২৮ অক্টোবর মাদের জন্য এক বেদনাবিধুর ট্র্যাজেডি ঘটনা

লিখেছেন লিখেছেন সত্যলিখন ২৮ অক্টোবর, ২০১৪, ০৮:১২:৪০ রাত



২৮ অক্টোবর মাদের জন্য এক বেদনাবিধুর ট্র্যাজেডি ঘটনা

সকাল সকাল রান্না করছি দেখে শ্বাশুড়ী একটু ধমকের সুরেই বললেন,

“ মেজ়হে বৌ ,তুমি কী কোথায় প্রোগ্রামে যাচ্ছ নাকি? এতো তাড়াহুড়া করছো কেন?”

আমি তার আগে শেখ হাসিনা সোনার ছেলেদেরকে লগি বৈঠা আনার হুকুম দেওয়ার কথা শুনেই ভয়ে ভয়ে ছিলাম আজ । তাই সকাল থেকে ছেলেদের প্রস্তুতি আর ওর বাবার চোখগুলো কে ফাকি দিয়ে বের হবার কলা কৌশল দেখেই আগেই রান্না শেষ করে ফেললাম।কারন কি জানি কি হয় দেশের।যাক ছেলেরা বাবার আর দাদী কাউকে না দেখায়ে বিকল্প চাবি দিয়ে দরজা খুলে বের হয়ে যেতে পারল। বুঝতে পেরে আলহামদুলিল্লাহ বলে আল্লাহর উপর ভরসা করে রইলাম।

বাসার বারিন্দা থেকে প্রেস্ক্লাবের সামনের রাস্তা পুরাই দেখা যাচ্ছিল।তাই শ্বাশুড়ি আর সাহেবকে সেখান থেকে সরানো গেলো না।কিন্তু আমি বার বার আল্লাহর সাহায্য চেয়ে স্বাভাবিক থাকতে চেষ্টা করছি।কিন্তু পারছিনা।আজ স্মরন করতে চাইনা সেই দিনের প্রকাশ্য দিবালোকে মূর্তির মত দাঁড়ানো পুলিশের সামনে কিছু মানুষ নামের হিংস্র নরপশুদের ভয়াবহ, নিষ্ঠুর ও বর্বরতম হামলার স্বীকার হল কিছু নিরোপরাধ কিছু বনি আদম।যা আইয়্যামে জাহিলায়াত যুগের বদর প্রান্তরের কাফেরদের কার্যকলাপকেও হার মানিয়েছিল। বদর যুদ্ধ দেখিনি কিন্তু ইতিহাসের ছাত্রী হও্যাতে অনেক যুদ্ধের কাহিনী পড়েছি।কিন্তু যা স্বচোখে দেখেছি এমন পাশবিকতার নগ্ন রূপ আর অমানবিক দৃশ্যপট ইতিহাসের ঘৃন্য ভিয়েতনামের মাইলাই হত্যাকান্ড,চেঙ্গিসী বর্বরতা আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ জার্মানের হিটলারের লোমহর্ষক হত্যাকান্ডের মানবিক মূল্যবোধহীনতার নিলজ্জ দলিল কেও হার মানিয়েছে। বিকট গুল আর বোমার শব্দে বুক আর কান ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছে।মনে হচ্ছে সব গুলো আমার বুকে এসে বিধে যাচ্ছে ।

একটি ভুল ফোন আর স্তম্ভিত অনুভূতি

আমি দুপুরের নামাজ পড়ে অনেক সময় চলে যাচ্ছে কেউই খাবার কথা বলছ না আমার সারা শরীল কাপছে ।তাই বেলা ৩ টার দিকে শ্বাশুড়িকে নিয়ে খেতে বসলাম।খাবার প্রায় শেষের দিকে সাহেব এর একটা জোরে একটা আওয়াজ শুনলাম,“ তা হলে কি ভাই আমার সব শেষ হয়ে গেল”।ফোন লাইন কেটে গেল।আমি বললাম কি হয়েছে আমাকে বল।অনেক সংবাদ সে আমাকে শুনান না।তার ধারনা আমি হাইপেসার ও হার্ডের রোগী বা অনেক দুর্বল হার্ডের। আমার শ্বাশুড়ি ইশারায় মানা করলেন আমাকে না বলতে।আমার ৮ বছরের ছোট ছেলে বলল,আম্মু আমার ভাইয়াদের তারা মেরে ফেলেছেন, আব্বু কে দাদু মানা করেছে তোমাকে বলতে না।আমি সাথে সাথে সাহেব কে বললাম,”আমাকে সত্য করে বল কি হয়েছে আমার বাবাদের”?ওনারা যা ভেবেছেন আমাকে নিয়ে আমার তেমন কিছু হয় নাই।আমি মনে হয় অধিক শোকে পাথর হয়ে গেছি। চোখে ও পানি আসে নাই ।কারন হৃদয়টা সাহারা মরুভুমির মত শুকনোখয়ে গেলো।

