সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেই হবে

লিখেছেন লিখেছেন সৈয়দ মোহাম্মদ ইব্রাহিম ০৪ নভেম্বর, ২০১৫, ১২:০০:১৪ দুপুর

সময় কারো জন্য বসে থাকে না। মনে হয় এই সে দিন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন পেলাম! মনে হয় এই সে দিন মুক্তিযুদ্ধ করলাম! দেখতে দেখতে অনেক বছর চলে গেল। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে আমার কমিশনের তারিখ ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭০। অংকের হিসাবে, ১৯৪৯ সালের ৪ অক্টোবর যেহেতু আমার জন্মদিন সেহেতু ১৯৭৫ সালের অক্টোবরের ৩ তারিখ আমার বয়স ২৬ শেষ হয়; সেনাবাহিনীর নিয়ম মোতাবেক বিবাহোত্তর সুবিধাগুলো পাওয়ার যোগ্য হই। বিয়ের প্রক্রিয়া অতিঅগ্রসর বা অ্যাডভান্সড অবস্থায় ছিল; তারিখ ঠিক হয় হয় এমন একটি পরিস্থিতি। তার মধ্যেই এসে গিয়েছিল ১৯৭৫ সালের নভেম্বরের ৩ তারিখের ঘটনা। ওই ঘটনার প্রভাবে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত হয়েছিল আমার বিয়ের সামাজিক আনুষ্ঠানিকতা পরিহার করে শুধু ‘আক্দ’ সম্পন্ন করে ফেলার। ১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাসের ৫ তারিখ আমার আক্দ সম্পন্ন হয়। সামাজিক আনুষ্ঠানিকতা অনেক পরে হয়। আমার বাড়ি চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী উপজেলার উত্তর বুড়িশ্চর গ্রামে। আমার শ্বশুরবাড়ি বর্তমান নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ উপজেলার সদরে অবস্থিত মুরাপাড়া গ্রামে।

বাংলাদেশের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বছর ও তারিখ

বলছিলাম, সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে না। আগামীকাল বৃহস্পতিবার ৫ নভেম্বর আমাদের পারিবারিক জীবনের ৪০ বছর পূর্ণ হবে। শোকর আলহামদুলিল্লাহ। মরহুম পিতা আলহাজ এস এম হাফেজ আহমেদ, এখনো হায়াতে আছেন সম্মানিত আম্মা, জীবিত ও মরহুম অন্য মুরব্বিগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা। পরিবারের ঘনিষ্ঠ সদস্যদের প্রতি, বিভিন্ন সময়ের ও পরিস্থিতির সহকর্মী, বন্ধু ও প্রতিবেশীদের প্রতিও কৃতজ্ঞতা। ব্যক্তিজীবনে যেমন সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে না, তেমনই সমষ্টিগত জীবনে বা জাতীয় জীবনেও সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে না। ২৬ মার্চ ১৯৭১ থেকে গণনা করলে বাংলাদেশের বয়স আজকে পর্যন্ত ৪৪ বছর আট মাস; আবার যদি শুধু ১৬ ডিসেম্বর থেকে গণনা করি, তাহলে বয়স ৪৩ বছর ১০ মাস। এই নাতিদীর্ঘ বয়সে বাংলাদেশের ইতিহাসেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ তারিখ আছে। ২৬ মার্চ ১৯৭১ স্বাধীনতা দিবস, ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ বিজয় দিবস, ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫ বাকশাল প্রতিষ্ঠা দিবস, ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ বঙ্গবন্ধু হত্যা দিবস, ৩ নভেম্বর ১৯৭৫ সামরিক অভ্যুত্থান দিবস ও জেলহত্যা দিবস, ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ সিপাহি-জনতার বিপ্লব দিবস, ৩০ মে ১৯৮১ চট্টগ্রাম সেনা বিদ্রোহ ও রাষ্ট্রপতি জিয়া হত্যা দিবস, ২৪ মার্চ ১৯৮২ সামরিক অভ্যুত্থান ও মার্শাল ল জারি দিবস, ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০ এরশাদ পতন দিবস বা এরশাদ পদত্যাগ দিবস, ২১ আগস্ট ২০০৪ শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড আক্রমণ দিবস, ২৮ অক্টোবর ২০০৬ লগি-বৈঠা দিয়ে রাজপথে মানুষ হত্যা দিবস, ১১ জানুয়ারি ২০০৭ জরুরি অবস্থা ও দীর্ঘমেয়াদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা দিবস, ২৯ ডিসেম্বর ২০০৮ শেষবারের মতো তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতিতে পার্লামেন্টারি নির্বাচন দিবস, ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ পিলখানা বিডিআর সেনা অফিসার হত্যা দিবস, ১০ মে ২০১১ বিচারপতি খায়রুল হক প্রদত্ত ঐতিহাসিকভাবে বিতর্কিত রায় দিবস, ৫ মে ২০১৩ মতিঝিল শাপলা চত্বরে হেফাজত সমাবেশ ও হেফাজত হত্যা দিবস, ৫ জানুয়ারি ২০১৪ ভোটারবিহীন নির্বাচন দিবস...ইত্যাদি। এতগুলো দিবসের মধ্যে একই বছরে চারটি গুরুত্বপূর্ণ দিবস আছে, ১৯৭৫ সালে। অতএব, বছরগুলোর মধ্যেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের ওপর প্রভাব বিস্তারকারী হিসেবে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বছর বা ল্যান্ডমার্ক-ইয়ার হচ্ছে ১৯৭৫। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে নিম্নলিখিত বছরগুলোও ঐতিহাসিভাবে গুরুত্বপূর্ণ : ১৯৮২, ১৯৯১ ও ২০১৪।

