আমাদের গৃহকর্মী

লিখেছেন লিখেছেন পত্রিকার পাতা থেকে ১৬ এপ্রিল, ২০১৪, ০১:০৬:৪৮ দুপুর



আমাদের গৃহকর্মী

নূর আঙ্গেছ বেগম (নূরী)

================

(ক) প্রভাতের আলো সে-তো বিছানাতেই পাওয়া হয়। তারপর প্রভাত কেটে সূর্যের আগমন। প্রতিদিনের মত আর একটি সকাল। এই বুঝি সে এলো। ফুটন্ত পানিতে চা ছেড়ে চোখ রাখে ঘড়ির কাঁটায়। নির্দিষ্ট সময়েরও পাঁচ মিনিট বেশি। কোথায় তুমি? চা’তে দুধ চিনি মেশায়। গত রাতের থালা- বাসন, হাড়ি-পাতিল আবর্জনার মত সব পড়ে আছে স্ত্তপ হয়ে। ঝাড়ুর ব্যবহার তাতো এখনও হয়নি। আয়েস করে চা শেষ করে ঐশী চৌধুরি। বিচলিত মন কিছুতেই শান্ত হয় না। অফিস, কলেজ, স্কুল সকলেরই তাড়া থাকবে নাস্তার টেবিলে। আর দেরি করা অনুচিত মনে করে নিজেই হাত লাগায়। রুটি, সবজি, সুজির হালুয়া আর গত রাতের মাংসের তরকারিও বাদ যায় না টেবিল সাজাতে। চাটা দেওয়া হলেই সকালের পর্ব শেষ। আহ্ কি স্বস্তি। কিন্তু সে যে এখনও এলো না। তার কোন বিপদ হলো না তো? সাথে তো মোবাইল থাকে। কেন যে নাম্বারটা রাখা হলো না। বারবার চোখ যায় ঘড়ির কাঁটায়। কলিং বেল যে এখনও বাজে না। বাসন মাজা, সবজি কাটা এখনও যে পড়ে আছে। সে আসবে তো?

(খ) আট বছরের লসমির ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরিই হয়ে গেল। তাড়াহুরাতে পাউরুটি সেঁকে কাপে দুধ নেওয়ার সময় কিছুটা দুধ পড়ে যায় নিচে। অমনি বাম গালে পাঁচ আঙ্গুলের ছাপ বসিয়ে দেয় ঈশিকা আহমেদ। সাবধানে নিতে পারিস না। কতখানি দুধ ফেলে দিলি। প্রাতঃরাশের অপেক্ষায় দুই সোনামণি। আদর মাখানো কণ্ঠ আর স্নেহের হাতে ওদের মুখে দুধ রুটি তুলে দেয় ঈশিকা আহমেদ। আর বাম গালে হাত বুলায় লসমি। বাধ ভাঙ্গা জোয়ারে। কাছাকাছি বয়সেরই তো তিনজন। ভাগ্য ওকে এখানে এনে ফেলেছে। কাজের বিনিময়ে টাকা দিতে হয় মা-বাবাকে। যে সংসারে প্রতিনিয়ত অভাবের আনাগোনা। পড়ালেখা সেখানেতো অস্পষ্ট স্বপ্ন হয়েই থাকে। মাঝে মধ্যে জুনাইরা আর আনায়ার বইয়ে হাত বুলায় লসমি। বই-এর ছবি আর অক্ষরগুলিতে কৌতুহলী হয়ে ওঠে। অজানা অক্ষরগুলি কখনো জানা হবে না। ওর বয়সী সবাই যখন স্কুলে ও তখন ঘরের কাজে ব্যস্ত। ভুল এবং অসাবধানতার মাশুল সে তো নিজেকেই সইতে হয়। এ বাসার ভাল খাবার সব সময় ফ্রিজে তোলা থাকে। বেড়ে দেওয়া খাবারে সব সময় খিদে মিটে না। তবুও নির্যাতনের ভিতরই বসবাস করতে হয় প্রয়োজনের তাগিদে।

