বাংলাদেশী হাজীদের হজ্ব; সমস্যা ও করণীয়।

লিখেছেন লিখেছেন মোস্তাফিজুর রহমান ০৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ০৭:৪২:০৯ সন্ধ্যা

২০১২তে হজ্ব উপলক্ষ্যে মক্কায় গিয়েছিলাম। তখনকার বেশ কয়েকটা দু:খ জনক ঘটনা থেকে একটা শেয়ার করছি। যেটা সবচেয়ে কম বেদনার ।

সেটা হলো-

ঈদের দিন সকাল বেলা তা্ওয়াফ করার জন্য হারাম শরীফে ঢুকতেছিলাম দূর থেকে খেয়াল করলাম লুংগি আর পাঞ্জাবি পরা এক ভদ্রলোক সৌদি পুলিশের সাথে বাংলায় কথা বলছে! উনার হাতে ৪/৭লিটার পানির একটি খালি বোতল। পঞ্চাশোর্ধ্ব (আনুমানিক) শক্ত গঠনের (পরিশ্রমী শরীর) পুলিশকে বলছে ভিতরে কি আছে দেখতে যাব। পুলিশতো বাংলা বুঝেনা। পুলিশ বলছে বোতল বাররা (বোতল বাহিরে রাখ) আর বাংলাদেশী লোকটা আরবী বুঝেনা। মিনিট খানেকের মধ্যে একই কথা দুইজন বলছে। আমি এগিয়ে গিয়ে বৃদ্ধলোকটিকে জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে? উনি বললেন আমি ভিতরে কি আছে দেখতে যাচ্ছিলাম কিন্তু পুলিশ যেতে দিচ্ছেনা। ভদ্রলোককে বোতল ফেলে দিতে বললে উনি তাই করলেন। মানুষের ভীড় ঠেলে উনাকে ভিতরে নিয়ে বললাম এটাই ক্বাবা ঘর। উনি বলল বাবা চারপাশটা একটু দেখব বললাম, আমার দ্বারা আপনাকে এত সময় দেয়া সম্ভব না। তাছাড়া প্রচন্ড ভীড় এর মাঝে আমি আপনাকে চারপাশ ঘোরাতে পারবনা। কিন্তু আপনার পরণে লুংগি আর পাঞ্জাবি কেন?? এখনতো আপনার ইহরাম থাকার কথা। আপনি তাওয়াফ-সাই করেছেন?? না; মিনায় গিয়েছেন? না; কংকর নিক্ষেপ করেছেন? না। মানে হজ্বের কোন কাজই উনি করেননি। বললাম কেন?? উনি বললেন- আমাদেরকে মক্কা এনে হোটেলে তুলে দিয়ে আমাদের সহকারী (মুতা্ওয়াল্লী) কোথায় চলে গেছে জানিনা। আমি হোটেল্ও চিনিনা। আমি উনার মুতাওয়াল্লীর নাম্বার নিয়ে কল দিলাম। মোবাইল বন্ধ! অসহায় বৃদ্ধকে নিয়ে কি করব বুঝতে পারছিলামনা। প্রথমে বললাম- “বাংলাদেশী পতাকা চিনেন? হ্যা চিনি; দেখবেন কিছু লোক বাংলাদেশী পতাকা নিয়ে মিছিলের মত (দলবদ্ধভাবে) আসবে আপনি তাদের সাথে যোগ দিয়ে তাদের রুমে চলে যান। তারপর ওখানকার কেউ আপনার হোটেল খুজে দিতে পারবে। আমি দাম্মাম থেকে এসেছি এখানকার কিছুই চিনিনা। এ বলে উনাকে ছেড়ে চলে আসছিলাম। কিন্তু পরক্ষণে ভাবলাম এ অসহায় বৃদ্ধটি হয়তো তাও করতে পারবেনা। আবার পেছনে এসে উনাকে বললাম বাইরে চলুন দেখি কি করা যায়। হারামের বড় বাথ রুম (অনেকের মতে আবু জেহেলের বাড়ি) এর গেইটে এলাম। দেখলাম বাংলাদেশের পতাকাযুক্ত ব্যাগ নিয়ে বেশ কয়েকজন হাজী বসে আছেন। বৃদ্ধ মানুষটাকে তাদের সহায়তায় হয়তো রুমে পৌছানো সম্ভব হবে মনে করে খুশি হলাম। ওখানকার এক বৃদ্ধকে হাজীকে বললাম, “মুরুব্বি উনি হোটেল হারিয়ে ফেলেছেন; আপনারা আপনাদের রুমে নিয়ে যান; ক্যাম্পে গেলে হয়তো উনি উনার রুমও পেয়ে যাবেন। বৃদ্ধ হাজীটি কান্নার স্বরে বলল “বাবারে আমরা ও আমাদের হোটেল চিনিনা; আমাদের মুতাওয়াল্লীও নাই, হারিয়ে গেছে।'' অল্প শোকে কাতর অধিক শোকে পাথর অবস্থা এমন হল। একজন পথ হারাকে পথ দেখাতে গিয়ে একদল পথহারা পেলাম। দ্বিতীয় বৃদ্ধ লোকের ব্যাগ খুজে একটা মোবাইল নাম্বার পেলাম। ওটাতে কল দিলাম। মুতাওয়াল্লী ধরেছে। বললাম আপনার কিছু হাজী আবু জেহেল বাথরুমের সিড়ির পাশে আছে নিয়ে যান। মুতাওয়াল্লী আমাকে অনুরোধ করল ওখানে অবস্থান করার জন্য। কিন্তু আমি পারলামনা। কারণ আমার শরীরটা খারাপ ছিল, কাজও অনেক বাকি ছিল। তাই অপারগতা জানিয়ে আবার মুতাওয়াল্লীকে কল দিয়ে বললাম আপনি বাথরুমের মেইন গেটে আসলেই উনাদের পাবেন। আর বৃদ্ধ মানুষগুলোকে বললাম আপনাদের মুতাওয়াল্লী আসার আগে এখান থেকে সরবেননা। এ বলেই চলে এলাম।

