৪০ বছর আগে-পরে নভেম্বর : কিছু মূল্যায়ন

লিখেছেন লিখেছেন সৈয়দ মোহাম্মদ ইব্রাহিম ১১ নভেম্বর, ২০১৫, ১১:২৬:৩৭ সকাল

১৯৭৫-এর আগস্টের পেছনের কথা

আজ বুধবার ১১ নভেম্বর সম্মানিত পাঠক কলাম পড়ছেন। ইতিহাসের তারিখ হিসেবে নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ বাংলাদেশের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ এবং তাৎপর্যবহ। আজকে থেকে নিয়ে গত আট-দশ দিন বিভিন্ন পত্রিকায় এ প্রসঙ্গে বিভিন্ন কলাম বের হয়েছে; বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে টকশো অনুষ্ঠিত হয়েছে। নিজেও ২ নভেম্বর দিবাগত রাত ১২টায় বাংলাভিশনে, ৩ নভেম্বর রাত ১০টায় ইন্ডিপেনডেন্ট টিভিতে, ৪ নভেম্বর রাত ১১-২০ মিনিটে আরটিভিতে, ৫ নভেম্বর দিবাগত রাত ১২টায় একুশে টিভিতে এবং ৬ নভেম্বর দিবাগত রাত ১টায় অর্থাৎ ৭ নভেম্বর তারিখের প্রথম প্রহরে চ্যানেল আইতে আলোচনায় অংশগ্রহণ করেছি। নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহের ঘটনাবলির উৎপত্তি বা শিকড়, নভেম্বরেই নিহিত নয়। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে বাকশাল কায়েম হয়েছিল। কাজটা অত্যন্ত বিতর্কিত ছিল। এর পরের সপ্তাহ এবং মাসগুলো আপাত দৃষ্টিতে অর্থাৎ বাহ্যিকভাবে ভালো ছিল বা শান্ত ছিল; আসলে ছিল না। এখন পেছনের দিকে তাকিয়ে পরিণত বয়সে জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি, ওই আমলের বাংলাদেশের রাজনীতির স্রোত, জনমতের স্রোত ও প্রশাসনের আনুগত্যের স্রোত দুটি ভিন্ন দিকে যাচ্ছিল। দৃশ্যমান ওপরের অংশ সরকারের অনুকূলে বহমান ছিল; অদৃশ্য গভীর জলের অংশ সরকারের প্রতিকূলে ছিল, মানে উল্টো দিকে ছিল। তৎকালীন অনুগত মিডিয়ায় এবং মিডিয়ার বাইরে ব্যক্তি ও সমষ্টিগত পর্যায়ে সরকারের বন্দনার প্রতিযোগিতা চলত। সরকারের কর্মকাণ্ডের সমালোচনার অবকাশ বা সুযোগ খুবই সীমিত ছিল। আমরা ১৯৭৫ সালের কথা বলছি। এমন একটা পরিস্থিতিতে আগস্ট মাস এসে গিয়েছিল। দেশের ভেতরের কিছু অপ্রীতিকর কারণ, দেশের বাইরের কিছু ষড়যন্ত্রমূলক কারণ মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। সবকিছুর পরিণতিতে ঘটেছিল ১৫ আগস্ট। শোকাবহ ঘটনা ও শোকাবহ দিন।

১৫ আগস্টের নায়ক ও খলনায়ক

১৫ আগস্টের ঘটনার নায়ক একজন নয়; সংখ্যায় একাধিক এবং একাধিক অঙ্গনের। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কিছু সংখ্যক মধ্যম এবং কনিষ্ঠ সারির কিছু অফিসার একটা আঙ্গিকের ও অঙ্গনের নায়ক। দু-একটা উদাহরণ দিই। তৎকালীন ৪৬ পদাতিক ব্রিগেডের সংগঠনভুক্ত তথা ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াত জামিল বীর বিক্রমের কমান্ডের অধীন দ্বিতীয় ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারি অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিল। অর্থাৎ ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াত জামিলের অগোচরে, আর্টিলারি রেজিমেন্টের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল খন্দকার আব্দুর রশীদ, তলে তলে বিদ্রোহের পরিকল্পনা করছিলেন। সেনাবাহিনী সদর দফতর বা আর্মি হেড কোয়ার্টারের সরাসরি অধীনস্থ তথা চিফ অব দি জেনারেল স্টাফ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ বীর উত্তমের কমান্ডের অধীন প্রথম বেঙ্গল ল্যান্সার অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিল। অর্থাৎ সিজিএস ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের অগোচরে এবং গোয়েন্দাদের দৃষ্টি ফাঁকি দিয়ে তলে তলে ল্যান্সারের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান বিদ্রোহের পরিকল্পনা করছিলেন। তাদের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন অন্যান্য চাকরিরত ও অবসরপ্রাপ্ত অফিসার। এটা গেল একটা আঙ্গিকের ও একটি অঙ্গনের কথা। স্বাধীনতার পূর্বেকার পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দুই দশকের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ও সহচর ছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ। মুক্তিযুদ্ধকালে বঙ্গবন্ধুর নামের ওপর প্রতিষ্ঠিত প্রবাসী সরকারের মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য ছিলেন খন্দকার মোশতাক। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন কেবিনেটের অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি। এই খন্দকার মোশতাকের সঙ্গী দুই শতাধিক আওয়ামী লীগ নেতা ও সংসদ সদস্য ছিলেন আরেকটি আঙ্গিকের নায়ক বা নায়কমণ্ডলী। দেশের বাইরের নায়কদের নামও এত দিনে সকলের প্রায় জানা হয়ে গেছে। তবে সেনাবাহিনী থেকে যারা জড়িত ছিলেন তাদেরকে নিয়ে যত কথাবার্তা হয়েছে এবং বিদেশী নায়ক বা নায়কমণ্ডলী নিয়ে যত কথাবার্তা হয়েছে, তারচেয়ে বহু অংশে কম আলোচনা সমালোচনা পর্যালোচনা হয়েছে খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বাধীন বঙ্গবন্ধু বিরোধী ১৫ আগস্ট-পরবর্তী আওয়ামী লীগের সদস্যদের নিয়ে।

