদেরকে বিনা শাস্তিতে ছেড়ে দেন নি। তিনি জালেমদেরকে অবকাশ দেন। পরিশেষে পাকড়াও করেন। কখনও তিনি তাঁর সৎ বান্দাদের দ্বারা তাদেরকে শাস্তি দেন, কখনও তিনি সরাসরি ধ্বংস করেন আবার কখনও তিনি অন্যান্য জালেমদেরকে তার উপর চাপিয়ে দেন, যারা তাদেরকে পরাস্ত করে। এটিই আল্লাহর অন্যতম নীতি। আল্লাহর নীতিতে কোন পরিবর্তন নেই। কখনও যদি দুনিয়ার কোন জালেম আল্লাহর পাকড়াও থেকে রেহাই পেয়েও যান, তার অর্থ এই নয় যে, আল্লাহ তাকে পরকালে ধরবেন না। অবশ্যই তাকে ধরবেন এবং সেখানে তার জন্য কঠিন ও চিরস্থায়ী শাস্তি অপেক্ষা করেছ। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

وَكَذَلِكَ نَجْزِي مَنْ أَسْرَفَ وَلَمْ يُؤْمِنْ بِآَيَاتِ رَبِّهِ وَلَعَذَابُ الْآَخِرَةِ أَشَدُّ وَأَبْقَى

“এমনিভাবে আমি তাকে প্রতিফল দেব, যে সীমালঙ্ঘন করে এবং পালনকর্তার কথায় বিশ্বাস স্থাপন না করে। আর পরকালের শাস্তি কঠোরতম এবং অনেক স্থায়ী”। (সূরা তোহাঃ ১২৭) তবে দুনিয়াতে আল্লাহ তাআলা কখনও কোন জালেমকে কেন শাস্তি দেন না বা প্রতিরোধ করেন না, তার হিকমত ও রহস্য আমরা জানিনা। হতে পারে সে যেন পরকালে তার শাস্তি পরিপূর্ণরূপে ভোগ করতে পারে, তাই আল্লাহ তাকে দুনিয়াতে অবকাশ দিয়েছেন। হতে পারে অন্য কিছু। আল্লাহই ভাল জানেন।

যেমন কর্ম তেমন ফল। কুরআন ও হাদীছের অসংখ্য উক্তি এই মুলনীতি সত্যতা প্রমাণ করে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

مَن يَعْمَلْ سُوءًا يُجْزَ بِهِ وَلاَ يَجِدْ لَهُ مِن دُونِ اللّهِ وَلِيًّا وَلاَ نَصِيرًا* وَمَن يَعْمَلْ مِنَ الصَّالِحَاتَ مِن ذَكَرٍ أَوْ أُنثَى وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَأُوْلَئِكَ يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ وَلاَ يُظْلَمُونَ نَقِيرً

“যে কেউ মন্দ কাজ করবে, সে তার শাস্তি পাবে এবং সে আল্লাহ্ ছাড়া নিজের কোন সমর্থক বা সাহায্যকারী পাবেনা। যে লোক পুরুষ হোক কিংবা নারী, কোন সৎকর্ম করে এবং বিশ্বাসী হয়, তবে তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং তাদের প্রাপ্য তিল পরিমাণও নষ্ট হবে না”। (সূরা নিসাঃ ১২৩-১২৪) আল্লাহ তাআলা আরও বলেনঃ

وَمَكَرُواْ وَمَكَرَ اللّهُ وَاللّهُ خَيْرُ الْمَاكِرِينَ

“এবং তারা চক্রান্ত করেছে আর আল্লাহ্ও কৌশল অবলম্বন করেছেন। বস্তুত আল্লাহ্ হচ্ছেন সর্বোত্তম কুশলী”। (সূরা আল-ইমরানঃ ৫৪) এ রকম আরও অনেক আয়াত প্রমাণ করে যে, الجزاء من جنس العمل “যেমন কর্ম তেমন ফল”। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ

(احْفَظْ اللَّهَ يَحْفَظْكَ، احْفَظْ اللَّهَ تَجِدْهُ تُجَاهَكَ)

তুমি আল্লাহর (হুকুম-আহকাম ও বিধি-বিধানের) হেফাজত কর, তাহলে আল্লাও তোমাকে হেফাজত করবেন। তুমি আল্লাহর হেফাজত কর, তাহলে তুমি আল্লাহকে তোমার সামনে পাবে। (তিরিমজী) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেনঃ

