ইসলামের পরশে ধন্য হলেন লরেন বুথ

লিখেছেন লিখেছেন আহমাদ ফিসাবিলিল্লাহ ৩০ মার্চ, ২০১৩, ১০:৩৭:৫৪ সকাল



[ইংল্যাণ্ডে প্রতি বছর প্রায় ৫ সহস্রাধিক খৃষ্টান ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় বিগত ২০১০ সালে প্রাক্তন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের শ্যালিকা প্রখ্যাত সমাজকর্মী ও ফিলিস্তীন স্বাধীনতা আন্দোলনের কর্মী লরেন বুথ ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁর জন্ম বৃটেনের লণ্ডন শহরে ১৯৬৭ সালে। তাঁর পিতা টনি বুথ ছিলেন একজন ইহুদী এবং পেশায় টিভি অভিনেতা। সাবেক বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের স্ত্রী চেরী ব্লেয়ারের বৈমাত্রেয় বোন তিনি। পেশায় সাংবাদিক। বর্তমানে লণ্ডনভিত্তিক ইরানী টিভি চ্যানেল প্রেস টিভিতে কর্মরত রয়েছেন। তিনি ২ সন্তানের জননী। ২০০৫ ও ২০০৬ সালে তিনি সাংবাদিক হিসাবে পশ্চিম তীর সফর করেন এবং ফিলিস্তীনী প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। এরপরও তিনি পেশাগত দায়িত্বপালনে বার বার ফিলিস্তীনে ছুটে গেছেন। ২০০৮ সালে ফিলিস্তীনী প্রধানমন্ত্রী ইসমাঈল হানিয়া তাঁকে বিশেষ সম্মানসূচক ভিআইপি পাসপোর্ট প্রদান করেন। তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন ২০১০ সালের সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে। অতঃপর ২৩ অক্টোবর’১০ তিনি একটি সম্মেলনে হিজাব পরিধান করে উপস্থিত হন এবং আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেন। তাঁর এই ঘোষণা তখন সারা বিশ্বে বেশ সাড়া ফেলে। ইসলাম গ্রহণের পর তিনি তাঁর মুসলিম হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে নিম্নোক্ত বক্তব্যটি প্রদান করেন।]

অনুবাদ : হাসীবুল ইসলাম

সম্পাদনা : আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব




এটা আমার জীবনের সবচেয়ে অদ্ভুত এক সফর। যার বাহন উঞ্চতায় ভরা আর সহযাত্রীরা অপ্রত্যাশিতভাবে বন্ধুসুলভ। কোন রকমের বিলম্ব ছাড়াই আমরা খুব দ্রুত এগিয়ে চলেছি। বৃষ্টি, তুষারপাত, রেলক্রসিং কোন কিছুই আমাদের অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারছে না। যদিও এখনও পর্যন্ত আমার কোন ধারণাই নেই যে, আমি কিভাবে এর আরোহী হলাম, না আমার কোনরূপ ধারণা আছে যে, ট্রেনের গন্তব্য কোথায়। তবে গন্তব্য যেটাই হোক না কেন সেটা যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোন স্থান, তা আমি অনুমান করতে পারছি।

আমি জানি আমার এসব কথা-বার্তা আপনাদের কাছে ভীষণভাবে অস্বাভাবিক মনে হবে। কিন্তু গত সপ্তাহে আমার ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়া প্রসঙ্গে আমার অনুভূতি সত্যিই এমন।

যদিও যেসব কারণ ও ঘটনাবলী আমাকে এ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে, তা রহস্যাবৃতই, তবে আমার এই সিদ্ধান্ত আমার ভবিষ্যত জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রকে এমন কঠিনভাবে নির্ধারিত করবে, যেমন রেলপথ যুগল দ্রুতগামী ট্রেনের নীচে দৃঢ়তার সাথে অবস্থান করে।

আমি একজন ফ্রীল্যান্স ইংরেজ সাংবাদিক এবং একজন সিঙ্গেল কর্মরত মা হয়ে পশ্চিমা মিডিয়ার সবচেয়ে কম জনপ্রিয় একটা ধর্মকে কিভাবে আঁকড়ে ধরলাম-এ প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে আমার মনে হয়, মাত্র মাসাধিককাল পূর্বে আমি যে এক ইরানী মসজিদে গভীর আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলাম, তার প্রতি ইঙ্গিত করতে হয়।

