উন্নত রাজনীতির আকাঙ্ক্ষায়

লিখেছেন লিখেছেন সৈয়দ মোহাম্মদ ইব্রাহিম ১১ জানুয়ারি, ২০১৬, ০২:০৩:১৭ দুপুর

নববর্ষের শুভেচ্ছা Rose Rose Rose

২০১৬ খৃস্টাব্দের আগমন উপলক্ষে আমি, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৫ তারিখের অপরাহ্ন ৬:২৫-এর সময় আমার ফেইসবুকে যে স্ট্যাটাসটি দিয়েছিলাম, সেটি এখানে হুবহু উদ্বৃত করছি। উদ্বৃতি শুরু। নববর্ষ ও শুভেচ্ছা। সৌরজগতে: চন্দ্র এবং সূর্য, মহান সৃষ্টিকর্তার হুকুমেই নিজ নিজ কক্ষপথে চলছে এবং ঘুরছে। চন্দ্র-সূর্যের ভ্রমণের অনেকগুলো মাপের সমষ্টিগত একক হচ্ছে, একটি বছর। আমাদের জীবনের দৈর্ঘ যতটুকুই হোক না কেন, ঐখান থেকে, একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব কমে গেল। শেষ-প্রান্ত আরও একটু কাছে এগিয়ে এলো! অবশিষ্ট জীবনের, আগামী বছরটি ২০১৬ যেন সুন্দর ও ফলপ্রসূ হয়—সবার জন্য এই প্রার্থনা। উদ্বৃতি শেষ।

আলোচনা ও সমালোচনায় ২০১৫

বিগত বছরটি ঘটনাবহুল ছিল। প্রথম তিন মাস আন্দোলনে উত্তপ্ত ছিল। আন্দোলনকারীরা করুক বা আন্দোলনের বিরোধীতাকারীরা করুক, অনেক সহিংস ঘটনা ঘটেছিল যেটা পরিহার্য এবং নিন্দনীয়। মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা ও চট্টগ্রামের তিনটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন ছিল। বছরের একদম শেষে অনেকগুলো পৌরসভায় নির্বাচন ছিল। মুক্তিযুদ্ধ আলোচনায় এসেছে; একাধিক আঙ্গিকে; ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের এবং সরেজমিনে বিরোধী রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ডের প্রসঙ্গে আলোচনা ও সমালোচনা ছিল প্রচুর। নির্বাচন কমিশন ছিল আলোচিত ও সমালোচিত। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে, পুকুর বা নদী বা সাগর চুরি নয়, বরং মহাসাগর-চুরির যে প্রক্রিয়া উদ্ভাসিত হয়েছে সেটিও আলোচিত ছিল। ব্যক্তি ইবরাহিম অথবা পরিবার প্রধান ইবরাহিম অথবা কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান ইবরাহিম-ও ব্যস্ত ছিল এবং আলোচিত-সমালোচিত ছিল। আমার ব্যস্ততার অন্যতম একটি আঙ্গিক হলো পত্রিকার জন্য কলাম লেখা এবং টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর পক্ষ থেকে দাওয়াত পেলে টকশোতে অংশগ্রহণ করা। পত্রিকায় কলাম লিখি প্রায় আঠারো বছর ধরে। ছয়টি কলাম-সংকলন বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে চারটি ভিন্ন প্রকাশনী সংস্থা থেকে। এই দীর্ঘ দেড় যুগ সময়ে, প্রচুর সংখ্যক কলামে আমি বাংলাদেশকে নিয়ে আমার চিন্তা চেতনা, বাংলাদেশের নেতৃত্ব প্রসঙ্গে আমার আগামী দিনের চিন্তা চেতনা এবং পৃথিবীর অন্যান্য স্থানের অনুকরণীয় নেতৃত্ব প্রসঙ্গে লিখেছি। উদ্দেশ্য, বাংলাদেশ যেন এগিয়ে যায়। উদ্দেশ্য, বাংলাদেশে যেন পরিশীলিত, পরিমার্জিত যুযোপযোগী নেতৃত্ব সৃষ্টি হয়। উদ্দেশ্য, আমাদের জীবনের অভিজ্ঞতা অন্যের নিকট পৌঁছিয়ে দেওয়া। এই পরিপ্রেক্ষিতেই, আজকের কলামটিতে ছোট ছোট দু’চারটি কথা তুলে ধরতে চাই, যেগুলো চিন্তাশীল পাঠকের জন্য চিন্তার খোরাক হতে পারে।

