দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদীদের রক্ষাকারী ও নাৎসীদের বিরুদ্ধে জীবন উৎসর্গকারী মুসলিমদের সাথে সাক্ষাত মাইকেল ওলফে

লিখেছেন লিখেছেন মৃনাল হাসান ০৯ মে, ২০১৫, ১০:৩৯:৫৮ রাত

(মাইকেল ওলফে আমেরিকান কবি ও ইউনিটি প্রোডাকশনস ফাউন্ডেশনের সহ প্রতিষ্ঠাতা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মুসলিমদের অবদান নিয়ে গবেষণা করেছেন ও নির্মান করেছেন চলচ্চিত্র। তার সাম্প্রতিক চলচ্চিত্র Enemy of the Reich: The Noor Inayat Khan Story। ২০১৪ সালের ৮ সেপ্টেম্বরে ওয়াশিংটন পোস্টে এই ফিল্মটি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির পক্ষে ও জার্মানদের কবল থেকে ইহুদীদের রক্ষায় মুসলমানদের ভুমিকা নিয়ে কিছুটা আলোচনা করেছেন। সেটি অনুবাদ করা হল)

নুর ইনায়েত খান অদ্ভুত জীবন যাপন করতেন।তিনি ১৯১৪ সালে ভারতের এক আধ্যাত্বিক সুফি মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। আমেরিকাতে যোগ ব্যায়ামের প্রচলনকারি পেরি বেকারের সৎবোন ছিলেন তিনি।শিশুকাল কেটেছে মস্কোতে, রাশিয়ার বিপ্লবের সময় পিতামাতার সাথে তলস্তয়ের সন্তানের পরিবহনে করে পালিয়ে যান প্যারিসে। পিতার ছাত্র ও ভক্ততে গাদাগাদি একটি একটি ম্যানসনে বসবাস করতে শুরু করেন। তিনি হার্প ও বীণা বাদনে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। পশ্চিমা ধাচের পোশাক পরতেন। সরবোন থেকে স্নাত্বক হয়েছিলেন এবং তার বয়স ২৫ না হতেই শিশুদের গল্পের বই প্রকাশ করেছিলেন।

একবছর পরে ১৯৪০ এর মে মাসে জার্মানরা ফ্রান্স দখল করে নেয়। নুর, তার মা ও ছোট ভাইবোনসহ হাজার হাজার ফরাসীদের মত ফ্রান্সের বরদো থেকে ইংল্যান্ডে পারাপারকারি সর্বশেষ নৌকাতে করে ইংল্যান্ডে পালিয়ে যান।ইংল্যান্ডে সে অনতিবিলম্বে ব্রিটিশ যুদ্ধ চেষ্টার সাথে শরিক হয়। ১৯৪২ সালে তিনি চার্চিলের এলিট Special Operation Executive (SOE) তে ওয়ারলেস অপারেটর হিসাবে নিয়োগ পান। তার গুপ্তচরবৃত্তি ফ্রান্সের ফরাসি প্রতিরোধ-সংগ্রামের পক্ষে কাজ করত, যার ফলে ইংল্যান্ড ডি-ডের অপারেশনের জন্য প্রস্তুত্তি গ্রহন করতে পারে। SOE এজেন্টদের মধ্যে ওয়ারলেস অপারেটরদের চাকরি ছিল সবচেয়ে বিপজ্জনক, কারণ, দখলকারি কর্তৃপক্ষ ওয়ারলেস সিগনাল ট্র্যাকিং করায় খুব দক্ষ ছিল। প্যারিসে প্রতিরোধ টেলিগ্রাফারদের টিকে থাকার গড় ছিল ছয় সপ্তাহ।

