ইসলামাবাদের ডায়েরী-১

লিখেছেন লিখেছেন আহমাদ ফিসাবিলিল্লাহ ১৯ নভেম্বর, ২০১৩, ১০:৩৫:৪১ রাত

ড. ফযলে ইলাহী যহীর সকাশে :



বৃষ্টিভেজা ইসলামাবাদ শহরের একটি রাস্তা

৩০ সেপ্টেম্বর’১৩ রাত ৯-টায় ইসলামাবাদ এসে পৌঁছেছি। ইতিমধ্যে চোখের পলকে এক মাস পার হয়ে গেল। আসার আগে বেশ কিছু প্লান করে রেখেছিলাম। যার মধ্যে অন্যতম ছিল পাকিস্তানের সাবেক আপোষহীন অনলবর্ষী বাগ্মী আহলেহাদীছ নেতা আল্লামা ইহসান ইলাহী যহীরের ছোট ভাই এবং রিয়াযের মুহাম্মাদ বিন সঊদ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের হাদীছ বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও বিশিষ্ট সালাফী বিদ্বান আল্লামা ড. ফযলে এলাহী যহীরের সাথে সাক্ষাৎ করা। জানতাম তিনি ইসলামাবাদেই থাকেন। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি সংক্রান্ত কাজের লম্বা ফিরিস্তি কোনভাবেই ফুরসৎ দিচ্ছিল না যে কোন এক ফাঁকে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করে আসব। মাঝখানে বালুচিস্তনের রাজধানী কোয়েটাতে ১০দিনের লম্বা সফরটাও বেশ সময় সংকটে ফেলে দিয়েছে। যাইহোক ইসলামাবাদে পৌঁছার ঠিক এক মাস পর গত ১ নভেম্বর অনেকটা অপরিকল্পিতভাবেই সাক্ষাৎ হয়ে গেল শায়খের সাথে। আগের দিনই ভাবছিলাম গত তিনটি জুম‘আ ফয়সাল মসজিদে পড়লাম কাল কোন আহলেহাদীছ মসজিদে যেতে হবে। ভাবাভাবি শেষ না হতেই আব্দুল বাছীর ভাইয়ের ফোন। ইসলামাবাদে স্বল্প সময়ে খুব কাছের বন্ধুতে পরিণত হওয়া ৩০/৩২ বছর বয়সী এই ভাই বললেন, ‘কাল জি-১১/৩-এ মিনারুল হুদা মসজিদে ছালাত আদায় করবেন? ড. ফযলে এলাহী যহীর আজ খুৎবা দিবেন। যদি যান তাহলে আমিও যাব, যাওয়ার সময় আমার গাড়িতে আপনাকে তুলে নেব হোস্টেল থেকে’। আমি সাথে সাথেই রাজি হয়ে গেলাম। এই আব্দুল বাছীর ভাই একজন পশতুন বালুচ এবং কনভার্টেড আহলেহাদীছ। কোয়েটার মরুময় পিশিন ভ্যালিতে তাঁর পৈত্রিক নিবাস। ইসলামাবাদ শহরে তারা সপরিবারে বসবাস করছেন গত ১৫ বছর ধরে। ৮ ভাইবোনের বিরাট ফ্যামিলিসহ বাবা-মায়ের সাথে থাকেন আমার ইউনিভার্সিটির নিকটবর্তী আই-১০ এলাকায়। দেশে থাকতেই লন্ডনের নাজমুল ভাইয়ের মাধ্যমে তার সাথে আমার পরিচয়। যাইহোক জুম‘আর আগে কোন কাজে আটকে গিয়ে দেরী হওয়ায় উনি আমার হোস্টেলে আর আসতে পারলেন না। তাই ঠিকানা দিয়ে দিলেন মিনারুল হুদা মসজিদের। কিন্তু হাতে পর্যাপ্ত সময় না থাকায় শেষ পর্যন্ত তাহের ভাইয়ের সাথে ফয়ছাল মসজিদে রওনা দিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়িতে। এই তাহের ভাই বর্তমানে আমাদের ইউনিভার্সিটির উছূলুদ্দীন ফ্যাকাল্টির ভিজিটিং লেকচারার এবং একই সাথে হাদীছ বিভাগে পিএইচ.ডি গবেষণারত। ফয়সালাবাদের এই আহলেহাদীছ ভাইটি দারুণ মেধাবী ও রসিক মানুষ। একটু পাগলাটে স্বভাবেরও বটে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি মাত্র ৫টি সাব্জেক্টে মাস্টার্স করে ফেলেছেন। মাস্টার্সের নেশা টুটে যাওয়ার পর এখন পিএইচডি শুরু করছেন। তবে এখনও সময় সুযোগ বুঝে বিভিন্ন সার্টিফিকেট কোর্সে অংশগ্রহণ করেন। এর সংখ্যাটাও আপাতত দাঁড়িয়েছে ডজনখানেকেরও বেশী। ফলে তাঁর লম্বা সিভির পৃষ্ঠা সংখ্যা ইতিমধ্যে পঞ্চম পেজে গিয়ে ঠেকেছে। এতকিছু অর্জনের পরও তার একটু আক্ষেপ এই কারণে যে, অনেকেই তাঁকে ‘ডিগ্রি বাবা’ বলে ডাকে। এই লকবটা আদতে প্রশংসাসূচক হলেও কোন দুর্বোধ্য কারণে তাঁর কাছে দারুণ অপছন্দের। তবে মুখ ফুটে বলতে পারেন না... :D/ :D/ জেনারেল মিডিয়ামের ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও ইংরেজীর সাথে আরবী ভাষাতেও মানুষটার দক্ষতা রীতিমত চোখ উল্টে দেয়ার মত।



