বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মানসিকতাঃ ভারতের অনিবার্য পাওনা

লিখেছেন লিখেছেন স্বপ্নলোকের সিঁড়ি ০৩ অক্টোবর, ২০১৬, ১১:৪২:৪৯ রাত


ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিকার বলেছেন, লঙ্কা বিজয় করে রাম যেমন তা বিভীষণকে দিয়ে দিয়েছিলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রেও ভারত তাই করেছে।তিনি বলেন; ‘আমরা কোনও দেশকে অধিগ্রহণ করতে চাই না। ভগবান রাম লঙ্কা জয় করে তা বিভীষণকে দিয়ে দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও আমরা তাই করেছি। আমরা কারও ক্ষতি করতে চাই না। তবে কেউ আমাদের ক্ষতি করতে চাইলে তার যোগ্য জবাব দেওয়া হবে।’ (বাংলা ট্রিবিউন, রামের লঙ্কা জয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতার তুলনা, অক্টোবর ০২, ২০১৬)

ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রীর এ মন্তব্যে অখন্ড ভারত তত্ব আর ভারতের আগ্রাসি সাম্রাজ্যবাদী নীতি আরেকবার প্রমাণিত হয়েছে।তিনি এমন সময় এ মন্তব্য করেছেন যখন পাক-ভারত যুদ্ধাবস্থার মুখোমুখি।বিশ্লেষকরা তার এ মন্তব্যের বিভিন্ন রকম ব্যাখ্যা দিচ্ছেন তথাপি উত্তপ্ত সময়ে তার এ মন্তব্য গভীর পর্যালোচনার দাবি রাখে।

জননী ও জন্মভূমি স্বর্গাদপী গরিয়সী।জন্মভূমির প্রতি নাড়ীর টান স্বভাবসূলভ চেতনা।মনের নিভৃতকোণ হতে সততই উতসারিত হয় নিজভূমের প্রতি টান।

Patriotism is an emotional attachment to a nation which an individual recognizes as their homeland. This attachment, also known as national feeling or national pride, can be viewed in terms of different features relating to one's own nation, including ethnic, cultural, political or historical aspects. It encompasses a set of concepts closely related to those of nationalism.১

দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে যারা দেশ রক্ষায় নিয়োজিত থাকবে, দেশের উন্নয়নের কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখবে, তাদের জন্য হাদিসে বিশেষ পুরস্কারের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। হজরত রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, একদিন এক রাতের প্রহরা ক্রমাগত এক মাসের নফল রোজা এবং সারারাত ইবাদতে কাটিয়ে দেয়া অপেক্ষাও উত্তম। (মুসলিম) দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে যারা দেশ রক্ষায় নিয়োজিত থাকবে, দেশের উন্নয়নের কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখবে, তাদের জন্য হাদিসে বিশেষ পুরস্কারের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। হজরত রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, একদিন এক রাতের প্রহরা ক্রমাগত এক মাসের নফল রোজা এবং সারারাত ইবাদতে কাটিয়ে দেয়া অপেক্ষাও উত্তম। (মুসলিম)

দেশপ্রেম ও বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট

বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে দেশপ্রেম একটি আলোচিত পরিভাষা।রাজনীতি,সাহিত্যাঙ্গণ সকল ক্ষেত্রেই এর প্রয়োগ লক্ষণীয়।ক্ষেত্রবিশেষে দেশপ্রেমের বুলির আড়ালে দেশের সর্বনাশী আয়োজনও চলছে।

দেশপ্রেমের উদাহরণ আমরা পাই গান্ধীর জীবনে।মোটাকাপড় আর দেশজ আবহে কৃষিজ অর্থনীতি নির্মাণের চিন্তাধারা ছিল তার।উপমহাদেশের ঐতিহ্য আর সাংস্কৃতিক চেতনার সংমিশ্রণে অর্থনীতি বিনির্মাণই ছিল তার লক্ষ্য।

সিঙ্গাপুরের জনক লি কুয়েন তার দেশকে একটি জেলেপট্রি থেকে সমৃদ্ধ অর্থনীতির দেশে পরিণতকরেছেন। তার আত্বজীবনীতে তিনি বলেন-জাতিসংঘের অধিবেশনে গিয়ে দেখলাম একটি বিমান এক সপ্তাহ পর্যন্ত পড়ে আছে।খোজ নিয়ে জানলাম এটি সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টের বিমান অথচ আমি টাকা সাশ্রয়ের জন্য পাবলিক বিমানে এসেছি এবং সাধারণ বিমানে আসা-যাওয়া করেছি।