সৌদি আরবে চাকুরী করার কারণে মনে একটু সাহস ছিল তাই মিনাতেও যথেষ্ট ঘুরেছি। বিশেষ করে আমার এক শিক্ষক হজ্জে আসাতে উনাকে খুজেছি অনেক।

প্রায় প্রতিটি গলিতে দেখলাম ভারত-পাকিস্থানের হজ্ব সহকারীরা মানচিত্র নিয়ে দাড়িয়ে আছে। কোন হাজী বিপদে পড়লে সহায়তা করছে।

কিন্তু বাংলাদেশী হাজীরা ছিল সম্পূর্ণ অসহায়। তাদের সাহায্য করার জন্য কাউকে দেখিনি।

এরকম আরো কয়েকটির মুখো-মুখি হয়েছিলাম। এবারের অবস্থা কেমন জানিনা।

হাজীদের দুরাবস্থার জন্য বাংলাদেশীদের মন মানসিকতা, হজ্ব এজেন্সীগুলোর অধ্যাধিক লোভ আর সর্বোপরি সরকারের নিস্ক্রিয়তাই দায়ী।

বাংলাদেশীদের মানসিকতা হল- বৃদ্ধ বয়সে হজ্ব করব এখন হজ্জ করলে রাখতে পারবনা (এক আজব কথা)তাই যখন হাটা চলা বন্ধ হওয়ার উপক্রম তখন আসে হজ্ব করতে। অথচ হজ্বের কাজগুলো যথাযথভাবে সম্পন্ন করতে যুবকদেরও খুব বেগ পেতে হয়।

বাংলাদেশী হাজীরা অধিকাংশই হজ্বের আহকামগুলোর কিছুই জানেনা এতে করে ইচ্ছা আগ্রহ থাকা স্বত্ত্বেও কাজগুলো করতে পারেনা।

হজ্জ এজেন্সীগুলো প্রয়োজনীয় কর্মী প্রেরণ করেনা। যা করে তাদেরও একদিকে অনেকে সৌদি আরবে নতুন আরেকদিকে হজ্বের আহকাম জানেনা ফলে তারা হাজীদের কোন উপকারে লাগেনা বরং তারাও বোঝা হয়ে যায়।

সর্বোপরি সরকারের অসহযোগীতা হাজীদের কষ্টকে বহুগুন বাড়িয়ে দেয়।

সুতরাং আমাদের করণীয় হচ্ছে-

১) সাবালক হওয়ার সাথে সাথে যেমন নামাজ রোজা ফরজ হয়ে তেমিন সাবালক সম্পদশালী হলেই হজ্ব ফরজ হয়ে যায়; বয়স কোন ফ্যাক্টরনা এটা সাধারণ মানুষকে বোঝাতে হবে।

২) আত্নীয় স্বজনের মধ্যে যারা হজ্বে যাবেন বলে যানতে পারেন তাদেরকে নিজ উদ্যোগে হজ্জের দিনগুলোতে করণীয় বিষয়গুলোর প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

৩) সরকার ও হজ্ব এজেন্সীগুলো যাতে হাজীদের সার্বিক পরিচর্যা তথা অসুবিধাগুলো দূর করার জন্য সচেষ্ট থাকে এজন্য তাদের প্রতি জোর দাবী জানান বা চাপ সৃষ্টি করা।

আল্লাহ তায়ালা চলতি বছরসহ অতীতের সকল হাজীদের হজ্বগুলোকে কবুল করুক, আমাদের সবাইকে যথাযথভাবে ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন করে আল্লাহর ইবাদত করার তাওফিক দিক, আমিন।