রাজনীতির জন্য রাজনৈতিক চিকিৎসক প্রয়োজন

১৯৬৮-৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে অনার্স পড়ার সময়, প্রতিটি একশো নম্বরের আটটি বিষয় ছিল। যতটুকু মনে পড়ে, একটা বিষয়ের নাম ছিল কমপারেটিভ ডেভেলপমেন্ট ইকোনোমি বা ঐ ধরণের কিছু। ঐ বিষয়ের আওতায় জাপান ও কোরিয়াসহ মোট চারটি দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়া আমাদের পাঠ্যসূচিতে ছিল। এখন রাজনীতিতে এসে, শুধু উন্নয়ন প্রক্রিয়া নয়, রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব প্রসঙ্গেও আমি তুলনামূলক পর্যালোচনা করতে বাধ্য। তবে স্থানাভাবে আমি শুধুমাত্র সুপরিচিত দুইটি দেশের নেতার কথা উল্লেখ করছি। একটি দেশ হল সিঙ্গাপুর। ১৯৬৫ সালে বাধ্য হয়েই, মালয়েশিয়ার নিকট থেকে, স্বাধীনতা নিয়েছিল নগর রাষ্ট্র সিঙ্গাপুর। ১৮ বছর একনাগাড়ে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন লি কুয়ান ইউ। সিঙ্গাপুর নামক অনুন্নত তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশকে উন্নত প্রথম বিশ্বের দেশে রূপান্তরিত করেছিলেন তিনি। আরেকটি দেশের নাম মালয়েশিয়া। একনাগাড়ে বাইশ বছর মালয়েশিয়ার নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার ডাক্তার মাহাথীর মুহাম্মদ, তাঁরা উভয়েই আত্মজীবনী লিখেছেন। মাহাথীরের লেখা দীর্ঘ বইটির নাম ‘এ ডক্টর ইন দি হাউজ’। নামটির বাংলা অনুবাদ করলে এরকম দাঁড়ায়, ‘বাড়িতে একজন চিকিৎসক’। তরুণ বয়সে আইনজীবী হতে চাইলেও, পরিস্থিতির কারণে মাহাথীর চিকিৎসক হয়েছিলেন। কিন্তু চিকিৎসক হিসেবে তিনি শুধু রুগী দেখেননি, চিকিৎসকের অভিজ্ঞতায় রাজনীতিকেও দেখেছেন। নিজের লেখা বইয়ের মধ্যেই মাহাথীর মুহাম্মদ ব্যাখ্যা দিয়ে লিখেছেন যে, পঞ্চাশের দশকে বা ষাটের দশকে বা সত্তরের দশকেও মালয়েশিয়া নামক দেশ ও সমাজকে একটি রুগী বিবেচনা করলে, তার চিকিৎসার জন্য ডাক্তারের প্রয়োজন ছিল। ঐ ডাক্তার রাজনৈতিক ডাক্তার। মাহাথীর মুহাম্মদ নামক একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ঐ রাজনৈতিক ডাক্তারের ভূমিকা পালন করেছিল। তাই তিনি তার আত্মজীবনীর নাম দিয়েছেন ‘বাড়িতে একজন চিকিৎসক’। ইংরেজিতে বইটা অনেক দীর্ঘ; এতদসত্ত্বেও যাদের দ্বারা পড়া সম্ভব, তারা যেন এটা পড়েন সেই অনুরোধ রাখছি। এই অনুরোধ রাখার পেছনে একটি কারণ আছে। ইদানিংকালে বাংলাদেশে পত্র-পত্রিকায় এবং টকশোগুলোতে একটি বিষয় বহুল আলোচিত। বিষয়টি হলো অর্থনৈতিক উন্নতি আগে; নাকি গণতান্ত্রিক উন্নতি আগে? বাংলাদেশের বর্তমান ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ব্যক্তিগণ এই মর্মে সোচ্চার যে, গণতন্ত্র যা-ই হোক না কেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন-কে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এই অগ্রাধিকার বাস্তবায়ন করতে গিয়ে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার গতি ও স্বচ্ছতা যদি একটু কমেও যায় তাতে কিছু আসে যায় না (!)। বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের এইরূপ ব্যক্তিগণ প্রায়শ সিঙ্গাপুর বা কোরিয়া বা মালয়েশিয়ার উদাহরণ টানেন। এজন্যই এই কলামের পাঠক সম্প্রদায়ের মধ্যে যারা অধিকতর সচেতন তাদের নিকট অনুরোধ যেন তাঁরা মাহাথীরের আত্মজীবনী পড়েন। তাহলে, তাঁরা নিজেরাই পূর্ণ ধারণা পাবেন মালয়েশিয়া এবং বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও প্রক্রিয়ার মধ্যে কী মিল আছে এবং কী মিল নেই। তাঁরা এই ধারণাও পাবেন যে, মালয়েশিয়ার নেতা ডাক্তার মাহাথীর মোহাম্মদ ও তাঁর পরিবার এবং বাংলাদেশের বর্তমান নেতা মাননীয় শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারের বৈশিষ্টাবলী এবং কর্মকাণ্ডের মধ্যে কী মিল আছে এবং কী মিল নেই।

