হাজার হাজার ফিলিস্তিনী মুসলিম হত্যার নায়ক এ্যারিয়েল শ্যারন।

লিখেছেন লিখেছেন এখলাস মাহেমাদ িসকদার ১৩ জানুয়ারি, ২০১৪, ০৩:১৩:২১ দুপুর



রক্তপিপাসু এ্যারিয়েল শ্যারন সামরিক ও রাজনৈতিক নেতা হিসেবে আরববিরোধী লড়াইয়ে বলিষ্ঠ ভূমিকার জন্য বীরোচিত সম্মান পেয়েছেন নিজ দেশে, একই ভূমিকার জন্য নিষ্ঠুরতার প্রতীক হয়ে আছেন বিশ্বের কোটি মানুষের কাছে- সেই অ্যারিয়েল শ্যারনের মৃত্যুর সঙ্গে সমাপ্তি ঘটল এক রক্তাক্ত ইতিহাসের জনকের অধ্যায়ের। উপরের ছবিটি এ্যারিয়েল শ্যারনের শাসনামলে ইসরাইলী আর্মি কর্তৃক সরাসরি হত্যা কান্ডের ছবি যা নিয়ে সারাবিশ্বে নিন্দার ঝড় উঠেছিল। ছবিতে যে ছোট্ট শিশুটিকে দেখা যাচ্ছে তাকে একই স্থানে নির্মম ভাবে খুন করে শ্যারন বাহিনী।



‘শ্যারনের জন্য চোখের পানি নয়’

দীর্ঘ আট বছর কোমায় থাকার পর শনিবার মারা যান ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শ্যারন। তার বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর।

রাজনীতিতে আসার আগে সামরিক বাহিনীতে দীর্ঘ সময় কাটিয়ে আসেন তিনি। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েলের জন্মলগ্নে সেনা কমান্ডারের দায়িত্বে থাকা শ্যারন রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন। প্রতিটি পর্যায়েই কঠোরতার ছাপ রাখায় ‘দ্য বুলডোজার’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন তিনি।



১৯৬৭ ও ১৯৭৩ সালের যুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য অনেক ইসরায়েলির কাছে তিনি নায়ক।

অন্যদিকে বৈরুত দখল এবং ১৯৮২ সালে লেবাননের সাবরা ও শাতিলা শরণার্থী শিবিরে কয়েক হাজার সাধারণ মানুষ নিহত হওয়ার জন্য মুসলিম বিশ্বের পাশাপাশি স্বদেশের অনেকের কাছেই তিনি কসাই।

১৯২৮ সালে শ্যারন উপত্যকায় জন্ম হয় অ্যারিয়েল শ্যারনের। এলাকাটি তখন যুক্তরাজ্য অনুমোদিত ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের অধীনে। তার বাবা-মা সমুয়েল ও ডেভোরা ছিলেন কৃষক। রাশিয়া থেকে গিয়ে সেখানে ঘর বেঁধেছিলেন এই ইহুদি দম্পতি।

মাঝে মাঝেই প্রতিবেশি আরব উপজাতিদের হামলার মুখে পড়তে হতো শ্যারনের পরিবারকে। এ কারণে ছোটবেলা থেকেই যুদ্ধের কৌশল শিখতে হয় তাকে।

ব্রিটিশ সেনারা টহল দেয়ার সময় পারিবারিক রাইফেলটি গরুর খামারে গোবরের নিচে লুকিয়ে রাখতেন শিশু শ্যারন। তেল আবিবে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ার সময় কৃষি, রাজনীতি ও সামরিক বিষয়ে শিক্ষা লাভ করেন তিনি।



মাত্র ১৪ বছর বয়সে ইহুদিদের গোপন সামরিক সংগঠন হাগানায় যোগ দেন। এর ছয় বছর পর ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠাকালে পদাতিক বাহিনীর অধিনায়কের দায়িত্ব পান তিনি।

১৯৫৩ সালে সামরিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা থাকাকালে তিনি কমান্ডো ইউনিট ১০১ গড়ে তোলেন, যার দায়িত্ব ছিল সে সময় জর্ডানের নিয়ন্ত্রণে থাকা পশ্চিম তীরে অভিযান চালানো।

সীমান্তবর্তী কিবিয়া গ্রামে এক অভিযানে ব্যাপক প্রাণহানির পর সমালোচনার মুখে পড়েন শ্যারন।

ইসরায়েলে এক হামলায় তিন জন নিহতের জবাবে সেনাদের ১০টি বাড়ি গুঁড়িয়ে দিতে বলা হলেও তারা ৪৫টি বাড়ি ও একটি স্কুলে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়, যাতে নিহত হয় ৬৯ জন আরব।

