ভয়াল ২৯শে এপ্রিল : প্রলঙ্ককরী ঘূর্ণিঝড় স্মরণে

লিখেছেন লিখেছেন সালমা ২৯ এপ্রিল, ২০১৪, ০২:২০:১৫ দুপুর



শাঁ শাঁ শাঁ.... কড় কড় কড়াৎ....! অবিরাম মহা প্রলয়ের ঘনঘটা বাড়ছে। প্রতিটি ক্ষণে শরীরের লোমকূপ খাড়া হয়ে যাচ্ছে। ভয়ে আতঙ্কে ছোট ভাই বোনদের লোম যে খাড়া হয়েছে, তা আর স্তিমিত হবার লক্ষণ নাই। প্রকৃতি যেন নিজে নিজের উপর প্রতিশোধ নিচ্ছে। ঘরের পাশেই দাঁড়ানে বিরাট নারকেল গাছটি যখন, তুলার ন্যায় শূন্যের উপর ঘুরে শত মাইল গতিতে, অন্য গাছের উপরে আঘাত হানল; তখন বুঝতে বাকি রইল না, আজকেই পৃথিবীতে আমাদের শেষ রাত। সবাই দোয়া পড়ছি, বাঁচার সম্ভাবনা আগেই তিরোহিত হয়েছে। সবার মৃত্যু কিভাবে হবে, তার জন্য চরম উৎকণ্ঠা আর বিভীষিকাময় আতঙ্ক নিয়ে প্রতিটি মুহূর্ত পার করছি। বাবা চিৎকার করে দোয়া পড়ছেন, “সোবহানাল্লাহে ওয়াল হামদুলিল্লাহে ওয়া লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবর”। দোয়ার কোন অর্থ জানিনা, এটি আগে কখনও শুনিনি। আমাদের একমাত্র নির্ভর ও নিরাপত্তা দাতা পিতার আতঙ্কজনক রক্ত শূন্য সাদা চেহারা দেখে বুঝলাম; এই দোয়ার বরকতে বাঁচার ক্ষীণ সম্ভাবনা হয়ত আছে নতুবা নয়। আমরাও সবাই তার সাথে সাথে দোয়া পড়তে রইলাম। নিশুতি রাত্রের গভীর আঁধারে বাহিরে ভেতরে কয়েকটি তাজা প্রাণ অন্তহীন তাণ্ডব অনুভব করছি; একটি হ্যারিকেন বাতিকে ঘিরে! তিন বছরের ছোট অবুঝ বোনটি ডাঁশের মত চোখ পাকিয়ে, ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। সেও বুঝে গেছে বাহিরের হাজারো আতঙ্কময় চিৎকার ও কর্কট আওয়াজ; কখনও খুশীর নয়, বরং তা এক মহাপ্রলয়ের পদধ্বনি।

বাবা চাকুরী জীবনের প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে যে কটি টাকা পেয়েছিলেন; সেটা দিয়ে কয়েক বন্ধু মিলে ব্যবসা শুরু করেন। তম্মধ্যে একবন্ধু সমুদয় টাকা নিয়ে ব্যবসায়ীক মালামাল আনতে গেলে; ধারনা করা হয়, সর্বহারাদের কবলে পড়ে, টাকা সহ তিনি চিরতরে হারিয়ে যান। যাকে আর কোনদিন পাওয়া যায়নি। ফলে বাবাকে দীর্ঘদিন সে অসহায় পরিবারের ঘানি টানতে হয়। সর্বহারা সদস্যরা নিজেদের আদর্শ বাস্তবায়নে, আরো চারটি পরিবারকে নতুন করে সর্বহারা করেন। সবকিছু হারিয়ে বাবা একপর্যায়ে পথে বসেন। অবশেষে পৈত্রিকভাবে প্রাপ্ত সম্পদ বিক্রি করে, চাচাদের পরামর্শে, বাবা চট্টগ্রাম শহরের স্টিল মিল এলাকায় ব্যবসা শুরু করেন। সুখে-দুঃখে সর্বদা তিনি পরিবার সাথে রাখতেন। বাবার সরকারী চাকুরীর সুবাদে আমরা দেশের বহু জায়গায় তার সাথে থাকা ও দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। সব হারানো পিতার, এত কষ্টের মাঝেও তিনি আমাদেরকে গ্রামের বাড়ীতে রেখে আসতে ইচ্ছুক ছিলেন না। তার কথা ছিল; সন্তানেরা বাবার দুঃখ কষ্ট নিকট থেকে দেখলে, তারা পিতা-মাতার প্রতি দয়াশীল হয়। সন্তানেরা কখনও কল্পনামুখী জীবন বাছাই করেনা। ফলে তিনি স্টিল মিল এলাকায় একটি বাড়ী ভাড়া নিলেন; যার পিছনে ছিল বড় পুকুর। তখনও সেখানে দালান-কোটার বাসা ভাড়া চালু হয়নি। জীবনে এই প্রথম, বাবা আমাদের জন্য ছাদ বিহীন একটি টিনের চাউনি ঘরে থাকার ব্যবস্থা করলেন। বারবার মনে পড়ল, গ্রামের দোতলা বাড়ীটির কথা, যার চারিদিকে প্রসস্থ বারান্দা, সামনে-পিছনে বিরাট উঠানে। সেই বাড়ি ফেলে, শহরের জীবনে এই বাড়ীটিতে উঠেছি। তারপরও আনন্দিত এ কারণে যে, আমি বাবার জন্য পাগল ছিলাম, তিনিও আমাকে সর্বক্ষণ না দেখলে পাগল হতেন।

বিকাল থেকেই হালকা গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল, পুরো আকাশ গুমোট বাঁধা। সারাদিন সূর্যের আলোর দেখা নাই, পুরো আকাশটাই ধূসর-কালো হালকা মেঘে ঢাকা। রেডিও-টিভিতে অনবরত ঘোষণা চলছে, সন্ধ্যার মধ্যেই ঘূর্ণিঝড় চট্টগ্রাম উপকূলে আঘাত হানবে, তাই ১০ নম্বর মহা বিপদ সঙ্কেত ঘোষণা করা হল। আমি এ এলাকাতে আসার পর এটি এ ধরনের তৃতীয় ১০ নম্বর মহা বিপদ সঙ্কেত। আগের দুটি দেখে বুঝে নিয়েছিলাম ১০ নম্বরের এর মাত্রা কেমন হবে। পরিপূর্ণ বাতাস শুরু না হওয়া পর্যন্ত কেউ দোকান বন্ধ করতনা। তবে আজকের বিপদ সঙ্কেতে বাবাকে দেখলাম, কাষ্টমার ফিরিয়ে দিয়ে, দোকান বন্ধ করে ঠিক সন্ধ্যায় বাসায় ফিরেছেন। সবাইকে আগে খাইয়ে দেবার জন্য মাকে তাগাদা দিলেন। আমি তখনও কিশোরী, বড় এক বোন, ছোট দু’বোন ও এক ভাই। ছোটরা যথাক্রমে ৯ বছরের এক বোন, ৬ বছরের একমাত্র ভাই ও ৩ বছরের ছোট বোন। ঘটনাক্রমে তখন আমাদের বাসায় বেড়াতে এসেছিল আমার বৃদ্ধা নানী ও আমারই বয়সে ছোট, জেঠাত বোন। এই কয়জন বাবার নির্দেশে আগেভাগে খানা খেয়ে জড়সড় হয়ে বসে আছি। বাহিরে তখন ১০ নম্বর মহা বিপদ সঙ্কেতের ঘনঘটা। আমার সচেতন মা সন্ধ্যার আগেই, সবকিছু ভালভাবে গুছিয়ে, গুটিয়ে নিয়েছেন। সবাই আল্লাহর কাছে বিপদ থেমে মুক্ত থাকার জন্য দোয়া করছি।

আমাদের বাসস্থানের আশে পাশে খুবই ঘন বসতি এবং গাছ-গাছালী দিয়ে ভরা। এক মাইল পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে, পাহাড় সম উঁচু শহর রক্ষা বাঁধ। সাধারণত এই বাঁধ থেকেও এক মাইল পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরে পানির দেখা মিলে। এই বাঁধের কোল ঘেঁষে আছে জেলেদের পাড়া, আছে নানাবিধ অস্থায়ী বাসস্থান সহ ছিন্নমূল বস্তিবাসীর বিক্ষিপ্ত আবাস। হাজার হাজার মানুষ এখানে মাছ নির্ভর ব্যবসা করে। সেগুলো উত্তরে দক্ষিণে অনেক মাইলব্যাপী বিস্তৃত। চট্টগ্রাম শহরের এই জায়গাটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও জনবসতিপূর্ণ এলাকা। এখানে রয়েছে দেশেরে প্রথম ই,পি,জেট তখন প্রায় ৪০ হাজার মানুষের আয়ের কেন্দ্রস্থল (বর্তমানে কয়েক লক্ষ)। নৌ-বাহিনী ও বিমান বাহিনীর বিভাগীয় সদর দপ্তর ও ঘাঁটি। বিমান বন্দর, মেরিন একাডেমী এখানেই অবস্থিত। দেশ খ্যাত স্টিল মিল সহ, আরো মিলের অবস্থান ছাড়াও এটি দেশের একমাত্র ব্যস্ত সমুদ্র বন্দর। সকালে-বিকালে লক্ষ লক্ষ মানুষের জনস্রোত দেখলে তাজ্জব হতে হয়, এই এলাকা কত খেটে খাওয়া মানুষের প্রিয় জায়গা।