বিষয়: বিবিধ

১৫৪০ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

263093
০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪ রাত ১১:১০
হতভাগা লিখেছেন : প্রতারনা করতে পারদর্শী বাংলাদেশীদের এটা একটা ব্যবসা , মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্ল্যাকমেইল করে এজেন্সীর লোকেরা এসব করে - শুনেছি যারা গিয়েছে তাদের মধ্যে থেকে ।

হজ্বে কোন অন্যায় কাজ করলে দম দিতে হয় - এটাকে কাজে লাগায় এজেন্সীর লোকেরা ।

এক রুমে ৪ জন রাখার কথা বলে নাকি তারা ৭-৮ জন রাখায় , এতে অনেকে পারলেও ক্ষিপ্ত হতে পারে না হজ্বের পবিত্রতা বজায় রাখার জন্য । তাদের দেয় খাবারও নাকি অতি জঘন্য । মোয়াল্লেমরা নাকি সেখানে খুব একটা পাত্তা পায় না সৌদিদের কাছে ।

এটা প্রায় সবার কাছেই শোনা যায় যে , টাকা নেয় ঠিকই - তবে এজেন্সী ভাল সার্ভিস দেয় না ।

এসব এজেন্সীদের মেইন কাজ তো আদম ব্যবসা , হজ্ব হল সিজনাল ব্যবসা । সারা বছর যে আইডলজি নিয়ে ব্যবসা করে হজ্বের সময় কি সেটার পরিবর্তন হবে ?

বাংলাদেশীরা বয়স বেশী হলে হজ্বে যায় - এটার কারণ বাংলাদেশের অর্থ সামাজিক অবস্থা । আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও তারা যেতে পারে না টাকার অভাবে । আবার কেউ কেউ পোলাপানদের একটা গতি করে দিয়ে হজ্বে যেতে চায় ।

বাংলাদেশীরা মনে করে যে সারা জীবন যেমনে পারি কামিয়ে নেই , শেষ বয়সে হজ্বে গিয়ে আল্লাহর কাছে মাফ চেয়ে ভাল পথে চলে আসবো ।

তবে ততক্ষনে সামর্থ্য হলেও শরীরে শক্তি থাকে না । অনেক বয়ষ্ক হাজী সেখানেই মারা যায় বা হজ্বের পুরো আহকাম পালন করে আসতে পারে না ।

পৃথিবীর অন্যান্য দেশের অবস্থা কিন্তু ভিন্ন । সেখান থেকে তরুন তরুন পোলাপানরাই আসে হজ্ব পালন করতে - এবং সেটাই হওয়া উচিত । তারা তাদের দেশের হাজীদের নাকি আর্থিক সহায়তা দেয় , এমনকি ভারতও নাকি সেটা করে ।

বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাস যেমন সে দেশের প্রবাসীদের খোঁজ খবর রাখে না , হজ্বের বেলায় সেটাও করে থাকে । ফলে সৌদিরা যে বাংলাদেশীদের মিসকিন বলে সেটা বাংলাদেশীরাই নিজেদের আচরনের মাধ্যমে অর্জন করেছে । অন্য দেশের সাথে সৌদিদের আচরন বেটার , কারণ তারা নিজেদের গাডথস নিজেরা ধরে রাখার চেষ্টা করে ।
তবে আজ এই ভাইয়ের পোস্টে জানতে পারলাম যে , বাংলাদেশ হজ্ব মিশনের লোকেরা নাকি এবার খুব তাক লাগানো ভাল কাজ করতেছে । শুনে ভালই লাগলো । তবে এটা যে আরেক ধরনের ধান্ধাবাজি না তার সন্দেহ থেকে মুক্ত হতে পারছি না ।
০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ দুপুর ০২:৩৬
206893
মোস্তাফিজুর রহমান লিখেছেন : সুন্দর বলেছেন। বিশেষ করে যারা প্রবাসে আছে তারা হাড়ে হাড়ে টের পায় বাংলাদেশী কোন জিনিস!!
263096
০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪ রাত ১১:৫৯
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : এই অভিজ্ঞতার কথা আরো অনেকের মুথেই শুনেছি। আমাদের দেশে অবশ্য এখন অনেকেই মোটামুটি কম বয়সে হজ্জে যাচ্ছেন। কিন্তু হজ্জ মিশন বলে একটি বস্তু প্রতিবছর সরকার প্রেরন করেন বলে জানি। সেই মিশনটির আসল কাজ কি সেটাই বেশিরভাগ হাজি্ জানেননা! আর মিশনের উচ্চ শিক্ষিত উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারিরা নাকি সামান্য সাধারন হাজিদের সাথে কথা বলতে অপমান বোধ করেন।
০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ দুপুর ০২:৩৭
206894
মোস্তাফিজুর রহমান লিখেছেন : ধন্যবাদ সুন্দর মন্তব্যের জন্য। হজ্ব মূলত যুবক তথা শক্তিশালীদের জন্য ইবাদত। বৃদ্ধদের জন্য নয়।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File