জীবনের স্বাদ

লিখেছেন লিখেছেন ক্লান্ত ভবঘুরে ০৪ মে, ২০১৪, ১১:৪৯:১৫ রাত

ভরদুপুরে কাটফাটা রোদের মধ্যে হাঁটতে বের হওয়ার অন্যরকম একটা আনন্দ আছে। প্রচণ্ড গরমে হাঁটার মধ্যে একধরনের অনুভূতি খুঁজে পাই আমরা। হ্যাঁ, এটা পাগলামোই। কলেজ লাইফে আমাদের তিনজনের একটা পাগলা সার্কেল ছিল। এখনো সুযোগ পেলেই আমরা একসাথে হই, পাগলামিগুলো জিইয়ে রাখার জন্য। অদ্ভুত কিছু নেশা আছে আমাদের। আর নেশাগুলোই আমাদের দেয় জীবনের স্বাদ।

মাথার উপর প্রচণ্ড রোদ শরীর থেকে ঘাম ঝরিয়ে দিছে, আর আমরা আপনমনে হেঁটে যাচ্ছি ছোট্ট রাস্তা ধরে। উদ্দেশ্য উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটাহাঁটি করে গরমটা অনুভব করা।

শহরের পথ ছাড়িয়ে চলে যাই দূরে, কোন পায়ে হাঁটা পথ ধরে। কখনো ধানক্ষেতের পাশের আইল ধরে হাঁটতে থাকি। দূরে কোথাও কয়েকটা তালগাছ দেখা যাচ্ছে। চারপাশে পাকা ধানক্ষেতের সোনালী রাজ্য, কোথাও কোথাও পাকা ধানগাছগুলি শিলার আঘাতে নুয়ে পড়েছে।



ছোট্ট বেলায় কোন ক্যালেন্ডারের একটা ছবি মনে খুব গেঁঁথে গিয়েছিল। দুইটা ছোট্ট ছেলে-মেয়ে, ভাইবোন হবে, রাস্তার আইল ধরে হেঁটে যাচ্ছে। চারপাশের বিশাল মাঠজুড়ে শুধু সরিষা ক্ষেত। সরিষাফুলগুলি এক অদ্ভুত মাদকতা ছড়িয়ে যাচ্ছে। শেষ বিকেলের সূর্যটা একটা স্নিগ্ধ আভা ছড়িয়ে যাচ্ছে। বিশাল বড় মাঠ পেরিয়ে বহুদূরে কয়েকটা তালগাছ সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে। তারপর কয়েকটা বাড়ি দেখা যাচ্ছে। মনে হয়, বাচ্চা দুটো তার নানাবাড়ি যাচ্ছে, অনেক পথ এখনো বাকি। কিন্তু কোন ক্লান্তি নেই চেহারায়, তার বদলে এক অদ্ভুত আনন্দ খেলা করছে তাদের মুখে। কিছুক্ষণ পরেই নানা বাড়ি পৌঁছে যবার আনন্দ। মেয়েটা সম্ভবত বড় ছিল। ছবিটা হঠাৎ মনে পড়ে গিয়েছিল। ছোটবেলায় অনেকদিন পর্যন্ত নিজেকে সেই ছবির ছেলে হিসেবে কল্পনা করেছি। যেন আমি মাঠে-ঘাটে হেঁটে বেড়ানো কোন বালক। হাঁটাতেই আনন্দ, ক্লান্তিহীন পথিক।


আমরাও হাঁটতে থাকি রোদ মাথায়। একসময় তালগাছগুলোর নিচে পৌঁছে অদ্ভুত শান্তিতে বসে যাই। হালকা দখিনা বাতাসের দোলা লাগে গায়ে। আমাদের কারো গলার স্বর ভালো না হলেও আপনমনে গান ধরি। আশে পাশে কেউ শুনার নাই তো, নিজেরাই শ্রোতা! গানগুলো খারাপ লাগেনা। দূরে কিছু কৃষককে কাজ করতে দেখা যায়। কয়েকটা বাচ্চা আইল ধরে বই হাতে স্কুলে যাচ্ছে। ছোট্ট বেলার কথা মনে হয়!!!

তারপর আবার শুরু উদ্দেশ্যহীন হাঁটা, যতদূর যাওয়া যায়। কখনো ধানক্ষেতের আইল ছেড়ে মাটির রাস্তায় উঠি। তারপর আবার কোন খালের পাশ দিয়ে হাঁটা শুরু হয়। খালের পানির স্রোতকে অনুসরণ করি। রাস্তার পাশে অনেক বিচ্ছু পড়ে থাকতে দেখা যায়। জোঁকেরও ভয় হয়। তারপরও হাঁটি।

পাকা ধানের একধরনের মিষ্টি গন্ধ আছে। কেমন যেন মাদকতায় ভরা। মনে হয় এইতো নতুন ধানের পিঠা তৈরি হবে, পায়েস, পোলাও কত কিছু। নতুনের খুশিতে মনেও নতুনত্ব আসে। আহা! কৃষকদের ঘরেও আনন্দ ছড়িয়ে যাবে, পকেট ভারি হবে তাদের। মুখে হাসি লেগে থাকবে কিছুদিন। গ্রামের শৈশবের কথা মনে হয়।

রোদ বাড়তে থাকে, আমরাও হাঁটতে থাকি। সামনে কোন ব্রীজ পড়ে, কিছুক্ষন সেখানে বসি। মানুষের আসা যাওয়া দেখি। কর্মব্যস্ত মানুষের চলে যাওয়া কিংবা আমাদের মত কারো আলস হাঁটাহাঁটি। দুপুর পেরিয়ে বিকেলের ছায়া বাড়তে থাকে। আমাদের হাঁটাও শুরু হয়, নতুন পথ ধরে। একসময় মুয়াজ্জিনের কন্ঠে আসরের আযান শোনা যায়। আশেপাশের কোন ভাঙ্গা মসজিদে নামায পড়ি। দেয়ালের আস্তরণ খসে পড়া মাটির কোন মসজিদ, গুটিকয়েক বৃদ্ধ মুসল্লী। তারপর আবার...

সামনে দেখা যায় রেললাইন। একা একা কত পথ পাড়ি দিয়েছে এই লাইন! কত সুখ-দুখের স্মৃতির সাক্ষী হয়ে আছে নিরবে। আমরাও তার ভাগ নিতে চাই। বিকেলের মিষ্টি রোদে রেললাইনের পাশে গা এলিয়ে বসে থাকার একটা স্নিগ্ধ অনুভূতি বয়ে যায় শরীরে। আহা! এইতো ক্ষনিকের ভবঘুরে জীবন! জীবনের মায়াগুলো এখানে জড়াজড়ি করে বাস করে ক্লান্ত জীবনের বাঁকে।

তারপর হঠাৎ নিজেকে বেশ স্বার্থপর মনে হয়। মনে হয় ভেতরের মানবিকতাবোধের দেয়ালে জং ধরে গেছে। আমরা যখন জীবনের স্বাদ নিতে ব্যস্ত তখন সেদিকে কিছু মানুষের জীবনে হিসাবটা শেষ হয়ে গেছে। হয়তো বুলেটের একটা আঘাত, কিংবা হাতে পায়ে কেটে বসা বাঁধা একটা দড়ির দাগ কিংবা গলায় আটকে দেয়া একটা ফাঁস।

নিজেকে কেবল ব্যর্থ বোবা এক দর্শক মনে হয়।

বিষয়: বিবিধ

১০২৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File