অথচ আমদের দেশের অবস্থা সম্পূর্ণ উল্টো।সাধারণ মানুষের চেয়ে নেতাদের বিদেশমুখীতা যখন বেশি হয় তখন দেশের অর্থনীতি স্বাভাবিকভাবেই বিপরিতমুখি হবে।

আমাদের রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী বা পদস্থ অনেকে যেকোনো ধরনের স্বাস্থ্যগত সমস্যার মুখোমুখি হলে বিদেশে চিকিৎসা নেয়ার ওপর গুরুত্ব দেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী তার মায়ের নামে প্রতিষ্ঠিত বিশেষায়িত হাসপাতাল উদ্বোধনকালে চিকিৎসকদের অনুরোধ করেন তার যেকোনো ধরনের চিকিৎসার প্রয়োজন দেখা দিলে তাকে যেন বিদেশে নেয়া না হয়। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর মতো রাষ্ট্রপতির অবস্থানও যদি অনুরূপ হয় সে ক্ষেত্রে তা আমাদের পদস্থ অনেককে বিদেশে চিকিৎসা সেবা নিতে নিরুৎসাহিত করবে। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একাধিক কর্মকর্তার বক্তব্য থেকে জানা যায়, বিদেশে চিকিৎসা করাতে তারা যতটুকু না আগ্রহী তার চেয়ে অধিক আগ্রহ দেখিয়ে থাকেন যারা উভয়ের বিদেশ সফরকালীন সফরসঙ্গী হওয়ার সুযোগ ভোগ করেন। উল্লেখ্য, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর চিকিৎসার ব্যয়ভার রাষ্ট্র বহন করে। তারা উভয়ে চিকিৎসার কারণে বিদেশে গেলে তাদের সাথে যে বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তা সফরসঙ্গী হন এর ব্যয়ভারও নেহাত কম নয়। তারা উভয়ে আমাদের দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার বর্তমান মান বিবেচনায় নিজ দেশে চিকিৎসা গ্রহণে আগ্রহী হলে দ্রুত আমাদের চিকিৎসার মান উন্নততর হবে এবং বর্তমানে অযৌক্তিক আস্থা সঙ্কটের কারণে যারা অহেতুক ভারতসহ বিদেশে চিকিৎসা নিয়ে দেশের মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় করছেন তাদের বোধোদয় হবে। (বাংলাবার্তা ১৬/৭/২০১৬,ইকতিদার আহমদ)

বিদেশে টাকা পাচার আর ক্রমাগত দূর্নীতির মাধ্যমে ফুলে উঠা স্বভাবসূলভ মানসিকতা হয়ে উঠেছে আমাদের কাছে।এ সম্পর্কিত এক ভয়ানক প্রতিবেদন ছাপা হয় বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায়।প্রকাশিত এ প্রতিবেদনে বলা হয়-