সাহেব বললেন “আমাকে এক ভাই ফোন করে বলেছেন,ডিসলাইনে অনেক চ্যানেলে দেখাচ্ছে রাস্তার উপর সাপের মত মানুষ মেরে মেরে লাশের মত ফেলে রেখেছেন।তার মধ্যে একজন তোমার বড় ছেলে।আর বাকী ছেলেদের খবর কেউই বলতে পারছি না”।ছেলেরা খারাপ হয়ে যাবে ডিস দেখে তাই আমি তখন আমার বাসায় ডিসলাইন লাগাই নাই।তাই ইননালিল্লাহ পড়ে বোরকাটা গায়ে দিয়ে বের হলাম কাকরাইল ইসলামি ব্যাংক হাসপাতালের দিকে।রাস্তায় কোন যানবাহন নেই।কিন্তু আওয়ামীলিগের সন্ত্রাসীদের মুহুমুহু গুলিবর্ষন, বোমা ও ইটপাটকেল নিক্ষেপে আহতদের নিয়ে এম্ব্যুলেন্স গুলো পাগলা ঘোড়ার মত ছুটছে ।বার বার মনে হচ্ছিল, আমার ছেলেরা এর ভিতর আছে।এর মাঝেও হাটছি আর সেই মহিলা সাহাবীর কথা ভাবছি, স্বামী সন্তান ভাই অনেকের যুদ্ধের ময়দানে শহিদ হবার কথা শুনেও শান্ত থেকে জিজ্ঞাসা করলেন, আগে বলেন আমার রাসুল কেমন আছেন?আমার তখন বার বার মনে হয়েছে আমার সন্তান হয়ত বেচে আছে নয়ত শহিদ হয়েছে।কিন্তু আমার প্রান প্রিয় ইসলামের দায়িত্বশীল ভাই ও ছেলেরা কেমন আছেন।কাকরাইলের মোড়ে পুলিশ আমাকে বাধা দিতে আসলেও আমার মনের অবস্থ্যা বুঝে আলহামদুলিল্লাহ আমাকে নিরাপদে নিয়ে হাসপাতালে পৌছায়ে দেন।আমি সেখানে আমার সন্তান্দের না পেলেও আমি দেখেছি এক এক তলায় আমার বোনদের আহতওনিহত সন্তানদের জন্য অন্যভাইদের বুক ফাটা আর্তনাথ।তখন আমি আমার কষ্টের কথা ভুলে পাথরের মূর্তি হয়ে যাই।বাসায় এসে আল্লাহর সান্নিধ্যে সাহায্য চেয়ে বুকের ব্যাথা নিরবে জানাচ্ছি।

আলহামদুলিল্লাহ আমার ছেলেরা বেচে আছেঃ

রাত ৮ আমাদের এলাকার এক ছেলে ফোন দিয়ে জানালেন ,আমার ৩ ছেলেই আহত ও শাজাহানপুর ইসলামী ব্যাংক হসপিটালে আছেন।সে বাসার থেকে কাউকে বের হতে না মানা করলো।মায়ের মন শুনলো না কোন বারন।আমি একা আল্লাহর উপর ভরসা করে অনেক খাবার ওপানিয় সাথে নিয়ে জনমানবহীন এক ভূতুরে পরিবেশের মধ্যদিয়ে হসপিটালে উঠি।আলহামদুলিল্লাহ আমি আমার হারানো ৩ ছেলেকে খুজে পেয়েছি । আল্লাহু আকবার । আমি শুধু আমার ছেলেকে বেডে শায়িত অবস্থ্যায় দেখিনি ।আমি অনেক মায়ের সন্তানের রক্তাক্ত ক্ষত বিক্ষত শরীল দেখছি।আমার ছেলে অনেক কষ্টের মাঝেও আমাকে কান্না করতে দেখে ও আমার হাতে খাবার দেখে বলল, আম্মু আমি সুস্থ্য আছি ।এই খাবার গুলো অন্য ভাইয়াদের কে দিয়ে দেন।ওনারা আরো বেশি কষ্টে আছে।আমার তখন মনে পড়ল ,ঐ যুদ্ধের ময়দানের আহত সাহাবাদের কথা যারা একজন আরেকজন কে পানি দেবার কথা বলতে বলতে আর কারোই পানি পান করা হয় নাই । আমি হসপিটালে যতবার যেতাম আমি অল্প খারার আর পানিয় নিতে পারতাম না ।কারন আমার মনে হত আমার এত ছেলের মাঝে কিভাবে আমি এক ছেলের মুখে খাবার তুলে দিবো ? ছেলে রা বলত খালাম্মা আপনি কষ্ট করে এতো খাবার আনেন কেন ? আমি শুধু বলতাম আমার যত ছেলে আহত হয়ে কষ্টে কাত্রাচ্ছে সেই হিসাবে আমার খাবার খুবই সামান্য।

