হযরত সালমান আল ফারসির (রা) ইসলাম গ্রহণের অসাধারণ কাহিনী ==========================================

লিখেছেন লিখেছেন আলোর পথে আলোকিত ০৬ নভেম্বর, ২০১৩, ০১:১৯:৩৮ দুপুর



হযরত আব্দুল্লাহ ইবন্‌ আব্বাস (রা) ছিলেন রসুলুল্লাহের (সা) চাচাতো ভাই। তিনি বিভিন্ন সাহাবীর (রা) কাছ থেকে দ্বীন শিক্ষা নিয়েছেন। হযরত সালমান ফারসি (রা) ছিলেন আবদুল্লাহ ইবন্‌ আব্বাসের (রা) অন্যতম শিক্ষক। তিনি (হযরত সালমান ফারসি (রা)) হযরত হুসাইনেরও (রা) শিক্ষক ছিলেন। তিনি ছিলেন জ্যৈষ্ঠ সাহাবাদের মধ্যে অন্যতম। ইবন্‌ আব্বাস (রা) যেহেতু তাঁর (হযরত সালমান ফারসি (রা)) শিষ্য ছিলেন তাই তিনি তাঁর কাছ থেকে শুনেছেন যে কিভাবে তাঁর ইসলাম গ্রহণের কাহিনী। কাহিনীটা খুবই মজার এবং মনোমুগ্ধকর!!

হযরত সালমান ফারসি (রা) বর্ণনা করেন, “আমি পারস্যের [বর্তমান ইরান] আস্পাহানের একটা গ্রামের,[গ্রামের নাম ছিল ‘জি’] অধিবাসী ছিলাম। আমার পিতা ছিলেন গ্রামের ‘দাহকান’ [আগুন রক্ষাকর্তা, কারণ সেই সময়ে ইরানের ধর্ম ছিল জোরাষ্ট্র, আর এরা ছিল আগ্ন উপাসক, তাই এদের কাজ ছিল দিন রাত ২৪ ঘন্টা আগুন প্রজ্বলিত রাখা। প্রত্যেক পাড়া মহল্লায় এরকম একটা জায়গায় (উপাসনালয় ধরণের) আগুন জ্বালিয়ে রাখা হত এবং একজন আগুনের রক্ষাকর্তা থাকত যে চরম নিবেদিত এবং সে সর্বদা আগুনটাকে পর্যবেক্ষন করবে যেন আগুন নিভে না যায়! সমাজে তার মর্যাদা ছিল ব্যাপক। ]। আমার পিতা গ্রামের কৃষি বিষয়ক ব্যাপারে কর্তাব্যক্তি ছিলেন, যেটা ছিল খুবই গুরত্বপূর্ণ একটা পদ [জোতিষশাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা ও অন্যান্য বিষয় তখনকার দিনে যেগুলো কৃষি বিষয়ক জ্ঞানের জন্য অপরিহার্য ছিল]।” হযরত সালমান ফারসি (রা) তার পিতার হাত ধরে পরে তিনিই আগুনের রক্ষাকর্তা হন, যেটা ছিল বিরাট একটা পবিত্র দায়িত্ব এবং পদ।

হযরত সালমান ফারসি (রা) বলেন যে, “আমার পিতা আমাকে ভীষণ ভালবাসতেন। তিনি আমাকে তার চোখের আড়াল হতে দিতেন না [তিনি সাবালক হওয়ার পরও তাঁর পিতা তাঁকে সবসময় চোখে চোখে রাখতেন]। আমার পিতা আমাকে কোন জায়গায় যেতে দিতেন না। আমি আগুন ছাড়া পৃথিবীর অন্য কিছুই জানতাম না [জোরাস্ট্র ধর্ম সম্পর্কেই তাঁর জ্ঞান ছিল অন্য কিছু নয় ]। একদিন আমার পিতা বাড়ি তৈরি করছিলেন এবং একটা জরুরী প্রয়োজনে তিনি আমাকে বাইরে পাঠালেন।”