(مَنْ بَنَى مَسْجِدًا يَبْتَغِي بِهِ وَجْهَ اللَّهِ، بَنَى اللَّهُ لَهُ مِثْلَهُ فِي الْجَنَّةِ

“যে ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশ্যে একটি মসজিদ তৈরী করবে, আল্লাহ তার জন্য অনুরূপ একটি ঘর জান্নাতে প্রস্তুত করবেন”। (বুখারী, হাদীছ নং- ৪৫০)

যেমন কর্ম তেমন ফল। পৃথিবীর মানব সমাজের দিকে দৃষ্টি দিলে এমন অনেক ঘটনার সন্ধান মিলবে, যা এই মুলনীতিটির সত্যতা ও বাস্তবতার উজ্জল প্রমাণ।

জনৈক বিদ্বান বলেনঃ আমি একবার রাস্তায় দঁড়িয়ে এক বন্ধুর আগমণের অপেক্ষা করছিলাম। এ সময় আমার সামনে একটি স্মরণী ঘটনা সংঘটিত হয়।

ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ এই যে, দেখলাম একদল যুবক এসে রাস্তার ঠিক মাঝখানে বসে গেল। তাদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ অপকর্মের বীরত্ব প্রকাশ করছিল। তাদের একজন বলতে লাগলঃ হে বন্ধুরা! তোমরা কি আমার অমুক বান্ধবীকে চেন? সত্যিই সে আমার অন্তরঙ্গ বান্ধবী। দিনে ও রাতে সে আমার সাথে মোবাইল ফোনে অসংখবার কথা বলে। আমিও তাই করি। তার সাথে আমার সম্পর্ক খুবই গভীর। ইত্যাদি ইত্যাদি……আরও অনেক লোম হর্ষক অপকর্মের কথা। অন্যরাও অনুরূপ অনেক ঘটনা বলাবলি করল। পরিশেষে তারা সেই স্থান ত্যাগ করে চলে।

কয়েক মিনিট পর আরেক দল যুবক এসে একই স্থানে বসে গেল। তারাও পূর্বোক্ত যুবকদলের ন্যায় নিজ নিজ অপকর্মের গল্প জুড়ে দিল। তাদের একজন ঠিক ঐ স্থানে বসল, যেখানে বসে একটু আগে এক যুবক তার প্রেমিকার গল্প করেছিল। সে হঠাৎ বলতে লাগলঃ বন্ধুরা! একটু আগে এখানে যেই যুবকটি বসাছিল, তোমরা কি তাকে চেন? তোমাদের কি জানা আছে, তার বোন আমার বান্ধবী? সত্যিই সে আমার হৃদয়ের সাথী। আমি তার সাথে দিনে ও রাতে যোগাযোগ করি। সেও আমার জন্য সাথে প্রেমের শিকলে আবদ্ধ। আমাকে ছাড়া সে বাঁচেনা। আমিও তার জন্য পাগল। ইত্যাদি…….আরও অনেক কথা।

সুবহানাল্লাহ! যেমন কর্ম তেমন ফল। এই যুবকদ্বয়ের ক্ষেত্রে কি তা বাস্তবায়িত হয়নি? এই ঘটনা কি আমাদের জন্য শিক্ষণীয় নয়? এর দ্বারা কি আমরা শিক্ষা নিবোনা? আজকের অপরাধ জগৎ যদি এই ঘটনা নিয়ে চিন্তা করত, তাহলে পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন জীবন যাপন করার জন্য এটিই যথেষ্ট হত। এ রকম ঘটনা যে সমাজে একটিই ঘটেছে, তা নয়। এমন হাজারো ঘটনা আমাদের সমাজে অহরহ ঘটছে।

এ রকম আরেকটি ঘটনা শুনুন। ইরাকে ছিল এক ব্যবসায়ী। নাম তার মাহমুদ। সে ইরাক থেকে সিরিয়ায় পণ্য নিয়ে যেত। সেখানে তা বিক্রি করে সিরিয়ার পণ্য ক্রয় নিয়ে এসে ইরাকে বিক্রি করত। সে ছিল একজন ধার্মিক, চরিত্রবান এবং আমনদার ব্যবসায়ী। নিয়মিত তার মালের যাকাত আদায় করত, গরীব দুঃখীদের সহায়তা করত, অসহায়ের পাশে দাঁড়াত, রোগীর সেবা করত এবং এমনি আরও অসংখ্য সৎগুণ ছিল তার চরিত্রে ভূষণ।