লগিবৈঠার তান্ডবে সেই দিন্ টি ছিলো কালো দিনঃ

ঐ দিনের কথা মনে হলে এখনো আতকে উঠি। আমার মনে হয় বদরের ফেরেস্তারা ঐ দিন বাংলাদেশের জমিনেও নেমে এসেছিল । না হলে তারা ধ্বংস লিলা যে ভাবে চালিয়েছে সেই ভাবে আল্লাহ আমাদের ভাই আর সন্তান্দের রক্ষা করেছেন । আমার ছেলেরা বলে ,"আম্মু ময়দানে যেই সুন্দর সুন্দর সাদা পাঞ্জাবী পরা ভাইয়াদের কে দেখেছি আম্মু জীবনে কোথায়ও এই রকম ভাইদের দেখি নাই । " আমার বড় ছেলে বলে " আম্মু তাদের কাচের বোতল ভাঙ্গা ফিরাতে ফিরাতে দুই হাত যখন রক্তে রঞ্জিত তখন একটুও ব্যাথা লাগে নাই । মাথায় কয়েকটা ইট পড়ার পর যখন মাটিতে পড়ে যাই তখন আমার চারিদিকে তারা ঘিরে রেখেছে । এর মাঝে কে আমাকে তুলে নিলো আমি আর কিছুই জানি না । পরে দেখি আমি হসপিটালে ।" আমার তখন শুনে মনে হয়েছে এটা সত্যিই আল্লাহর পাঠানো সাহায্য । আমার মেঝে ছেলে ছিলো বায়তুল মোকারমের উত্তর এর রাস্তায় । সে বলে আম্মু ," আমি যখন তাদের বোমা আর বৃষ্টির মত ইটের মাঝে পড়ে যাই তখন কে একজন আমার মাথায় একটা হেলমেট এনে দেয় । আমি একটু শক্তি আল্লাহর কাছে চেয়ে দাড়ায়ে দেখি শফিকুল ইসলাম মাসুদ ভাই তাদের সামনে পড়ে যাচ্ছে । আমি দৌড়ায়ে আমার হেলমেট ওনার মাথায় দিয়ে উনাকে সেইফ করি । নিজের জানের আশা বাদ দিয়ে দেই । কিন্তু মা তুমি গুনাগার , আমরা গুনাগার তাই ৩ ভাইয়ের কেউই শহিদী মর্যাদা পাই নাই ।আর তুমিও শহিদের মা হতে পারো নাই ।" আমি এখনো বলি আমি সত্যি গুনাগার ।

আমি মনে করতে চাই না সেই দিনের কথা।কেন আসে বার বার ২৮ অক্টোব্রের এই ভয়াল অমানিশার কালো দিনটি।আমি দুপুর ৩টা থেকে রাত ৮পর্যন্ত এই ৫ ঘন্টায় তিলে তিলে বুঝতে পেরেছি শহিদ পরিবারের শহিদের মা বাবা আত্নীয় স্বজনদের কেমন লাগছে?আমি তো আমার সন্তান দের আহত হলেও ফিরে পেয়েছি কিন্তু যারা আর ফিরে পান নাই তাদের কথা ভাবলে আজ চোখের লোনা জল ধরে রাখা যায় না।