“ ঢাকার একটি আইটি কোম্পানির কনসালটেন্ট হিসেবে কাজ করছেন ব্রিটিশ নাগরিক মি. পিটার। তিনি থাকেন অবশ্য থাইল্যান্ডে। তাকে এ দেশে আসতে হয় না। নামমাত্র সেই কনসালটেন্টের নামে মোটা অঙ্কের ফি থাইল্যান্ডের একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দেওয়া হয় নিয়মিত। বাংলাদেশ থেকে বিদেশে টাকা পাচারের এটি হলো খণ্ডচিত্র। এমন অসংখ্য পদ্ধতিতে দেশ থেকে টাকা পাচার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। হুন্ডির মাধ্যমে যেমন পাচার হচ্ছে টাকা, তেমনি বিদেশি নাগরিকদের চাকরি দেওয়া বা কনসালটেন্ট নিয়োগের নামেও অর্থ পাচার হচ্ছে। ভুয়া দলিল দিয়ে হাজার কোটি টাকা ব্যাংকঋণ নিয়ে কোম্পানির লোকজন লাপাত্তা হয়ে যায়। ব্যাংকঋণের বিপুল অঙ্কের টাকা বিদেশে পাচার করার অসংখ্য ঘটনা ধরাও পড়েছে। সেকেন্ড হোমের সুবিধা নিয়েও দেশ থেকে টাকা পাচার হচ্ছে। আমদানি-রপ্তানির সময় পণ্যের প্রকৃত মূল্য গোপন করার মাধ্যমে অর্থ পাচার নিয়মিত ঘটনায় দাঁড়িয়েছে। আর পাচার করা অর্থের বেশির ভাগই মালয়েশিয়া, ব্যাংকক ও দুবাই চলে গেছে। বিদেশি বিনিয়োগ উন্মুক্ত করে দেওয়ায় পাচারকারীরা টাকা পাচারে ওই সব দেশকে বেছে নিচ্ছে। সেখানে আবাসিক ভবন, জমি ক্রয়, হোটেলসহ বিভিন্ন ব্যবসায় এসব টাকা বিনিয়োগ করা হচ্ছে। এ ছাড়া যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের মধ্যে ইংলিশ চ্যানেলের ছোট দ্বীপরাষ্ট্রগুলোতেও অর্থ পাচারের অভিযোগ রয়েছে। পাচারের টাকা যাচ্ছে বিদেশের নামিদামি ক্যাসিনোতে। আর এসব অর্থ পাচারকারীকে দেখানো হচ্ছে ঋণখেলাপি হিসেবে। জানা গেছে, দেশের অন্যতম আর্থিক কেলেঙ্কারিগুলোর মধ্যে একটি হলো শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি। এর পরে রয়েছে, একের পর এক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ লোপাট। হলমার্ক, বেসিক ব্যাংকসহ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংগুলোতে একের পর এক কেলেঙ্কারি। দেশ থেকে অর্থ পাচার ও সর্বশেষ বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে রিজার্ভের অর্থ চুরি। ২০০৮ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত আট বছরে দেশ থেকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় লুট হয়েছে ১০ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বিদেশে পাচার হয়েছে ৫ লাখ ৩০ হাজার ৪২৪ কোটি টাকা। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিনানশিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) সম্প্রতি প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, বাংলাদেশ থেকে ২০১৩ সালে ৯৬৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার পাচার হয়েছে। টাকার অঙ্কে যা ৭৬ হাজার ৩৬১ কোটি ৪০ লাখ টাকা। পাচার হওয়া এ অর্থ আগের বছরের তুলনায় ৩৩ দশমিক ৭৯ শতাংশ বেশি। ২০১৪ ও ২০১৫ সালে এই পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ বেড়েছে। সংস্থাটির সর্বশেষ ২০১৫ সালের ডিসেম্বরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া ওই অর্থ বাংলাদেশের ২০১৫-১৬ অর্থবছরের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহন, পল্লী উন্নয়ন, শিল্প ও ভৌত অবকাঠামো খাতের মোট উন্নয়ন বাজেটের সমান। প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে যারা অর্থসম্পদ গড়েন, তারাই মূলত এ টাকা পাচার করেন। পাশাপাশি দেশের শিল্পোদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের একটি অংশ নিজেদের পরিবার এবং সন্তানদের নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তার জন্য বিভিন্নভাবে অর্থ বাইরে পাঠিয়ে দিচ্ছেন।(বাংলাদেশ প্রতিদিন,৭ জুলাই,২০১৬,আলী রিয়াজ ও মির্জা মেহেদী)

অর্থপাচারের ভয়াবহচিত্র উঠে এসেছে দুদকের এক প্রতিবেদনে।দুদকের ২০১৪ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনের অর্থপাচার সংক্রান্ত অধ্যায়ের ৪২ নং পৃষ্ঠায় বলা হয়-

২০১৪ সালে কমিশন অর্থপাচার অনুসন্ধানে গুরুত্বারোপ করেছে।এই বছর ২২৬টি অনুসন্ধান চালানো হয় যা ২০১২ ও ২০১৩ সালের চেয়ে ছয়গুণ এবং দেড়্গুণ বেশি(২০১২ সালে ৩৯টি ও ২০১৩ সালে ১৮০টি)।