সে তার মহল্লার মসজিদেই পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করত। তার প্রতিবেশীদের কেউ জামআতে অনুপস্থিত থাকলে তার অবস্থা জিজ্ঞেস করত। অসুস্থ থাকলে দেখতে যেত, প্রয়োজন থাকলে তার প্রয়োজন পূর্ণ করত এবং বাড়ির বাইরে থাকলে তার পরিবারের দেখাশুনা করত।

এই ছিল তাঁর প্রতি দিনের আচরণ। স্রষ্টার হক আদায়ের সাথে সাথে বান্দার হক আদায়েও তিনি ছিলেন অগ্রণী ও তৎপর। একদিন তার একমাত্র ছেলে খালেদকে ঢেকে বললেনঃ হে বৎস্য! তুমি এখন যুবক হয়েছ। দুনিয়াকে চিনতে পেরেছ। বয়সের ভারে আমি নুইয়ে পড়েছি। জীবন ছায়াহ্নে এসে গেছি। এখন তুমি তোমার পিতার সহায়ক হও। আমি আর সিরিয়ার পথে ভ্রমণ করতে আগের মত সক্ষম নই। তুমি তোমার দায়িত্ব বুঝে নাও। আল্লাহর উপর ভরসা করে সিরিয়ার পথে চল। সততা ও বিশ্বতার সাথে রিযিকের সন্ধানে বের হও। আমি তোমাকে তাকওয়ার (আল্লাহর ভয়ের) উপদেশ দিচ্ছি এবং তোমার একমাত্র বোনের সম্মান ও সতীত্বের হেফাজতের উপদেশও করছি।

এটি ছিল প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের পূর্বের ঘটনা। তখন রেল বা মোটরযান ছিলনা। সহযাত্রীদের সাথে খালেদ চলছে সিরিয়ার পথে। ইরাকের পণ্য সিরিয়ায় বিক্রি করে সিরিয়ার পণ্য ইরাকে আনবে। পিতার ব্যবসার দায়িত্ব গ্রহণ করে খালেদ নিয়মিত ইরাক ও সিরিয়ায় যাতায়াত করতে লাগল।

একবার সিরিয়া থেকে ইরাকে ফেরার পথে এক সুন্দরী যুবতীর দিকে তার দৃষ্টি পড়ল। তখন সন্ধ্যা বেলা। নেই কোন জনমানব। একটু পরেই সূর্য পশ্চিমাকাশে উদাও হবে। যুবতীর রূপ-সৌন্দর্য্য দেখে খালেদ নিজেকে সংবরণ করতে না পেরে শয়তানের পাকানো রশিতে নিজেকে জড়িয়ে ফেলল।

যুবতীকে জড়িয়ে ধরে একটি চুম্বন করল। এরপরই যুবতীটি তার আক্রমণ থেকে পালিয়ে গেল। সেও পিছনে চলে আসল এবং কতৃকর্মের জন্য লজ্জিত হল।

এই ঘটনা গোপন রইল। সহযাত্রীদের কেউ তা জানতে পারেনি। ঐ দিকে তাদের বাড়িতে একটি ঘটনা ঘটে গেল। তাদের বাড়িতে একটি যুবক যাতায়াত করত। মিঠা পানি সরবরাহ করাই ছিল যুবকটির প্রধান কাজ। প্রতিদিনের মতই একদিন যুবকটি পানির কলসী নিয়ে তাদের বাড়িতে এসে ঘরের দরজায় করাঘাত করল। কলসী ভর্তি পানি বাড়িতে রেখে খালী কলসী নিয়ে ফেরত যাবে। খালেদের বোন দরজা খুলে খালি কলসী ঘরের বাইরে রাখল। যুবকটি পানি ভর্তি কলসীটি রেখে খালী কলসী নিয়ে ফেরত যাচ্ছিল। এমন সময় হঠাৎ পিছনে ফেরত এসে খালেদের বোনকে জড়িয়ে ধরে চুম্বন করল। এতটুকু করেই যুবক চলে গেল। মেয়েটি লজ্জায় মস্তক অবনত করে গৃহে প্রবেশ করল।