সময়ের অপর নাম বয়স

বাংলাদেশের কথা বলছিলাম। নিজের জীবনের কথা বলছিলাম। বলছিলাম, সময় কারো জন্য বসে থাকে না। মাননীয় শেখ হাসিনা, মাননীয় খালেদা জিয়া, মাননীয় হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, অথবা সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের জন্যও সময় বসে নেই। সময় যখন অতিবাহিত হয়, তখন খেসারত দিতে হয়; ওই খেসারতের নাম সময়-ট্যাক্স। সময়-ট্যাক্স দিতে দিতে শরীর-মন অনেক সময় ক্লান্ত হয়ে পড়ে। চিন্তাশক্তি অনেক সময় দুর্বল হয়ে পড়ে। আবার পারিপার্শ্বিক অবস্থা যদি শক্তিশালী ও উৎসাহব্যঞ্জক থাকে তাহলে শরীর ও মন দুর্বল হয় না। সে জন্যই সময়-ট্যাক্স পরিশোধ করলেও শরীর ও মনকে রক্ষা করতে হয়। সম্মানিত পাঠক, আপনারা খেয়াল করুন, বাংলাদেশ নামে রাষ্ট্র সময়-ট্যাক্স দিচ্ছে। ভোটারবিহীন নির্বাচনের কারণে গত দেড় বছর একটি মারাত্মক অবস্থার মধ্য দিয়ে দেশের সময় পার হচ্ছে। বিশেষ করে গত ছয়-সাত সপ্তাহ কিরূপ নিরাপত্তাহীনতার শঙ্কায় ভুগছে মানুষ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-বিলাত-পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো, সৌদি আরব-আবুধাবি-দুবাই, ইরান, মালয়েশিয়া-থাইল্যান্ড-মিয়ানমার, জাপান-চীন, পাকিস্তান ইত্যাদি দেশগুলোর পররাষ্ট্রনীতি, বাংলাদেশের অর্থনীতি, রাজনীতি ও পররাষ্ট্রনীতিকে প্রভাবান্বিত করে। তবে, যে দেশের পররাষ্ট্রনীতি বাংলাদেশকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবান্বিত করে সে দেশের নাম ভারত। দক্ষিণ এশিয়ার সর্বাধিক শক্তিশালী ও ক্ষমতাশালী দেশ; আঞ্চলিক শক্তি তো বটেই, আন্তর্জাতিক বা পরাশক্তি হওয়ার পথে এখন ভারত। আমাদের তিন দিকের প্রতিবেশী ভারত। নিজেদের মর্যাদা রক্ষা করে, নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করে সুপ্রতিবেশিসুলভ সম্পর্ক রাখা এবং পরস্পরের মধ্যে উপকারমূলক সম্পর্ক রাখা কঠিন কাজ। তাও করতে হবে। আন্তর্জাতিকভাবে উগ্রবাদ কট্টরবাদ চরমপন্থা ইত্যাদি বিস্তার লাভ করছে। নিজেদেরকে এর প্রভাব থেকে রক্ষা করতে হবে। এরূপ কঠিন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জনগণকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