বাংলাদেশের সুস্থতা ও অসুস্থতা

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক অসুস্থতার নিরাময় করার জন্যও চিকিৎসক প্রয়োজন। বাংলাদেশ কি রাজনৈতিকভাবে বা সামাজিকভাবে অসুস্থ? আমার মতে উত্তর হল, অসুস্থ না বললেও অবশ্যই বলতে হবে যে, পুরোপুরি সুস্থ নয়। সুস্থতায় ঘাটতি কতটুকু অথবা অপর ভাষায় কতটুকু অসুস্থ, তার উত্তর একেকজন চিন্তাশীল ব্যক্তি বা বিশ্লেষক একেক নিয়মে দিবেন। উত্তরটি পাঁচ পৃষ্ঠার রচনা থেকে নিয়ে পাঁচশো পৃষ্ঠার বই করেও দেওয়া যাবে। পাঁচ পৃষ্ঠার থেকেও ছোট হল তিন হাজার শব্দের একটি কলাম। এইরকম একটি কলাম লিখেছেন একজন প্রথিতযশা সাংবাদিক যার নাম পীর হাবিবুর রহমান। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিন নামক জনপ্রিয় পত্রিকার নির্বাহী পরিচালক ছিলেন। আমি বাংলাদেশের অসুস্থতা প্রসঙ্গে, উত্তর নিজের ভাষায় না দিয়ে, পীর হাবিবুর রহমানের ভাষায় দিচ্ছি। আজ থেকে প্রায় চৌদ্দ মাস পূর্বে, মঙ্গলবার ২৫ নভেম্বর ২০১৪ তারিখে তিনি ঐ সময় যেই পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন, সেই পত্রিকায় (বাংলাদেশ প্রতিদিন), যেই কলামটি লিখেছিলেন সেই কলামটির কিছু অংশ এখানে হুবহু উদ্বৃত করছি। উদ্বৃতি শুরু ... “রাষ্ট্র পরিচালনার মতো কঠিন এবং রাজনীতির মতো দুর্বোধ্য বিষয় মোকাবিলা করেও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অনেক ছোট খাটো বিষয়ের সমস্যা সমাধানেও যখন ভূমিকা রাখতে দেখা যায় তখন নেতৃত্বের সংকট উন্মোচিত হয়। দেশে দলীয়করণের প্রতিযোগিতা, প্রশাসনের উপর মানুষের আস্থা ও সম্মানের জায়গা সরিয়ে দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন নেই। ছাত্র রাজনীতি মেধাবী সৃজনশীল ছাত্রদের কাছ থেকে বহু দূরে সরে গিয়ে, ছাত্র সমাজের আস্থা হারিয়েছে। নিয়োগ বাণিজ্য বা রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ স্বীকৃত হয়েছে। দুর্নীতি দিনে দিনে বহু বেড়েছে। রাজনীতিতে সহনশীলতার উল্টো পথে আগ্রাসী রূপ নিয়েছে প্রতিহিংসা। গুম, খুন মানুষের জীবনকে নিরাপত্তাহীন করেছে। ইয়াবাসহ মাদকের আগ্রাসন একেকটি পরিবারকেই নয় দেশের একটি প্রজন্মকে অন্ধকার পথে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। সম্পদ সীমিত, জনসংখ্যা বাড়ছে। শিল্প, কল-কারখানা থেকে ব্যবসা বাণিজ্যে বিনিয়োগকারীরার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছেন। শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে, কর্মসংস্থানের খবর নেই। উন্নয়ন চলছে, দুর্নীতি থেমে নেই। রাজনীতিতে ত্যাগবাদী আদর্শের উল্টোপথে উন্নাসিক রূপ নিয়েছে, ভোগ-বিলাসের অসুস্থ প্রতিযোগিতা। তদবির বাণিজ্য সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। মানুষের লোভ-লালসা এতটাই তীব্র যে, রাতারাতি বড়লোক হওয়ার স্বপ্নে বাজিকরদের আস্ফালন চলছে। গণতন্ত্রের নামে রাজনৈতিক দমন-পীড়ন যেমন চলছে তেমনই আন্দোলনের নামে দেখা দেয় মানুষ হত্যা আর জান মালের ভয়াবহ ধ্বংসলীলা। সাংবিধানিকভাবে জনগণ ক্ষমতার মালিক হলেও রাজনৈতিক শক্তির কাছে মানুষের অধিকার ও সম্মানবোধ দিনে দিনে পদদলিত হচ্ছে.....।” উদ্বৃতি শেষ। কলাম লেখার চৌদ্দ মাস পরেও, কলাম-লেখক প্রখ্যাত সাংবাদিক পীর হাবিবুর রহমানর কথাগুলো হুবহু প্রযোজ্য। এইরূপ পরিস্থিতি একদিনে সৃষ্টি হয়নি। দীর্ঘদিনের অশুভ পৃষ্ঠপোষকতায় এইরূপ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। অতএব এইরূপ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণও একদিনে পাওয়া যাবে না।

যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত ও ঐগুলোর প্রভাব

পরিত্রাণ পেতে হলে অনেক পরিশ্রম করতে হবে। যে কোনো কাজ করতে গেলে শুধু শ্রম দিয়েও হয় না। মেধা, শ্রম, সময় এবং অর্থ এই সব কিছুর সমন্বিত বিনিয়োগেই একটা ফলাফল পাওয়া যায়। কিন্তু সবকিছুর আগে প্রয়োজন একটি সিদ্ধান্ত। ইতিহাসের একেকজন মহানায়ক, তার পারিপার্শ্বিকতার পরিপ্রেক্ষিতে একেকটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন; সিদ্ধান্তগুলো যুগান্তকারী ছিল। পৃথিবীর ইতিহাসের প্রথম সংবিধান প্রণেতা ও সাংবিধানিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর জীবনী থেকে, দক্ষিণ আফি্রকার সংখ্যা গরিষ্টঠ কালো মানুষের মুক্তিদূত নেলসন মেন্ডেলার জীবনী থেকে, পূর্ব তিমুরের স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতা জানানান গুজমাও-এর জীবনী থেকে, উত্তর ভিয়েত নামের সংগ্রামী রাষ্ট্রনায়ক হো চি মিন এর জীবনী থেকে অনেক উদাহরণ আমরা টানতে পারি। বর্তমানে যা বাংলাদেশ, ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত সেটাই ছিল পূর্ব পাকিস্তান। নয় মাসের দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশের নেতৃত্বকেও সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল তারা নিকটতম প্রতিবেশি, একটু দূরের প্রতিবেশি, অনেক দূরের প্রতিবেশি এইরূপ রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে কীরকম সম্পর্ক রাখবে এবং বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থা কীরকম হবে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রাথমিক বছরগুলোতে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো, পরবর্তী দশকগুলোতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্র্রশাসনিক ও আর্থিক ব্যবস্থাপনাকে প্রভাবান্বিত করছে। স্থানের অভাবে সিদ্ধান্তগুলো আজ এখানে আলোচনা করছি না; অন্যদিন করবো। সরকার বলছেন যে, তারা বাংলাদেশকে অগ্রগতি ও উন্নয়নের মহাসড়কে তুলেছেন। দৃশ্যমান অনেক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডও আছে। কিন্তু সরকার যে কথাগুলো জনগণকে স্বচ্ছভাবে বলছেন না সেটা হচ্ছে আপাতত দৃশ্যমান উন্নয়নের বিনিময় মূল্য কী? অর্থাৎ সামাজিক রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কতটুকু মূল্য দিয়ে বা কতটুকু ছাড় দিয়ে বা কতটুকু ত্যাগ স্বীকার করে আমরা উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছি?