ফয়সাল মসজিদের একটি মনোরম দৃশ্য

যাইহোক ফয়সাল মসজিদে সেদিন খুৎবা দিচ্ছিলেন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. আহমাদ বিন ইউসুফ আদ-দারাভীশ। সঊদী আরবের ইমাম মুহাম্মাদ বিন সঊদ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ডেপুটি রেক্টর হিসাবে দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় গত বছরের শেষের দিকে তিনি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাঁকে তাঁর চেহারা এবং নামের কারণে প্রথমে পাকিস্তানীই মনে করেছিলাম। তবে এক সেমিনারে তাঁকে চমৎকার উচ্চারণে আরবীতে বক্তব্য রাখতে দেখে সন্দেহ হলে একজনকে জিজ্ঞাসা করে জেনেছিলাম তিনি আরব। আজও এখানে আরবীতেই খুৎবা দিলেন। কিন্তু খুৎবা সম্পূর্ণ লিখিত হওয়ায় অনেকটা আকর্ষণহীন ছিল। ছালাত আদায়ের পর তাহের ভাইয়ের সাথে মসজিদ ক্যান্টিনে লাঞ্চ করে বিদায় নিলাম। পাশেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ওল্ড হোস্টেল’ নামে পরিচিত কুয়েত হোস্টেল। সেখানে গেলাম হাবীব ভাইয়ের রুমে আমার রেখে আসা কিছু বই নেয়ার জন্য। এ সময় আব্দুল বাছীর ভাই ফোন দিলেন। কুয়েত হোস্টেলে আছি শুনে বললেন সেখানেই অপেক্ষা করতে। ১০ মিনিটের মধ্যে উনি উনার ছাইরঙা চকচকে টয়োটা কারটি নিয়ে হাজির। বললেন আজ আপনাকে আহলেহাদীছ মসজিদগুলো সব দেখাব।