রাত ১০ টার দিকে হালকা বাতাস শুরু হল; ১২ টার দিকে বাতাসের তীব্রতা অস্বাভাবিক বেড়ে গেল। দেওয়ালের ফাঁক দিয়ে দেখা গেল, কোন আস্ত গাছ দাঁড়িয়ে নাই! সুপারি গাছ গুলো যেন মাটিতে সেজদাবনত। সুযোগই পাচ্ছেনা কোমর সোজা করার জন্য। টিন, গাছের ডাল, ঘরের লাকড়ি; চেয়ার, টেবিল ও খাট আকাশে শূন্যের মাঝে তীব্র গতিতে ঘুরছে। আবার সেগুলো ততোধিক তীব্র গতিতে কখনও কারো ঘরের উপর আছড়ে পড়ছে। যে ঘরের উপর আছড়ে পড়ছে, সেটি যতই মজবুত হোক না কেন, মুহূর্তেই চ্যাপ্টা হয়ে যাচ্ছে। বাতাসের তীব্র গতির আওয়াজের কারণে, মানুষের ক্রন্দন বোঝার উপায় নাই। কেননা আকাশে ঘূর্ণায়মান বস্তুর মহা দামামার বিকট আওয়াজে, মানুষের অসহায়ত্বকে চাপা দিয়েছে। মহা আতঙ্কে, চেহারার রক্ত শুকিয়ে সাদা হওয়া, অসহায় একদল মানুষ আমাদের ঘরেই আছে। সবাই দৈব সাহায্যের প্রত্যাশায় কান্না ও চিৎকারের কথা চিরতরে ভুলে গেছে। ভাড়া বাসার শহুরে সমাজে কার উদ্দেশ্যে সাহায্যের আশায় চিল্লানো যাবে? সেখানে নীরব গলায় আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়া ব্যতীত কোন উপায় থাকেনা। সর্বক্ষেত্রে আল্লাই একমাত্র ভরসা, বিপদে মুছিবতে সর্বদা মানুষ আল্লাহর কাছাকাছি হয়।

মনে হল বাহিরে আওয়াজের একপ্রকার হঠাৎ পরিবর্তন হয়েছে; তাই খটকা লাগল। বাবাকে বললাম দরজা খুলে একটু দেখুন। তিনি কড়াভাবে জানালেন কোন অবস্থাতেই দরজা খুলবেন না। দরজা খুললে বাতাসের গতির সাথে তিনি পারবেন না। খেয়াল করে দেখলাম দরজার ফাঁক গলে, ঘরে পানি ঢুকছে। ইশারায় ৬ বছর বয়সী ছোট ভাইকে বললাম, তোমার প্রস্রাব ধরেছে বলে কান্না কর। আমার মন বলছে এখুনি দরজাটা খুলে ফেলি। ছোট ভাই ও আমার চাপে বাবা; ভাইকে তার পায়ের কাছে ধরে, যেই মাত্র দরজা ফাঁক করেছেন, সেই মুহূর্তে চিৎকার দিলেন; পালাও। কিছু বুঝে উঠার আগেই, মুহূর্তের মধ্যে প্রবল বেগে ঘরে পানি ঢুকে গেল। আমরা উলট পালট খেয়ে সবাই ভেসে উঠলাম ঠিক ঘরের উপরে, টিনের কাছাকাছি। মুহূর্তেই ঘরের সমুদয় জিনিষ ভেসে উঠল। দোচালা টিনের ঠিক উপরের ফাঁকে একবার নিঃশ্বাস নেবার সুযোগ ঘটল। বুঝতে পারলাম ঘরের টিনের উপরেও পানির স্রোত বয়ে যাচ্ছে। ঘরের ভিতর অসম্ভব অন্ধকারে সবাই ভাসছি আর এক হাতে ছোট বোনকে ধরেছি। নানু চাচাত বোনকে ধরতে পেরেছেন। মায়ের কোলে ছোট বোন থাকার কারণে, মায়ের সাথে সেও ভেসে উঠল। বাবা ছোট ভাই মুহূর্তে কোথায় হারিয়ে গেল বুঝতে পারলাম না। কে মরল, কে বাঁচল সে ধারনা মাথায় ঢুকানোর সময় নাই, এক মুহূর্ত শুধু ভাবলাম; আল্লাহ যে কেয়ামতের কথা বলেছিলেন, সেই কেয়ামত ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। ভাবার সময় কোথায়? প্রতিটি সেকেন্ড মহা মূল্যবান, উপরে নীচে প্রবল বেগে ছুটছে পানি। টিনের নীচের শেষ অক্সিজেন টুকু টেনে নেয়া মাত্রই, আরেকটি বিশাল ধাক্কায় পুরো বাড়ীর টিনের চালটি মুহূর্তে উল্টে গেল। চাল চলে গেলেও আমরা যথাস্থানে ঠিক ঘরের মধ্যেই আটকা পড়ি। প্রবল গতিতে ঘরের চাল যাওয়ার প্রাক্ষালে পাকা দেওয়াল ভেঙ্গে, মুহূর্তের মধ্যে বাড়িটি হারিয়ে যায়।

তীব্র গতিপ্রাপ্ত টিনের চালের পেছন পেছন আমরা সবাই এক মুহূর্তে ভেসে গেলাম। সে রাত ছিল পূর্ণিমার রাত, ঝড়ের তাণ্ডবে সবাই ভেসে যাচ্ছে, সবার আতঙ্কিত কান্নার স্বরও শুনতে পাচ্ছি। আমার পাশেই মাকে ভাসমান অবস্থায় উদ্ধার করলাম, তিনি চিৎকার করে উঠলেন, হায় হায় লায়লা ফসকে গেছে, ঐ তো ডুবে যাচ্ছে। হাত পা নাড়ানো অবস্থায় কাদা পানি খেতে খেতে সামনেই তলিয়ে যাচ্ছে তিন বছরের ছোট বোনটি! গায়ের সমুদয় শক্তি জোগাড় করে, ডুবন্ত স্থানে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। একটা পা পেলাম, বুঝলাম না কার পা; হ্যাঁচকা টানে উপরে ভাসালাম। নিথর দেহের একটি বাচ্চা উঠে এলো, মা বললেন হ্যাঁ লায়লা, বুঝলাম না বেঁচে আছে কিনা। সবাই চলমান স্রোতের সাথে লড়ছি, আর ভেসে চলছি। মনে হল একটি বড় বড় পুকুরের উপর ঘূর্ণায়মান ভাসছি। দুই বোনের পরিচিত ডাক শুনতে পেলাম। আওয়াজ বরাবর যেতে চেষ্টা করলাম, পারলাম না। যায়গাটিতে সবকিছু জমে বিরাট জটলার সৃষ্টি হয়েছে।