খালেদের পিতা মাহমুদ ঘরের জানালা দিয়ে তাঁর একমাত্র কন্যার সাথে সাধারণ একটি কাজের লোকের এই কান্ড দেখে ফেললেন। সাথে সাথে তাঁর কণ্ঠনালীর গভীর থেকে শুধু উচ্চারিত হল لا حول ولا قوة إلا بالله العلي العظيم (লা-হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ)। যুবকটিকে তিনি কিছুই বলেন নি। যেমন বলেন নি তাঁর মেয়েকে। এই দৃশ্য দেখে তিনি হতাশ হলেন। লজ্জায় অপমানে নিশব্দে ক্রন্দন করতে থাকলেন। তাঁর মাথায় হাজারো প্রশ্ন। কেন এমনটি হল? কাজের ছেলেটি বহুদিন যাবৎ তার বাড়িতে পানি দিয়ে যায়। সে প্রতিবেশীদের বাড়িতেও তাই করে। কেউ কোন দিন তার চরিত্রের ব্যাপারে প্রশ্ন তুলেনি। কোন দিন সন্দেহ জনক কিছু চোখে পড়েনি। কোন মহিলার দিকেও কখনও তাকিয়ে দেখেনি। তার মেয়েটিও স্বীয় চরিত্রের হেফাজত করায় ত্র“টি করেনা। বাড়ির চার দেয়ালের বাইরে পা বাড়ায়না। কোন পুরুষের দিকে তাকিয়েও দেখেনা। আজ কেন এমনটি হল?

এমনি হাজারো প্রশ্ন মাহমুদের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। খালেদের আগমণের পথ পানে চেয়ে তাঁর দিনাতিপাত হতে থাকল। মনের দুঃখ-বেদনা মনের গহীন কোঠায় লুকায়িত রইল। তিনি তো কোন দিন এমনটি করেন নি যে, তাকে অনুরূপ ফল পেতে হবে। স্মৃতি পটে অতীত জীবনের প্রতিটি পাতা উল্টাচ্ছেন। কোথাও এমন কিছু পাচ্ছেন না, যা তাকে এহেন জ্বালাময়ী বেদনায় নিপতিত করতে পারে। আল্লাহর ভয় এবং অনুপম চারিত্রিক গুণাবলী ধারণ করেই তিনি যৌবন পার করেছেন। যৌবনে এমন কিছু করেন নি, যা তাকে পরিণত বয়সে পীড়া দিতে পারে।

কয়েক দিন পর ব্যবসায় লাভবান হয়ে এবং সুস্বাস্থ নিয়ে খালেদ ইরাকে ফেরত আসল। পুত্রের নিরাপদে ফেরত এবং ব্যবসায় লাভবান হওয়ার প্রতি তার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। ব্যবসায়ের হাল অবস্থা, সফরের সুবিধা অসুবিধা কিংবা তার সহযাত্রীদের ব্যাপারে কোন প্রশ্ন নেই।

সরাসরি সরল মনে যেই প্রশ্নটি করলেন, তা হল সিরিয়া থেকে ফেরার পথে তুমি কি করেছ? খালেদ তার ব্যবসায়িক সফরের ছোট-খাট অনেক ঘটনাই বলতে চাইল। যখনই কোন ঘটনা বলতে যায়, পিতা থামিয়ে দেন এবং জিজ্ঞেস করেনঃ কোন যুবতীর সাথে তোমার অপ্রীতিকর কিছু ঘটেছে কি? কোন মহিলার শরীরে তোমার হাত পড়েছি কি? তুমি কি কোন মহিলাকে চুম্বন করেছ? করে থাকলে তা কোথায় ও কখন?

খালেদ দৃঢ়তার সাথে তা অস্বীকার করল। তার চেহারা লাল হয়ে গেল। সর্বশক্তি প্রয়োগ করে কলঙ্ক গোপন করতে চাইল। কিন্তু পর্বত সাদৃশ মনোবল এবং জীবন ও জগৎ সম্পর্কে অসাধারণ অভিজ্ঞতা সম্পন্ন পিতার সামনে প্রকৃত ঘটনা গোপন করতে গিয়ে খালেদের সকল প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হল। পরিশেষে মূল ঘটনা স্বীকার করতে বাধ্য হল।

পিতা ও পুত্রের মাঝে দীর্ঘক্ষণ এক অনাকাঙ্খিত নিরবতা বিরাজ করল। মাথা নীচু করে পিতার সামনে খালেদ পাথরের মত নিরব হয়ে বসে রইল। পিতার মুখেও নেই কোন রব। অনেক কথাই তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, কিন্তু তার ক্ষুরধার জবানীতে বার বার অজ্ঞাত কারণে কথা আটকে যাচ্ছে। এভাবে বেশ কিছু সময় অতিবাহিত হল।