একটি সুসংবাদ আলোচনা করা যেতেই পারে।

২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসের পহেলা তারিখ একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পুস্তক বিতরণ অনুষ্ঠানে অতিথি হয়েছিলাম। চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী থানার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে প্রতিবেশী হচ্ছে চট্টগ্রাম মহানগরে চাঁনগাঁও থানা। আমার বাড়ি হাটহাজারী থানার (বা উপজেলার) সর্ব দক্ষিণ পূর্বে অবস্থিত ১৫ নম্বর বুড়িশ্চর ইউনিয়নের উত্তর বুড়িশ্চর গ্রামে। উত্তর বুড়িশ্চর এবং দক্ষিণ বুড়িশ্চরের সঙ্গে কমন সীমান্ত আছে চাঁনগাঁও থানার মোহরা গ্রামে। মোহরা গ্রামের বিখ্যাত পরিবারগুলোর মধ্যে অন্যতম দুইটি বিখ্যাত পরিবার বা বাড়ি, আমাদের আত্মীয় বাড়িও বটে। একটি বাড়ি হলো কাজী বাড়ি, আরেকটি বাড়ি হলো কাদেরি বাড়ি। সেই মোহরায়, “ছায়রা খাতুন কাদেরিয়া বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ”—এ শিশুদের জন্য সরকার কর্তৃক প্রদত্ত বিনামূলের পাঠ্যপুস্তক বিতরণ অনুষ্ঠান বা উৎসব ছিল। ১৯৬৮ সালে মাত্র দুইজন ছাত্রী নিয়ে শুরু হওয়া প্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত নয়শতের অধিক ছাত্রী আছে। ফলাফল খুবই ভালো। ম্যানেজিং কমিটির চেয়ারম্যান এবং বিভিন্ন সময়ের প্রধান শিক্ষয়ত্রি বা প্রিন্সিপালগণের নেতৃত্বে সকলে মিলে, প্রতিষ্ঠানটির উন্নতিতে অবদান রেখেছেন। শিক্ষা থেকে আমাদের দেশের ধারাবাহিক অগ্রগতির অন্যতম উদাহরণ এই পুস্তক বিতরণ উৎসব। যাহোক, পুনরায় বলিৎ: অমাদের দেশে বিভিন্ন আঙ্গিকে উন্নতি অবশ্যই অনেক হয়েছে, কিন্তু আমাদেরই মতো পরিস্থিতিতে থাকা অন্যান্য দেশের তুলনায় সেটা কম। অপর ভাষায় বলা যায় যে, যতটুকু উন্নতি করতে পারতাম, ততটুকু হয়নি। আমাদের সাফল্য যা কিছু আছে তার জন্য কৃতিত্ব যেমন আমাদের, তেমনই ব্যর্থতাগুলোর জন্য দায়িত্বও আমাদের। এইরূপ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ প্রয়োজন। অতীতের ভুল সংশোধন প্রয়োজন। একটি দেশ যেহেতু রাজনীতিবিদগণ পরিচালনা করেন তাই, রাজনীতিতেই চিকিৎসা প্রয়োজন। এইটুকু সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতেই রাজনীতি করছি।