কেন জানি এখানে পানির স্রোত কম, আমিও ডাকতে রইলাম। তাদের ডাকের সাড়া পেলাম, কাছাকাছি ভিড়াটা কঠিন হয়ে উঠল। গাছ, কাঠ, টিন ও আসবাব পত্রের সাথে, অসংখ্য মানুষের লাশ; গরু, ছাগল, কুকুর, বিড়াল, হাঁস, মুরগী, কাকের লাশ ভাসছে। বাবা আর ছোট ভাই ছাড়া সবাই, সেই পুকুরের কুন্ডলী থেকে সাঁতরিয়ে কোনমতে একত্রিত হলাম। যেই না একে অন্যের হাত ধরে চিন্তা করছি কি করব; ঠিক সেই মুহুর্তে বিশাল আকৃতির আরেকটি ঢেউ আমাদের উপর আছড়িয়ে পড়ল। আমরা ডুবে যাওয়া থেকে রেহাই পেলেও মুহুর্তের মধ্যে পানি ফুলে ভবনের দুই তলা পর্যন্ত ঢুবিয়ে নেয়। অধিক গাছ পালা থাকার কারনে ঢেউ গুলো উপর দিয়ে না এসে, পানি ফুলে যাবার মাধ্যমে প্রকাশ ঘটল। পানির আবার তীব্র স্রোত তৈরী হল, প্রচন্ড স্রোতে যেদিকে ভেসে যাচ্ছি, তার একটু সামনেই প্রকট বিষ্ফোরণ হল, ভয়ানক ভাবে আগুন জ্বলে উঠল। পুরো পানিতে আগুন ছড়িয়ে গেল। বুঝতে পারছিনা কি করা উচিত। নিজেদের উপর নিজেদের নিয়ন্ত্রন নাই, সোজা আগুনের উপর দিয়েই আমাদের স্রোত। ভাবলাম অবশেষে আগুনে পুড়ে মরতে হবে! আগুনের কাছাকাছি পৌছামাত্র, পানির আরেকটি প্রবল ধাক্ষা! সবাই চিৎকার করে উঠলাম। মুহূর্তে তাকিয়ে দেখি আগুন আমাদের পিছনে পড়ে গেছে। বুঝতেই পারিনি ঢেউয়ের এক ধাক্কায় এতটুকু পথ দ্রুত পাড়ি দিয়ে ফেলেছি! পেছনে শুনতে পেলাম অনেক মানুষের আতঙ্কিত কণ্ঠস্বর আর চিৎকার। বুঝলাম রেল রাস্তার পাশে যে গ্যাস সংযোগ কেন্দ্র ছিল, সেটা ভেঙ্গে গেছে; ফলে সেখানে আগুন ধরেছে এবং নতুন আরেকটি বিপদ যোগ হয়েছে।

পানির স্রোত আমাদেরকে একটি পাঁচ তলা ভবনের সামনে দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। দূরে থেকে অনুমান করলাম, ভবনের দুই তলা পর্যন্ত ঢুবে গেছে। তৃতীয় তলার গ্রিল লাগানো বারান্দায় মানুষ জন দাঁড়িয়ে আছে। বাতাসের গতি অনেক কমে গেছে, পানির বন্যা থই থই করছে, বিক্ষিপ্তভাবে স্রোত তৈরি হচ্ছে। আমাদের নজর যখন ঠিক পাঁচ তলা ভবনের দিকে, ঠিক তখনই সবাই, পানির নীচে তার কাঁটার জালে আটকা পড়েছি। পায়ের নীচে অগণিত লাশ বাধা পড়েছে; এই তার কাঁটায় আটকা পড়ে মারা গেছে অনেক মানুষ, পায়ের নীচে লাশের দেওয়াল অনুভূত হচ্ছে। স্থানীয় চেয়ারম্যানেরা দুই ভাই, আজন্ম শত্রু, কারো চেহারা কেউ দেখেননা। শত্রুতার পরিমাণ ও ধরন বুঝানোর জন্য, সীমানা প্রাচীরের উপরে, ভবনের দুই তলা পরিমাণ উঁচু তার কাঁটা বসিয়েছে। পানির উচ্চতা আর তার কাটার উচ্চতা প্রায় সমান হয়েছিল; ফলে বহু জীবন্ত মানুষ এই মরণ ফাঁদে মরেছিল। আমাদের আটকে পড়ার মুহূর্তে নতুন ঢেউ না থাকায়, মাংস ছিলে বহু কষ্টে উদ্ধার পেয়েছিলাম। পা দুটো ফালা ফালা হয়ে যায়। তাছাড়া ঐ তারে আটকানো চিনের টুকরা, কাঠের সাথে লাগানো পেরেক ও তারের সূচাগ্র কাঁটা পুরো শরীর ক্ষত বিক্ষত হয়ে যায়। আরেকটি ঢেউ এসে পড়ার আগেই, অনেকে কাপড়-চোপরের মায়া ত্যাগ করে, অবধারিত মৃত্যুর জটলা থেকে উদ্ধার পায়।

সাঁতরিয়ে সেই পাঁচ তলা ভবনের, দ্বিতীয় তলার ফ্লোরের রড ধরে ভাসলাম। এটি এই এলাকার চেয়ারম্যানের বাড়ি। তারা অতীতে অনেক দুঃখ কষ্টে বড় হয়েছেন। একদা তাদের বংশের একজন জাহাজ থেকে লাফিয়ে, সমুদ্রে সাঁতরিয়ে আমেরিকার উপকূলে উঠতে পেরেছিলেন। আমেরিকার টাকায় তারা বড় মানুষ হিসেবে পরিচিত এবং বর্তমানে চেয়ারম্যান। আমরা সবাই তার ভবনের দ্বিতীয় তলার ফ্লোর ধরে ভেসে আছি এবং সাহায্যের জন্য চিৎকার করছি। ঘর থেকে কঠোর কণ্ঠে দারোয়ানের প্রতি নির্দেশ জারি হল। কাউকে ঘরে ঢুকতে দেবেনা, ভেজা শরীরে ঢুকে সব বরবাদ করে দেবে। সৌভাগ্যক্রমে ভবনের সিঁড়িটি আবিষ্কার করলাম এবং তৃতীয় তলায় ঘরে ঢুকার জন্য যেখানে দাঁড়াতে হয়, সেখানে গিয়ে দাঁড়াতে পারলাম। কলাপসিবল গেট বন্ধ, ভিতরে দারোয়ান বসা। অনুরোধ করলাম, আমাদেরকে যেন সকাল পর্যন্ত তাদের বাসার বারান্দায় বসার সুযোগ দেয়। আবেদন যথারীতি প্রত্যাখ্যাত হল এই ভয়ে; শরীরে ভিজা কাপড়ের পানি দিয়ে ঘর ভিজিয়ে দিব, কিংবা আমেরিকান দামী জিনিষ নষ্ট করব! বললাম সকালে যাবার কালে ভেজা ঘর, মুছে পরিষ্কার করে যাব। উল্টো নির্দেশ আসল, যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সেখান থেকেই যেন সরে যাই। বললাম আমাদের শরীরের পানিতে ঘর ভিজে যাবে বলে ঘরে ঢুকার অনুমতি দিলেন না। ইতিমধ্যে আপনাদের দুটি ফ্লোর পানির নীচে তলীয়ে আছে। বাহিরে হাজার হাজার মানুষ মরেছে। এর পরের ঢেউ আসলে অন্যদের মত, আমাদের সাথে আপনাদেরকেও মরতে হবে। আরো বললাম, আমাদের সবাই আহত, ছোটবোন আর নানীর নাকে-মুখে লবণাক্ত কাদা পানি ঢুকেছে; নিঃশ্বাস নিতে পারছেনা, অন্তত একটু পরিষ্কার পানি দিন, তাহলে তাদের বাঁচিয়ে রাখতে পারব। দারোয়ান এক মগ পানি নিয়ে আসলেন এবং গ্রিলের ফাঁক দিয়ে দিতে চেষ্টা করলেন। চেষ্টা বার বার ব্যর্থ হল; এবার দারোয়ান ভয়ে ভয়ে কলাপসিবল গেট খুললেন। পানি দিতে এসে আমাদের কাঁপুনি, স্বল্প বসনে দেহ এবং ক্ষত বিক্ষত রক্তার্থ শরীর দেখে, তার দিলে দয়ার উদ্রেক হল। তিনি আমাদের ইশারা দিলেন, চিৎকার না করে এখানে বসে পড়ুন, সকালেই বের হয়ে যাবেন!

শেষ রাতের দিকে, বাতাসের তাণ্ডব বন্ধ হল, সকালের আবছা আলোতে দেখলাম চারিদিকে থৈ থৈ পানি। যতটুকু নজর যায় শুধু লাশ আর লাশ। রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, চারিদিকে কেয়ামতের আলামত। কোথাও একটি গাছ আস্ত দাঁড়িয়ে নাই, একটি ঘরও অক্ষত নাই, ভেঙ্গে যাওয়া গ্যাস কেন্দ্রের আগুনের মাত্রা আরো বেড়েছে। মনে হল পানি একটু কমেছে, রাত্রে সাঁতরিয়ে যে স্থান দিয়ে সিঁড়িতে ঢুকেছিলাম, সে স্থান এখন মাথার উপরে, তবে সব এক তলা বাড়ীগুলো এখনও পানির নীচে। শরীরের ক্ষতস্থানগুলো একপ্রকার ফ্যাকাসে হয়ে গেছে, তখনও রক্ত ঝাড়ছিল, সবার শরীর ব্যথায় কাতর। সরব জনপদের এই বিরান পরিণতি দেখে সবার কান্না শুরু হল। নতুন করে ভাবা শুরু করছি, এখন কি করা যায়। আমার বয়স ১৩ হলেও এই অসহায় মানুষগুলোর জন্য এই মুহূর্তে আমিই অভিভাবক। কেউ মুখে কিছু না বললেও, সবাই ধরে নিয়েছে পিতা ও ৬ বছর বয়সী একমাত্র ছোট ভাইয়ের পরিণতি অন্য দশ জনের মতই হয়েছে। ভাবছি যদি লাশগুলো উদ্ধার হয়, তাহলে মনকে সান্ত্বনা দেওয়া যাবে। তবে কিভাবে শুরু করব, কোথা থেকে শুরু করব ভেবে পাচ্ছিনা। এখানে আমাদের কোন আত্মীয় স্বজন নাই। ভয়াবহ এই বিপদ থেকে অলৌকিক ভাবে আল্লাহ আমাদের উদ্ধার করেছেন, হয়ত বাকিগুলো তিনি ভালভাবে সমাধা করার সুযোগ দিবেন।