অবশেষে মনকে শক্ত করে স্বীয় পুত্র খালেদকে লক্ষ্য করে তিনি বলতে লাগলেনঃ দেখ খালেদ! তুমি যখন সিরিয়ার পথে বের হয়ে যাও, তখন তোমাকে মাত্র একটি উপদেশ দিয়েছিলাম। তোমাকে বলেছিলাম, সফরে তোমার একমাত্র বোনের ইজ্জত রক্ষা কর, যেমনটি করে থাক স্বদেশে। কিন্তু তুমি তা করোনি।

অতঃপর তিনি আসল ঘটনা খুলে বললেন। বললেনঃ কিভাবে তাদের ঘরের খাদেম তার সম্মান ও মর্যাদার বস্তুতে আঘাত করেছে এবং তার জীবনকে কলঙ্কিত করেছে!! আরও খুলে বললেন যে, তুমি সিরিয়া থেকে ফেরার পথে এক যুবতীকে যেই চুম্বন করেছিলে, এটিই হচ্ছে সেই ঋণ, যা তোমার বোনের দ্বারা পরিশোধিত হল।

যেমন কর্ম তেমন ফল। আরবী কবি ঠিকই বলেছেনঃ من يَزن يُزن به ولو بجداربيته “যে লোক যেনা করবে, তার সাথেও তা করা হবে। তাকে পাওয়া না গেলে কমপক্ষে তার ঘরের দেয়ালের সাথেই তা করা হবে”। কেননা যেমন কর্ম তেমন ফল। এটি হচ্ছে সৃষ্টির মধ্যে আল্লাহর অলংঘনীয় নীতি, যার কোন পরিবর্তন হবেনা। যে যতটুকু অন্যায় করবে, তাকে সে পরিমাণ ফলাফল ভোগ করতেই হবে। অপর পক্ষে যে নিজেকে হেফাজত করবে এবং পবিত্র রাখবে তার সুফলও ভোগ করবে। এতেও কোন পরিবর্তন হবেনা।

এবার বৃদ্ধ পিতা বলতে লাগলেনঃ দেখ খালেদ আমি জানি যে, জীবনে আমি কোন দিন এমন কর্মের চিন্তা করিনি। তিনি তাঁর কন্যা ও পুত্রের প্রতি দয়ার স্বরে এবং নতুন করে উপদেশ দিতে শুরু করলেন। বললেনঃ আমি এ পর্যন্ত আমার সম্ভ্রম ও সম্মান রক্ষা করেছি। মানুষের ইজ্জত ও সম্মান রক্ষার মাধ্যমেও নিজের সম্মান রক্ষা করার হাতিয়ারকে আরও মজবুত করেছি। যৌবনে কখনও খেয়ানত করিনি, অশ্লীলতার ধারেও যাইনি। এর মাধ্যমে আমি আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করেছি। যেমনটি করেছি আমার নামায, যাকাত এবং রোযাসহ অন্যান্য কর্মে।

ঘরের খাদেম যখন তোমার একমাত্র বোনের শরীরে হাত দিল, তখন আমি নিশ্চিত বিশ্বাস করে নিয়েছি যে, তুমিও কারও না কারও বোনের সাথে অনুরূপ আচরণ করেছ। তোমার বোন তোমার সেই ঋণ হুবহু পরিশোধ করেছে। এতে কোন বাড়তি বা কমতি হয়নি। একটি চুম্বনের বিনিময়ে মাত্র একটি চুম্বন। তুমি যদি আরও কিছু করতে, আরও কিছু হত। এটিই স্বাভাবিক, এটিই নীতি। যেমন কর্ম তেমন ফল। আল্লাহর নীতিতে কোন পরিবর্তন নেই।

তথ্যসূত্রঃ

১) আলকুরআনুল কারীম

২) সুন্নাতে নববী

৩) মানুষের অভিজ্ঞতা

৪) আরবী সাহিত্যের বিভিন্ন প্রবন্ধ

সংগ্রহে ও প্রস্তুতেঃ আব্দুল্লাহ শাহেদ আল মাদানী

জুবাইল দাওয়া এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব

বিষয়: বিবিধ

১৭৪১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File