হযরত সালমান ফারসি (রা) এর আগে কোনদিন তাঁর গ্রাম ছেড়ে যান নি যদিও তিনি ছিলেন সাবালক। তাঁর পিতা তাঁকে যেতে দেননি। কিন্তু এদিন ছিল ব্যতিক্রম একটা ঘটনা। সালমান ফারসি (রা) গ্রামের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন, তাঁর কাছে মনে হচ্ছে যেন এটা একটা ভিন্ন জগত!! যেহেতু তিনি এর আগে এদিকে আসেন নি। যেতে যেতে হযরত সালমান ফারসি (রা) একটি খৃস্টানদের চার্চের পাশ দিয়ে অতিক্রম করলেন। যদিও তাঁর চারিদিকে জোরাস্ট্র ধর্মাবলীরা থাকত কিন্তু সেখানে এক আধটা খৃস্টানরাও [যেই গ্রামের পথ দিয়ে তিনি যাচ্ছিলেন] ছিল। হযরত সালমান ফারসি (রা) একটু কৌতুহলী হয়ে উঠলেন, তিনি জানতে চাইলেন যে এই উপাসানালয়ে কি হচ্ছে। তিনি বলেন, “আমি তাদের প্রার্থনা শুনলাম, তাই আমি ঘটনাটা দেখতে গেলাম। আমি চার্চের ভিতর গেলাম এবং আমি তাদের প্রার্থনার ধরন দেখে খুবই আকৃষ্ট হলাম। আমি তাদের ধর্ম দেখে খুবই আশ্চর্য হলাম এবং সেখানে সূর্যাস্ত পর্যন্ত বসে থাকলাম [যদিওবা তাঁর পিতা তাঁকে সকালবেলা কিছু জিনিস আনতে পাঠিয়েছিলেন]। যখন আমি বাড়ি ফিরলাম আমি আমাদের সেই বাড়ি যেটা আমাকে দেখাশুনা করতে বলা হয়েছিল সেখানে পর্যন্ত গেলাম না! আমি যখন বাড়ি পৌছুলাম আমার পিতা আমাকে বললেন, “আমি তোমার জন্য লোক পাঠিয়েছিলাম। আমি তোমাকে নিয়ে বড় দুশ্চিন্তায় ছিলাম। ব্যাপারটা কি, হয়েছিল কি?” হযরত সালমান ফারসি (রা) বললেন, “আমি একটা চার্চের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম এবং আমি তাদের ইবাদতের ধরণ দেখে মুগ্ধ হলাম।” আমার পিতা আমাকে বললেন, “ওদের কাছে থেকে দূরে থাক, তোমার ধর্ম ওদেরটার থেকে ভাল।”

হযরত সালমান ফারসি (রা) ছিলেন একজন সাদাসিধে মানুষ [অনেক সময় মানুষের সামাজিকতার কারণে অন্তরে এক বাইরে প্রকাশ করে আরেক, কিন্তু হযরত সালমান ফারসি (রা) এরকম ছিলেন না। তাঁর ভিতর এধরণের অভ্যাস ছিল না, তিনি সোজাসাপ্টা কথা বলতেন]। তিনি তাঁর পিতাকে বললেন, “না। এই ধর্মটাই বেশি ভাল।” তাঁর পিতা খুবই আশ্চার্য হয়ে গেল এবং মনখারাপ করলো। তিনি তাঁকে বন্দি করে রাখলেন। হযরত সালমান ফারসি (রা) বলেন, “আমি খৃস্টান চার্চে একটা বার্তা (Message) পাঠাতো সক্ষম হলাম। তাতে তাদের বললাম যদি তোমরা তোমাদের ধর্মের উৎসস্থল থেকে কোন পথিক/কাফেলার সন্ধান পাও তবে আমাকে জানাবে। [হযরত সালমান ফারসি (রা) তাদের সাথে আগে যখন কথা বলেছিলেন, তখন জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, তোমাদের ধর্মের উৎপত্তিস্থল কোথায়? তারা বলেছিল, ‘আস-সাম (অর্থাৎ বর্তমান সিরিয়া, ফিলিস্তিন, ইসরাইল, জর্ডান, লেবানন মিলে যে এলাকা)। যদি আপনারা ঐ এলাকার কোন পথিক/কাফেলাকে দেখেন তাহলে আমাকে জানাবেন।’]”

আস-সাম থেকে একটা কাফেলা এসেছিল এবং তারা হযরত সালমান ফারসিকে (রা) সেটার তথ্য পাঠালো। হযরত সালমান ফারসি (রা) তাঁর বাড়ি ছেড়ে পালালেন এবং তাদের (কাফেলা) সাথে সামের দিকে গেলেন। এখানেই বুঝা যায় যে, হযরত সালমান ফারসির (রা) সত্য অনুসন্ধানে কি রকম আগ্রহ ছিল। তিনি তাঁর সবকিছু ত্যাগ করে দিলেন, সমাজে তাঁর এত বড় পজিশন, পরিবার, জমি-জায়গা, এত বড় স্ট্যাটাস ছিল সব তিনি সত্য অনুসন্ধানের জন্য ত্যাগ করলেন, যদিও কিছুদিন আগেও তাঁর খৃস্টান ধর্ম সম্পর্কে কোন ধারণায় ছিল না!!