তবে বিষয়টি আরো বোধগম্য হবে যদি আমি ২০০৫ সালের জানুয়ারিতে ফিরে যাই। সেসময় আমি পশ্চীম তীরে রবিবারের ঞযব গধরষ পত্রিকার জন্য একটি নির্বাচনের সংবাদ কাভার করতে একাকী উপস্থিত হয়েছিলাম। বলে রাখা ভাল, ঐ সফরের পূর্বে আমার কখনো কোন আরব বা কোন মুসলিমের সাথে সময় কাটানোর অভিজ্ঞতা ছিল না।

সুতরাং পুরো অভিজ্ঞতাটি ছিল আমার জন্য অপ্রত্যাশিত। তবে সেসব কারণে নয়, যা আমার ধারণা করার কথা ছিল। আসলে আমরা যতখানি জানি পৃথিবীর এই অংশের মানুষ সম্পর্কে, যারা নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে অনুসরণ করে, তা মূলতঃ এক অস্বাভাবিক ধারণার ফসল। বরং বলা যায় পক্ষপাতদুষ্ট সংবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত।

তাই আমি যখন মধ্যপ্রাচ্যের দিকে উড়াল দিলাম, তখন ভ্রমণ গাইডে মনোযোগ দেয়ার পরিবর্তে আমার মনে রাত ১০টার বকওয়াজ গুঞ্জনের মত অধিকতরভাবে ভন ভন করছে- চরমপন্থী মৌলবাদী, ধর্মান্ধ, বাধ্যগত বিবাহ, আত্মঘাতি বোমারু, জিহাদ ইত্যাদি শব্দগুলো। যদিও আমার প্রথম অভিজ্ঞতাটি এর চেয়ে বেশি ইতিবাচক হতে পারত না।

আমি যখন ফিলিস্তীনের পশ্চিম তীরে পৌঁছাই তখন পরনে শীতের কোটটি ছিল না। কেননা ইসরাঈলী বিমান বন্দর কর্তৃপক্ষ আমার সুটকেসটি তাদের হেফাযতে রেখে দিয়েছিল।

রামাল্লার কেন্দ্রস্থলের কাছে হাঁটাহাঁটির সময় আমি শীতে জবুথবু হয়ে থরথর করে কাঁপছিলাম। তখন এক বৃদ্ধা এসে আমার হাত চেপে ধরলেন। আরবীতে দ্রুত কিছু কথা বলে, তিনি আমাকে একটি পার্শ্বের রাস্তার ধারে একটি বাড়ীতে নিয়ে গেলেন। আমি ভাবছিলাম, আমি কি একজন বৃদ্ধা জঙ্গীর হাতে কিডনাপ্ড হচ্ছি? বিব্রতকর কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর দেখলাম, তিনি তাঁর মেয়ের ওয়ারড্রোব থেকে একটি কোট, একটি হ্যাট এবং একটি চাদর বের করে নিয়ে আসলেন।

তারপর যেখানে আমি হাঁটাহাঁটি করছিলাম, সে রাস্তায় ফিরিয়ে নিয়ে এসে একটি চুমু দিয়ে তিনি আমাকে খুব উষ্ণতার সাথে আমার গন্তব্যের পথে ছেড়ে দিলেন। অথচ আমাদের দু’জনের মাঝে একটি বোধগম্য কথাও বিনিময় হয়নি।

এই উদারতার কথা আমি কখনোই ভুলিনি এবং এ কথা বিভিন্নভাবে এবং বিভিন্ন স্থানে আমি শতাধিকবার পুনরাবৃত্তি করেছি। তথাপি আমার দেখা এই নৈতিকতার উষ্ণতা আমাদের সংবাদপত্রে যা আমরা পড়ি এবং দেখি তাতে খুব কমই প্রতিফলিত হয়েছে।

