মিসর ও মুসলিম ব্রাদারহুড

লিখেছেন লিখেছেন আমরা স্বাধীন ০২ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ১২:৫৩:২৭ দুপুর



১৯২৮ সালে ইখওয়ানুল মুসলিমীন নামক সংগঠনটির প্রতিষ্ঠা। যে সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন শহীদ হাসানুল বান্না রহঃ। প্রতিষ্ঠার প্রায় ৮৬ বছর পার করলেও অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় এই সংগঠনটি নিষিদ্ধ ছিল। এই সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা হাসানুল বান্না রহঃ কে ১৯৪৯ সালে গুলি করে হত্যা করা হয়। ১৯৬৬ সালে দলটির শীর্ষ নেতা শহিদ সাইয়েদ কুতুবকে ফাঁসি দেয়া হয়। এছাড়াও ব্রাদারহুডের অসংখ্য নেতাকে ফাঁসি দেয়া হয়। ব্রাদারহুডের হাজার হাজার নেতা-কর্মী বছরের পর বছর জেল খাটেন। কিন্তু এত কিছুর পরও ব্রাদারহুড নির্মূল হয়নি বরং গতি লাভ করেছে।

১৯৫৩ সালের ১৮ জুন মিসরকে প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করা হয়। ১৯৫৪ সালের এপ্রিলে কর্নেল জামাল আবুদল নাসের (১৯১৮-১৯৭০) নাগিবকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করেন। ১৯৫৬ সালের ২৩ জুন নাসের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এর পরে ১৯৭০ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর নাসের মারা গেলে আনোয়ার সাদাত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৮১ সালের ৬ অক্টোবরে সাদাত নিহত হওয়ার ফলশ্রুতিতে তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট হোসনী মোবারক প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে আসীন হন। এভাবে ৩২ বছরের বেশি সময় মিসরকে শাসন করেন স্বৈরশাসক হোসনী মোবারক।

কিন্তু ২০১০ সালের শেষের দিকে আরববিশ্বে শুরু হয় রাজনৈতিক সুনামি। তিউনিসিয়ায় ১৭ ডিসেম্বর গণবিক্ষোভ শুরু হয়। ১৪ জানুয়ারি তিউনিসিয়ায় সেই বিপ্লব রেশ ছড়িয়ে পড়ে মধ্যপ্রাচ্যের নীলনদের দেশ মিসরেও। ২৫ জানুয়ারি ২০১১ সাড়া জাগানো সরকার বিরোধী গন-বিক্ষোভের মুখে ১৮ দিনের ব্যাপক ও তীব্র আন্দোলনের মাথায় ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১১ প্রেসিডেন্ট হোসনী মোবারক ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন। সাধিত হয় নীল বিপ্লব। এরপর থেকেই মিসরে রাজনৈতিক সঙ্কটের সূচনা হয়।

২০১১ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি মিসরের রাজধানী কায়রোর তাহরির স্কয়ারে প্রায় ২০ লাখের বেশি মানুষের সমাগম হয় এবং এ স্কয়ারে মুরসী সমর্থকদের জুমার নামাজ আদায়ের দৃশ্য আল জাজিরা, সিএনএন প্রভৃতি চ্যানেলের মাধ্যমে বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করেন। সেই দৃশ্য আসলেই ভুলে যাবার নয় !!

জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে শান্তিপূর্ণ এই বিক্ষোভকালে প্রায় ৮০০ মানুষ শাহাদাত বরণ করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষমতায় থাকাকালে দুর্নীতি ও ২০১১ সালের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে গুলি চালানোর নির্দেশ দেয়ার অভিযোগে মোবারককে গৃহবন্দী এবং তার সহযোগীদের গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনা হয়। হোসনী মোবারক ১৯৮১ সালের ১৪ অক্টোবর থেকে ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১১ পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। তারপরে চলমান আন্দোলনে বাধ্য হয়ে প্রথম বারের মতো নির্বাচন দিতে বাধ্য হয় সুপ্রিম কাউন্সিল। এবং ২ দফার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ২০১২ সালের ২৪ জুন মুসলিম ব্রাদারহুডের রাজনৈতিক শাখা ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টির প্রার্থী ড. মোহাম্মদ মুরসি মিসরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। মোহাম্মদ মুরসি পেয়েছিলেন ৫১ দশমিক ৭৩ শতাংশ ভোট। তার প্রতিদ্বন্দ্বী আহমেদ শফিক পেয়েছিলেন ৪৮ দশমিক ২৭ শতাংশ ভোট। কিন্তু এর মাত্র এক বছর পর ২০১৩ সালের জুলাই মাসের শুরুতে এক সেনা অভ্যুত্থানে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন।