এমন সময় দেখি, ঢুবে যাওয়া এক বাড়ীর সীমানা প্রাচীরের উপর দিয়ে হেঁটে এদিকে আসছে এক কিশোরী এবং মেরী, মেরী বলে সজোরে চিল্লাচ্ছে। আমার খুবই পরিচিত কণ্ঠস্বর! সে জিন্নাত। এলাকায় স্থানীয় মেয়ে, আমার ক্লাস মেট ও এখানে আসার পর প্রথম বান্ধবী। সেও জানেনা আমাদের কি অবস্থা, তারপরও মনুষ্যত্বের টানে, ভোর বেলাতেই বের হয়েছে আমাদের খবর নিতে। সে নিজেই একটি পথ আবিষ্কার করে, বাড়ী-ঘরের দেওয়ালের উপর দিয়ে এতটুকু এসেছে। এখান থেকে আমাদের বাসা দূরে হলেও সে আমাদেরকে এই বাড়ীতে পেয়ে যায়। তাকে চিল্লায়ে আমাদের বেঁচে থাকা ও বাপ-ভাইকে হারানোর কথা জানালাম। সে উত্তরে জানাল, মেইন রোডে হাজার হাজার লাশ। জিবীত ও আহত মানুষেরা লাশ সংগ্রহ করছে, তুমি আমার সাথে আস, সেখানে কাউকে পেতে পারি। আমি এবং সে পাতলা ছিলাম বলে, তার দেখানো পথে, দেওয়ালের উপর দিয়ে হাঁটা দিলাম। জিনাতের সাথে যাবার সময় পিছনে ফিরে দেখি, চরম আহত মা আর নানু ততক্ষনে চেয়ারম্যানের ভিজানো বারান্দার পানি মুছতে শুরু করেছেন!

মেইন রাস্তায় নামার পর নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিনা, কত লাশ বিকৃতভাবে রাস্তার পাশে শোয়ানো। তখনও ঢেউয়ের জোড়ে লাশ ভেসে আসছে আর রাস্তার পাশে ভিড়ছে। কোন লাশের শরীরে কাপড় নেই, তাই শুধুমাত্র মহিলাদের লাশগুলোকে টুকরো কাপড় দিয়ে ইজ্জত আব্রু ঢাকার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। অবশেষে সেখানে কাপড়ের অভাব দেখা দিল। আমি বাবা ও ভাইয়ের আকৃতির প্রতিটি পুরুষের লাশ উল্টিয়ে বাবা ও ভাইকে খোঁজছি; আর উদ্ভ্রান্তের মত সী বীচের দিকে দৌঁড়াচ্ছি। পানির কাছাকাছি ভাসতে থাকা লাশগুলোও পরখ করে দেখছি সেখানেও থাকতে পারে কিনা? আমার সহমর্মী বান্ধবীও আমাকে সেভাবে ক্লান্তিহীন সহযোগীতা দিচ্ছে। সে যদি সাথে না থাকত, দীর্ঘ চার কিলোমিটার পর্যন্ত বাবা-ভাইয়ের সন্ধানে শত শত লাশকে উল্টিয়ে দেখার মত হিম্মত পেতাম না। অল্প শোকে কাতর, অধিক শোকে পাথর হয়ে, কান্নার কথা ভূলে গেছি, বুঝতে পারছি রাত্রে কেয়ামতের চোবলে, চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। হারানো বাবা-ভাইকে খোঁজতে এসে, ইতিমধ্যে মা-বোনদের কিভাবে রেখে এসেছি তা ভূলে গেছি। সামনে একটি লাশকে ভাসতে দেখে এই প্রথম থমকে দাঁড়ালাম। কাটগড়ের এই জায়গাতে এখনও কেউ উদ্ধার তৎপরতা শুরু করেনি। মনে হল এ জায়গার কোন মানুষই বেঁচে নাই। পানির ঢেউয়ের আওয়াজ ছাড়া, কোন কিছুর আওয়াজ নাই। অসম্ভব নীরবতা এখানে; লাল শাড়ী, লাল ব্লাউজ পড়া লাশ; হাতে চুড়ি, কানে দূল, নাকে নোলক ও গলায় তখনও স্বর্নের হাঁর খানা লেপ্টে আছে। হিন্দু নব বধুই হবে; হয়ত আজকের রাতে বিয়ে ছিল, মাথায় লাল সিঁথি তখনও স্পষ্ট চিক চিক করছে।

আরো যেতে চাইলাম, এই প্রথম জিনাত ওদিকে আর না যেতে বারণ করল। পূনরায় একই পথে ছুটলাম, ততক্ষনে নতুন ভাবে আরো হাজারো লাশ জড়ো হয়েছে। একইভাবে প্রতিটি লাশ চেক করতে করতে পুরানো গন্তব্যের দিকে ছুটলাম। দু’জন কিশোরী মেয়ে আপন জনের লাশের সন্ধানে, শত শত লাশ উল্টিয়ে দেখার ভৌতিক দৃশ্য কেমন, তা কেবল দিব্যদৃষ্টি সম্পন্ন মানুষই বুঝতে পারে। বন্দর টিলা ঈশা খাঁ গেইটের সামনে যখন পৌঁছি তখন মধ্যাহ্নে পেরিয়ে গেছে। ততক্ষণে উদ্ধারকারী ও লাশের সংখ্যা দুটোই বেড়ে গেছে। আর কত লাশ দেখব, কোথায় দেখব? কূল কিনারা করতে পারছিনা। ততক্ষণে মনে হল প্রচণ্ড খিদে ও পিপাসায় আক্রান্ত হয়েছি। শরীর আর চলছেনা, সেই রাত ১০ টা থেকে পরদিন দুপুর পর্যন্ত প্রায় ১৪ ঘণ্টা প্রকৃতির সাথে লড়াই করে চলছি। আমাদের স্কুলের সামনে একটি নলকূপ ছিল, পানির আশায় সেদিকে ছুটলাম। রাস্তার ওপারে গতরাত্রে এসব এলাকাও পানিতে ভাসিয়েছিল, তবে পানি হয়েছিল গলা পরিমাণ, তাই সম্পদের ক্ষতি হলেও, প্রাণের ক্ষতি হয়েছে কম। যখনি নলকূপের কাছে গেলাম, জিন্নাত শুনতে পেল, আমার নাম ধরে কেউ একজন তার কন্যাকে খুঁজে ফিরছে। খেয়াল করে দেখলাম হ্যাঁ ঠিক তাই, তবে সেটি আমার বাবার গলা নয়। তিনি কোনদিকে, কোথা থেকে চিৎকার করছেন শত চেষ্টা করেও বুঝতে পারলাম না। পানি পান করার কথা ভুলে গেলাম, গায়ের সমুদয় বল, গলায় হাজির করে বলে উঠলাম; মেরী এখানে। বার বার, কয়েক বার, মনে হল তিনি আমার গলা শুনেতে পেয়েছেন। আবার বললাম মেরী স্কুলের সামনে। খানিক পরেই দেখলাম, একটি লোক উদভ্রান্তের মত ছুটে আসছে; পুরো গায়ে কাদা, ধুসর হয়েছে চামড়া, শুধু লুঙ্গি খানা পরনে। তিনি মাঠের দিকেই দৌঁড়ে আসছেন, পরিষ্কার চিনতে পারছিনা, আরো কাছাকাছি হলাম! হ্যাঁ! তিনি আমার বাবা! আমরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরলাম! জানিনা কতক্ষণ-কতসময় পিতা-কন্যা এভাবে ছিলাম। আমিই প্রশ্ন করলাম, বাবু কই? তিনি কোন উত্তর না দিয়ে উল্টো প্রশ্ন করলেন, আমার মা কই। তাকে বললাম সবাই কমবেশি আহত, তবে সবাই জীবিত আছে। এবার বলুন বাবু কোথায়? তিনি দীর্ঘক্ষণ থামলেন, চিন্তা করছেন, ঘর থেকে বের হয়ে, কি কি পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। সবার দুঃচিন্তায় তিনি সব ভুলে গেছেন; অবশেষে মনে করতে পারলেন, আমরা যে পরিমাণ জায়গা ভ্রমণ করে তাদের লাশের সন্ধান করেছি, তিনি ইতিমধ্যে সেসব জায়গা আমাদের সন্ধানে, পাঁচ বার ঘুরে এসেছেন। তারপর মনে করতে পারলেন, বাবুকে আমাদের বাসার পাশে নির্মাণাধীন ভবনের উপরে খালি আকাশের নীচে রেখে এসেছিলেন। যখন তিনি তাকে রেখে নীচে নামছিলেন, সে সময় পানির দ্বিতীয় ধাক্কাটা সে জায়গায় আঘাত হানে। এক মুহূর্তে নির্মাণাধীন ভবনের প্রায় সবটুকুই ঢুবে যায়। একটু পরে তিনি প্রায় সাঁতরে বাসার দিকে যেতে চেষ্টা করেন; ঢেউয়ের পরবর্তী প্রচণ্ড ধাক্কায় সে এলাকাতে অবশিষ্ট যা ছিল, সব কিছুই ভাসিয়ে নিয়ে যায়। তিনিও সে স্রোতের ধাক্কায় হারিয়ে যান। তিনি কিভাবে প্রাণে বেঁচেছেন, সেটা মাথায় আনতে পারছেনা। সকাল বেলা সাঁতরিয়ে তিনি বাবুর সন্ধানে গিয়েছিলেন; আমাদের বাসা কিংবা বাবুকে রেখে আসা বাড়িটির কোন হদিস তিনি পাননি।

