২৮ অক্টোবর ও বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি

লিখেছেন লিখেছেন স্বপ্নলোকের সিঁড়ি ২৭ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:২১:১৬ রাত

‘‘বল বীর উদাত্ত কণ্ঠে আমি বীর মোসলমান।

আল্লাহ ভিন্ন মানিনা অন্য, আমি চির নির্ভিক প্রাণ।

আমি মৃত্যুর মাঝে চিরদিন খুঁজি নব জীবনের সন্ধান

আমি আগুনের হল্কা, ঘূর্ণিত উল্কা, খোদাই তেজে তেজীয়ান।’’

কাজী নজরুল ইসলামের এ অমীয়বাণীগুলোর প্রায়োগিক দিকটাই যেন মুখ্য হয়ে উঠেছিল ২০০৬ সালের ২৮শে অক্টোবর পল্টন ময়দানে।একদিকে বোমা ফুটছিল মূহুর্মূহু আর অন্যদিকে নেতার প্রাজ্ঞ ভাষন-শত প্রতিকূলতাকে মাড়িয়ে চলার এক ধীশক্তিসম্পন্ন শিক্ষা।জানবাজ কর্মীরা জীবন বাজি রেখে নেতার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করছিল সেদিন।মানবঢাল তৈরি করে সমাবেশস্থল আর নেতাকে রক্ষার সে দীক্ষা বাংলাদেশের সংকীর্ণ রাজনৈতিক সংস্কৃতির মধ্যে যুগ-যুগান্তরে অক্ষয় হয়ে থাকবে।

বিশ্বে অস্থিতিশীল দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম ১০টি দেশের মধ্যে আছে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ভেরিস্ক ম্যাপলক্রফটের তৈরি করা সিভিল আনরেস্ট ইনডেক্স বা অস্থিতিশীলতা সূচকে ১৯৮ দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ। সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটি তাদের ওয়েবসাইটে এই তালিকা প্রকাশ করে।

এই সূচক তৈরিতে পরিচালিত জরিপে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন দেশের মানুষের রাজনৈতিক প্রতিবাদ ও গণবিক্ষোভের ধরন, জাতিগত ও ধর্মীয় সহিংসতা।

গৃহযুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া, ইয়েমেন ও লিবিয়া এই তালিকায় যথাক্রমে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে রয়েছে। আর ভারত রয়েছে চতুর্থ স্থানে। আফ্রিকার দেশ ববুরুন্ডি পঞ্চম, মেক্সিকো সপ্তম, মিয়ানমার অষ্টম স্থানে রয়েছে। এমনকি বোকো হারাম জঙ্গিগোষ্ঠীর তাণ্ডবে জর্জরিত নাইজেরিয়ার অবস্থানও বাংলাদেশ ও ভারতের চেয়ে ভালো দেখানো হয়েছে। সূচকে তাদের অবস্থান ১০ম।(সমকাল, ৭ আগস্ট ২০১৬)

রাষ্টবিজ্ঞানী গ্যাব্রিয়েল আলমন্ড ও সিডনি ভার্বা রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন তাদের "The Civic Culture" গ্রন্থে।এর মধ্যে একটি হচ্ছে parochial political culture- যা প্রকারান্তরে রুগ্ন রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে নির্দেশ করে।২৮শে অক্টোবর সে রুগ্ন সংস্কৃতির এক বাস্তব স্বাক্ষী।



সম্ভবত সৃষ্টির সূচনাকাল থেকে মানুষের মধ্যে মানবিকতা,দয়া,ভালোবাসা এসব মূল্যবোধ গড়ে উঠেছিল।আদিম সমাজ হতে সভ্যতার ধারাবাহিক উত্থানে এসব গুণাবলী ভূমিকা রেখেছে সন্দেহাতীতভাবে।কিন্তু বিজ্ঞান ও সভ্যতার চরম উত্থানের এ লগ্নে টিভির পর্দায় একেকজন জীবন্ত মানুষের উপর লগি-বৈঠার উপর্যুপরি আঘাতে আঘাতে প্রাণবায়ূ বের হতে দেখা আর নিথর দেহের উপর লাফিয়ে লাফিয়ে পৈশাচিক উল্লাস প্রকাশের মাধ্যমে মানবতার যে ঘৃণ্য কদর্যরূপ প্রদর্শন করা হয়েছে -তা অনন্তকালব্যাপী কালো অধ্যায় হয়ে থাকবে।



ইতিহাসের পাতায় অনেক যুদ্ধ-বিগ্রহের স্থান হয়েছে-এসব যুদ্ধে মানুষ হত্যার নির্মম কাহিনী রচিত হয়েছে কিন্তু এরকম বিয়োগান্তক কাহিনীর স্থান সম্ভবত হয়নি।

ঘটনা যদি এখানেই সীমাবদ্ধ থাকত- কিন্তু শেষ পর্যন্ত থাকেনি।শুরু হয় লাশের রাজনীতি।মিথ্যাচারের সে রাজনীতি গোয়েবলসের তত্বকেও হার মানায়।২৮ অক্টোবরের শহীদ হাবিবুর রহমানের লাশ নিয়ে মিথ্যাচার শুরু হয়।ঢাকা মহানগরী আওয়ামীলীগের ৪২ নং ওয়ার্ড শ্রমিকলীগ নেতা নূরু মিয়া শহীদ হাবিবুর রহমানকে তার সন্তান পরিচয়ে লাশ সনাক্ত করেন এবং আওয়ামীলীগ কর্মী দাবী করেন এবং পরবর্তিতে তার এ মিথ্যাচার ধরা পড়ে।তিনি মিডিয়ার কাছে স্বীকার করেন উপরের নির্দেশে তিনি এ ঘৃণ্য কাজ করতে বাধ্য হয়েছেন।