তিনি সেই কাফেলার সহায়তায় সিরিয়াতে পৌছুলেন। তিনি সেখানে জানতে চাইলেন, এখানকার কর্তাব্যক্তি কে? তারা একটি চার্চের একজন বিশপকে [খৃস্টান যাজক] দেখাল। তিনি সেই বিশপকে বললেন, “আমি আপনার ধর্ম শিখতে এসেছি এবং আমি আপনার একজন শিষ্য হতে চাই এবং আমি আপনার সেবা করতে চায় ও সঙ্গী হতে চায়।” বিশপ রাজি হলেন।

হযরত সালমান ফারসি (রা) বলেন, “আমি জীবনে কোনদিন তার [বিশপ] মত খারাপ লোক দেখিনি।” [চিন্তা করে দেখুন, হযরত সালমান ফারসি (রা) পারস্য বা ইরান থেকে এতদূর তাঁর সবকিছু ছেড়ে সত্য অনুসন্ধানের জন্য সিরিয়াতে আসলেন আর এসে হাতে পড়লেন একজন খারাপ লোকের!! তিনি যে বিশপের কাছে আসলেন, যাকে লোকজন মনে করতো সৎ লোক, আসলে সে ছিল চরম খারাপ। সে লোকজনের টাকা পয়সা আত্মসাৎ করতো। সে লোকজনের কাছে থেকে টাকা পয়সা দান করার উদ্দেশ্যে নিত আর তা নিজের জন্য রেখে দিত!! আর এ বিষয়টা শুধুমাত্র হযরত সালমান ফারসি (রা) জানতেন, কারণ তিনি তার খুব কাছের লোক ছিলেন। তার আখলাক/চরিত্র ছিল চরম খারাপ।]

এঘটনা হযরত সালমান ফারসিকে (রা) সত্যা অনুসন্ধানে বাধা হয়ে দাড়ায় নি। যারা সত্য অনুসন্ধান করতে চান তাদেরকে এসব ঘটনা সত্য অনুসন্ধান থেকে দূরে রাখতে পারে না। যদিও হযরত সালমান ফারসি (রা) খারাপ ব্যক্তির হাতে পড়েন তারপরও তাঁর উদ্দেশ্যের কারণে তিনি তাঁর পথ থেকে বিমুখ হননি।

হযরত সালমান ফারসি (রা) বলেন, “আমি ঐ লোকের [বিশপ] সাথে তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ছিলাম, যদিওবা সে খারাপ চরিত্রের লোক ছিল এবং আমি ঘটনার কিছু পরিবর্তন করতে পারিনি কারণ লোকজন তাকে [বিশপ] অত্যন্ত ভালবাসত, যদি আমি সেটা করতাম তাহলে এত আমারই ক্ষতি হত, তাই আমি চুপ ছিলাম। যখন সে মারা গেল আমি লোকজনদের বললাম, তোমাদের এই বিশপ একজন খারাপ লোক। সে একজন জাল-জোচ্চুর। তারা বলল, কি প্রমাণ আছে তোমার? তিনি বললেন, দাড়ান দেখাচ্ছি।” তিনি তাদেরকে বিশপের বাসস্থানের দিকে নিয়ে গেলেন এবং তিনি মাটি খুঁড়ে ৭টি বিরাট স্বর্ণ রৌপ্য ভর্তি কলস বের করলেন। লোকজনের সেই বিশপের জোচ্চুরি এতটাই মর্মাহত করলো যে তারা তাকে দাফন করতে অস্বীকৃতি জানাল এবং তার লাশকে ময়লা আবর্জনার মধ্যে ফেলে দিল। তারপর তারা একজন লোককে বিশপ হিসেবে নিয়োগ দিল এবং তার সম্পর্কে হযরত সালমান ফারসি (রা) বলেন, “আমি তার মত এরকম সৎ এবং ধার্মিক লোক আর দেখিনি এবং আমি তার মত আর কাউকে বেশি ভালবাসিনি [ইসলাম গ্রহণের আগে]।”

ধৈর্যের পুরস্কার দেখুন, হযরত সালমান ফারসি (রা) আগের বিশপের জোচ্চুরি দেখেই বলতে পারতেন যে তাঁর খৃস্টান ধর্ম দেখা শেষ এবং যা দেখার তিনি দেখে নিয়েছেন এবং এখন বাড়ি যাওয়ার পালা। কিন্তু তিনি নাছোড়বান্দা ছিলেন এবং তার প্রচেষ্টা তাঁকে ফল দিয়েছে। তিনি এমন একজন মানুষের সাথে বাস করতে পারছেন যিনি সৎ এবং ধার্মিক। তিনি [নতুন বিশপ] সারা দিন সারা রাত আল্লাহ তা’য়ালার ইবাদত করতেন। তিনি দুনিয়ার প্রলোভনে লিপ্ত ছিলেন না। তিনি খুবই কঠোর ও সাধারণ লোক ছিলেন।