পানি পান করার কথা ভুলে গিয়েছি, এই প্রথম আপন জনের জন্য কান্না আসল। আমার নাদুস-নুদুস একমাত্র ভাইটির চেহারা মনের পর্দায় ভেসে উঠল। তার শান্ত-সুন্দর চেহারা দেখলে, রাগান্বিত মানুষের গোস্বা ঠাণ্ডা হয়ে যেত। পাশের বাসার মানুষ বুঝতে পারত না যে, আমাদের কাছে একটি ছেলে বাচ্চা আছে। সে ছিল আমরা তিন বোনের কাছে “টেডি বেয়ারের” মত। আদর ব্যতীত তার অন্য কোন আবদার থাকতনা, কিছু চেয়ে জেদ করতনা, যেটা দিতাম সেটা পেয়ে খুবই উৎফুল্ল হত। প্রশ্ন করলে কি চাই তোমার? বলত আপনি যা দেন! আর যা দেওয়া হত, সেটা পেয়েই খুব খুশী হত। তাকে খুশী করা ছিল একেবারে সহজ। প্রতিবেশী বহু মানুষ শুধু তাকে দেখার জন্য, আমাদের ঘরে ক্ষণিকের মেহমান হতেন। একটি ভাইয়ের জন্য আমরা সব বোনেরা মিলে শবে ক্বদর, শবে বরাতের রাতে; একটি ভাইয়ে আশায় আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতাম। সে ধরনের একটি আদরণীয় ভাই পেয়েও দুর্ভাগ্যজনক ভাবে হারালাম! বাবা বললেন তুমি মায়ের কাছে যাও, বাবুকে খুঁজতে আমি আবারো যাচ্ছি, সেখানে অনেক পানি, তুমি যেতে পারবেনা।

সকাল বেলা বাবা-ভাইকে খুঁজতে গিয়ে, নতুন করে আমিই হারিয়ে গেছি। সেজন্য মা-নানুর কান্নার নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। তাদেরকে চেয়ারম্যানের বাড়ীর সিঁড়িতেই পেলাম। বাবার জীবিত থাকার কথা শুনে মনে হল তাদের দুর্বল শরীরে শক্তি ফিরে এসেছে। কিছুক্ষণ পরেই বাবা ছোটভাইকে জীবিত উদ্ধার করে আমাদের কাছে পৌঁছলেন। সবার সে কি আনন্দ! লেখায় বুঝানো দুষ্কর। সেখানে বাড়ী ঘরের কোন হদিস ছিলনা, আমাদের বাসায় একটি দেওয়াল, নির্মাণাধীন ভবনের, খালি পিলার গুলোই দাড়িয়ে ছিল। নির্মাণাধীন ভবনের ইট, সিমেন্ট মাটি সহ সব উদাও হয়ে যায়। তাছাড়া সকালে ওসব পানির নিচেই ছিল, যার কারণে বাবা সেটিকে চিহ্নিত করতে পারেনি, বাবা কৌতূহল বশত: তল্লাশি করতে গিয়ে দেখে, বাবু ছোট্ট ইটের গাঁথুনির আড়ালে সেভাবে বসে আসে, যেভাবে বাবা তাকে রেখে গিয়েছিলেন। সে উপুড় হয়ে ছিল, অসম্ভব কাঁপছিল তখনও বৃষ্টির গুড়ি গুড়ি ফোঁটা তার মাথা দেহের উপর আছড়ে পড়ছিল। আমরা সবাই একসাথে লড়াই করলেও ষোল ঘণ্টা সে একাকী সেখানেই ছিল। অবশেষে বাবা দোকানে খবর নিতে গেলেন। গিয়ে দেখলেন সেখানে কোনকালে দোকান ছিল, তার কোন অস্তিত্বই বর্তমান নাই। দু’দিন পরে বাবা আমাদের বাসায়, কাদায় আটকানো ব্যবহার্য ঘড়িটি উদ্ধার করেন। সেটির কাঁটা রাত ১ টা ১০ মিনিটে বন্ধ হয়ে যায়।

এটা ছিল ১৯৯১ সালের ২৯ শে এপিলের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের রাত। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বরিশাল, ভোলা ও নোয়াখালী সহ দেশের প্রায় অর্ধেক অংশে এটি আঘাত হানে। পৃথিবীর ইতিহাসের ভয়াবহতম ঘূর্ণিঝড় গুলোর মধ্যে এটিও একটি। ২৫০ কিমি তথা ১৫৫ মাইল গতি সম্পন্ন ঘূর্ণিঝড়, ২০ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসের মাধ্যমে দেশের বিশাল অংশ ধ্বংস করে দেয়! সরকারী হিসেব মতে ১ লক্ষ ৩৮ হাজার, বেসরকারি হিসেবে প্রায় ৬ লক্ষ মানুষ মারা যায়। এক কোটি মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে। আমার পিতাও আমাদের সবাইকে এক কাপড়ে নিয়ে, চিরতরে নিঃস্ব হয়ে যান এই ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে। আমাদের হারানোর আর কিছুই ছিলনা, দুঃচিন্তাগ্রস্থ বাবাকে মা সান্ত্বনা দেন, কোন চিন্তা করোনা, আমার কাজের ডিমান্ড আছে, আমি চাকুরী করব তোমার সংসারে উপকার হবে। আমি কি বলে বাবাকে সান্ত্বনা দিব বুঝতে পারছিনা; তারপরও বললাম. আমি ছোট সবার লালন পালনের দায়িত্ব নেব। বাবা আজ বেঁচে নেই; তবে বাবার সাথে কৃত ওয়াদা আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলাম।

স্কুলের একটি রুমে আমাদের আশ্রয় হল; না খেয়ে, না পড়ে পরবর্তী রাত খানা সেখানে কাটাতে হয়েছিল। বড় বিভীষিকাময় সে রাত। ঘূর্ণিঝড় থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষগুলো খোদার কৃতজ্ঞতার কথা ভুলে গেল। সামান্য সাহায্য দেবার উছিলায়, সে অবস্থায়ও তারা অসহায় নারীদের উপর থেকে লোলুপ দৃষ্টি সরাতে পারেনি। কার কি হয়েছে জানিনা, আমার বাবা একটি বড় চাদর যোগাড় করেছিলেন এবং স্কুল কক্ষের এক কোণে জড়ো-সড় করে বসিয়ে, চাদর দিয়ে আমাদের সবাইকে ঢেকে রেখেছিলেন। তখনও আমাদের পেটে কিছু পড়েনি; শরীরের বড় ক্ষতস্থান গুলো থেকে তখনও হালকা রক্ত ঝরছিল। বিবেকহীন মানুষের তত্বাবধানে কাটানো সে রাত ছিল, ২৯ শে এপ্রিলের রাতের চেয়েও ভীতিকর ও বিভীষিকাময়! পরদিন প্রত্যূষেই মামা এসে পড়েন, এবং আমরা তার সাথে চলে যাই।