সিদ্ধান্ত নিতে হবে

বিশেষ করে যারা সচেতন নাগরিক তাদেরকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বিশেষ করে যারা রাষ্ট্রের কাছ থেকে সুবিধা পেয়ে জীবন যাপন করেছেন, যারা জনগণের ট্যাক্সের টাকায় নিজেদের জীবন গড়েছেন তাদেরকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যারা সচেতনভাবে বিশ্বাস করেন, জনগণের প্রতি ও দেশের প্রতি আপনার দায়বদ্ধতা আছে, তাদেরকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আপনি রাজনীতি করুন বা না করুন; দলীয় রাজনীতি করুন বা না করুন; আপনি যদি একজন সচেতন নাগরিক হন এবং আপনি যদি বিশ্বাস করেন, দেশ ও জনগণের প্রতি আপনার দায়বদ্ধতা আছে, তাহলে আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতেই হবে। সিদ্ধান্তের একটি দিক হলো- আমরা বসে থাকব এবং দেখতে থাকব। সিদ্ধান্তের আরেকটি দিক হলো- আমরা বসে থাকব না; দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য, জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমরা সচেষ্ট ও সক্রিয় হব। আমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি, যে কর্মক্ষেত্রেই আছি, সেই কর্মক্ষেত্রে আমরা সচেষ্ট হব। কিন্তু যে কর্মক্ষেত্রটি সব কর্মকে ভালোভাবে হোক বা মন্দভাবে হোক নিয়ন্ত্রণ করে, অথবা অপর ভাষায় প্রভাবান্বিত করে, সেই কর্মক্ষেত্রটির নাম হলো রাজনীতি। অতএব, আমরা রাজনীতি সচেতন হব। বিশেষ করে তরুণ সম্প্রদায়। ৬৬ বছর শেষ করে ৬৭-তে পা দেয়া মুক্তিযোদ্ধা ইবরাহিম, রাজনীতিবিদ ইবরাহিম আবেদন রাখছেন তরুণ সম্প্রদায়ের প্রতি, আপনারা রাজনীতিসচেতন হোন। রাজনীতি দেশকে নিয়ন্ত্রণ করে। এবং দেশের মালিক আপনারা। সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা কঠিন কাজ। আপনাকে অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত করার জন্য পরের অনুচ্ছেদগুলো লিখলাম। সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা খুবই কঠিন কাজ; তার পরও সিদ্ধান্ত নিতেই হয়।

দূর ইতিহাসের তিনটি উদাহরণ

এখন থেকে তিন-চার হাজার বা তার থেকেও বেশি বছর আগে আল্লাহর নবী ইবরাহিম আ: সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, মহান আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন করার জন্য নিজ পুত্রকে নিজ হাতে ছুরি দিয়ে কোরবানি করবেন। এখন থেকে ১৪৩৭ হিজরি বছর আগে, সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী হজরত মুহাম্মদ সা: সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, মহান আল্লাহর হুকুম পেয়ে, নিজ জন্মস্থান, নিজ আত্মীয়স্বজন সব কিছুর মায়া ত্যাগ করে হালকাভাবে পরিচিত ইয়াসরেব নামক জনপদের অধিবাসীদের নিমন্ত্রণে মক্কা ত্যাগ করতে। এই ঘটনাকে আমরা হিজরত বলি। এখন থেকে ১৬৫ বছর আগে আমেরিকার ১৬তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল যে, দাসপ্রথা বিলুপ্ত করার জন্য প্রয়োজনে তিনি বিদ্রোহীদের সশস্ত্রভাবে মোকাবেলা করবেন। আব্রাহাম লিংকন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অখণ্ডতা রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনে তিনি বিদ্রোহীদের সশস্ত্রভাবে দমন করবেন। বাস্তবে আমেরিকার গৃহযুদ্ধ তিন বছরের অধিককাল স্থায়ী হয়েছিল এবং প্রেসিডেন্টের পক্ষ জয়ী হয়েছিল।