হযরত সালমান ফারসি (রা) এই লোকের কাছে থেকে অনেক কিছু শিখলেন। কিন্তু এই লোকের বয়স অনেক বেশি ছিল, তিনি মুমূর্ষু অবস্থায় ছিলেন। বিশপ মারা যাওয়ার আগে হযরত সালমান ফারসি (রা) তাকে জানালেন যে, “আমি সত্যের সন্ধানে সিরিয়াতে এসেছিলাম। এসে আপনার আগের বিশপকে পেলাম যে ছিল একজন জোচ্চুর। তারপর আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা’য়ালা আপনাকে আনলেন। আমি আপনার সততা দেখেছি, এখন আমি আপনাকে চাচ্ছি যে, আপনি আমাকে এমন কারো সন্ধান দেন যিনি আপনার মত সৎ ও ধার্মিক; যিনি আপনার মত পথেই রয়েছেন।” বিশপ বললেন, “আমরা যে পথে আছি খুব বেশি লোক পৃথিবীতে আর এরকম পথে নেই। তবে মওসেল একজন বিশপ আছেন, আমি তোমাকে তার দিকে যেতে বলতে পারি।”

হযরত সালমান ফারসি (রা) এখন সিরিয়া থেকে ইরাকে [যেহেতু মওসেল ইরাকে] যাত্রা করলেন। যখন তিনি মওসেলে পৌছুলেন তিনি সেখানকার বিশপের দেখা পেলেন। হযরত সালমান ফারসি (রা) বলেন, “তিনি ছিলেন তাঁর পূর্বসূরীর মতই। একই রকমের সততা, ধর্মভীরুতা, আল্লাহ তা’য়ালার ইবাদতে মশগুল, সরল সাধারণ জীবন।” এই বিশপও বৃদ্ধ ছিলেন এবং হযরত সালমান ফারসি (রা) তার সাথে বেশি দিন সময় কাটাতে পারলেন না। যখন তিনি মারা যাচ্ছিলেন, হযরত সালমান ফারসি (রা) তাকে বললেন, “আমাকে এমন কারো সন্ধান দেন যিনি আপনার মত এরকম সৎ, ধর্মভীরু, সরল সাধারণ।” তিনি উত্তরে সেই আগের বিশপের মতই বললেন, “আমরা যে পথে আছি খুব বেশি লোক পৃথিবীতে আর এরকম পথে নেই। কিন্তু আমি তোমাকে নসীবিনের [সিরিয়াতে অবস্থিত!] বিশপের দিকে তোমাকে দিক নির্দেশনা দিতে পারি।”

তিনি আবার সিরিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। তিনি সেখানে পৌছুলেন এবং সেখানেও একই জিনিষ হল। সেই বিশপ বৃদ্ধ বয়সে মারা গেল। মার যাওয়ার আগে হযরত সালমান ফারসি (রা) তাকে একই প্রশ্ন করলেন। এই সময় সেই বিশপ তাকে এবার রোমান বিজেন্টিয়াম/বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যে [বর্তমান তুরস্ক] যেতে বললেন। তিনি তুরস্কে গেলেন। তিনি আমুরিয়ার বিশপের কাছে গেলেন। হযরত সালমান ফারসি (রা) বলেন, “সেই সময় আমি ব্যাবসা করতে শুরু করি। আমি কিছু টাকা পয়সা যোগাড় করতে সমর্থ হই। আমার সাথে একপাল ভেড়া ছিল। আমি বিশপের সাথে থাকা অবস্থায় কিছু টাকা পয়সা যোগাড় করতে পেরেছিলাম। যখন সেই বিশপ মারা যাচ্ছিল তখন আমি তাকে বললাম, “আমাকে এমন কারও সন্ধান দিন যিনি আপনার মত।” বিশপ এসময় বললেন, “আমি কাউকেই জানি না যে আমি যে পথে আছি সেই একই পথে আছে কিন্তু এইটা এমন একটা সময় যখন আল্লাহ একজন নবীকে পাঠাচ্ছেন, এই সময়টা শেষ নবী আসার সময়। এবং তাঁর নিদর্শন হল-

১] তিনি দান/সাদকা গ্রহণ করেন না

২] তিনি উপঢৌকন গ্রহণ করেন এবং

৩] তুমি তাঁর দুই কাঁধের মাঝে নবুওয়াতের মোহর দেখতে পাবে [যেটা একটা ডিমের মত এবং তা পিঠের উপরাংশে থাকবে]।”