এ হত্যাকাণ্ডের পর বিশ্বজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে বাধ্য হন ইসলায়েলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন-গুরিয়ন।



এরপরেও শ্যারনের ক্ষমতা বাড়তে থাকে। যুক্তরাজ্য ও ফরাসি বাহিনী সুয়েজে হামলা চালানোর পর তাদের সহযোগী হিসেবে ১৯৫৬ সালের অক্টোবরে মিশরের সিনাই উপত্যকায় হামলা চালায় ইসরায়েলি সেনারা।

এবারোও সামনের সারিতে শ্যারন। তার নেতৃত্বে থাকা ছত্রীসেনারা কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ মিটলা পাস দখল করে।

ইসরায়েলি সেনাপ্রধানই এ যুদ্ধে প্রাণহানির ঘটনায় সমালোচনা করেন। অযথা নিষ্ঠুরতা চালানো হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

এরপর তিন বছর ক্যামবার্লিতে ব্রিটিশ আর্মিজ স্ট্যাফ কলেজে সামরিক বিষয়ে লেখাপড়ার পর কর্নেল হিসেবে পদোন্নতি নিয়ে ইসরায়েলে ফেরেন শ্যারন। সেনাবাহিনীর ইনফানন্ট্রি স্কুলে করেন শিক্ষকতা।

১৯৬৭ সালের যুদ্ধে আবারো স্বমূর্তিতে দেখা যায় তাকে। ছয় দিন স্থায়ী যুদ্ধে মিশর, জর্ডান ও সিরিয়ায় হামলা চালায় ইসরায়েলি বাহিনী। এ যুদ্ধে সেনাবাহিনীর একটি ডিভিশনের নেতৃত্ব দেয়া শ্যারন নিজ দেশের মানুষের কাছে হয়ে ওঠেন বীর।

তার নেতৃত্বে রাতের বেলায় মিশরীয় সৈন্যদের হটিয়ে সিনাই উপত্যকার গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ সড়ক উম কাতাফ দখল করে ইসরায়েলিরা। সিনাইয়ে মিশরীয়দের হারের জন্য এটা বড় ধরনের ভূমিকা রাখে বলে ধারণা করা হয়।

ওই যুদ্ধে শ্যারনের নেতৃত্বাধীন সৈন্যদের বিরুদ্ধে মিশরীয় বন্দিদের উপর গুলি চালানোর অভিযোগ ওঠে।

সেনাপ্রধান হওয়ার লক্ষ্যপূরণে হতাশা থেকে ১৯৭২ সালের জুনে সেনাবাহিনী থেকে ইস্তফা দেন শ্যারন। এর পরপরই লিকুদ পার্টি গঠন করেন তিনি।

কিন্তু ১৯৭৩ সালের অক্টোবরে মিশর ও সিরিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ বাঁধলে ইসরায়েল সরকারের ডাকে আবারো সেনাবাহিনীতে ফেরেন শ্যারন।

এবারো একটি সেনা ডিভিশনের নেতৃত্ব দেয়া হয় তাকে। উর্ধ্বতন কর্তৃপেক্ষর নির্দেশ ছাড়াই দুইশ ট্যাঙ্ক ও পাঁচ হাজার সৈন্য নিয়ে সুয়েজ খাল পেরিয়ে মিশরীয় সেনাবাহিনীকে ঘিরে ফেলেন তিনি। কায়রোর প্রায় একশ’ মাইলের মধ্যে ঢুকে যায় তার বাহিনী। এ যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য ‘আল্লাহর সিংহ’ খেতাব জোটে তার।

এরপর আবার রাজনীতিতে ফিরে ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বরে ইসরায়েলের পার্লামেন্ট নেসেটের সদস্য নির্বাচিত হন শ্যারন।

সত্তরের দশকের মাঝামাঝিতে প্রধানমন্ত্রী আইজাক রবিনের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

পরে ১৯৭৭ সালে প্রধানমন্ত্রী মেনাচেম বেগিনের সরকারে কৃষিমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। এ সময় ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে দখলকৃত এলাকাগুলোতে স্থায়ী ইহুদি বসতি স্থাপনের পরিকল্পনা নিয়ে এগোন তিনি।

“আমি মনে করি, আমরা যদি এসব বসতি তৈরি করি তাহলে ঝুঁকি মোকাবেলার ক্ষেত্রে আমরা পর্যােপ্ত নিরাপদ বোধ করবো,” বলেন শ্যারন।

ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির বিরোধিতা করলেও ইসরায়েলি সরকারে ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন শ্যারন। এরপর প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর দায়িত্বে আসেন তিনি।

১৯৮২ সালের জুনে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন পিএলওকে হঠাতে ইসরায়েলের উত্তরের প্রতিবেশি লেবাননে অভিযান চালানোর নির্দেশ দেন অ্যারিয়েল শ্যারন। কয়েক দিনের মধ্যে ইসরায়েলি সৈন্যরা লেবাননের রাজধানী বৈরুত ঘিরে ফেলে।