এদেশের মানুষের দেশপ্রেমে বিরক্ত হয়ে আহমদ ছফা সত্যিই বলেছেন-

‘আমি অত্যন্ত বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করেছি আমাদের জাতীয় জীবনের মূলস্রোতের সঙ্গে আমাদের উচ্চবিত্ত শ্রেণীর কোন সংযোগ নেই। আমি নানা কার্যব্যপদেশে ধানমন্ডি, গুলশান, বনানী এলাকার অনেক আধুনিক রুচিসম্পন্ন ধনাঢ্য ভদ্রলোকদের বাড়িতে যাতায়াত করেছি। ঐ সকল এলাকায় কমসংখ্যক মানুষই ঘরে বাংলা ভাষায় কথা বলে থাকেন। তরুণ কমবয়েসি ছেলেমেয়েরা সে সকল বাংলা শব্দ ব্যবহার করে থাকে যেগুলোর ইংরেজি প্রতিশব্দ তারা জানে না। আর বাংলা বললেও এমন একটা ভঙ্গিতে বলে, মনে হবে আপনার প্রতি কৃপাবশত সে এই ভাষাটিতে বাতচিত করছে।’

‘এই সমস্ত ভদ্রলোক এবং ভদ্রমহিলা আকারে-প্রকারে, ভাবেভঙ্গিতে আপনাকে জানিয়ে দিতে কসুর করবেন না, নেহায়েত করুণা করেই, দায়ে পড়ে, ঠেকে এই দেশটিতে বসবাস করছেন। তাঁদের বাড়িঘরের আসবাবপত্রে, সাজ-সরঞ্জামে বাংলাদেশের কোন চিহ্ন আপনি খুঁজে পাবেন না। এঁদের ঘরের ছেলেমেয়েরা ভিসিপিতে বিদেশি ছবি দেখে থাকে। বিদেশি সঙ্গীত শুনে সঙ্গীতপিপাসা মেটায়, আচারে-ব্যবহারে কথাবার্তায় এমন একটা ভঙ্গি ফুটিয়ে তোলে যেন তারা এদেশের কেউ নয়।’(. আহমদ ছফা, ‘বাংলাদেশের উঁচুবিত্ত শ্রেণী ও সমাজ বিপ্লব প্রসঙ্গ,’ “রাজনীতির লেখা”, আহমদ ছফা রচনাবলি, ৭ম খণ্ড, নূরুল আনোয়ার সম্পাদিত (ঢাকা: খান ব্রাদার্স, ২০০৮), পৃ. ১৮০-১৮২)

দেশপ্রেম ও বুদ্ধিজীবীশ্রেণীঃ

দেশপ্রেমিক তারাই যারা এ দেশের শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী কিংবা দেশের খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষ নিঃস্বার্থভাবে যারা দিনরাত গায়ে খেটে, শ্রম দিয়ে সমগ্র দেশের মানুষদের অন্নের জোগান দিয়ে চলেছেন। কিন্তু রাষ্ট্র উন্নয়ন কিংবা দেশ গড়ার ক্ষেত্রে, দেশের উন্নয়নে নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে এদের অংশগ্রহণের কিংবা বুদ্ধি-পরামর্শ দানের কোনো সুযোগ নেই। তা ছাড়া শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় দেশপ্রেমিক হলেও এ দেশের সরকারগুলো, এ দেশের ক্ষমতাসীনেরা তাদের এমনভাবে দলগত বিভাজনে বিভক্ত করে ফেলেছেন যে, তারা প্রকৃত অর্থে মেরুদণ্ডহীন অথর্বে পরিণত হয়েছেন। রাষ্ট্রের কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে তারা প্রতিবাদ করতেও ভয় পান। এরা প্রকৃত অর্থে বিভিন্ন দলের মহাস্তাবকে পরিণত হয়েছেন। হয়েছেন ক্ষমতালোভী, সুবিধাভোগী, মাথা বিকানো মানুষ। আর এ ধরনের মানুষদের ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন- ‘ধূর্ত, কপট, মিথ্যুক, প্রবঞ্চক, চালবাজ, সুবিধাবাদী, মোনাফেক এবং মক্কর’ (কেউ থাকে যুদ্ধে কেউ চলে ভিক্ষায়, পৃ. ১৬)। যদি তাই না হবে তাহলে দেশের পক্ষে বলিষ্ঠভাবে কথা বলার লোক পাওয়া যাচ্ছে না কেন। বাংলাদেশকে খুবলে খাওয়ার জন্য, দেশের অভ্যন্তরে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য কোনো কোনো দেশ প্রস্তুত হয়ে আছে।(নয়াদিগন্ত,৩০ জুলাই,ড আব্দুস সাত্তার,দেশপ্রেম ও বাংলাদেশ)