হযরত সালমান ফারসি (রা) জিজ্ঞাসা করলেন, “কোথায় এই নবীকে পাওয়া যাবে?” তাঁকে বলা হল, “আরবে [সেই সময়ে আরব বলতে শুধুমাত্র আরবের উপদ্বীপকে (Arabian Peninsula) বোঝানো হত, যদিও কিছু আরব গোত্র ইরাক, সিরিয়া এবং ফিলিস্তিনে বসবাস করতো]।” তাঁকে বলা হল যে এই নবী মরুভূমির মরুদ্যানে [মরুদ্যান যেখানে খেজুর গাছ আছে] হিজরত করবেন। তিনি (বিশপ) হযরত সালমান ফারসিকে (রা) তিনটা নিদর্শনের পাশাপাশি এই অতিরিক্ত নিদর্শনের কথাও বললেন। তারপর তিনি মারা গেলেন। হযরত সালমান ফারসি (রা) বলেন, “আমি বনি খালব নামের এক আরব গোত্রের সাথে সাক্ষাৎ করলাম এবং আমি তাদের বললাম, আমাকে আপনাদের সাথে আপনাদের দেশে নিয়ে চলেন। আমি আপনাদের এই সব টাকা পয়সা দিয়ে দেব [তুরস্কে থাকাকালীন সময়ে তিনি যত টাকা পয়সা জমিয়েছিলেন তিনি তার সবটুকু দিতে রাজি হলেন বিনিময়ে তাঁকে শুধু আরবে পৌছে দিতে হবে!!]।” তারা রাজি হল, তারা আরবে পৌছে হযরত সালমান ফারসিকে (রা) এক ইহুদির [ওয়াইদুলকুরআ] কাছে দাস হিসেবে বিক্রি করে দিল‍‍!! হযরত সালমান ফারসি (রা) সেই আরব কাফেলাদের দাবিকে খন্ডিত করতে পারলেন না। আর একবার কাউকে দাস হিসেবে বিক্রি করলে সে সারা জীবনের জন্য দাস হয়েই থাকবে [যদিনা কেউ মুক্ত করে]!!

হযরত সালমান ফারসি (রা) বলেন, “যখন আমাকে ওয়াইদুলকুরআর কাছে নিয়ে যাওয়া হল আমি মনে করলাম যে এটা নবীর দেশ কারণ আমি সেখানে অনেক খেজুর গাছ দেখতে পেলাম। আমি সেখানে তার দাস হিসেবে কাজ করা অবস্থায় বনু কুরাইজার এক লোক ওয়াইদুলকুরআর কাছে আসলো এবং আমাকে কিনে নিল এবং সে আমাকে মদিনাতে নিয়ে গেল। যখনই আমি মদিনাতে পৌছলাম তখনই আমি বুঝলাম যে এটাই সেই জায়গা, যে জায়গা সম্পর্কে আমাকে বলা হয়েছিল!!”

এখন হযরত সালমান ফারসি (রা) অপেক্ষা করতে লাগলেন কারণ তাঁকে কোন দিনক্ষণ বলে দেওয়া হয়নি যে কখন সেই নবী আসবেন। তাই তিনি অপেক্ষা করতে লাগলেন।

দেখুন, হযরত সালমান ফারসি (রা) কি অবস্থা!! তাঁর এলাকার এক বিরাট সম্মানীয় অবস্থানে তিনি ছিলেন। সেখান থেকে এক বিদেশভূমিতে তিনি এখন দাস!! কিসের জন্য? সত্য অনুসন্ধানের জন্য!!

হযরত সালমান ফারসি (রা) একদিন খেজুর গাছের উপর উঠে কাজ করছিলেন এবং তাঁর মালিক তাঁর নিচে ছিল। সেই সময় তার ভাতিজা দৌড়ে আসল এবং বলল, “আল্লাহ বনি কায়লাকে [ইহুদিরা আল আওস ও খাযরাযদের বনু কায়লা নামে ডাকতো] মেরে ফেলুন! তারা মদিনা ছেড়ে কুবাতে গিয়েছে এক ব্যক্তিকে স্বাগতম জানাতে যে নিজেকে নবী বলে দাবি করছে।”

হযরত সালমান ফারসি (রা) মদিনাতে ছিলেন, সেই সময়ে রসুলুল্লাহ (স) মক্কাতে ছিলেন কিন্তু তাঁর সে সম্পর্কে কোন ধারণায় ছিল না। তিনি একজন দাস ছিলেন, কোন খবর বা তথ্যই তিনি পাচ্ছিলেন না। আর এখন তিনি একজন লোককে বলতে শুনলেন যে নবী কুবাতে [মদিনার কয়েক কিলোমিটার দূরে] এসেছেন!!