দুই মাসের মাথায় ১৪ হাজার পিএলও ও সিরীয় যোদ্ধারা বৈরুত ছেড়ে গেলেও সাবরা ও শাতিলার মতো শরণার্থী শিবিরগুলোতে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি আশ্রয় নেয়।

এ সময় যুক্তরাষ্ট্রকে দেয়া প্রতিশ্রুতি লংঘন করে পশ্চিম বৈরুতে সেনা পাঠান শ্যারন। দুই হাজার পিএলও যোদ্ধা শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে অজুহাত তুলে এ অভিযানের বৈধতা আদায়ের চেষ্টা চালান তিনি।

শরণার্থী শিবিরে গণহত্যা চালায় ইসরায়েলি সৈন্যরা। প্রায় দুই হাজার মানুষ নিহত হন। ধর্ষণ করা হয় অনেক নারীকে। নির্যাীতনের শিকার হন অনেকে।

এ ঘটনার প্রতিবাদে বিশ্বজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। শ্যারনের নিজের দেশেও এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড় প্রতিবাদ হয়। হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানাতে প্রায় চার লাখ ইসরায়েলি রাজপথে নেমে আসেন। এ সময় দেশবাসীর কাছেও খুনী হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন তিনি।

তীব্র জনরোষের মুখেও পদত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানানোয় শ্যারনকে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী করেন প্রধানমন্ত্রী বেগিন।

পরের বছর ইসরায়েলি একটি তদন্তে শরণার্থী শিবিরে গণহত্যার জন্য শ্যারনকে ব্যক্তিগতভাবে দায়ী করা হয়। তবে তিনি তা অস্বীকার করেন।

এ ঘটনার পর রাজনীতি থেকে বিদায় না নিলেও কিছুটা ধাক্কা খান শ্যারন। তারপরেও ১৯৯৯ সালের নির্বাচনে লিকুদ পার্টির পরাজয় হওয়া পর্যান্ত পিছনে থেকে সরকারের নীতি-নির্ধারণীতে ভূমিকা রাখেন তিনি।

এরপর অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে আবার দলের নেতৃত্বে চলে আসেন শ্যারন।

২০০০ সালের শেষভাগে ইন্তিফাদা বা দ্বিতীয় ফিলিস্তিনি বিক্ষোভ শুরু হওয়ার ছয় মাসের মাথায় ক্ষমতায় আসেন অ্যারিয়েল শ্যারন। জেরুজালেমে মুসলিমদের পবিত্র আল-আকসা মসজিদে তার সফরকে কেন্দ্র করেই ওই বিক্ষোভ শুরু হয়।

মসজিদ চত্বর দিয়ে শ্যারন হেঁটে যাওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে প্রতিবাদী ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে ইসরায়েলি বাহিনীর সংঘর্ষ শুরু হয়।

আল-আকসা মসজিদ ও এর চত্বর ইহুদিদের কাছে পবিত্র টেম্পল মাউন্টে অবস্থিত, যা মুসলমানদের কাছে হারম আল শরিফ নামে পরিচিত।

২০০১ সালে ক্ষমতায় আসার পর ইসরায়েলিদের সুরক্ষার জন্য দখলিকৃত পশ্চিম তীরে একটি ‘বাঁধ’ তৈরি করেন শ্যারন, যা নিয়ে সমালোচনায় মুখর হয় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়।

এদিকে গাজা ও পশ্চিম তীরের কিছু এলাকা থেকে দখলদার ইহুদিদের সরিয়ে আনার পাশাপাশি সৈন্য প্রত্যাহারের ঘটনায় নিজ দেশ ও দলের মধ্যে সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি।

দলীয় বিরোধের মুখে ২০০৫ সালের নভেম্বরে লিকুদ পার্টি থেকে পদত্যাগ করে নতুন ডানপন্থী দল ‘কাদিমা’ (হিব্রুতে যার অর্থ এগোনো) প্রতিষ্ঠা করেন শ্যারন।

পরের মাসে একটি স্ট্রোক হয় অ্যারিয়েল শ্যারনের। সে যাত্রায় বড় ধরনের কোনো সমস্যা না হলেও ২০০৬ সালের জানুয়ারিতে দ্বিতীয় স্ট্রোক হওয়ার পর কোমায় চলে যান তিনি। সেখান থেকে আর কখনো জেগে ওঠা হয়নি ইতিহাসের এই আলোচিত চরিত্রের।

(কিছু তথ্য সিএনও থেকে নেয়া)

বিষয়: বিবিধ

১৪৯২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File