(গ) কথার বান সেতো তীর হয়ে বুকে বিধে। এই কাজটা এখনও শেষ হয়নি। ওটা কখন করবে। এখনও তো কাপড় কাচা ঘর মোছা তরকারি কাটা বাকি। এত সময় নিয়ে কাজ করলে কাজ শেষ হবে কখন। ঘরে ফেরার তাগিদ সে তো তোমার খুব তাড়াতাড়ি হয়। তাড়াতাড়ি হাত চালাও রাহেলা। সেই রাহেলাই আজ দুই-তিনদিন ধরে উধাও। গৃহকর্ত্রীর অবস্থা তো দেখার মত। হাড়ি মাজা, ঘর মোছা কাপড় কাচা পরিশ্রম ছাড়া তো অসম্ভব ব্যাপার। অভ্যাস ছাড়া কোন কাজই সহজ নয়। তারপরও সংসারে আরও অন্যান্য কাজ থাকে যা শুধু গৃহকর্ত্রীকেই করতে হয়। কয়েক দিন পর রাহেলার চাঁদ মুখ দেখা গেলেও তার সাফ জবাব সে আর কাজ করবে না। গৃহকর্ত্রীর নরম সুরেও বরফ গলে না। এত শাসনে বাসা-বাড়িতে কাজ করা অসম্ভব। স্বাধীনতার খোঁজে সে এখন ফেরি করে তার সংসারের অভাব মিটায়।

উপরের এই সমস্যাগুলো তো আমাদের সংসারের প্রতিদিনের ছবি। আমরা এটি কখনো খেয়াল করি না, যাকে আমরা ফরমায়েশ দিচ্ছি সে তার কতটুকু ভার বইতে পারবে। এই তো কিছুদিন আগে টিভি পর্দায় মাত্র নয় বছরের শিশুটির মুখ, কি করুণভাবে দেখা গেল। নির্যাতনের চিহ্নগুলো কত স্পষ্ট । সে তো একজন ডাক্তারের বাসায় কাজ নিয়েছিল, যার সেবায় রুগী সুস্থ হয়ে ওঠে। নয় বছরের সেই শিশুর গায়ে ছ্যাঁকা দিতে, আঘাত করতে তার এতটুকু বাধেনি। ওদের আমরা অনেকটা মেসিনের মত ব্যবহার করি। কাজ একটু দেরি অথবা অগোছানো হলেই আমাদের মেজাজ ঠিক রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। অন্যের বাসায় কাজ করে কত রকমের খেসারত তাদের দিতে হয়। নির্যাতন যখন সহ্যের সীমা ছাড়ায়, উঁচু বিল্ডিং-এর ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়েতেও সাহসের অভাব হয় না। হাসপাতালের বিছানায় কাতরায় কতজন। সেই বিছানায় হয় অনেকের শেষ শয্যা। অভাব শুধু একটু সহানুভূতির। আমাদের বিবেক শুধু নিজ স্বার্থের মাঝেই বিচরণ করে। শিশু-কিশোরী-যুবতী যারাই গৃহকর্মে নিয়োজিত হোক না কেন, তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থাও গৃহর্কত্রীর করা চাই। বস্তি ঘরের অভাব, রোগশয্যায় নিজ পিতা কিংবা স্বামী অথবা বাকি সদস্যরা যখন খিদের তাড়নায় ধুঁকে ধুঁকে মরে, অভাব থাকে আরও কিছুর, তখন পুরুষের লালসার শিকার হতে হয় কত গৃহকর্মীকে। ফলস্বরূপ রাস্তার নর্দমায়, ডাস্টবিনে পড়ে থাকে পিতৃ পরিচয়হীন কত শিশু। হারায় মায়ের কোল। দুধ সেতো রিযিকেই লেখা থাকে না। যাদের কারণে আমরা স্বস্তিতে থাকি, বিশ্রামে থাকি। সুযোগ থাকে নিজের উপার্জনেরও। তাদের প্রতি একটু খেয়াল রাখা কি আমাদের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে না?

http://www.dainikpurbokone.net/index.php/-lfontglfont-colorq5a5757qg-lfontg/2013-08-24-18-47-50/25182-2014-04-15-19-12-56

বিষয়: বিবিধ

১৩২২ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

208813
১৬ এপ্রিল ২০১৪ বিকাল ০৪:৪৮
মেঘ ভাঙা রোদ লিখেছেন : অনেক ভালো লিখেছেন। আমাদের গৃহকর্তীদের উপর আমরা হরহামেশাই নির্যাতন করে থাকি যা মোটেই উচিত না। তাদের অন্তত সুন্দরভাবে বাঁচতে দেয়া উচিত।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File