ইসলামাবাদ শহরে প্রায় ১৫টি আহলেহাদীছ মসজিদ আছে। কেবল জি এরিয়াতেই আছে ৫টি বড় মসজিদ (উল্লেখ্য, জি এরিয়া ইসলামাবাদের অন্যতম অভিজাত এলাকা)। প্রথমেই মিনারুল হুদা মসজিদ নিয়ে গেলেন। সেখানে আছর পড়ে অন্যান্য মসজিদগুলো দেখার জন্য বের হলাম। জি-১১ মারকায মোড় অতিক্রমের সময় একেবারে ফ্রন্টেই দেখলাম ড. ফযলে এলাহীর দোতলা বাড়ীটি। সেখান থেকে বেশ কিছুটা দূরে ‘মারকাযুদ দাওয়াহ’ পরিচালিত নির্মীয়মাণ বিশাল দোতলা মসজিদ এবং ড. ফযলে এলাহী যহীর পরিচালিত আরেকটি বৃহদাকার দোতলা মসজিদ দেখলাম। জি-১০/৪-এ এসে আরো একটি দোতলা আহলেহাদীছ মসজিদের দেখা পেলাম। মুছল্লীরা তখন আছর পড়ে বের হচ্ছে। এটি তুলনামূলক পুরোনো। এরপর আমরা জি এরিয়া থেকে বের হয়ে রওনা হলাম ব্লু এরিয়া তথা পার্লামেন্ট রোডের দিকে। এই রোডেই অবস্থিত ইসলামাবাদের প্রসিদ্ধ হোটেল 'সেভার ফুডস’। আগেও একবার এসেছিলাম। এখানে এসে আবার লাঞ্চ করতে হল বাছীর ভাইয়ের জোরাজুরিতে বাধ্য হয়ে। লাঞ্চের পর অনেকটা পথ ঘুরে এফ-৮ আসলাম সুপ্রসিদ্ধ দারুস সালাম লাইব্রেরীতে বই কেনার জন্য। অল্প সময়ে আমার প্রয়োজনীয় কয়েকটি বই পেয়ে খুব ভাল লাগল। তারপর তাড়াহুড়া করে রওনা দিলাম ড. ফজলে এলাহীর দারস ধরার জন্য। মিনারুল হুদা মসজিদে পৌছে দেখি শায়খ ততক্ষণে দারস শুরু করে দিয়েছেন। আমরা দু’জন মসজিদের বারান্দায় মাগরিব ছালাতের পর দারসে বসলাম। হালকা-পাতলা গড়নের মানুষ। অনেকটা লম্বা। বাকচারিতায় রাশভারিত্বের সাথে প্রগাঢ় আন্তরিকতার মিশেল। দেখে অনেকটা প্রবীণ বাঙালীদের মতই লাগে। বয়স ৬৫/৬৬-এর বেশী হওয়ার কথা নয়। তবে শরীর ও চেহারায় বয়সের ছাপ সুস্পষ্ট। বুলুগুল মারামের দারস দিচ্ছিলেন। উর্দূ ভাষা ততটা রপ্ত করতে না পারলেও সারাংশটি বুঝতে পারলাম। দারসের পর উনার সাথে সেই কাংক্ষিত সাক্ষাতপর্বটি হল। পরিচয় পেয়ে জড়িয়ে ধরলেন। বেশ কিছুক্ষণ কথা হল। আববার কথা জানতে চাইলেন। উনার রিয়াদের বাসায় আববার যাওয়ার কথা স্মরণ করলেন। তারপর আমার ইউনিভার্সিটির খোঁজ-খবর নিলেন এবং কিছু উপদেশ দিলেন। আর দারসে আসতে বললেন মাঝে মাঝে। তারপর তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে আসলাম।

আসার সময় গল্পের ফাঁকে যে বাছীর ভাই গাড়ি ভুলক্রমে আমার পুরনো হোস্টেল ‘কুয়েত হল’-এ নিয়ে হাজির হয়েছেন তা খেয়াল করিনি। ভাগ্যক্রমে সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়িটা পেয়ে গেলাম। তাই বাছীর ভাইকে আর কষ্ট না দিয়ে ওটাতেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসলাম।