দরকার সদা জাগ্রত জনতাঃ রাজনীতিবিদ্যা তাই বলে

নির্ভীক,সুশিক্ষিত ও সচেতন নাগরিকই দেশের স্বাধীনতা ও স্বার্বভৌমত্বের প্রধান রক্ষাকবচ।প্রবল সচেতন জনগোষ্ঠীকে এড়িয়ে চলা যেকোন প্রতিষ্ঠানের জন্য কষ্টকর। আবার এরকম প্রবল সচেতন জনগোষ্ঠী সহজে বা একদিনে গড়ে উঠেনা।দীর্ঘদিনের শিক্ষা,সাহিত্য ও মূল্যবোধের সমন্বয়েই কালক্রমে তা বিকশিত হয়। চিরন্তন সতর্কতাই স্বাধীনতার মূল্য। Henry Nevinsion এর পক্ষে যুক্তি দিয়ে বলেন- “Freedom,we know,is a thing that we have to conquerafresh ourselves everyday like love ; and we are always loosing freedom just as we are always losing war because after each victory,we think,we can settle down and enjoy it without further struggle.The battle of freedom is never done and field never quite.”

সুতরাং দেখা যাচ্ছে সচেতন জনগণ রাষ্ট্রের যথাযথ বিকাশের জন্য জরুরি।বাংলাদেশের জন্য সচেতন দেশপ্রেমিক জনগণ –বাংলার ভৌগলিক বাস্তবতায় খুব বেশি জরুরি।এরকম সচেতন জনগোষ্ঠী দরকার যারা দেশমাতৃকার জন্য অকাতরে জীবন দিতে প্রস্তুত থাকবে সর্বক্ষণ।

ভারতবিরোধীতা করতেই হবে যদি তা আমাদের জাতীয়স্বার্থ পরিপন্থি হয়

উগ্রজাতীয়তাবাদী না হয়ে জাতীয়স্বার্থের পরিপন্থি কাজে অবশ্যই ভারতবিরোধীতা করা দরকার।আমাকে ভাতে মারবে,পানিতে মারবে,সীমান্তে গুলি করবে আর আমি নির্লজ্জ দালালী করব –আর যাই হোক তা দেশপ্রেম হতে পারেনা।স্বাধীনতার পর ভারত তাদের কোন প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি আমাদের সাথে।তালপট্রি দ্বীপ দখল করে নিল,কিছুদিনের কথা বলে ফারাক্কাবাধ দিয়ে পদ্মা মরুভূমি করে করে দিল-



আর আমরা মরু সাহারায় ধূলোর সাথে গড়াগড়ি খাব-এমন বধির দেশপ্রেমিক আর কোথাও পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। আহমদ ছফা যথার্থই বলেছেন-ভারত বিরোধিতা মানে হিন্দু বিরোধিতা বুঝে থাকে।তবুও আমি মনে করি, একটা স্বনির্ভর [দেশ] নির্মাণ করতে হলে আমাদের কিছু কিছু ক্ষেত্রে অবশ্যই ভারতের বিরোধিতা করতে হবে।



নিছক শত্রুতা, নিছক ঘৃণা, নিছক বিরোধিতা–এগুলো কোন কাজের কথা নয়। অন্ধকারের শক্তির ওপর আস্থা স্থাপন করলে রসাতলে যাওয়ার পথটাই পরিষ্কার হয়। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতা, পারস্পরিক কল্যাণকামনা–এগুলো অত্যন্ত প্রয়োজনীয় জিনিশ। কিন্তু জাতীয় অর্থনীতির উজ্জীবনের প্রশ্নে বড়দেশের বিরোধিতা করা একটি স্বাস্থ্যকর লক্ষণ।

তাইওয়ান যদি মূল চীনের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির একটা চ্যালেঞ্জ গ্রহণ না করত তো এত দ্রুত তার অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটত না। কোরিয়া জাপানের পার্শ্ববর্তী একটি অসহায় দেশ ছিল। শিল্পোন্নত জাপানের কাছে নতিস্বীকার না করে নিজের পায়ের ওপর দাঁড়াবার সময়োচিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার কারণে আজকের পৃথিবীতে কোরিয়া একটি সম্মানজনক স্থান অধিকার করতে পেরেছে।ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশকে তার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি ত্বরান্বিত করার জন্য একটি নিজস্ব অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। নইলে ক্রমসম্প্রসারমাণ ভারতীয় শিল্পবাণিজ্যের চাপে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উত্থান সুদূর পরাহত হয়ে দাঁড়াবে।(আহমদ ছফা- বাংলাদেশ: জাতি রাষ্ট্র এবং গন্তব্য, আজকের কাগজ, ২০ জুন ১৯৯৬, ৬ আষাঢ় ১৪০৩।)

ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কথা বলতেই হবে

গৌতম বুদ্ধের নীতি রাষ্ট্রনীতিতে চলেনা।কেউ চড় মারলে পাল্টা জবাবদান বর্তমান বিদেশনীতির গুরুত্বপূর্ণ অনুষনজ্ঞ।নিম্নে কিছু যথার্থতা তুলে ধরা হলো-

এশিয়ান হাইওয়ের নামে ট্রানজিট :

Asian Highway Ges Trans-Asian Railway হলো United Nation-এর অঙ্গ সংগঠন। ESCAP-এর পরিকল্পনায় প্রথমে ১৫টি দেশের কথা বলা হলেও পরে এই মহাসড়কের গতিপথ ২০টি রাষ্ট্র হবে বলে ঘোষণা করা হয়। বর্তমানে ৩২টি রাষ্ট্র এর অন্তর্ভুক্ত বলে দাবি করা হয়। প্রকল্পটির উদ্দেশ্যে বলা হয় এশীয় রাষ্ট্রগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়নের স্বার্থে ঐ দেশগুলোর মধ্যে সহজ ও দ্রুত বাণিজ্যিক যোগাযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে ভিন্ন এশীয় রাষ্ট্রের রাজধানীগুলোকে একই সড়ক ও রেলযোগাযোগ ব্যবস্থার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। ট্রানজিট-এর মূল প্রকল্পের আওতায় পশ্চিম এশিয়া তুরস্কের ইস্তাম্বুল আঙ্কারা থেকে শুরু করে Asian highway কে শুধুমাত্র সড়কের মাধ্যমে ইরানের তেহরান, আফগানিস্তানের কাবুল, পাকিস্তানের লাহোর ও পরে শেরশাহের ঐতিহাসিক গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোডের মাধ্যমে ভারতের দিল্লি হয়ে বাংলাদেশের ঢাকা-চট্টগ্রাম ও মিয়ানমারের আকিয়াব এবং রাজধানী ইয়াংগুন হয়ে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর ও সিঙ্গাপুর পর্যন্ত যোগাযোগ স্থাপনের কথা ছিল।



চীনকে কৌশলে এশিয়ান হাইওয়ে থেকে বাদ দিতে না পারলে এশিয়ায় ভারতের শক্তিশালী কর্তৃত্ব কায়েম হবে না, আমেরিকার কথা কেউ শুনবে না। অন্য দিকে বাংলাদেশ চীনের সাথে সড়ক যোগাযোগের মাধ্যমে গভীর সম্পর্কে আবদ্ধ হবে যা বর্তমান সময়ের দাবি হওয়া উচিত। তাতে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবেও ব্যাপক লাভবান হতো। চীন এই মহাসড়কে যুক্ত হলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব ভারতের হিংস্র থাবা থেকে অনেকটা মুক্ত থাকত।

কিন্তু ভারতের মাথা ব্যথা হলো চীন যদি বাংলাদেশের সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে তোলে তাহলে ভারতের কর্তৃত্ব বাংলাদেশের ওপর রাখতে পারবে না। যা আমেরিকা ও ভারত কোনভাবেই মেনে নিতে পারছে না। ভারতের সাথে আমেরিকার সাম্প্রতিক সময়ের পরমাণু চুক্তি, তাদের সম্পর্ককে অত্যন্ত গভীর করেছে। যার জন্য ভারত যাতে ঐ রুটের- মাধ্যমে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে Seven Sister States -এ তাদের পণ্যসামগ্রী নিয়ে যেতে পারে সে জন্য আমেরিকা ভারতের হয়ে চাটুকারিতা করছে।

Transit আমাদের জন্য যা ক্ষতিকর, তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি করবে ভারতের স্বার্থে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে সাতবোন রাজ্যে যাওয়ার নতুন মহাসড়ক Asian Highway । সামান্য যা অর্থ পাওয়া যাবে তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি খরচ করতে হবে বাংলাদেশের। বাংলাদেশের সীমান্তের প্রায় ১০৫০ কিলোমিটার বা ৬৫০ মাইল রাস্তা যার নির্মাণ খরচ বহন ও রক্ষনের দায়িত্ব পালন করা বাংলাদেশকে পক্ষে সম্ভব হবে না।