পরিবর্তন আহ্বান বিদেশে ও বাংলাদেশে

আমি ১৯৭০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৯৬ সালের জুন পর্যন্ত সক্রিয়ভাবে সেনাবাহিনীতে চাকরি করেছি মহান আল্লাহ তায়ালার দয়ায়, সম্মান ও সন্তুষ্টির সঙ্গে, মহান মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গণে অংশগ্রহণসহ। আমার এলপিআর বা প্রাক-অবসর ছুটি শেষ হয় জুন ১৯৯৭ সালে। দশ বছর গ্যাপ-এর পর, ২০০৭ সালে প্রত্যক্ষভাবে একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে কাজ শুরু করি। পার্থক্য হল, আমি একটি দল প্রতিষ্ঠা করে, সেই দলের কর্মী হিসেবে, রাজনীতির মাঠে সংগ্রামী জীবন শুরু করেছি, ৫৮ বা ৫৯ বছর বয়সে। যখন আরাম-আয়েশের দিকে বা বিশ্রামের দিকে মনোযোগ দেওয়াটাই স্বাভাবিক, তখন কষ্ট বেছে নিয়েছি। ২০০৭-০৮ সালে বারাক ওবামা এবং ২০০৮ সালে শেখ হাসিনা উভয়েই, পরিবর্তনের আহ্বান জানিয়ে বা পরিবর্তনের কথা প্রচার করে, পরিবর্তন কায়েম করার জন্য নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। তাদের দল ছিল, তাদের রাজনৈতিক দলগত কাঠামো ছিল, তাঁদের দলের আর্থিক শক্তি ছিল, তাঁদের দলের প্রতি শুভাকাঙ্ক্ষী মিডিয়া ছিল এবং তাদের দলের শুভাকাঙ্ক্ষীদের মেধা-শক্তি ছিল। সবকিছু ব্যবহার করেই যথাক্রমে বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট এবং শেখ হাসিনা পার্লামেন্ট সদস্য হওয়ার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। ২০০৭ সালের ডিসেম্বর মাসের ৪ তারিখে অনেক চিন্তাশীল সচেতন নাগরিক মিলে পরিবর্তনের আহ্বান জানিয়ে, পরিবর্তনের প্রচারণার সূচনা করেই বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি নামক একটি নতুন রাজনৈতিক দল যাত্রা শুরু করেছিল। জন্মদিবস থেকেই এদের নীতিবাক্য (বা ইংরেজি ভাষায় ‘মটো’) ছিল ‘পরিবর্তনের জন্য রাজনীতি’ বা ‘পলিটিক্স ফর চেইঞ্জ’। পরিবর্তন অনেক আঙ্গিকেই কাম্য ছিল এবং এখনও কাম্য আছে। প্রথম এবং প্রধানতম কামনা হচ্ছে, বাংলাদেশের রাজনীতির অঙ্গনে গুণগত পরিবর্তন। কিন্তু বারাক ওবামার দলের মতো বা মাননীয় শেখ হাসিনার দলের মতো এই নতুন দলটির ঐতিহ্য ছিল না, মেধা-শক্তি সীমিত ছিল, অর্থ-শক্তি অতি নগণ্য ছিল। এই নতুন দলটি ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে ৩৬টি আসনে প্রার্থী দিয়ে অংশগ্রহণ করেছিল। বাংলাদেশের প্রাচীন ও বিদ্যমান প্রথা ও রাজনৈতিক ঐতিহ্যের বিকল্প হিসেবে পরিবর্তনের জন্য রাজনীতি শ্লোগান নিয়ে, আমরা চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু পারিনি। নির্বাচনে জিততে পারিনি, তার মানে এই নয় যে, পরিবর্তনের জন্য মনের আকাঙ্ক্ষা স্থগিত হয়েছে। আকাঙ্ক্ষা এখনও জাগ্রত এবং প্রচেষ্টা অব্যাহত। তবে কৌশল বা স্ট্র্যাটেজি কিঞ্চিত পরিবর্তিত হয়েছে। সচেতন মহলের নিকট সহযোগিতার কামনা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।