বঙ্গ ও বাংলাদেশ থেকে উদাহরণ

১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর, বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার খরচ মেটানোর কাজে সহায়তা প্রয়োজন ছিল। ওই সহায়তা করার জন্য টাকা যোগাড় করতে গিয়ে নিজেদের সম্পত্তি বন্ধক দিয়েছিলেন ও বিক্রি করেছিলেন ধনবাড়ির নবাব জনাব নবাব আলী খান এবং ঢাকার নওয়াব খাজা সলিমুল্লাহ। নিজেদের পারিবারিক স্বার্থ তথা সন্তানসন্ততির স্বার্থকে ক্ষুদ্রজ্ঞান করেছিলেন এই দু’জন মহৎ ব্যক্তি; একটা মাত্র উদ্দেশ্যে যে, পূর্ববঙ্গ তথা ঢাকার আশপাশের জেলাগুলোর অবহেলিত ও বঞ্চিত এলাকার তরুণেরা, বিশেষ করে মুসলিম তরুণেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাবে। ১৯৫২ সালে, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক চিন্তা করলেন, গ্রামবাংলার দরিদ্র, নিপীড়িত ও নির্যাতিত সাধারণ কৃষক সম্প্রদায়কে মুক্ত করবেন। এটা করতে গেলে পৌনে দু’শো বছরের পুরনো জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ করতে হবে। মারাত্মক কঠিন কাজ। কিন্তু শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক সাহস করে সিদ্ধান্ত নিলেন, আইন পাস করলেন এবং জমিদারি প্রথা বাতিল করলেন। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের কথা ধরি। ২০ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতের কথা মনে করুন। তরুণ ছাত্ররা মিলিত হয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছেন, আগামীকাল ২১ ফেব্রুয়ারি অত্যাচারী জালিম প্রাদেশিক সরকার কর্তৃক জারি করা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হবে কি হবে না? ছাত্ররা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হবে।