হযরত সালমান ফারসি (রা) বলেন, “আমার শিড়দাড়া ঠাণ্ডা শিহরণ বয়ে গেল! আমি খেজুর গাছ থেকে হোঁচট খেলাম এবং প্রায় আমার মালিকের উপর পড়তেই বসেছিলাম! আমি আমার মালিককে বললাম, আপনার কি বিষয় নিয়ে বলছেন, সেটা কি আরেকবার বলবেন?” হযরত সালমান ফারসি (রা) বলেন, “আমার মালিক আমার দিকে তাকাল এবং আমার মুখে একটা থাপ্পড় মারলো এবং বলল, ‘তোমার এখানে নাক গলানোর কিছু নেই!’” হযরত সালমান ফারসি (রা) বলেন, “আমি ভোর হওয়া পর্যন্ত‌ও অপেক্ষা করতে পারলাম না। আমি কিছু খাবার আমার সাথে নিলাম এবং কুবার উদ্দেশ্য মুহাম্মদের (স) সাথে সাক্ষাতের জন্য যাত্রা করলাম।” তিনি বলেন, “আমি তাঁর কাছে গেলাম। আমি তাঁকে বললাম, “আমি শুনলাম যে, আপনি এবং আপনার সঙ্গীরা অতিথি হিসেবে এখানে এসেছেন এবং আপনি এই এলাকাতে নতুন, তাই সম্ভবত আপনি অভাবের মধ্যে আছেন। আমি আপনার কাছে সদাকা/দান হিসেবে এই খাবারগুলো এনেছি, তাই দয়াকরে কিছু নিন।” রসুলুল্লাহ (স) খাবার গ্রহণ করলেন এবং তিনি সেটা তাঁর সামনে রাখলেন এবং সাহাবীদের (রা) বললেন, “আস এবং খাও।” কিন্তু তিনি তাদের সাথে অংশগ্রহণ করলেন না।” হযরত সালমান ফারসি (রা) বললেন, “এটা ১ নং নিদর্শন।”

তিনি বলেন যে, “আমি ফিরে গেলাম।” তিনি বলেন, “পরের দিন আমি আরও বেশি খাবার নিয়ে গেলাম।” [হযরত সালমান ফারসির (রা) সারাদিন খাটা খাটনির পর সারারাত অপেক্ষা করে কুবাতে খাবার নিয়ে আসা এত সহজ ঘটনা ছিল না। চিন্তা করেন হযরত সালমান ফারসির (রা) আকাঙ্খা কথা, এত বছর অপেক্ষার পর! আর এখন যে লোক নিজেকে নবী বলে দাবি করছেন তিনি তার হাতের গোড়ায়! তিনি এই দিন ও রাতের সময়টুকু অপেক্ষা করছেন তাঁর (স) সাথে আবার দেখা করার!] হযরত সালমান ফারসি (রা) বলেন, “আমি পরবর্তী দিন গেলাম এবং রসুলুল্লাহের (স) সামনে কিছু খাবার প্রদর্শন করলাম এবং বললাম, “গতরাতে আমি আপনার কাছে কিছু খাবার প্রদর্শন করেছিলাম এবং বলেছিলাম যে এটা সদাকা/দান কিন্তু আমি সেটা থেকে আপনাকে কিছু খেতে দেখিনি তাই এখন আমি আপনাকে কিছু খাবার উপঢৌকন হিসেবে দিচ্ছি। কিছু নেন।” তিনি রসুলুল্লাহর (স) সামনে তা রাখলেন, রসুলুল্লাহ (স) সাহাবাদের ডাকলেন এবং বললেন, “আস এবং খাও।” এবং তিনি (স) তাদের সাথে অংশগ্রহণ করলেন।” হযরত সালমান ফারসি (রা) বললেন, “এটা ২ নং নিদর্শন।”