পরবর্তী তিন বছর আমি অসংখ্যবার অধিকৃত ভূমিতে সফর করেছি, যা একসময় ছিল ঐতিহাসিক ফিলিস্তীন ভূমি। প্রথমে আমি কিছু কাজ হাতে নিলাম। সময় গড়িয়ে যাওয়ার সাথে সাথে আমি দাতব্য সংস্থাসমূহ এবং ফিলিস্তীনীদের সমর্থক দলগুলোর সাথে সফরে বের হওয়া শুরু করলাম।

সকল ধর্মের ফিলিস্তীনীদের দুর্ভোগ দেখে আমি চ্যালেঞ্জ বোধ করলাম। এটা স্মর্তব্য যে, এই পবিত্র ভূমিতে দুই হাযার বছর ধরে খৃষ্টানরাও বসবাস করছে এবং ইসরাঈলের অবৈধ দখলদারিত্বের কষ্ট তাদেরকেও ভোগ করতে হচ্ছে।

ক্রমাগতভাবে আমি ‘মাশাআল্লাহ’, ‘আলহামদুলিল্লাহ’-এর মত কিছু অভিব্যক্তি আমার দৈনন্দিন কথার মধ্যে সঙ্গোপনে ঢুকে পড়তে দেখলাম। এগুলো মূলতঃ আল্লাহ্র একশটি নাম থেকে উৎসারিত প্রশংসাসূচক উচ্চারণ। মুসলিম গ্র“পগুলোর ব্যাপারে বিচলিত না হয়ে আমি বরং তাদের সাথে সাক্ষাত করার জন্য উদগ্রীব ছিলাম। এটা ছিল আমার জন্য জ্ঞান ও বুদ্ধিসম্পন্ন, সর্বোপরি দয়ার্দ্র ও উদারচিত্তের মানুষগুলোর সাথে সময় কাটানোর একটা সুবর্ণ সুযোগ।

আমি কোন প্রকার সংশয় ছাড়াই বুঝতে পারছিলাম যে, আমার রাজনৈতিক বুঝের পরিবর্তনটা এমন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, যেখানে ফিলিস্তীনীরা ‘সন্দেহভাজন সন্ত্রাসী’ না হয়ে পরিবারে পরিণত হয়েছে এবং মুসলিম শহরগুলো ‘ধারাবাহিক ধ্বংস’-এর মুখে পতিত হওয়া শহরের পরিবর্তে একটি সম্প্রদায়ে পরিণত হয়েছে।



কিন্তু ধর্মের পথে যাত্রা? না, এটি আমার ক্ষেত্রে কখনোই ঘটার কথা ছিল না। যদিও সর্বদাই আমি প্রার্থনা করতে পসন্দ করতাম এবং শিশুকাল থেকেই আমি স্কুলে এবং ব্রাউনিতে ঈসা (আঃ) এবং অন্যান্য প্রচীন নবীদের কাহিনী সম্পর্কে পাওয়া বইগুলো খুব উপভোগ করতাম। যদিওবা একটি ধর্মনিরেপেক্ষ পরিবেশে আমি বড় হয়েছি।

তারপরও ধর্মের দিকে আমি যাত্রা করলাম। সম্ভবত মুসলিম সংস্কৃতির প্রতি, বিশেষ করে মুসলিম নারীদের প্রতি মুগ্ধতা আমাকে প্রথম ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করেছিল।

ইংরেজদের চোখে মুসলিম মহিলাদের কেমন অদ্ভূত মনে হবে, যাদের পা হতে মাথা পর্যন্ত সমস্ত শরীর আবৃত, যারা মাঝে মাঝে তাদের স্বামীদের পিছনে চারপাশে সন্তানদের নিয়ে হেঁটে চলে (যদিও তা সার্বজনীন ঘটনা নয়)।

অন্যদিকে ইউরোপের পেশাজীবী মহিলাগণ তাদের শরীর দেখাতে পারলেই অধিক আনন্দিত বোধ করেন। উদাহরণ স্বরূপ, আমি নিজেই আমার আকর্ষণীয় স্বর্ণালী কেশ এবং আমার বুকের প্রশস্ত স্থানটির জন্য সর্বদাই গর্ববোধ করেছি। সবসময়ই এগুলো প্রদর্শন করাটা ছিলো স্বাভাবিক ব্যাপার, কারণ বর্তমানে আমরা যা মার্কেটে কেনাকাটা করি, তার অনেক কিছুতেই রয়েছে আমাদের নারীদের শরীরের ব্যবহার।