২৯ শে এপ্রিল বার বার আসে। স্মৃতিগুলো সব স্বপ্ন হয়ে ধরা দেয়। ইতিমধ্যে বাবা এবং নানু দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। সেই ভাই বোন বড় হয়েছে, তারাও তাদের মত করে জীবন বেছে নিয়েছে। আজ আমরা একে অপর থেকে অনেক অনেক দূরে। স্বার্থপরতার জীবন, স্বার্থের কারণে আপনজনকে দূরে ঠেলে দেয়। সবাই তার অতীত ভুলে যায়। এখনও মনে পড়ে সেই চেয়ারম্যানের দয়ার কথা, যার পূর্ব পুরুষ একদা ভাগ্যের অন্বেষণে সাঁতরিয়ে আমেরিকার উপকূলে উঠেছিল। আমরা কিছু নারী ও শিশু সাঁতরিয়ে তার ঘরের ফ্লোর ধরে ভেসেছিলাম। তার মনে গলেনি; অন্ধ বিবেক তাকে আমাদের কাপড়ের পানিতে ঘর ভিজার ভয় দেখিয়েছিল, অথচ আল্লাহ তখনও তার ভবনের দুটি ফ্লোর পানির নীচে রেখেছিলেন। চাক্ষুষ জলজ্যান্ত উদাহরণও তাদের দিলে কখনও চিন্তার খোরাক জোঠায় না।

আমরা সর্বস্বান্ত হয়েছি ২৯ শে এপ্রিলের তাণ্ডবে। যাকে সরাসরি বলে, রাস্তায় নেমে যাওয়া। তারপরও কারো জীবন থেমে থাকেনি। প্রতিনিয়ত সময় এবং প্রতিকূলতার সাথে লড়াই করে এ পর্যন্ত এসেছি। আল্লাহ কিছু মানুষকে কর্তব্যানুভূতি দিয়ে সৃষ্টি করেন, তাদের উপর অন্যরা সহায় হয়। কিছু মানুষ শুধু নিজেকে নিয়েই ভাবতে ব্যস্ত, তারা অকৃতজ্ঞ হয়। এসব মানুষ যত বড় ধনী কিংবা জ্ঞানী হোক, তাদের দিয়ে কোন কল্যাণ আশা করা যায়না। উপরে তার প্রমাণ বিদ্যমান পেয়েছি। আমরা যেখানকার বাসিন্দা ছিলাম, সেখানকার প্রতিটি পরিবারে হয় সবাই মারা গেছে নতুবা কেউ না কেউ মরেছেন। কোন পরিবারে কেউ না মরে থাকেনি। যাদের একতলা পাকা দালান ছিল তারা সবাই মরেছে। কেননা তারা ভেবেছিল, দালান তাদেরকে বাতাস থেকে রক্ষা করবে। তারা পানি নিয়ে চিন্তা করেনি; যখন তাদের উপরে পানি এসেছিল, প্রত্যেকে নিজের ঘরে মরেছে। যাদের ঘর সেমি পাকা ছিল উপরে ছাদ ছিল, তারাও মরেছে। আমাদের ঘরের উপরে কোন ছাদ ছিলনা, আর সে ঘরে বেশীর ভাগ মানুষ ছিল মহিলা ও শিশু। আমি সে ঘরকে নিয়ে মন ছোট করেছিলাম। আল্লাহ আমাদের কে সে ঘরের বিপদ থেকে শুরু করে, প্রতিটি ভয়াবহ বিপদ হতে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। মাছ ধরার মত করে অতিপ্রিয় ছোট বোনকে ডুব দিয়ে উদ্ধার করেছি, সেও বেঁচে গেছে। এগুলো মানুষের কোন কৃতিত্ব নয়, সব আল্লাহর রহমতের কারণেই হয়েছে। মহাপ্রলয়ে তিনিই আমাদের একমাত্র অবলম্বন ছিলেন। সেদিন যিনি বেঁচে গেছেন এবং যিনি মরে গেছেন, তারা সবাই কেয়ামতের আলামত দেখেছেন। সেদিনের প্রতিটি প্রলয় দোলায় মানুষ, মাটি আর পাথর একাকার হয়ে গিয়েছে। স্মরণ করি সেই রাতের কথা, হয়ত বেঁচেছিলাম কিছু ভাল কাজ করতে পারার জন্য, অসহায় ভাই-বোনদের জন্য এবং আজকে লিখে যেতে পারার জন্য। প্রতিটি জীবিত মানুষের জন্য একটি কেয়ামত এখনও অপেক্ষা করছে, সেটি হল তার মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। সে সন্ধিক্ষণে হিসেব করার সময় থাকেনা, তাই প্রত্যেক মানুষের উচিত তার হিসাব ঠিক রাখা এবং নিজের অবলম্বন ধরে রাখা।

বিষয়: বিবিধ

২০২৩ বার পঠিত, ৩৬ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

214821
২৯ এপ্রিল ২০১৪ দুপুর ০২:৩৮
শিশির ভেজা ভোর লিখেছেন : আল্লাহ তুমি মানুষ সহ যে সব পশু পাখি সেদিন মরেছে সবাইকে তুমি বেহেশত নসিব করো।আমিন
২৯ এপ্রিল ২০১৪ রাত ১১:২২
163330
সালমা লিখেছেন : আল্লাহ আপনাকে রহম করুন।
214822
২৯ এপ্রিল ২০১৪ দুপুর ০২:৪৬
গেরিলা লিখেছেন : ভালো লাগলো ধন্যবাদ
২৯ এপ্রিল ২০১৪ রাত ১১:২২
163331
সালমা লিখেছেন : ধন্যবাদ।
214823
২৯ এপ্রিল ২০১৪ দুপুর ০২:৪৭
বিবেক লিখেছেন : এটা ছিল ১৯৯১ সালের ২৯ শে এপিলের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের রাত। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বরিশাল, ভোলা ও নোয়াখালী সহ দেশের প্রায় অর্ধেক অংশে এটি আঘাত হানে। পৃথিবীর ইতিহাসের ভয়াবহতম ঘূর্ণিঝড় গুলোর মধ্যে এটিও একটি। ২৫০ কিমি তথা ১৫৫ মাইল গতি সম্পন্ন ঘূর্ণিঝড়, ২০ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসের মাধ্যমে দেশের বিশাল অংশ ধ্বংস করে দেয়! সরকারী হিসেব মতে ১ লক্ষ ৩৮ হাজার, বেসরকারি হিসেবে প্রায় ৬ লক্ষ মানুষ মারা যায়। এক কোটি মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে। আমার পিতাও আমাদের সবাইকে এক কাপড়ে নিয়ে, চিরতরে নিঃস্ব হয়ে যান এই ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে।

অনেক মানুষ নিঃস হয়েছিল, আমার পিতাও সেভাবে নিঃস হয়েছিল। করুন কাহিনী পড়ে আমিও অতীতে হারিয়েছিলাম। অনেক ধন্যবাদ
২৯ এপ্রিল ২০১৪ রাত ১১:২২
163332
সালমা লিখেছেন : আপনাকে ধন্যবাদ
214837
২৯ এপ্রিল ২০১৪ দুপুর ০৩:১৪
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : মর্মস্পর্শি অভিজ্ঞতা সম্বৃদ্ধ লিখাটির জন্য ধন্যবাদ।
সেই ভয়ংকর রাতেও কিছু মানুষ লিপ্ত হয়েছিল লুটপাট করতে। আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নেয়া মহিলাদের শ্লিলতাহানি করেছিল সেই দুর্যোগের মধ্যেই। এধরনের অমানুষরা আরো অনেক ধরনের কাজ করেছিল। পরদিন সকাল এগারোটার দিকে আমি আমার ফুফা যিন তখন কৃষি ব্যাংক এর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন তার সাথে সেই এলাকায় গিয়েছিলাম জিপে করে। যদিও রাস্তা গাড়ি চলাচলের খুব উপযোগি ছিলনা। অনেকে প্রথমে আমাদের দেখে রাগান্বিত হয়েছিলেন এই ভেবে যে আমরা তামাশা দেখছি এই কষ্টের মধ্যে তবে আমার ফুফা কে চিনতে পেরে অনেকেই আবার তার সাথে কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলছিলেন। মারাত্মক আহত কয়েকজনকে জিপে করে ফুফা হাসপাতালে নিয়ে যান। সেই একদিনেই আমি আমার শৈশবের সপ্নিল জিবন পেরিয়ে কঠোর বাস্তবকে চিনতে পারি।
পোষ্টটি ষ্টিকি করা হোক।
২৯ এপ্রিল ২০১৪ রাত ১১:২৩
163333
সালমা লিখেছেন : সরল অনুভুতি প্রকাশের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ
214840
২৯ এপ্রিল ২০১৪ দুপুর ০৩:১৬
চাটিগাঁ থেকে বাহার লিখেছেন : সেদিনের কিছু জলজ্যান্ত দৃশ্য এখনও আমার দৃশ্যপটে বর্তমান ।
আপনার বাস্তব অভিজ্ঞতা অনেক তরুন/তরুণীকে সেদিনের অগ্নিরূপের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে সহায়তা করবে । ধন্যবাদ ।
২৯ এপ্রিল ২০১৪ রাত ১১:২৩
163334
সালমা লিখেছেন : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, ভাল থাকুন।
214849
২৯ এপ্রিল ২০১৪ দুপুর ০৩:২৯
ঘাড় তেড়া লিখেছেন : তখন আমি সিক্সে পড়ি..