হযরত সালমান ফারসি (রা) বলেন, “এরপর আমি রসুলুল্লাহকে (স) দেখতে আবার আসলাম যখন তারা জানাজায় অংশ নিচ্ছিল এবং আমি রসুলুল্লাহর (স) পিছনে গেলাম। আমি রসুলুল্লাহর (স) ঘাড়ের দিকে দেখছিলাম এবং তার কাপড়ের ফাঁকা জায়গা দিয়ে দেখতে চেষ্টা করছিলাম নবুওয়াতের মোহর দেখার জন্য।” হযরত সালমান ফারসি (রা) বলেন, “রসুলুল্লাহ (স) বুঝতে পেরেছিলেন আমি কি খুজছিলাম। তাই তিনি তাঁর ঘাড় আমার জন্য উন্মুক্ত করলেন।” হযরত সালমান ফারসি (রা) বলেন, “আমি আমার নিজের চোখের সামনেই নবুওয়াতের মোহর দেখতে পেলাম!! আমি নিজের খুশি ধরে রাখতে পারলাম না!! আমি খুশিতে লাফিয়ে উঠলাম এবং রসুলুল্লাহকে (স) আলিঙ্গন করলাম [হযরত সালমান ফারসি (রা) রসুলুল্লাহর (স) পিছনে ছিলেন, তাই তিনি পিছন থেকে রসুলুল্লাহকে (স) জড়িয়ে ধরলেন!]।” রসুলুল্লাহ (স) তাঁকে বললেন, “আমার সামনে এসো।” এবং তিনি রসুলুল্লাহর (স) সামনে বসলেন এবং রসুলুল্লাহ (স) বললেন, “বল তোমার ঘটনা, তুমি কেন এরকম করছো।”

হযরত সালমান ফারসি (রা) হযরত ইবন্‌ আব্বাসকে (রা) বললেন, “আমি তাঁকে (স) আমার বৃত্তান্ত বললাম যেরকম আমি তোমাকে এখন বলছি।” হযরত সালমান ফারসি (রা) বলেন, “রসুলুল্লাহ (স) বললেন, “দাসত্ব থেকে নিজেকে মুক্ত কর।”” হযরত সালমান ফারসি (রা) তার মালিকের কাছে গেলেন এবং বললেন, “আমি দাসত্ব হতে মুক্ত হতে চাই।” তাঁর মালিক বলল, “তুমি আমাকে ৩০০ টি খেজুর গাছ ও ৪০ আউন্স (এখনকার হিসেবে প্রায়) স্বর্ণ প্রদান কর।” হযরত সালমান ফারসি (রা) রসুলুল্লাহর (স) কাছে আসলেন এবং বললেন, “সে ৩০০ টি খেজুর গাছ ও ৪০ আউন্স (এখনকার হিসেবে প্রায়) স্বর্ণ চায়।” রসুলুল্লাহ (স) সাহাবাদের বললেন, “তোমাদের ভাইকে সাহায্য কর।” হযরত সালমান ফারসি (রা) বলেন, “রসুলুল্লাহর (স) সাহাবারা কেউ ৩০টা কেউ ২০টা কেউ ১০টা যার যেরকম সামর্থ্য সে অনুযায়ী আমার কাছে খেজুর গাছের চারা আনলো যতক্ষণ পর্যন্ত না আমার কাছে ৩০০ টা খেজুর গাছের চারা হল। কিন্তু মালিক আমার কাছে খেজুর গাছের চারা চাইনি বরং পূর্নাঙ্গ খেজুর গাছ চেয়েছে।” রসুলুল্লাহ (স) হযরত সালমান ফারসিকে (রা) বললেন, “যখন তুমি ৩০০টা খেজুর গাছের চারা যোগাড় করবে তখন এটা নিজে বপন করবে না আমাকে জানাবে।” হযরত সালমান ফারসি (রা) রসুলুল্লাহর (স) কাছে গেলেন এবং জানালেন যে তাঁর ৩০০ টা খেজুর গাছের চারা হয়ে গেছে। তখন রসুলুল্লাহ (স) বললেন, “যাও এবং গর্ত খুড়। নিজে বপন করো না।” তারপর হযরত সালমান ফারসি (রা) ৩০০ টি গর্ত খুড়লেন এবং রসুলুল্লাহ (স) নিজে তাঁর হাত দিয়ে খেজুর গাছ বপন করলেন। হযরত সালমান ফারসি (রা) বলেন, “একটা গাছও মারা যায় নি।” তাঁর হাতের বরকতের কারনে একটা গাছও মারা যায়নি!! খেজুর গাছগুলো যখন একটু বড় হল তার মালিক তাতে খুশি হল এবং এখন সময় হল ৪০ আউন্স স্বর্ণের। হযরত সালমান ফারসি (রা) রসুলুল্লাহর (স) কাছে গেলেন এবং বললেন যে তার এখন স্বর্ণের দরকার। রসুলুল্লাহকে (স) এক সময় কেউ একজন স্বর্ণ উপহার দিয়েছিল এবং এটা ছিল ছোট্ট একটা ডিমের মত। তিনি সাহাবাদের বললেন, “তোমাদের পারস্যের ভাইকে খবর দাও।” তারপর হযরত সালমান ফারসি (রা) আসলে তিনি (স) তাঁকে স্বর্ণ দিলেন এবং বললেন তার মালিককে এটা দিতে। হযরত সালমান ফারসির (রা) চোখে স্বর্ণটি খুবই ছোট মনে হল, তিনি রসুলুল্লাহকে (স) বললেন, যে এটা দিয়ে কি তার প্রয়োজন মিটবে কিনা। রসুলুল্লাহ (স) তাঁকে আশস্ত করলেন। তাঁর মালিককে যখন এটা দিলেন, এটা এক্কেবারে ৪০ আউন্সই হয়েছিল!!