সেইসাথে যখনই আমি টেলিভিশনে আমন্ত্রিত হয়েছি, আমি বসে বসে বিস্ময়ের সাথে দেখেছি যে, মহিলা উপস্থাপিকাগণ কোন গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় ১৫ মিনিটেরও কম সময় অতিবাহিত করার জন্য পূর্বপ্রস্তুতি হিসাবে কেবল মেকআপ ও চুলের সজ্জাতেই ব্যয় করেন এক ঘন্টা!! এটা কি স্বাধীনতা? আমি বিস্মিত হতে লাগলাম যে, আমাদের ‘মুক্ত’ সমাজে বালিকা এবং মহিলাগণ আসলে কতটা সম্মান পেয়ে থাকেন!!

২০০৭ সালে আমি লেবাননে গিয়েছিলাম। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়ে শিক্ষার্থীদের সাথে চারদিন কাটালাম। যাদের প্রত্যেকেই ছিল পূর্ণ হিজাব পরিহিতা। পাজামা অথবা জিন্সের প্যাণ্টের উপরে বেল্ট বাধা জামা পরিহিতা, যাতে কোন চুলের প্রদর্শনী ছিল না। তারা ছিল আকর্ষণীয়া, স্বাধীন এবং স্পষ্টবাদী। তারা মোটেই ভীরু প্রকৃতির ছিল না বা এমন ছিল না যে, তারা শীঘ্রই বিবাহ করতে বাধ্য হবেÑযা কিনা আমি প্রায়ই পশ্চিমা পত্রিকায় পড়ে কল্পনা করতাম।

এক পর্যায়ে একজন শায়খের সাক্ষাৎকার নেয়ার সময় তারা আমার সঙ্গী হল, যিনি হিজবুল্লাহ মিলিশিয়াদের একজন কমাণ্ডারও ছিলেন। মেয়েদের প্রতি তাঁর আচরণে আমি আনন্দের সাথে বিস্মিত হলাম। বাদামী প্রলম্বিত জুব্বা ও পাগড়ী পরিহিত শায়খ নাবীল যখন বন্দী বিনিময় নিয়ে কিছু কথা গোপনভাবে বলতে চাইলেন, তখন তারা তাঁর আলোচনায় অনাহুতভাবে শরীক হল। তারা তাঁর কথার উপর কথা বলতে কিংবা তাঁর কথা আমাকে ইংরেজী অনুবাদ করে শোনানোর জন্য হাত উঁচু করে তাঁকে থামিয়ে দিতে কোনরূপ দ্বিধাবোধ করছিল না। আসলে মুসলিম মহিলাদের দাদাগিরিটা বেশ কৌতুককর, যা তাদের সম্প্রদায়ের বহু বাড়িতেই সত্য। তোমরা কি পুরুষদেরকে বৃদ্ধাঙ্গুলীর নিচে দেখতে চাও? তাহলে অন্যদের দিকে দৃষ্টি না দিয়ে অনেক মুসলিম স্বামীদের দিকে লক্ষ্য কর।

সত্যিই, ঠিক গতকালই বসনিয়ার প্রধান মুফতি আমাকে ফোন করলেন এবং আধা-কৌতুকের স্বরে নিজেকে ‘আমার স্ত্রীর স্বামী’ বলে আমার কাছে পরিচয় দিলেন।

এছাড়াও আমার মাঝে কিছু একটা পরিবর্তন হচ্ছিল। যতবারই আমি মধ্যপ্রাচ্যে সময় অতিবাহিত করেছি, ততবারই আমাকে মসজিদে নিয়ে যেতে বলেছি। মনে মনে নিজেকে বলতাম, আমি তো সেখানে কেবল ভ্রমণের উদ্দেশ্যেই যাচ্ছি। কিন্তু বস্তুতঃ মসজিদগুলো আমার কাছে মনোমুগ্ধকর লাগত। কোন মূর্তি বা প্রতিকৃতির কারবার নেই। গীর্জার হেলান দেয়া বেঞ্চের পরিবর্তে সেখানে রয়েছে মাটিতে বিছানো গালিচা। এই মসজিদগুলো ছিল আমার চোখে একটি বিশাল বসার ঘর, যেখানে শিশুরা খেলাধুলা করে, মহিলারা তাদের পরিবারকে পিঠা এবং দুধ খাওয়ায় এবং নানী-দাদীরা হুইল চেয়ারে বসে কুরআন তেলাওয়াত করেন। তারা তাদের জীবনকে নিয়ে যায় যেমন তাদের উপাসনালয়ে। তেমনি সেখান থেকে উপাসনাকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় নিজ নিজ গৃহে।