১৯৪৩ সালের জুন থেকে অক্টোবরে গেস্টাপো বাহিনীর হাতে বন্দী হওয়ার আগ পর্যন্ত নুর তার কাজ চালিয়ে গেছেন। তার অদ্ভুত জীবনাচার এবং ১৯৪৪ সালের সেপ্টেম্বরে জার্মানীর ড্যাকাও বন্দীশিবিরে নিহত হওয়ার ঘটনা PBS ফিল্মে ফোকাস করা হয়েছে। আমি সহকারি প্রযোজক, এই সপ্তাহে (সেপ্টেম্বর ২০১৪ তে) ছবিটি মুক্তি পাবে। তার কাহিনী গবেষণা করতে গিয়ে আমি অন্যান্য মুসলিমদের নিয়েও কাজ করেছি, যারা সাহসিকতার সাথে মিত্রবাহিনীর পক্ষে কাজ করেছে এবং অনেকে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন। তাদের সাহসিকতাপুর্ন বীরত্বে ইতিহাস সমৃদ্ধ এবং তাদের তড়িৎ সিদ্ধান্ত নাৎসীদের পরাজিত করতে সহায়তা করেছে।

বেহিক এরকিন, প্যারিসে তুর্কি রাষ্ট্রদুত, হাজার হাজার ইহুদীর জন্য নাগরিকত্বের কাগজপত্র ও পাসপোর্ট দিয়েছেন ( অনেকের সাথে তুরস্কের দুরতম সম্পর্ক ছিল) এবং ইউরোপ থেকে অনেক ইহুদীকে রেলযোগে অন্যত্র চলে যাওয়ার ব্যাবস্থা করেছেন। নেকদেত কেন্ট মার্সেলিতে তুরস্কের কাউন্সেল জেনারেল ছিলেন, এমন এক সৌভাগ্যের দিনে , মার্সেলিতে ৮০ জন তুর্কি ইহুদী বোঝাই জার্মান জাহাজের গতিরোধ করেন , যাদেরকে মার্সেলি থেকে জাহাজে বোঝাই করে হত্যার উদ্দেশ্যে জার্মানি নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তিনি সেই ইহুদীদের জোড়পুর্বক কেড়ে নিয়েরেলযোগে নিরাপদে ফ্রান্সে পাঠিয়ে দেন।

আবদল হোসেন সরদারি প্যারিসে ইরানী কনস্যুলেটের কর্মকর্তা নাৎসীদের হাতে বন্দী ইহুদীদের কৌশলে সহায়তা করতে তার পজিশনকে ব্যাবহার করেছেন। পরে তিনি ইরানী সিন্ডলারে পরিনত হন, দখলদার জার্মানদের বুঝান যে, ইরানিরা হচ্ছে আর্য এবং ইরানি ইহদীরা মহান সম্রাট সাইরাসের সময় থেকে ইরানী এবং সেই কারনে তাদের নির্যাতন করা উচিৎ নয়। পরে তিনি শত শত অ-ইরানি ইহুদীকে পাস্পোর্ট দেন এবং তাদের জীবন বাঁচান।

প্যারিসের অদুরে ফ্রেঞ্চ মুসলিম হাসপাতালের তিউনিশিয়ান সমন্বয়ক আহমেদ সোমিয়া গোপন অস্ত্রভান্ডারের ব্যাবস্থা করেন, প্রতিরোধ রেডিও ট্রান্সমিশন সহজতর করে দেন, প্রতিরোধ যোদ্ধাদের চিকিৎসা দেন এবং আহত ব্রিটিশ ও আমেরিকান পাইলটদের ভুয়া টিবি ওয়ার্ডে লুকিয়ে রাখেন, যেখানে গেস্টাপো ও ফ্রেঞ্চ জেনডার্মের সদস্যরা যেতে ভয় পেত।