সেদিন স্কুলে কি যেন একটা প্রোগ্রাম ছিল। প্রোগ্রাম শেষ হওয়ার পর রশিদ স্যার বললেন বাসায় চলে যাও আজ ১০ নম্বর সিগনাল...

স্কুলের কাছে মামার বাড়ি আর আমাদের বাড়ি বেশী দুরে। আমি কিছুক্ষন আমাদের বাড়ির দিকে আর কিছুক্ষন মামার বাড়ির দিকে হাটছি..বুঝতে পারছিনা কি করবো।

২ ঘন্টা কেটে গেল। রশিদ স্যার কি কাজে স্কুলে ছিলেন, তিনি আমাকে বাইরে দেখে বলবেন "এখনো বাসায় যাওনি ?"..খুলে বললাম আমার সমস্যা।

এমন সময় ছোটমামা স্কুলে এসে হাজির। তিনি হ্য়ত ঠিকই বুঝেছিলেন আমার অবস্থা। আমাকে আমাদের বাড়ি পৌছিয়ে দিয়ে গেলেন...

রাত ১০:৩০ এর দিকে শুরু হল আসল ঝড়...সে এক ভয়াল রাত।
২৯ এপ্রিল ২০১৪ রাত ১১:২৪
163335
সালমা লিখেছেন : আপনার অনুভুতি জানতে পেরে আমারও খারাপ লাগল।
214859
২৯ এপ্রিল ২০১৪ দুপুর ০৩:৪৪
আহ জীবন লিখেছেন : আপনি প্রিয় জনের সাথে মিলতে পেরেছেন, সৌভাগ্যবতী। কত জন আজকের এই দিনে চোখের জলে ভাসে।
২৯ এপ্রিল ২০১৪ রাত ১১:২৫
163338
সালমা লিখেছেন : আমার জানা মতে বহু বান্ধবী ও সহপাঠিদের অনেক আত্মীয় স্বজন মারা গেছে। কোন পরিবারে মাত্র একজন সদস্য বেঁচে ছিলেন এমন ও আছে।
214885
২৯ এপ্রিল ২০১৪ বিকাল ০৪:২০
জুমানা লিখেছেন : পোস্টটি স্টিকি করা হোক, আর সেই দিন যারা মারা গিয়েছিলেন ,আল্লাহ যেন তাদেরকে বেহেস্ত নসীব করেন ।
২৯ এপ্রিল ২০১৪ রাত ১১:২৬
163340
সালমা লিখেছেন : আমীন, আপনার দোয়া কবুল হউক।
214905
২৯ এপ্রিল ২০১৪ বিকাল ০৪:৫৮
প্রবাসী আশরাফ লিখেছেন : আপনার এই লেখাটিই মনে হয় সোনারবাংলাদেশ ব্লগে পড়েছিলাম। ভয়াবহ এক স্মৃতি যা কখনো ভুলা যায় না। আর আপনি তো প্রায় মৃত্যুর কাছাকাছি থেকে ফিরে এসেছেন। আসলে আমাদের দেশটি প্রাকৃতিক ভাবেই বন্যা/ঝড় কবলিত। একমাত্র মহান আল্লাহ ছাড়া প্রাকৃতিই এই বিপর্যয় থেকে মুক্তি পাবার কোন উপায় নাই। আল্লাহ যেন আমাদেরকে হেফাজত করেন - আমীন।
২৯ এপ্রিল ২০১৪ রাত ১১:২৬
163342
সালমা লিখেছেন : আল্লাহ আমাদের সবাইকে হেফাজত করুন। আমীন
১০
214906
২৯ এপ্রিল ২০১৪ বিকাল ০৪:৫৯
নজরুল ইসলাম টিপু লিখেছেন : ২৯শে এপ্রিল পর্যন্ত আমার বাবা ধনী ছিলেন, ৩০শে এপ্রিলে আমার বাবা নিঃস ও গরীব হয়ে যান। তিনি ১৯৮৭ সালে একটি রাবার বাগান করেছিলেন ১৯৯৩ সালের শুরুতে রাবার বিক্রির জন্য ক্রেতা ঠিক করেছিলেন।

পেয়ারা, আমলকি, কাঠাল, লেবু, ডালিম, কলা সহ নানাবিধ ফলের বাগান ছিল প্রতি বছর বহু টাকা আয় হত।

সকল ধরনের সবজী উৎপন্ন হত, প্রায় ৭০০ মিষ্টি কুমড়া অপেক্ষামান ছিল বাজারে পাঠানোর জন্য। এছাড়া বিজের জন্য সিম, বরবটি, আলু সহ বহু সবজি ষ্টোরে ছিল।

পাওয়ার টিলার, পাম্প মেশিন, গরু-ছাগল, খামার বাড়ী সবই ছিল।

ঘর্ণিঝড়ের পরের দিনই কেউ বুঝতে পারলনা গতকাল এখানে একটি সুদৃশ্য বাগান ছিল। মেশনারিজ কোথায় হারিয়ে গেল কেউ জানল না।

একই দশা বাড়ী ঘরেও। পুরো গ্রামটি লন্ডভন্ড হয়েছিল। আমাদের গ্রামের অনেক স্বচ্ছল পরিবার সেদিন রাস্তায় বসেছিল। আমাদের বাড়ীর প্রত্যেকটি কক্ষে এক একটি ক্ষতিগ্রস্থ পরিবার উঠেছিল। শরনার্থীর মত দীর্ঘদিন সবাই গাদাগাদি করে থাকতে হয়েছিল।

বাবা ব্যাংক লোন করে রাবার বাগান ও গরুর খামার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ঘূর্ণিঝড়ে তাকে চিরদিনের জন্য ফতুর করে দেয়, বাড়ী ঘর সব যাবার পরেও তাঁর মাথায় ব্যাংক ঋনের বিশাল বোঝা চেপে বসে।

বাবার সে ঋণ শোধ করে দিতে অবশেষে আমার বিদেশী কোম্পানীর ভাল চাকুরী ছেড়ে প্রবাসে এসেছিলাম। দীর্ঘদিন প্রচেষ্টায় যে বছর আমি একক ভাবে বাবার ঋণ পরিশোধ করেছি, সে বছর তিনি আমাদের মায়া ছেড়ে চলে যান। পরিতাপের বিষয় ছিল, যে বাবাকে ঋণ মুক্তি দিয়ে আমি একদা প্রবাস ধরেছিলাম সে বাবকে মৃত্যু কালে সাহচর্য দিতে পারিনি।

এই সুন্দর পোষ্টটির জন্য লেখিকাকে অনকে ধন্যবাদ। পোষ্টটি ষ্টিকি করা হউক।
২৯ এপ্রিল ২০১৪ রাত ১১:২৭
163344
সালমা লিখেছেন : আপনার অনুভুতি যোগ করার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
৩০ এপ্রিল ২০১৪ সকাল ১০:৫২
163471
আহ জীবন লিখেছেন : ধন্য বাবার ধন্য ছেলে @ নজরুল ইসলাম টিপু ভাই। আমরা যেন এমন হতে পারি দোয়া করবেন।
১১
214981
২৯ এপ্রিল ২০১৪ সন্ধ্যা ০৭:৩১
সূর্যের পাশে হারিকেন লিখেছেন : আমি অর্ধেক পড়ছি আর পারছি না আপু আর পারছি না.....
২৯ এপ্রিল ২০১৪ রাত ১১:২৭
163345
সালমা লিখেছেন : অসংখ্য ধন্যবাদ, সাথে থাকার জন্য।
১২
215231
৩০ এপ্রিল ২০১৪ সকাল ০৯:৪৪
রেহনুমা বিনত আনিস লিখেছেন : আপনাকে তো চিনি, পেছনের নাম দু'টো ছেঁটে ফেলাতে বুঝতে পারছিলাম না এতদিন। এই লেখাটা নিয়ে আপনার সাথে অনেক আলাপ হয়েছিল যেহেতু আমিও সেই একই রাত নিয়ে একটি পোস্ট দিয়েছিলাম। মাত্র দু'দিন আগেও আপনার সাহসিকতার কথা আমি আমার ক্যানাডিয়ান সহকর্মীদের শোনাচ্ছিলাম, তাক লেগে যাচ্ছিল ওদের। আল্লাহ আপনাদের পরিবারটিকে আসলেই ভালবাসেন, নইলে এত বড় দুর্‍্যোগের মধ্যে সবাইকে উদ্ধার করে আবার মিলিত করে দেয়াটা সহজ ব্যাপার নয়।
৩০ এপ্রিল ২০১৪ বিকাল ০৪:৩১
163703
সালমা লিখেছেন : আমার উপকার হবে তাই,আমার ছেলে নাম ছোট করে দিয়েছে এই ব্লগে,দু বছর আগে আপনার সাখে কথা হয়ে ছিল,মনে রাখার জন্য মোবারকবাদ। আসলে আল্লাহর রহমত এত পেয়েছি যে আমি তা বুঝাতে পারব না। প্রতি ওয়াক্ত নামাজে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দরবারে শুকরিয়া আদায় করি তার রহমতের জন্য। আমার পরিবারের জন্য দোয়া করবেন। আবারো ধন্যবাদ আপা আপনাকে।
১৩
215407
৩০ এপ্রিল ২০১৪ দুপুর ০৩:২৭
সূর্যের পাশে হারিকেন লিখেছেন : কালকে এত কষ্ট লাগছিলো অর্ধেক পড়ার পর শ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে মনে কর্ছিলাম। এবার পুরোটা পড়লাম। এমন পরিস্থিতিতেও কিছু মানুষ নামক নরপশুদের আচরনে ব্যথিত হলাম খুব। এই জানুওয়ারগুলো বেচে যায় কি করে? .....