তারপর এল সেই রাত, ইরানের কোম শহরে ফাতেমা মাসুমার সমাধির সোনালী গম্বুজের নীচে। অন্য তীর্থযাত্রী মহিলাদের মতো আমিও ফাতেমার সমাধির খিল ধরে থেকে কয়েকবার আল্লাহ্র নাম উচ্চারণ করলাম। যখন আমি বসলাম, তখন স্রেফ এক অদ্ভূত আধ্যাত্মিক আনন্দ আমার ভিতরে আন্দোলিত হতে লাগল। এ এমন এক আনন্দ যা তোমাকে মাটি হতে উপরে লাফিয়ে তুলবে না; বরং তোমাকে পরিপূর্ণ প্রশান্তি এবং পরিতৃপ্তিতে ভরিয়ে দেবে। আমি দীর্ঘক্ষণ বসে ছিলাম। তরুণীরা আমার চারপাশে জড়ো হল। আর বলতে লাগলÑতোমার মধ্যে তো দারুণ কিছু ঘটেছে মনে হয়। তখন আমি জানলাম যে, আমি আর ইসলামের পথে কেবল একজন সৌখিন পর্যটক নই বরং সেই মুসলিম উম্মাহ এবং সেই ইসলামী সম্প্রদায়ের অভ্যন্তরে প্রবেশকারী পরিব্রাজক, যা কি না সকল বিশ্বাসীকে একতার সূত্রে সংযুক্ত করে দেয়।

প্রথম প্রথম ইসলামে প্রবেশ করে আবার বেরিয়ে আসার একটা অনুভূতি আমার ভিতরে বিরাজ করছিল কয়েকটি কারণে। আমার মনে হচ্ছিল, আমি কি পরিবর্তিত হওয়ার জন্য প্রস্তুত? আমার পরিবার আর বন্ধুরা আমাকে নিয়ে কী ভাববে? আমি কি ব্যাপকভাবে আমার আচরণকে সংযত করতে তৈরী?

তবে বাস্তবতা সত্যিই খুব অদ্ভুত। মূলতঃ এসব বিষয় নিয়ে আমার চিন্তিত হওয়ার কোন প্রয়োজনই ছিল না। কেননা যেভাবেই হোক মুসলিম হওয়াটা সত্যিই খুব সহজ ব্যাপার। যদিও বা প্রাক্টিসিং মুসলিম হওয়া অবশ্যই অন্যরকম কঠিন।

প্রাথমিকভাবে ইসলাম পর্যাপ্ত পড়াশুনা দাবি করে। তাছাড়া আমি দু’টি সন্তানের মা এবং ফুলটাইম কাজ করি। একজন মুসলিম হিসাবে কুরআনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়ে ফেলাই তোমার কাছে প্রত্যাশিত। সেই সাথে ইমামদের চিন্তা-গবেষণা এবং আধ্যাত্মিকভাবে আলোকিত মানুষদের আচার-আচরণ সম্পর্কেও জানতে হয়। অধিকাংশ মানুষকে তাদের ইসলামের ঘোষণা দেওয়ার পূর্বে যদি বছরাধিককাল নাও হয় তবুও কমপক্ষে কয়েকটি মাস অধ্যয়নে অতিবাহিত করতে হয়।