২০১৩ সালের ৩ জুলাই সেনা অভ্যুত্থানে ড. মোহাম্মদ মুরসি ক্ষমতাচ্যুত হলে তার পরের দিনই ৪ জুলাই মুরসিকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনার দাবিতে আন্দোলনে ঝাপিয়ে পরে মিসরবাসী। নাসের সিটির রাবা আল-আদাউইয়া মসজিদ ও আন-নাহদা স্কয়ারে অবস্থান নেয় প্রেসিডেন্ট মুরসির সমর্থকেরা।

তাহরির স্কয়ারে ১৮ দিনের টানা আন্দোলনে মোবারকের পতন হয়েছিল। এবার সবার প্রিয় মুরসিকে ফিরিয়ে আনতে ১৮ দিন ছাড়িয়ে টানা ৪১ দিন রাজপথে অবস্থান ধরে রেখেছিল মুরসি সমর্থকরা। এ অবস্থান ধরে রাখতে তাদের দিতে হয়েছে প্রতি-নিয়ত রক্ত। তাদের রক্তে মিসরের রাজপথ হয়েছে রক্তাক্ত।

বাবার সামনে ছেলেকে, মায়ের সামনে মেয়েকে, ভাইয়ের সামনে ভাইকে এভাবে অগণিত কাছের মানুষকে শহীদ হতে দেখেছেন অসংখ্য পিতা-মাতা, ভাই ও কাছের মানুষ। যা দেখে আমিও সেই সময় গুলোতে চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি।

আন্দোলনের প্রথম থেকে পুরুষদের পাশাপাশি মহিলা ও শিশুদের অংশগ্রহন ছিল চোখে পড়ার মত। কোলে নিয়ে অসংখ্য মাকে দেখা গেছে, রাজপথে দুর্বার আন্দোলনে শরীক হতে। তাদের সাথে কিছু পঙ্গুত্ববরণকারি ভাইদেরও দেখা গেছে।

সে সময় মিসরের আন্দোলনকারীদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করতে দেখা গেছে, বাংলাদেশ সহ বিভিন্ন দেশের ইসলাম প্রিয় জনগনকে। রাজপথে তারা বিক্ষোভ করেছে মুরসির পক্ষে। আর যারা রাজপথে নেমে মুরসির পক্ষে বিক্ষোভে যোগ দিতে পারেননি অনলাইন যোগাযোগ মাধ্যম যেমনঃ ফেসবুক, টুইটার ইত্যদি মাধ্যমে মিসরের সার্বক্ষনিক আপডেট এবং বিভিন্ন সংবাদ শেয়ার করে দেশ-বিদেশের মুরসি প্রেমীদের কাছে পৌঁছে দেবার চেষ্টা করেছেন।

আন্দোলনের শুরু থেকে মুরসি সমর্থকদের উপরে বারবার ঘটেছে নৃশংস হত্যাকাণ্ড, জরুরি অবস্থা জারি ও কারফিউ ঘোষণার পরও আন্দোলনে সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ কোন অংশেই কমেনি। বরঞ্চ তাদের মনোবল আগের মতোই আছে। কোন কিছুই তাদের দমাতে পারেনি। তারা উজ্জীবিত হয়েছে শহীদদের রক্তে।



লাশের গন্ধে আকাশ ভারি হয়ে গিয়েছিল। এ যেন এক মৃত্যুপরী। রক্তে রঞ্জিত রাজপথে সারি-সারি লাশ দেখে যেন মনে হয়েছিল কোন এক বধ্যভূমি। সেই বধ্যভূমির নাম রাবেয়া স্কয়ার। যেই স্কয়ারে ঘটেছে কয়েক হাজার মুরসি সমর্থকের শাহাদাতবরন। তবু থেমে থাকেনি আন্দোলন, বিজয়ের লক্ষে এখনও এগিয়ে যাচ্ছে মুরসি সমর্থকেরা। তারা সপ্তাহের শুক্রবার, শনিবার ও মঙ্গলবার কায়রোসহ সারা দেশে বিকেল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছেন।

সেই রাবেয়া স্কয়ারে ঘুমন্ত অবস্থায় তাঁবু জ্বালিয়ে দিতে তাদের অন্তরে কিঞ্চিৎ দ্বিধাবোধের সৃষ্টি হয়নি, বিমান থেকে তারা চালিয়েছে গুলি, চলেছে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ, ট্যাঙ্ক দিয়ে তছনছ করা হয়েছে রাবেয়া স্কয়ারের তাবুগুলো, বুলেটের আঘাতে পাখির মতো গুলি করে ক্ষত-বিক্ষত করা হয়েছে নিরীহ ইসলাম প্রিয় মানুষদের। রেহায় পাইনি হাসপাতালে পড়ে থাকা আহত অথবা নিহিতদের নিথর দেহ, হাসপাতালও জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে।

টেয়ারশেলের গন্ধ, ট্যাঙ্ক ও বুলেটের আঘাত থেকে বাঁচতে রাবেয়া আল-আদাউইয়ার মসজিদে আশ্রয় নিলে সেখানেও আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। সেই নির্মম চিত্রগুলো এখনও চোখের সামনে ভেসে উঠলে বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠে। যা বিভিন্ন মিডিয়ার সুবাদে সারা বিশ্বের মানুষ দেখেছে।