পরিবর্তনের জন্য রাজনীতি

বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে গুণগত পরিবর্তন চাই। বাংলাদেশে বিদ্যমান বহুদলীয় রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্য থেকেই এই গুণগত পরিবর্তনের জন্য চেষ্টা করতে হবে বলে আমি বিশ্বাস করি। আমরা চাই সৎ, মেধাবী, সাহসী ব্যক্তিগণ রাজনীতিতে জড়িত হোক। আমরা চাই সৎ, সাহসী, মেধাবী ব্যক্তিগণ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই জনগণের খেদমতের সুযোগ পাক। আমরা চাই যে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশ এমন হোক যেখানে সৎ, সাহসী, মেধাবী ব্যক্তিগণ নির্বাচনে দাঁড়াতে পারেন, জনগণের সামনে নিজেদেরকে উপস্থাপন করতে পারেন এবং জনগণকে আশ্বস্ত করে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পেতে পারেন। যথেষ্ঠ সংখ্যক বা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সৎ, মেধাবী, সাহসী ব্যক্তি যদি পার্লামেন্ট সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হতে পারেন, তাহলে পার্লামেন্ট সদস্যগণের মধ্যে একটি গুণগত পরিবর্তন সূচিত হবে। সেজন্য বাংলাদেশে সাহসী ভোটার প্রয়োজন, যেই ভোটারগণ সৎ, সাহসী, মেধাবী ব্যক্তিদেরকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবে। সেজন্য বাংলাদেশে সাহসী মিডিয়া প্রয়োজন, যেই মিডিয়া সৎ, সাহসী, মেধাবী ব্যক্তিদেরকে উৎসাহিত করবে এবং প্রচারণায় পৃষ্ঠপোষকতা করবে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে কাঙ্ক্ষিত গুণগত পরিবর্তনের আরও কয়েকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নিম্নরূপ। প্রথম: মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের চেতনা সম্মিলিতভাবে বা যুগপৎ বিদ্যমান থাকবে। দ্বিতীয়: ধর্মীয় নেতাগণ, মুক্তিযুদ্ধের নেতাগণ এবং জাতীয় নেতাগণ, জাতীয় ঐক্যের প্রেরণা হবে, জাতীয় বিভক্তির কারণ হবে না। তৃতীয়: সমাজে ন্যায় ও সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে। চতুর্থ: জ্ঞানভিত্তিক সমাজ ও কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রয়াস শুরু হবে। পঞ্চম: প্রতিহিংসা নয়, পারস্পরিক প্রতিযোগিতাই হবে উন্নয়নের এবং অবদানের কাঠামো। ষষ্ঠ: আর্থিক ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা সততা এবং প্রতিযোগিতা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। সপ্তম: রাজনীতি ও ব্যবসায় তারুণ্যকে তথা বাংলাদেশের তরুণ সমাজকে উৎসাহিত করতে হবে অগ্রাধিকার দিতে হবে। অষ্টম এবং শেষ: বাংলাদেশের মঙ্গল, বাংলাদেশের কল্যাণ, বাংলাদেশের নাগরিকগণের উপকার কোন কোন পন্থায় এবং কীসে কীসে নিহিত এই প্রসঙ্গে ইচ্ছাকৃতভাবে পরিকল্পিতভাবে সচেতনতা সৃষ্টির কর্মসূচি চালু করতে হবে।

উপসংহার ও দোয়া প্রার্থনা

এই মুহূর্তে আমরা দুইটি রাজনৈতিক সংগ্রামে লিপ্ত। একটি সংগ্রাম অতি সহজেই দেখা যাচ্ছে, আরেকটি সংগ্রাম অত সহজে দেখা যাচ্ছে না বা অনেক সহজে অনুভব হচ্ছে না। সহজেই দেখা যাচ্ছে এমন সংগ্রামটি হচ্ছে: সঠিক গণতন্ত্রের চর্চা নিশ্চিত করার জন্য তথা সর্বদলীয় অংশগ্রহণে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধানে পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা। সহজে দেখা যাচ্ছে না বা অনুভূত হচ্ছে না এমন সংগ্রাম হচ্ছে: রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনার সংগ্রাম। নয়াদিগন্তের পাঠকগণ তাদের মনের চক্ষুকে প্রসারিত করে অনুভব করার চেষ্টা করবেন বলে আমরা আশা রাখি। ২০১৬ সালের জন্য আমাদের সকলের সৎ কর্ম প্রচেষ্টাগুলো যেন সাফল্যের তরঙ্গে থাকে, সেই দোয়া প্রার্থনা করি।

-মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক

বিষয়: বিবিধ

১২০৬ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

356683
১১ জানুয়ারি ২০১৬ রাত ০৯:৩৯
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File