মুক্তিযুদ্ধ থেকে উদাহরণ

মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ থেকে উদাহরণ দিই। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ৭ তারিখ সকালের কথা মনে করুন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল- বিকেলবেলা রমনা রেসকোর্সের ভাষণে কোন ভাষায় কোন মাত্রার ঘোষণা দেবেন। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ২৫ তারিখ দিনের শেষে রাত্রি ৯টা বা ১০টা বা ১১টার কথা খেয়াল করুন। অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নামে পরিচিত বাঙালি পল্টনের পাকিস্তানি পাঞ্জাবি অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আব্দুর রশিদ জানজুয়া কৌশলগত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তারই উপ-অধিনায়ক বাঙালি মেজর জিয়াউর রহমানকে চট্টগ্রাম বন্দর এলাকায় পাঠাও, পথিমধ্যে তাকে হত্যা করো, অথবা বন্দী করো, অথবা বন্দর এলাকায় পৌঁছানোর পর তাকে নিরস্ত্র ও নিষ্ক্রিয় করো। এটা করতে পারলে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে আক্রমণ করে নিশ্চিহ্ন করা পাঞ্জাবিদের জন্য সহজ হতো। সম্মানিত পাঠক, এখন তারিখ বদলাই। ২৫ মার্চ দিনের শেষে মধ্যরাত ১২টায় তারিখ বদল হয়েছে। ২৬ মার্চ শুরু হয়েছে। অষ্টম বেঙ্গলের উপ-অধিনায়ক মেজর জিয়াউর রহমানকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল। তার সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় ছিল পুরো ব্যাটালিয়ন; তার সিদ্ধান্তের জন্য মনে মনে অপেক্ষা করছিলেন চট্টগ্রামবাসী। জিয়াউর রহমান সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবেন; বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য যুদ্ধ শুরু করবেন। যে কথা সেই কাজ; প্রকাশ্যে ব্যাটালিয়নের সামনে ঘোষণা দিলেন; ৩৬ ঘণ্টা পর ২৭ মার্চ তারিখে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর নামে ঘোষণা দিলেন। একই ২৭ মার্চ ১৯৭১; জয়দেবপুরে অবস্থিত ভাওয়াল রাজাদের বাসস্থান নাম রাজবাড়ী। দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের তিন-চার শ’ লোক যারা এখানে, রাজেন্দ্রপুরে এবং সমরাস্ত্র কারখানায় ছিল তারা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের জন্য। তিন দিন আগে ব্যাটালিয়নে যোগ দিয়েছেন বা যোগ দেয়ানো হয়েছে অধিনায়ক হিসেবে বাঙালি লেফটেন্যান্ট কর্নেল রাকিবকে। কর্নেল রাকিবকে সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে, তিনি মুক্তিযুদ্ধে যাবেন কি যাবেন না? তিনি জানিয়ে দিয়েছিলেন : আমি রাকিব যেতে পারব না। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে ২৮-২৯ তারিখের কথা। যশোর ক্যান্টনমেন্ট। প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নামে পরিচিত বাঙালি পল্টন। অধিনায়কের নাম বাঙালি লেফটেন্যান্ট কর্নেল রেজাউল জলিল। তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে তিনি পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবেন কি করবেন না? তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তিনি বিদ্রোহ করবেন না। অতএব, তরুণ ক্যাপ্টেন হাফিজ উদ্দিন আহমেদ (বর্তমানের বিএনপি নেতা অবসরপ্রাপ্ত মেজর হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বীর বিক্রম) নিজে বাঙালিদের নেতৃত্ব দিয়ে প্রথম বেঙ্গলকে নিয়ে বিদ্রোহ করেন, যুদ্ধ করতে করতে সেনানিবাস থেকে নিজেদেরকে বাইরে নিয়ে যান এবং মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর প্রথম পাঁচ মাস বন্যার পানির মতো, তারপর একটু কম কিন্তু অব্যাহতভাবে, বাংলাদেশের তরুণেরা ঘরবাড়ি ত্যাগ করে পিতা-মাতার স্নেহধন্য আশ্রয় ত্যাগ করে, সীমান্ত অতিক্রম করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করার জন্য, অথবা দেশের ভেতরেই গোপন গেরিলা বাহিনীগুলোর সাথে যোগ দিয়েছিলেন যুদ্ধ করার জন্য।

স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে উদাহরণ

স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসের কথা। পার্লামেন্ট অধিবেশন চলছে। সংবিধানে বড় রকমের সংশোধনী আনার প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন; বহুদলীয় গণতন্ত্রকে ফাঁসি দিয়ে একদলীয় শাসন তথা বাকশাল চালু করা হবে। পুরো পার্লামেন্ট স্তব্ধ। দু’জন পার্লামেন্ট সদস্য অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল এম এ জি ওসমানী ও ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন। তারা দাঁড়ালেন এবং বঙ্গবন্ধুকে বললেন, আমরা বাকশালের পক্ষে নই; আমরা এই সংশোধনীর পক্ষে ভোট দেবো না। এই দু’টি ভোটের অভাবে বাকশাল চালু করতে অসুবিধা হয়নি; কিন্তু এ দু’জন ব্যক্তি তাদের বিবেকের কাছে পরিষ্কার, জাতির কাছে স্বচ্ছ এবং ইতিহাসে গণতন্ত্রমনা ব্যক্তি হিসেবে অমর হয়ে থাকলেন। আমরা এতক্ষণ অনেকগুলো উদাহরণ দিলাম, যেখানে মানুষকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। সিদ্ধান্ত নিতে গেলে পূর্বাপর অনেক কিছুই চিন্তা করতে হয়, ভালো-মন্দ চিন্তা করতে হয়। ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে গেলে লাভ- লোকসানের চিন্তা করতে হয়। জাতীয় ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে গেলে এত চিন্তা করার অবকাশ থাকে না।