কয়েক মাস আগে মুসলিম ব্রাদারহুডের একজন নেতার দেয়া তথ্য মতে, রাবেয়া স্কয়ারের গণহত্যায় তিন হাজার ৪১৫ জন, আন-নাহাদা স্কয়ারের গণহত্যায় ২১৯ জন, রামসিস স্কয়ারের গণহত্যায় ১১৩ জন, জাতীয় নিরাপত্তা কার্যালয়ে ফজরের নামাজরত অবস্থায় ১৭২ জন ও আবু জাবিল নামক কারাগারে ৫২ জন সহ সারাদেশে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজারের অধিক মুরসি সমর্থক নারী-পুরুষ ও ছাত্র-ছাত্রীকে হত্যা করা হয়েছে।

প্রায় ২৬০ জন মানুষকে পুড়িয়ে কয়লা করে দেওয়া হয়েছে। আধুনিক এই যুগে এসব ভাবতেই অবাক লাগে। শিশুরাও বাঁচতে পারেনি তাদের বুলেটের নিশানা থেকে। এছাড়াও অন্তত ২০ হাজারের অধিক নেতা ও কর্মীকে গ্রেফতার করেছে সেনারা। উল্ল্যেখ যে, আন্দোলন করতে গিয়ে ৩৫ জন স্কলারসহ নামকরা প্রাচীন আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় দেড় হাজারের অধিক ছাত্র শাহাদতবরণ করেন।

আরেক প্রতিবেদনে কয়েকদিন আগে মিসরের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে একাডেমিক স্বাধীনতা লঙ্ঘনের বিষয় উত্থাপন করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছেঃ সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে ২০১৪ সালের এই পর্যন্ত

শিক্ষার্থী গ্রেপ্তারঃ ১৩৪৭ জন, শিক্ষার্থী নিহতঃ ১৭৬ জন, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে হামলার সময় নিহত হয়েছেন ১৬ জন শিক্ষার্থী, আটক করার সময় ৫ জন ছাত্রের মৃত্যু হয়েছে। জেলের ভেতরে বিচারাধীন অবস্থায় আছেনঃ ৫৯৪ জন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নিহিত হয়েছেনঃ ৭ জন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আটকঃ ১৬০ জন।



অতীত ইতিহাসের পথ ধরে মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতৃত্ব সর্বোচ্চ ত্যাগ-কুরবান স্বীকারের সর্বোচ্চ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। সেনাবিরোধী আন্দোলনে দলটির কারাবন্দী আধ্যাত্মিক নেতা মোহাম্মদ বদিইর ছেলে আম্মার বদিই, ভাইস প্রেসিডেন্ট খাইরাত আল সাতিরের মেয়ে ও জামাই সেনা অভিযানে নিহত হন।

সেই সময় মিসরের নিউজ মাধ্যম গুলোতে কিছু সময়ের জন্য হলেও যারা চোখ রাখতেন তাদের আসমা বেলতাগি নামটি ভুলে যাবার কথা নয়। ১৭ বছরের আসমা বেলতাগি ছিল মুসলিম ব্রাদারহুডের সেক্রেটারি মুহাম্মদ বেলতাগির মেয়ে। সে ১৪ আগস্ট সকাল বেলা সেই রাবেয়া স্কয়ারে সেনাদের বুলেটের আঘাতে শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করে। অবাক করার বিষয় এই যে, যখন মুহাম্মদ বেলতাগি জালিমের কারাগারে, বোন চলে গেছে না ফেরার দেশে তখন মুহাম্মদ বেলতাগির ছেলে হিশামকে দেখা গেছে, রাজপথে সিসির বিরুদ্ধে দেয়াল লিখনে ব্যস্ত সময় পার করতে।

এভাবে সেনা বিরোধী আন্দোলনের দিকে তাকালে দেখা যায় যে, মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতারা আন্দোলনে শুধুমাত্র নিজেরা সম্পৃক্ত না থেকে আল্লাহর পথে পরিবারের সকলকে অন্তর্ভুক্ত রাখার চেষ্টা করেছেন। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, এই আত্মত্যাগের প্রভাব চলমান সেনা বিরোধী আন্দোলনকে বেগবান করেছে বা করছে। এবং আন্দোলনে জোগিয়েছে বা জোগাচ্ছে নৈতিক শক্তি।

শহীদের রক্ত বৃথা যেতে পারেনা।

ইনশাআল্লাহ, সেই দিন বেশী দূরে নেই...

যেদিন মিসর সহ সারাবিশ্বে ইসলামের বিজয় পতাকা উড়বে ...

ছাত্র, ইমাম খোমেনী আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় কাজভিন, ইরান।

বিষয়: বিবিধ

১৪১৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File