পরবর্তী শুক্রবার তথা ৮ নভেম্বর জুম‘আ পড়ার জন্য গেলাম ‘মিনারুল হুদা’ মসজিদে। সঙ্গী ছিলেন তাহের ভাই ও তাঁর একজন কনভার্ট আহলেহাদীছ বন্ধু। আব্দুল বাছীর ভাইও আসলেন আমরা পৌঁছানোর কিছুক্ষণ পর। যথারীতি শায়খ খুৎবা দিতে উঠলেন ঠিক ১টার সময়। দেড়টা পর্যন্ত আধাঘণ্টা খুৎবা হল। বিষয়বস্ত্ত ‘অপচয়কারীর শাস্তি’। বক্তব্যের ধারা শান্ত ও ধীরগতিসম্পন্ন হলেও খুব তাক্বওয়াপূর্ণ ও হৃদয়গ্রাহী ছিল। প্রতিটি কথাতেই যেন তিনি আবেগভরা কণ্ঠে শ্রোতাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাইছিলেন। তবে হতাশ হলাম মুছল্লীদের সংখ্যা দেখে। হয়ত শহরাঞ্চলে আহলেহাদীছ জনবসতির অপ্রতুলতার কারণেই। অবশ্য ইসলামাবাদ খুব পরিকল্পিত শহর বলে এখানে সাধারণত সরকারী-বেসরকারী চাকুরিজীবীরাই বসবাস করে। ফলে জনবসতির হার এমনিতেই অনেক কম। অন্যদিকে শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন নয় এখানে। ফলে সবার পক্ষে হয়ত কাংখিত মসজিদে উপস্থিত হওয়া সম্ভবও হয় না। ছালাতের পর প্রথমে ছোট ছোট শিশুরা শায়খের পাশে ভিড় করে সালাম করা শুরু করল। তাদের সাথে শায়খের হাসিখুশি অন্তরঙ্গ মোলাকাতের দৃশ্যটা খুব ভাল লাগল। অনেক পিতাই এসেছেন সন্তানদের নিয়ে শায়খের কাছ থেকে দো‘আ নেয়ার জন্য। পাকিস্তানীদের মোলাকাতপর্বটা হয় খুব আন্তরিকতাপূর্ণ। সাক্ষাৎ হলেই বিশেষ স্টাইলে কোলাকুলি করে ‘কিয়া হাল’, ‘সাব ঠকঠাক হ্যায়’, ‘খায়রিয়াত হ্যায়’, ‘তবীয়ত ঠিক হ্যায়’ করতে করতে এদের বেশ খানিকটা সময় চলে যায়। একটু সময়সাপেক্ষ ব্যাপার হলেও আমার কাছে এই দৃশ্যটা খুব চমৎকার লাগে। শায়খ উঠে দাঁড়িয়ে মুরুববী, নওজোয়ানদের সাথে এভাবেই মোলাকাত করছিলেন। আমি সামনে যেতেই ‘কাইফাল হাল বেটা’ বলে আলিঙ্গন করে উর্দূ ছেড়ে আরবীতে কথা বলা শুরু করলেন, আববার কথা জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন। আমি অবাকই হলাম। গত সপ্তাহে অল্পক্ষণই কথাবার্তা হয়েছিল। তাতেও তিনি ভীড়ের মধ্যে চিনতে ভুল করেননি। বুঝতে পারলাম বার্ধক্যের কাছে শারীরিকভাবে অবনত হয়ে পড়লেও স্মৃতিশক্তি তাঁর পূর্ণ সচল। চোখের দিকে তাঁকালেই দৃষ্টির সেই তীক্ষ্ণতা আর মেধার স্ফূরণ টের পাওয়া যায়। প্রথম দেখায় বেশ রাগী ও রাশভারী মানুষ মনে হলেও ভুলটা ভেঙ্গে যায় যখন দেখলাম সাধারণ এক ব্যক্তির টাখনুর নিচে নেমে যাওয়া পায়জামা নিজ হাতে যত্নের সাথে তুলে দিচ্ছেন আর হাসিমুখে তার ভুলটা ধরিয়ে দিচ্ছেন। শরী‘আতগর্হিত কোন কাজ দেখলে কোনরূপ দেরী না করে তার প্রতিকারে নেমে পড়াই যে তার চরিত্র, তা বুঝতে বাকি রইল না। এই তাক্বওয়া-পরহেযগারিতার কারণেই বুঝি তিনি সবার কাছে এত শ্রদ্ধার পাত্র হয়েছেন এবং সর্বশ্রেণীর একান্ত অভিভাবকে পরিণত হয়েছেন। আগন্তুক সেই ব্যক্তিটির চেহারা বলে দিচ্ছিল সবার সামনে এমন কাজে বিব্রত হওয়ার পরিবর্তে সে নিজেকে পরম সৌভাগ্যবানই মনে করছে।

ভীড় কমে এলে আমি উনার কাছে গিয়ে আমাদের পত্রিকার কথা বললাম এবং পত্রিকার জন্য তাঁর একটি সাক্ষাৎকার নিতে চাইলাম। তিনি একটু ভাবছিলেন। তখন তাহের ভাই পার্শ্ব থেকে হঠাৎ বলে ফেললেন, কেবল ‘ইন্টারভিউ’, অন্য কিছু নয়। তিনি সাথে সাথে গররাজি হয়ে পড়লেন। বললেন, ‘দেখ ‘ইন্টারভিউ’ দেয়ার লোক অনেকেই আছে। আমার কাছ থেকে এসব নিও না। আত্মপ্রচার আমার পছন্দ নয়’। ‘ইন্টারভিউ’ শব্দটাতেই উনি একটু ভুল বুঝলেন। তাহের ভাইয়ের প্রতি বিরক্ত হলাম। ভাবছিলাম আরেকটু চাপ দিয়ে আবার বলি। কিন্তু তাঁর অনড় অবস্থান দেখে মনে হল, থাক পরে আরেকদিন চেষ্টা করা যাবে। অন্য প্রসঙ্গে যেয়ে তাঁর বই-পত্র সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম এবং জানালাম আমাদের বাসায় ওনার কয়েকটি বই আছে। উনি বললেন, ‘শুনেছি আমার কিছু বই নাকি বাংলায় প্রকাশ পেয়েছে?’ বললাম ‘হ্যা, সম্ভবত রাবওয়া ইসলামী সেন্টার, রিয়ায থেকে প্রকাশিত হয়েছে’। বললেন, ‘রাবওয়া সেন্টার তো মাশহুর, কিন্তু অন্য কোন প্রকাশনী বের করেছে কি না?’ বললাম, ‘ঠিক জানি না। তবে খোঁজ নিয়ে দেখব’। তিনি বললেন, ‘যে প্রকাশনীই বের করুক না কেন, আমার অনুমতি নিতে হবে। এর জন্য রয়েলটি দিতে হবে তা নয়, কিন্তু কমপক্ষে অনুমতি তো নিতে হবে!’ তারপর বললেন, ‘সবার আগে পড়াশোনা, তারপর অন্যকিছু। পড়াশোনা আগে মনোযোগ দিয়ে শেষ করে নাও, তারপর যা করার করবে’। অনেক দো‘আ করলেন। শেষে আববাকে সালাম দেয়ার জন্য বিশেষভাবে আবার বললেন। আগের দিন বার বার বলছিলেন, ‘হুয়া আলেমুন মুহতারামুন ওয়া মুকাররামুন ইনদানা’।