আমার নিজের জীবন থেকে উদাহরণ

১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাসের ৭ তারিখ। এই তারিখটিকে এখন আমরা সিপাহি জনতার বিপ্লব দিবস হিসেবে, অথবা বিপ্লব ও সংহতি দিবস হিসেবে পালন করি। কিন্তু যারা পালন করি তারা এই দিবসটি সৃষ্টির প্রেক্ষাপট অথবা ওই দিবসে সংঘটিত ঘটনাবলি সম্বন্ধে কতটুকু জানি? জানা উচিত। ৬ তারিখ দিনের শেষে রাত ১২টায়, ৭ নভেম্বরের প্রথম মুহূর্তে তখনকার আমলের চাকরিরত মেজর সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকদের সাথে যোগ দিয়েছিলেন। সৈনিকদের সংহত করেছিলেন; সৈনিকদের ইতিবাচক বিপ্লবে যেতে সহায়তা করেছিলেন। বিয়ে করার মাত্র তিরিশ ঘণ্টার মাথায় ইবরাহিম সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সৈনিক-জনতার সাথে বিপ্লবে যাবেন। অবসর জীবনের ইবরাহিমের কথা বলি। ২০০৬ সালে একটু একটু এবং ২০০৭ সালে পুরোপুরি গভীর চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, প্রত্যক্ষভাবে একজন রাজনৈতিককর্মী হবো; নতুন রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি উন্মুক্ত করব। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ২০১১-তে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, তৎকালীন পার্লামেন্টের বিরোধী দল বিএনপির সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কল্যাণ পার্টি আন্দোলন করবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য। ২০১৩ সালের শেষ তিন মাস; প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দাওয়াত ছিল সম্মানজনকভাবে ও লাভজনকভাবে পার্লামেন্ট নির্বাচনে কল্যাণ পার্টি যেন অংশগ্রহণ করে; পার্টির জ্যেষ্ঠ নেতাদের নিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে, সরকার বাহাদুর ধন্যবাদ; আমরা আমাদের অবস্থানেই থাকি।

উপসংহার

রাজনীতিতে হোক বা যেকোনো জায়গায় হোক, কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে অনেক সাহস ও আত্মপ্রত্যয় লাগে। সম্মানিত পাঠক, চিন্তা করুন তো ওপরের উদাহরণগুলোর কথা- এরূপ সিদ্ধান্ত নিতে কতটুকু সাহস, খোদাপ্রেম, মানবপ্রেম ও দেশপ্রেম লাগে? খোদাপ্রেম, মানবপ্রেম ও দেশপ্রেম সবার মধ্যেই আছে; কম হোক বেশি হোক। প্রধান অনুঘটক হলো সাহস। সাহস করে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সিদ্ধান্ত নিতে হয় এই মর্মে যে, আমি আমার মধ্যে বিরাজমান খোদাপ্রেম, মানবপ্রেম ও দেশপ্রেমকে দেশের জন্য ও দশের জন্য কাজে লাগাব কি লাগাব না। গত বুধবার ও আজ বুধবার-এর মাঝখানের সময়ে হত্যাকাণ্ড বা হত্যার উদ্যোগ সংঘটিত হয়েছে। ব্লগারদের পুস্তক সংক্রান্ত বিষয়ে। ঢাকা মহানগর উত্তাল। যে বয়সের মানুষ হোক না কেন, মন শঙ্কিত ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। এই প্রেক্ষাপটেই আপনি এই দীর্ঘ কলাম পড়লেন। সম্মানিত পাঠক, নিজের মনকে স্থির করুন এবং এরূপ ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য আপনার কী করণীয় হতে পারে, সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুন।

লেখক : মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক

(৪ নভেম্বর ২০১৫ নয়া দিগন্ত পত্রিকায় প্রকাশিত)

বিষয়: বিবিধ

১১৪২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File