আমার প্রশ্ন কেন এই কালো অধ্যায় রচনা করলেন।একজন মা হয়ে কিভাবে অন্য মায়ের সন্তানদের এই ভাবে লগি বৈঠা দিয়ে সাপের মত পিটায়ে মারার হুকুম দিলেন ?।কিভাবে একজন নেত্রী তার পোষা ও শিকারী হিংস্র ক্ষুদার্থ জানোয়ার গুলো নিরিহ , নিরস্ত্র ও নিরোপরাধ সাধারন জনগনের উপর লেলিয়ে দিলেন । যারা মৃত লাসের উপর নৃত্য করতেও বিবেক বাধা দেয় নাই। পুরানা পল্টন থেকে রায়তুল মোকারম কুচ কুচে কালো পিছঠালা রাস্তা রক্তের বন্যায় লালে লাল হয়ে যায়। যা দেখে দেশ বিদেশে সবাই থু থু মেরেছে তাদের নাকের ডগায় বার বার।

আইয়্যামে জাহিলিয়াতের যুগে হিন্দা তার ভাইয়ের হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য হামযা রাঃ কলিজা চিবিয়ে খেয়েছে।আর এই নব্য যুগের নব্য হিন্দা তার কিসের প্রতিশোধ নেবার জন্য এত শত মায়ের কলিজা চিবিয়ে তাদের কলিজার টুকরা সন্তান্দের রক্ত পান করল।এটা তো কোন গনতান্ত্রিক দেশের গনতন্ত্রের মানষ কন্যার কাজ হতে পারে না। হিন্দা তো পরে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে।কিন্তু এই হিন্দা তো বুঝা তো দুরে থাক আরো ডাইনির মতো পুরো দেশের ইসলামী আন্দোলনের নেতা কর্মীদের জেল জুলুম গুম হত্যা পঙ্গু করেই চলেছে। পুরো দেশটা কে একটা মিনি কারাগার বানায়ে ফেলেছে।কেউই তাদের মৌলিক চাহিদা গুলো পুরোন করতে পারছে না। স্বৈরাচারী মনোভাব ্ত্যাগ করে গনতান্ত্রিক না আসলে কেউ আগামিতেও শান্তি পাবে না। তাই সবাই সচেতন থাকুন ।এদের চাটুকারী বা দালালী করে দেশ ও জাতির ক্ষতি করে মীর জাফরের খাতায় নাম তুলবেন না।আল্লাহ আমাদের কে আর যেন ২৮ অক্টোবরের মত কোন দিন এর মোকাবেলা না করান।

বিষয়: বিবিধ

১৩৭৫ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

279037
২৮ অক্টোবর ২০১৪ রাত ০৮:২৬
ফাতিমা মারিয়াম লিখেছেন : '-হে ঈমানদারগণ! সবর ও নামাযের দ্বারা সাহায্য গ্রহণ করো, আল্লাহ‌ সবরকারীদের সাথে আছেন।

-আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হয় তাদেরকে মৃত বলো না। এই ধরনের লোকেরা আসলে জীবিত। কিন্তু তাদের জীবন সম্পর্কে তোমাদের কোন চেতনা থাকে না।

-আর নিশ্চয়ই আমরা ভীতি, অনাহার, প্রাণ ও সম্পদের ক্ষতির মাধ্যমে এবং উপার্জন ও আমদানী হ্রাস করে তোমাদের পরীক্ষা করবো। এ অবস্থায় যারা সবর করে

-এবং যখনই কোন বিপদ আসে বলেঃ “আমরা আল্লাহ‌র জন্য এবং আল্লাহ‌র দিকে আমাদের ফিরে যেতে হবে, তাদেরকে সুসংবাদ দিয়ে দাও।

- তাদের রবের পক্ষ থেকে তাদের ওপর বিপুল অনুগ্রহ বর্ষিত হবে, তাঁর রহমত তাদেরকে ছায়াদান করবে এবং এই ধরণের লোকরাই হয় সত্যানুসারী।'

[সূরা আল বাকারাহ; আয়াত নং ১৫৩-১৫৭]
279043
২৮ অক্টোবর ২০১৪ রাত ০৯:০৮
অনেক পথ বাকি লিখেছেন : সেদিন নিহতদের পরিবারের জন্য দোয়া করছি আল্লাহ যেন তাদের আরো ধৈর্য ধরা তৌফিক দেন। আমিন Praying Praying
279051
২৮ অক্টোবর ২০১৪ রাত ০৯:৫৭
আফরা লিখেছেন : সেদিন নিহতদের পরিবারের জন্য দোয়া করছি আল্লাহ যেন তাদের আরো ধৈর্য ধরা তৌফিক দেন। আমিন ।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File