লোকেরা আমাকে জিজ্ঞাসা করে আমি কুরআনের কতটুকু পড়েছি। আমার উত্তর, আমি এখন পর্যন্ত কেবল ১০০ পৃষ্ঠার মত পড়েছি অনুবাদসহ। তবে আমাকে তাচ্ছিল্য করার পূর্বে কোন ব্যক্তির জানতে হবে, একবারে মোট ১০টি আয়াতই পড়া উচিৎ; এর বেশী নয়। আর সাথে সাথে আয়াতগুলো তেলাওয়াত করে পড়তে হয়, অনুধাবন করতে হয়, আর যদি সম্ভব হয় তবে মুখস্তও করতে হয়। সুতরাং বিষয়টি মোটেও ঙক ম্যাগাজিনের মত হালকা নয়।

এই কুরআন একটি মহাগুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ, যা আমি আমার জীবন পরিচালনার জন্য জানতে চলেছি। এটা আমাকে আরবী শিখতে সাহায্য করবে। আর আমি এটাই চাই, যদিও তা সময় সাপেক্ষ। উত্তর লণ্ডনের কয়েকটি মসজিদের সাথে আমার সম্পর্ক আছে এবং সপ্তাহে কমপক্ষে একদিন সেখানে নিয়মিতভাবে যাওয়ার আশা করছি। যাইহোক আমি কখনই বলব না যে, আমি সুন্নী না কি শী‘আ মতদর্শী। বরং আমার জন্য ইসলাম একটাই আর আল্লাহ একজনই।

শালীন পোশাক ব্যবহার করাকে তোমরা যেমন দেখ, তার চেয়ে অনেক কম ঝামেলার। মাথায় ওড়না পরার অর্থ আমি আগের চেয়ে দ্রুত বাইরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। ঠিক এক সপ্তাহ আগে যখন আমি প্রথমবার এটা আমার চুলের উপর ঢিলেঢালাভাবে পরেছিলাম তখন লজ্জা পাচ্ছিলাম। সৌভাগ্যক্রমে বাইরে ঠাণ্ডা থাকায় সামান্য কয়েকজন লোকই আমার দিকে মনোযোগ দিতে পেরেছিল। তবে সূর্যালোকে বের হওয়া ছিল আরো বেশী চ্যালেঞ্জের ব্যাপার। কিন্তু এদেশ একটি সহনশীল দেশ এবং বাইরে কেউই এ পর্যন্ত আমার দিকে আড় চোখে তাকায়নি।

নেকাব বা বোরকার মত কঠোর পর্দা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। যদিও যেসব মহিলা সংযমের এই সর্বোচ্চ পর্যায়টা বেছে নিয়েছেন আমি তাদের সমালোচনা করছি না। কিন্তু ইসলামে এই বাধ্যবাধকতা নেই যে, আমাকে এত কঠোর পোষাক বেছে নিতে হবে (প্রাথমিক পর্যায়ে এ মন্তব্য করলেও বর্তমানে তিনি বোরকা ও হিজাব পরিধান করেন)।

পূর্বানুমিতভাবে গণমাধ্যমের কিছু অংশে আমার ধর্মান্তর নিয়ে অবারিতভাবে গালিগালাজ করা হয়, যার লক্ষ্যবস্তু মূলতঃ আমি ছিলাম না বরং তা ছিল ইসলাম সম্পর্কে কিছু ভূল ধারণা। তবে আমি তাদের সেসব নেতিবাচক মন্তব্যসমূহকে পাত্তা দেইনি। কেননা কিছু লোক আছে যারা আধ্যাত্মিকতার মূল্য বোঝেনা এবং এ সম্পর্কে কোন আলোচনা শুনলে ভীতু হয়ে পড়ে। এটা তাদেরকে জীবনের অর্থ সম্পর্কে বিব্রতকর প্রশ্নের সম্মুখীন করে। আর তাই তারা এভাবে তীব্র বাক্যবাণে জর্জরিত করে।

আমার আর একটা চিন্তার বিষয় হ’ল পেশাগত। বিশেষ করে আমি যদি মাথায় স্কার্ফ পরি, তাহলে নিঃসন্দেহে আমাকে চাকুরী থেকে অব্যাহতি দেওয়া হবে। আসলে অন্যান্য ধর্মান্তরিত মহিলাদের অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে আমি ভাবছি আমার সাথেও ঐ রকম ব্যবহার করা হবে কি-না। কেননা তাদের মতে, আমি তো আমার মনটাই হারিয়ে ফেলেছি।