পার্বত্য শান্তি চুক্তি ও সেনা প্রত্যাহার :

পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করা গেলে ভারত সহজেই চট্টগ্রাম বন্দর পেয়ে যাবে। এই লোভে শান্তিবাহিনী ও জনসংহতি সমিতির নেতা সন্তু লারমাকে ভারত অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষন দিয়ে পর্দার অন্তরাল থেকে সার্বিক সহযোগিতা করে আসছে। সরকার পার্বত্য অঞ্চল থেকে সেনা প্রত্যাহার করছে অন্যদিকে স্বাধিকার আন্দোলনের ডাক দিলেন সন্তু লারমা (নয়া দিগন্ত ১০.০৮.০৯)।

পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে সন্তু লারমার স্বাধিকার আন্দোলনের ডাক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও অস্তিত্বকে ঝুঁকির সম্মুখীন করবে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক দেশ কর্তৃক অন্য দেশে সন্ত্রাসে মদদদান অন্যতম বিতর্কিত একটি বিষয়। ভারতের অভিযোগ হলো, পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার সহযোগিতায় বাংলাদেশ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সন্ত্রাসবাদ ও বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন পরিচালনায় সাহায্য করছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ দাবি করছে, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কাজ করছে এই রকম ৩৯টি ঘাঁটি রয়েছে ভারতে। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তিবাহিনীর ৪৫টি সশস্ত্র ক্যাম্প খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, বান্দরবানের সন্নিকটস্থ বর্ডারিং এরিয়ায় ভারতে অবস্থিত। একইভাবে বঙ্গভূমি আন্দোলনেও বঙ্গসেনাদের ভারত সরাসরি মদদ দানের মাধ্যমে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করে তুলছে।

সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া :

ভারত বাংলাদেশ থেকে অবৈধ অভিবাসন ঠেকানোর অজুহাতে বাংলাদেশ ভারতের আন্তর্জাতিক সীমানায় কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করছে। এই কাঁটাতারের বেড়া দেয়ার মধ্য দিয়ে ভারতের অবন্ধুত্বসুলভ নির্মম আচরণ প্রকাশ পায়। এর মধ্য দিয়ে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, ভারত বাংলাদেশের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখতে চায় না, চায় বাংলাদেশকে আবদ্ধ করে রাখতে। ইতোমধ্যে ভারত ১৩৫৭ কিলোমিটার এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণকাজ সম্পন্ন করেছে। তা ছাড়াও ভারতের দ্বিতীয় পর্যায়ে ২৪২৯.৫ কিলোমিটার কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ পরিকল্পনাধীন রয়েছে। এই কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের মধ্য দিয়ে ভারতের রাষ্ট্রীয় মতার উদ্ধত রূপটি প্রকাশ পেয়েছে। আর এর জের ধরে মিয়ানমারও সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেয়ার কাজে মনোযোগী হয়েছে। অর্থাৎ ভারতের সাথে নতুন করে এখন মিয়ানমার যোগ হলো। ফলে একসাথে দু’টো দেশকে এখন পর্যবেণে রাখতে হবে যা বাংলাদেশের অস্তিত্বের জন্য বিরাট হুমকি।



আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৫ সালে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বিএসএফ এর হাতে ৪৬ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছে৷ আহত হয়েছে ৭৩ জন৷ এছাড়া অপহরণ করা হয়েছে ৫৯ জনকে । কয়েক সপ্তাহ আগে ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং অবৈধ অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত শিগগিরই বেড়া দেয়ার কাজ শেষ করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে বলে জানান৷

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত বিশ্বের ঝুকিপূর্ণ ১০ টি সীমান্তের মধ্যে ২ নম্বর অবস্থানে আছে।তাছাড়া প্রায় প্রতিদিন সীমান্ত হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেই চলছে যে প্রতিদিন কোন এক ফেলানী সীমান্ত হত্যার প্রতিনিধিত্ব করছে।

তাই আসুন-সবাই বাংলাদেশের দালাল হই।শেখ মুজিব যেমনটি বলেছেন-আর দাবায়া রাখতে পারবা না; প্রমাণ দেই কাজে।

বিষয়: বিবিধ

১২৯২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File