বিদায়ের সময় ঘটল এক মজার কান্ড। এক ব্যক্তি এসে উনাকে সালাম করতেই তিনি হাসতে হাসতে আমাকে দেখিয়ে দিয়ে বললেন, ‘হুয়া মিন তাখাছছুছিকা’। আমি তো অবাক। লোকটি এসে পরিচয় দিয়ে বললেন, ‘আমি সঊদী নাগরিক। তবে গত ৩ বছর থেকে আমি ও আমার স্ত্রী পাকিস্তানে থাকছি। উদ্দেশ্য বাংলা শেখা। আমি সঊদী হজ্জ মন্ত্রণালয়ে চাকুরী করি। বাঙালী হাজীদের জন্য আমাকে বাংলা শিখতে পাঠানো হয়েছে। আমি এখানে ‘ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ মডার্ন ল্যাংগুয়েজে’ বাংলা বিভাগে অনার্স করছি। আর আমার স্ত্রী ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটিতে ইংলিশে পড়ছে’। সব শুনে আমার তো হতবিহবল অবস্থা। আবার জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি বাংলা শিখছেন? উনি আমার জিজ্ঞাসার ধরন দেখে হাসতে হাসতে বললেন, কেন বিশ্বাস হয় না? এবার অদ্ভুত উচ্চারণে শুরু করলেন, ‘আমাল নোম মহসিন’, আ-মি বানলা ছিখছি’। আমি তো তখন হাসব না কাঁদব এমন অবস্থায়। শায়খ তখনও মসজিদে ছিলেন। আমার অবস্থা দেখে তিনিও হাসতে লাগলেন। বললেন, ‘সমস্যা নেই তুমি বাংলায় কথা বল, উনি উত্তর দেবেন’। তারপর বাংলায় দু’চারটা প্রশ্ন করে ঠিক ঠিক উত্তর পেলাম। কিন্তু তাঁর উচ্চারণ ভঙ্গি এতই হাস্যকর যে আমার হাসতে হাসতে পেট ফেটে যাওয়ার দশা। আমার আহলেহাদীছ পরিচয় পেয়ে তো আরো খুশী। উনি বলতে লাগলেন, আপনি বাংলাদেশের মানুষ, আরবী জানেন এবং সালাফীও। অতএব আপনার কাছেই আমি বাংলা শিখব। কোথায় থাকেন আপনি, আপনার মোবাইল নাম্বার দেন...ইত্যাদি। তারপর আমাদের আপত্তি সত্ত্বেও উনার নিজের গাড়িতে আমাদেরকে বিশ্ববিদ্যালয় পৌঁছে দিলেন। ২০ মিনিটের এটুকু পথ আসতেই এত গল্পের ডালি খুলে দিলেন যেন তিনি আমাদের কতদিনের বন্ধু। পরিশেষে তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রুমে ফিরে আসলাম। শুয়ে শুয়ে পেপারটা দেখতে দেখতে ভাবছিলাম, নানান দেশের নানান কিসিমের কত মানুষই না দেখছি! আচার-সংস্কৃতি, চেহারা-ছুরতে পরস্পরের মধ্যে কত ভিন্নতা! অথচ আমাদের প্রত্যেকের ভিতরের মানুষটা যেন সেই একটাই। দিন শেষে প্রত্যেকের মাঝেই তাই বার বার খুঁজে পাই সেই সহজ-সরল প্রাকৃতিক মানুষটাকেই, এক নসলে জন্ম নেয়া সেই আদম সন্তানটাকেই।

বিষয়: বিবিধ

১৭৫২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File