সারা জীবন আমি রাজনীতিক ছিলাম এবং আগামীতেও থাকব। আমি অনেক বছর ধরে ফিলিস্তীনীদের পক্ষে কাজ করে আসছি এবং এখান থেকে আমার থেমে যাওয়ারও কোন ইচ্ছা নেই। তবে এটা ঠিক যে, ফ্রান্স বা জার্মানীর তুলনায় বৃটেন এ ব্যাপারে অনেক বেশি সহিঞ্চু। আমি ভালভাবেই জানি যে, অনেক মুসলিম মহিলাই আছেন, যারা টেলিভিশন ও গণমাধ্যমে অনেক সফলতা পেয়েছেন এবং তারা বাহ্যত পশ্চিমা পোষাক পরলেও তা সংযতভাবে পরিধান করেন। এটা কেবলই আমার নিজের জন্য একটি ইচ্ছা। যদিও আমি ইসলামে একেবারেই নতুন। আমি এখনও মৌলিক আক্বীদা ও মতবাদগুলো রপ্ত করার চেষ্টা করছি। তাই আমার সাথে ইসলামের সম্পর্কটা ভিন্ন ধরণের। আমি এ কথা বলার অবস্থানে নেই যে, নবপ্রাপ্ত এই বিশ্বাসের কিছু কিছু আমার জন্য উপযোগী হয়েছে। আর কিছু কিছু আমি উপেক্ষা করব।

আমার ভবিষ্যত জীবন সম্পর্কে এখনও অনেক অনিশ্চয়তা আছে। আমি অনুভব করি প্রতিদিন আমার মধ্যে পরিবর্তন আসছে যে, আমি একজন ভিন্ন ব্যক্তিতে পরিণত হচ্ছি। আমি ভাবি কোথায় এর শেষটা দাঁড়াবে? আমি কে হব?

আমি ভাগ্যবতী যে, আমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্কগুলো এখনও অটুট রয়েছে। আমার প্রতি আমার অমুসলিম বন্ধুদের প্রতিক্রিয়া যতটা না বৈরী, তার চেয়ে বেশি কৌতুহলী। তারা জিজ্ঞেস করে ইসলামগ্রহণ কি তোমাকে পরিবর্তন করে ফেলবে? এরপরও কি আমরা তোমার বন্ধু থাকতে পারব? আমরা কি ড্রিংক করতে বাইরে যেতে পারব?

প্রথম দু’টি প্রশ্নের উত্তর ইতিবাচক। কিন্তু শেষেরটা বড় আনন্দের সাথে নেতিবাচক। আর মায়ের ব্যাপারে আমি মনে করি, আমি সুখী হলেই আমার মা সুখী হবেন। আর আমার বাবার মাদকাসক্তির পটভূমি উঠে আসার পরও যদি আমি মাদক এড়িয়ে চলতে পারি, তাহলে কোনটি ভাল হবে?

উগ্র বাবার মাদকাসক্ত সংসারে বেড়ে উঠা আমার জীবনে একটা বড় ফাঁক রেখে গেছে। এটা এমন এক ক্ষত যা কোনদিন নিরাময় হবার নয়। আমার ব্যাপারে তার মন্তব্যগুলো খুবই আঘাতপূর্ণ। বেশ কয়েক বছর ধরে আমরা একে অপরকে দেখিনি, তাহলে কিভাবে তিনি আমার সম্পর্কে কিছু জানবেন? আর কিভাবে আমার ধর্মান্তর হওয়ার ব্যাপারে সঠিক ধারণা পাবেন? আমি তাই তার জন্য কেবল দুঃখ বোধ করছি। এছাড়া আমার পরিবারের বাকী সদস্যরা আমাকে খুব সমর্থন করেছে। আমার মা এবং আমার মাঝে একটি কঠিন সম্পর্ক ছিল যখন আমি বড় হচ্ছিলাম। তবে আমরা সম্পর্কটা আবার জোড়া লাগিয়েছি এবং তিনি আমার প্রতি ও তাঁর মেয়েদের প্রতি এখন খুব সহানুভূতিশীল। যখন আমি তাকে বললাম আমি ধর্মান্তরিত হয়েছি। তিনি বললেন, ‘যাক, ঐসব পাগলদের মত তো নয়. আমি তো ভেবেছিলাম তুমি বৌদ্ধ ধর্মের কথা বলেছিলে!’ তবে তিনি এখন আমার বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন এবং মেনে নিয়েছেন।