ছাত্রমৈত্রী নেতা বাপ্পাদিপ্ত বসু শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন।কথায় কথায় তারা বুর্জোয়া রাজনীতিকে গালাগালী করেন।সে বাপ্পাদিপ্তরা ঐদিন লাশের উপর লাফিয়ে তাদের যে নগ্নরূপ প্রকাশ করেছেন-তা প্রকারান্তরে তাদের ভিতরের পশুসুলভ চরিত্রের প্রতিনিধিত্ব করেছে।



তখনকার বিরোধীদলীয় নেত্রীর সুস্পষ্ট ঘোষণা ছিল- সবাই লগি-বৈঠা নিয়ে আসবেন।তার নির্দেশে তার কর্মীবাহিনী এসেছে এবং জিঘাংসু নেত্রীর নির্দেশের পূর্ণ বাস্তবায়নও করেছে।বিশ্ববিবেক স্তব্দ হলেও স্তব্দ হয়নি আওয়ামী বিবেক।আজকের আওয়ামী সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের তখনকার নির্বাচন কমিশনারের বাড়ীতে অক্সিজেন বন্ধেরও হুমকি দিয়েছিলেন।




২৮ অক্টোবর শুধু একটি হত্যাকান্ড নয় বরং একটি গণহত্যাও বটে।উইকিপিডিয়ার ভাষ্যমতে-"গণহত্যা বলতে দুইয়ের অধিক বা অনেক মানুষ মেরে ফেলা বোঝায়। পারিভাষিক অর্থে কোন দেশ, জাতি, গোষ্ঠী বা ভিন্ন মতাদর্শধারীদের খুন এবং মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করাই হল গণহত্যা। ১৯৪৮ সালের ৯ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত রেজ্যুলেশন ২৬০ (৩) এর অধীনে গণহত্যা বলতে বোঝানো হয়েছে এমন কর্মকান্ড যার মাধ্যমে একটি জাতি বা ধর্মীয় সম্প্রদায় বা নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে নিশ্চিহ্ন করার প্রয়াস নেওয়া হয়েছে বা হচ্ছে।" ভিন্নমত দমনের লক্ষ্যে এদিনের আওয়ামী বর্বরতা তাদেরকে গণহত্যাকারীদের কাতারে শামিল করেছে।হিটলারের হলোকাস্ট,আর্মেনিয়ার গণহত্যা,কাশ্মীরের গণহত্যা,কিংজিং গণহত্যা আর একাত্তরের গণহত্যার সাথে এর সাদৃশ্য রয়েছে।স্থানিক ও সংখ্যাগত পার্থক্য আছে নিশ্চয় কিন্তু উদ্দ্যেশ্যগত সাদৃশ্য রয়েছে উপরোক্ত গণহত্যার সাথে ২৮ অক্টোবরের।১/১১ এর তত্বাবধায়ক সরকারের আমলে খুনের নির্দেশদাতা হিসেবে সরকার শেখ হাসিনাকে আসামী করে একটি মামলা দায়ের করেছিল কিন্তু পরে ক্ষমতার পটপরিবর্তনে এ মামলা খারিজ হয়ে যায় রাজনৈতিক বিবেচনায়।এতসব দালিলিক আর ভিডিও রেকর্ড থাকার পরেও যদি এ মামলা খারিজ হয়ে যায় তাহলে পত্রিকার ডকুমেন্ট আর বিবৃতি দেখিয়ে জামায়াত নেতাদের সাজাদান আর সাজা কার্যকর ইতিহাসের এক নির্মম প্রহসন ছাড়া আর কিছু নয়।২৮ অক্টোবরের খুনিদের যদি বিচার না হয় তাহলে স্বয়ং ইতিহাসকে একদিন কাঠগড়ায় দাড়াতে হবে।

২৮ অক্টোবরে আওয়ামীলীগের পক্ষে বর্বরতা চালিয়েছিল বস্তির ভাড়াটে গুন্ডা-মাস্তান আর নির্দেশে ছিল আওয়ামী গডফাদারেরা।টাকার ও ক্ষমতার কাছে তারা তাদের বিবেক বন্ধ রেখেছিল।আর বিপরীতে ছিল আদর্শিক এক কাফেলা। বস্তির লেলিয়ে দেয়া সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধপরায়ণ না হয়ে শান্তচিত্তে প্রতিকূলতাকে মোকাবিলা করা আর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে অমর হয়ে থাকবে।

"এ বয়স জানে রক্তদানের পুণ্য

বাষ্পের বেগে স্টিমারের মতো চলে,

প্রাণ দেওয়া-নেওয়া ঝুলিটা থাকেনা শূণ্য

সঁপে আত্বাকে শপথের কোলাহলে।"

কবি সুকান্ত বাংলার তরুণের মধ্যে দেশমাতৃকা আর আদর্শের জন্য বাসনা করেছিলেন।শহীদ মুজাহিদ,শিপ[ন,রুহুল আমিন,হাবিবুর রহমান ইসলামকে কালজয়ী আদর্শ হিসেবে উপস্থাপনের জন্য স্বপ্ন দেখতেন আর সে স্বপ্নের বাস্তবায়নে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন পরমের প্রবল সন্তুষ্টির প্রত্যাশায়।তাদের এ আত্বত্যাগ বৃথা যাবেনা,যেতে পারেনা।ক্রুসেডজয়ী সালাউদ্দিন এর ভাষায়- Blood never sleeps.পল্টনের এ রক্ত তরঙ্গাকারে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের প্রতিটি ইঞ্চি প্লাবিত করবে একদিন।

বিষয়: বিবিধ

১২০২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File