নুর পরে ফ্রান্স ও ব্রিটিশ কর্তৃক মরনোত্তর সামরিক ও বেসামরিক সম্মানে ভুষিত হয়েছেন। কিন্তু ব্রিটিশ-ইন্ডিয়ান ২.৫ মিলিয়ন অদম্য বীর, যারা বিশ্বব্যাপী অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, তারা সহ অন্যান্য মুসলিমদের কি পেয়েছে? রেকর্ডকৃত ইতিহাসে এই বৃহৎ স্বেচছাসেবী বাহিনীতে হিন্দু, বৌদধ সেনাদের মত মুসলিমরা (বাহিনীর প্রায় এক তৃতীয়াংশ) গুরুত্বপুর্ন ভুমিকা পালন করেছে। যুদ্ধের সময় চার্চিল রুজভেল্টের কাছে লেখা এক চিঠিতে উল্লেখ করেছিলেন- ‘মুসলিম সৈন্যরা প্রধান আর্মি এলিমেন্টগুলো সরবরাহ করছে, দ্রুত আক্রমনের জন্য যার উপর আমরা (ব্রিটিশ) অবশ্যই নির্ভর করি’। ১৯৪৪ -৪৫ সালে ‘দ্য গলে ফ্রি ফ্রান্স ফোর্সে’ যোগদানকারি আফ্রিকায় ফরাসী বাহিনীর কলেবর বৃদ্ধি করে ২৬০০০০ পুরুষ সৈন্য নিয়োগ দেওয়া হয়,যাদের ৫০ শতাংশ ছিল উত্তর আফ্রিকান, যার বেশীরভাগ ছিল মুসলিম, সেখানে সেনেগালিজ মুসলিম রাইফেলমেনদের একটি শক্তিশালী গ্রুপ ছিল। এই বাহিনী ইতালি আক্রমন করে এবং দক্ষিন ফ্রান্স মুক্ত করে। আমেরিকান ইতিহাসবিদ জুয়ান কোলের মতে- আর্য ইউরোপে এই কালো চামড়ার মানুষদের যুদ্ধ এবং আর্যদের পরাজয়, জার্মান সেনাদের নিজ জাতির শ্রেষ্টত্বের ব্যাপারে সন্দিহান ও হতাশ করে তোলে।

পুর্ব ইউরোপ আরো বেশী দৃষ্টান্ত অফার করে। উদাহরণস্বরুপ- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বলকান রাষ্ট্র আলবেনিয়াতে মাত্র ২০০ ইহুদী বাস করত, কিন্তু যুদ্ধ শেষে দেখা গেল আলবেনিয়াতে প্রায় ২০০০ ইহুদী আছে। কারন, গ্রিস, অস্ট্রিয়া ও ইউরোপের অন্যান্য অংশ থেকে বহু ইহুদী পালিয়ে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ আলবেনিয়াতে আশ্রয় নেয়, আলবেনিয়া তাদের লুকিয়ে রাখে এবং রক্ষা করে।

কোল ডি ডে’র ৭০ তম বার্ষিকীতে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছেন- খুব কম সংখ্যক মুসলিমই অক্ষ শক্তিকে সমর্থন করেছে। পশ্চিমা সম্রাজ্যবাদে ক্ষুব্ধ ও বিকল্প শক্তির উত্থান তাদের স্বাধীনতা অর্জনে সহায়তা করবে, এই আশায় অতি নগন্য সংখ্যক মুসলিমই অক্ষশক্তিকে সমর্থন করেছে। যেসব মুসলিম মিত্র শক্তিকে শুধু সমর্থনই করেনি, বরং প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধ করেছে, তাদের চেয়ে অক্ষশক্তিকে সমর্থনকারি মুসলিমের সংখ্যা খুবই নগন্য।

ইতিহাসের পুস্তকে অনুপস্থিত কাহিনীগুলোকে উদ্ধার করা হচ্ছে এই ডকুমেন্টারির অন্যতম একটি কাজ। নুরের ত্যাগ ও এই রকম আরো কিছু, মধ্যপ্রাচ্যের সাম্প্রতিক ইতিহাসের সাথে বেমানান মনে হয়, যার যোদ্ধারা কিনা আরব, তুর্কি, ইরানী অথবা ইসরাঈলী, তাদের নিজ স্বার্থের কারণে মুসলিম-ইহুদী কোলারোরেশনের ইতিহাসকে ঢেকে রাখতে চাইতে পারে। কিন্তু এইসব কাহিনিগুলোকে স্মরণ ও সম্মান করা উচিৎ। নুর ইনায়েত খানের কাহিনীতে আমি আন্তরিক ভাবে সেই আশাই করেছি।

ওয়াশিংটন পোস্ট থেকে অনুবাদ- মৃনাল হাসান

বিষয়: বিবিধ

১২৭৪ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

319165
১০ মে ২০১৫ সকাল ০৮:১৪
আবু জারীর লিখেছেন : ভালো লাগলো
ধন্যবাদ
319247
১০ মে ২০১৫ বিকাল ০৫:৩৭
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : নুর ইনায়েত খান এর কথা আগেও পড়েছি। তিনি টিপু সুলতান এর অন্যতম উত্তরাধিকারি ছিলেন।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File