আর যথারীতি এ্যালকোহল পরিত্যাগ করা ছিল একটা সহজ কাজ। বস্তুতঃ আবার কখনোও এটার স্বাদ নেওয়ার কথা আমি আর ভাবতেই পারি না। আমি একেবারেই চাইনা।

আর পুরুষদের সাথে সম্পর্কের কথা ভাবার সময় আমার এখন নয়। কেননা আমি বর্তমানে বিবাহবিচ্ছেদ থেকে সামলে উঠছি। তাই আমি এ নিয়ে ভাবছি না এবং বিয়ে করার জন্য কোন চাপেও নেই। যদি পুনরায় বিয়ের কথা ভাবার সময় আসে, তবে তখন আমার লালিত বিশ্বাস অনুযায়ী স্বামীকে মুসলিম হতে হবে।

আমাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আমার মেয়েরা কি মুসলিম হবে? আমি জানি না, সেটা তাদের ব্যাপার। তুমি কারো অন্তরকে পরিবর্তন করতে পার না। তবে অবশ্যই তারা বৈরীভাবাপন্ন নয় এবং আমার বিস্ময়কর ধর্মান্তরে তাদের প্রতিক্রিয়া ছিল সবচেয়ে বেশী আলোচিত বিষয়।

আমি সেদিন রান্নাঘরে বসে ছিলাম। তাদেরকে ভিতরে ডাকলাম। বললাম, ‘মেয়েরা, তোমাদের জন্য কিছু সংবাদ আছে’। আমি শুরু করলাম, ‘আমি এখন মুসলিম’। বড় মেয়ে এলেক্সের সাথে একসাথে জড়ো দু’জন বলল, ‘আমাদের কিছু প্রশ্ন আছে, আমরা এখনই ফিরে আসছি’।

তারা একটি তালিকা করে ফিরে আসল। এলেক্স একটু কেশে বলল, ‘তুমি কি আর এ্যালকোহল সেবন করবে’? আমি বললাম, ‘না’। সে উদ্বেগের সাথে বলল, ‘তাই?’

‘তুমি কি আর সিগারেট খাবে?’ আমি উত্তর দিলাম, ‘না’। এতেও তাদের নীতিবাগীশ অনুমোদন মিলল।

তবে তাদের শেষের প্রশ্নটা আমাকে বিব্রত করে ফেলল। তারা বলল, ‘তুমি একজন মুসলিম, তুমি কি তোমার বক্ষদেশকে মানুষের সামনে উন্মুক্ত রাখবে?

কী! মনে হয় তারা আমার ভিতরের এবং উপরের জামায় বিব্রত হয়েছে এবং তাদের স্কুলে যাওয়া-আসার সময় আমার অনাকর্ষনীয় বক্ষ নিয়ে লজ্জাবোধ করে। পশ্চাদদৃষ্টিতে সম্ভবত আমারও লজ্জিত হওয়া উচিত ছিল।

যাহোক আমি বললাম, ‘আমি এখন মুসলিম, ‘আমি আর কখনোও আমার বক্ষদেশ মানুষের সামনে প্রদর্শন করব না’।

‘আমরা ইসলামকে ভালবাসি’-তারা উল্লোসিত হয়ে চিৎকার দিল এবং খেলতে চলে গেল। আর আমিও ইসলাম ভালবাসি।

তাওহীদের ডাক (মার্চ-এপ্রিল ২০১৩)

বিষয়: বিবিধ

১৭৭৯ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

309978
২০ মার্চ ২০১৫ সকাল ০৮:৩৩
গাজী সালাউদ্দিন লিখেছেন : আলহামদুলিল্লাহ্‌!

আল্লাহ তাকে এই পথে অটল অবিচল রাখুন। এবং তার মাধ্যমে অন্যদের ও ইসলামে আসার জন্য মন অনুপ্রাণিত হোক।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File