হযরত সালমান ফারসি (রা) বলেন, “আমি নিজেকে মুক্ত করলাম। দাসত্বের কারণে আমি বদর ও ওহুদের যুদ্ধ মিস করেছিলাম এবং আমি রসুলুল্লাহে (স) সাথে শুধুমাত্র খন্দকের যুদ্ধে [খন্দকের যুদ্ধে যে খন্দ খোড়া হয় সে হযরত সালমান ফারসির (রা) উপদেশেই এবং সেটা কতটা কার্যকর ছিল সেটা খন্দক যুদ্ধের ইতিহাস না পড়লে বোঝায় সম্ভব নয়, সেই সময় মুসলিমরা যে কি বিপদের মধ্যে ছিল সেটা কল্পনাও করা যাবেনা।] অংশ নিতে পেরেছিলাম।”

এটাই হযরত সালমান ফারসির (রা) ঘটনা যেটা তিনি নিজ মুখে হযরত আবদুল্লাহ ইবন্‌ আব্বাসকে (রা) বলেছেন।

হযরত সালমান ফারসির (রা) ঘটনা থেকে আমরা কতগুলো শিক্ষা নিতে পারিঃ

যে হিদায়াতের জন্য খোজ করবে আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা’য়ালা তাকে পথ প্রদর্শন করবেন। যারা sincerely আল্লাহর পথে আসার জন্য চেষ্টা করবে আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা’য়ালা তাদেরকে পথ প্রদর্শন করবেন। হাদিসে কুদসীর মধ্যে আছে, আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা’য়ালা বলেন, “যদি তুমি আমার দিকে হেটে আস, আমি তোমার দিকে দৌড়ে আসব; যদি তুমি আমার দিকে এক কদম অগ্রসর হও, আমি তোমার দিকে কয়েক কদম অগ্রসর হব।” কিন্তু আমাদের প্রথম পদক্ষেপটা নিতে হবে, প্রথম স্টেপটা আমাদেরই নিতে হবে।

হযরত সালমান ফারসি (রা) সত্য পথের জন্য তিনি তাঁর পরিবার, তাঁর ধর্ম, তাঁর স্ট্যাটাস, তাঁর সংস্কৃতি, তাঁর সম্পদ সবকিছু ত্যাগ করেছিলেন। সত্য খোঁজের কারণে তিনি বিশাল সম্মানীয় ব্যক্তি [আগুনের রক্ষাকর্তা] থেকে দাসে [ইহুদির] পরিণত হয়েছিলেন!! কিন্তু তিনি সত্য অনুসন্ধান থেকে পিছপা হননি!! তার ফলে কি পেলেন তিনি? গাইডেন্স, হিদায়াত, সঠিক পথ – দুনিয়া ও আখিরাতের জন্য। আর বোনাস কি পেলেন? যখন উমার ইবন্‌ আল-খাত্তাবের (রা) খিলাফতকালে মুসলিমরা পারস্য [আল-ক্বদিসিয়া ও নাহওয়ান্দ জয়ের পর] জয় করলো তখন হযরত উমার ইবনুল খাত্তাব (রা), হযরত সালমান ফারসিকে (রা) পারস্যের রাজধানী আল-মাদা'য়িনের গভর্ণর হিসেবে প্রেরণ করেন!! দেখুন অবস্থা, হযরত সালমান ফারসিকে (রা) যদি ইসলামের পথে না আসতেন তাহলে দুনিয়াতে তিনি কি পেতেন? সর্বোচ্চ তার গ্রাম বা জেলার প্রধানের দায়িত্ব, সেটার কর্তাব্যক্তিত্ব! আর ইসলামের কারণে তিনি পেলেন পারস্যের গভর্ণরের দায়িত্ব!!!! ইসলাম এভাবেই মানুষকে বড় করে!! দুনিয়াতে এটাই মহান রব্বুল আ’লামীনের পুরস্কার আর আখিরাতের, সেটাতো কেবল তিনিই জানেন।

বিষয়: বিবিধ

৩০৩৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File