আমার মনে হচ্ছে, আল্লাহর বিশেষ রহমত আছে আপনাদের পরিবারের উপর। জান্তে ইচ্ছে করছে আপনারা এমন কি (আমল) কাজ করতেন যা আল্লাহ'র এত নৈকট্য লাভ করতে সক্ষম হয়েছিলেন?
৩০ এপ্রিল ২০১৪ বিকাল ০৪:৪৩
163706
সালমা লিখেছেন : আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ,আল্লাহর রহমতের ছায়া তলে এখনও আছি। জানিনা কি আমল করতেন আমার বাবা, মা,তবে আমাদের কে বলতেন হারাম থেকে দুরে থাকতে। আর উনি কখনও হারাম খেতেন না। অনেক কষ্ট করে আমাদের কে লালন পালন করেছেন কিন্তু কখনও হারাম খান নাই জানা মতে। আর স্বামীর ঘড়ে এসে শিখেছি আল্লাহর আইন এবং নবীর আদর্শ মেনে চলা।
১৪
216376
০২ মে ২০১৪ সকাল ০৭:৫৮
আবু জারীর লিখেছেন : চুড়ান্ত কিয়ামত তো একদিন আবশ্যই হবে তবে প্রতিটি মানুষের মৃত্যুর পূর্ব মূহুর্তটা মনে হয় তার জন্য কিয়ামত।

জীবনের শুরুতেই আপনি একটা কিয়ামতের অভিজ্ঞতা আর্জন করে ফেলেছেন। আপনি যে বেচে আছেন এটা আপনার বোনাস লাইফ আর আমাদের জন্য বার্তি পাওনা।

আল্লাহ আপনাকে আপনার বোনাস লাইফের সঠিক ব্যবহারের তৌফিক দিন।

আর হ্যা, একজন খ্যাতিমান ব্লগারের পুত্র ধনের ফটো আপনার প্রপিকে! কাহিনিটা কি?

আবশ্য আপনিও কম যান না মাশা'আল্লাহ।

যার হাতের লেখা এত সুন্দর এবং সুপাঠ্য তিনি কিভাবে চুপ থাকেন সেটা একটা গবেষণার বিষয়।

আল্লাহ আপনার জীবনের নেক মকসুদ গুলো পুরা করুন। ছেলেটাতো মাশা'আল্লাহ! আশা করি বাবা মায়ের চেয়েও খ্যাতিমান এবং মানব কল্যাণে অগ্রগণ্য হবে ইনশা'আল্লাহ।
০৫ মে ২০১৪ সন্ধ্যা ০৭:৪৬
165966
সালমা লিখেছেন : কেমন আছেন আপনি? আর প্রপিকে যে ফটোটা দেখছেন সে হলো আমাদের নয়নের মনি কলিজার টুকরা এক মাত্র ছেলে। তার জন্য দোয়া করবেন যাতে দ্বীনের খেদমত করতে পারে। রিয়াদে যাওয়ার পথে অাপনার সাথে এক পলক দেথা হয়ে ছিল। আপনার প্রায় লেখা কবিতা সে পড়ে। মাঝে মাঝে আমরা পারিবারিক ভাবে ব্লগের লেখা গুলো পড়ে থাকি। সে কারণে সে আপনাদের চিনে। বাবা ছেলের খুব ইচ্ছা ছিল একসাথে সবার সাথে দেখা করবে মনের কথা গুলো শেয়ার করবে কিন্তু আমার অসুস্থ্যতার কারণে হয়ে উঠেনি। তাই আমি দু:খিত। দোয়া করবেন যেন ব্রগে আপনাদের সাথে থাকতে পারি। অনেক ধন্যবাদ আমার লেখাটি পড়ার জন্য। ভাল থাকুন।
১৫
216441
০২ মে ২০১৪ দুপুর ০১:০৯
প্রবাসী মজুমদার লিখেছেন : সেদিন আমি ছিলাম চট্রগ্রামে মাদায্যপাড়ায়। শহরের ভেতরেই যা দেখেছি, ভূলার মত নয়। এটি ছিল মিনি কিয়ামত। আজও সব সব স্মরনে আতকে উঠি।

ধন্যবাদ আপনাকে নিজের দেখা কিয়ামত সুন্দরভাবে তুলে ধরার জন্য।
০৫ মে ২০১৪ সন্ধ্যা ০৭:৪৯
165968
সালমা লিখেছেন : আপনাকেও অনেক অনেক ধন্যবাদ কষ্ট করে পড়ার জন্য। আসা করছি আপনার সেই দিনের অনুভুতি জানিয়ে পোষ্ট লিখবেন, আর আমাদের জন্য দোয়া করবেন। ভাল থাকুন।
১৬
216822
০৩ মে ২০১৪ দুপুর ১২:১১
মোঃ ওহিদুল ইসলাম লিখেছেন : আপনার এ হৃদয়স্পর্শী লেখাটা পড়েছিলাম আগেও। ‘স্বপ্ন দিয়ে বোনা’ বই ও সম্ভবত এস বি ব্লগেও। Rose Rose Rose

আপনি সালমা আক্তার মেরী?
০৫ মে ২০১৪ সন্ধ্যা ০৭:৫১
165969
সালমা লিখেছেন : আপনি ঠিকই চিনেছেন,‘স্বপ্ন দিয়ে বোনা’ বইটি পড়ার জন্য আপনাকে মোবারক বাদ। কেমন আছেন আপনি? আমাদের জন্য দোয়া করবেন। ভাল থাকুন।
১৭
219168
০৮ মে ২০১৪ সন্ধ্যা ০৭:৫৩
মোহাম্মদ লোকমান লিখেছেন : আমি তখন আবুধাবীতে। চট্টগ্রামের টি এন্ড টি টাওয়ার ভেঙে পড়াতে অনেক দিন দেশের সাথে যোগা যোগ করতে না পেরে খুবই অশ্বস্থিতে ছিলাম প্রবাসে। পরে ভিডিওতে দেখেছিলাম মানুষ আর পশু পাখির লাশের মিছিল। এসব কিয়ামতেরই নমুনা।
১১ মে ২০১৪ রাত ০১:১৬
167722
সালমা লিখেছেন : জি ভাই ছোট খাট একটা কেয়ামত বলতে পারেন, কেমন আছেন লোকমান ভাই? ধন্যবাদ আপনার অনুভূতি শেয়ার করার জন্য।
১৮
234596
১৩ জুন ২০১৪ রাত ০৯:৫৩
মাটিরলাঠি লিখেছেন : দয়াময় আল্লাহ আপনার ও আপনার পরিবারকে রহমত দান করেছেন। আলহামদুলিল্লাহ।

কিছু মানুষ এমনই হয়ঃ "যখন সমুদ্রে তোমাদের উপর বিপদ আসে, তখন শুধু আল্লাহ ব্যতীত যাদেরকে তোমরা আহবান করে থাক তাদেরকে তোমরা বিস্মৃত হয়ে যাও। অতঃপর তিনি যখন তোমাদেরকে স্থলে ভিড়িয়ে উদ্ধার করে নেন, তখন তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও। মানুষ বড়ই অকৃতজ্ঞ।" (১৭:৬৭)

"যখন তাদেরকে মেঘমালা সদৃশ তরংগ আচ্ছাদিত করে নেয়, তখন তারা খাঁটি মনে আল্লাহকে ডাকতে থাকে। অতঃপর তিনি যখন তাদেরকে স্থলভাগের দিকে উদ্ধার করে আনেন, তখন তাদের কেউ কেউ সরল পথে চলে। কেবল মিথ্যাচারী, অকৃতজ্ঞ ব্যক্তিই আমার নিদর্শনাবলী অস্বীকার করে।" (৩১:৩২)

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File