১৯৭৫-এর তিনটি ব্যস্ত মাস

আমরা ১৯৭৫-এর কথা বলছি। ওই আমলের বাংলাদেশ সেনাবাহিনীও, অর্থাৎ ’৭৫ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের সেনাবাহিনীর জ্যেষ্ঠ অংশ ব্যস্ত এবং তৎপর ছিল তাদের সদস্যদেরকে নিয়ে, যারা ১৫ আগস্টের সাথে জড়িত ছিলেন। ওই আমলের বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জ্যেষ্ঠ এবং মধ্যম সারির বেশির ভাগ কর্মকর্তার চিন্তা ছিল, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অফিসারদের ভেঙে যাওয়া চেইন অব কমান্ডকে জোড়া লাগানো বা পুন:স্থাপন করা। পাঠক প্রশ্ন করতে পারেন, কেন? যেহেতু ১৫ আগস্টের ঘটনায় জড়িত অফিসারেরা তাদের উপরিস্থ জ্যেষ্ঠ ব্যক্তিদের অনুমতি ছাড়াই জড়িয়ে গিয়েছিলেন, তাদের কী হবে, এটাই ছিল বিবেচ্য বিষয়। আগস্টের ২৪ তারিখ থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন তৎকালীন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বীর উত্তম। সেনাবাহিনী অত্যন্ত ব্যস্ত দিন কাটাচ্ছিল। ১৯৭২ সাল থেকে ক্রমান্বয়ে সৃষ্টি হওয়া জাতীয় রক্ষীবাহিনী বা জেআরবি নামে সংগঠনটিকে ভেঙে দেয়া হয়নি বা বাতিল করা হয়নি; কিন্তু বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মধ্যেই বা সেনাবাহিনীর ভেতরে একীভূত বা আত্তীকরণ হয়েছিল। উল্লেখ্য, জাতীয় রক্ষীবাহিনীর বেশির ভাগ সদস্য রণাঙ্গনের তরুণ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। আমি তার চাক্ষুষ সাক্ষী। সিদ্ধান্ত প্রদানকারী ও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষের সাথে যেসব স্টাফ অফিসার কাজ করছিলেন, তাদের মধ্যে একজন ছিলাম আমি। ওই সুবাদে বলছি, সময় খুব ব্যস্ততাপূর্ণ ছিল এবং ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ ছিল। এর মধ্যে চাপা অবস্থায় বিরাজমান ছিল ওই দ্বন্দ্ব। দ্বন্দ্বটি কী? দ্বন্দ্বটি হলো যারা ১৫ আগস্ট সংঘটিত করে ফেলেছে তারা কোথায় যাবে কোন অবস্থায় থাকবে, কোন দায়িত্বে থাকবে? নাকি, তাদের দ্বারা কৃত কর্মটিকে শৃঙ্খলা ভঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করত সেটার বিহিত করা হবে? সমাধান পাওয়া যাচ্ছিল না; ঐকমত্য সৃষ্টিতে বিলম্ব হচ্ছিল।

খালেদ মোশাররফ বীর উত্তম

এরূপ পরিস্থিতিতেই, ওই আমলের বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদর দফতরে কর্মরত, সুনামধারী, মেধাবী, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সাহসী সেক্টর কমান্ডার, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ বীর উত্তমের নেতৃত্বে একটি প্রতিবাদী কর্মকাণ্ড অথবা কারো কারো দৃষ্টিতে সংশোধনমূলক কর্মকাণ্ড সংঘটিত হয়। সামরিক পরিভাষায় বা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিভাষায় এটি ছিল একটি কু-দ্যতা। বাংলায় বলা যেতে পারে সামরিক অভ্যুত্থান। অভ্যুত্থানের অংশ হিসেবে খালেদ মোশাররফ তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী করেছিলেন। অভ্যুত্থানের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় ১৫ আগস্টের সশস্ত্র নায়কেরা ঢাকা মহানগরের কেন্দ্রীয় জেলখানায় বন্দী অবস্থায় থাকা চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করান। অভ্যুত্থানের ফলে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ এস এম সায়েমকে নতুন রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করা হয়েছিল; মোশতাক কর্তৃক জারি করা সামরিক শাসন অব্যাহত ছিল। কিন্তু কিছু লক্ষণ (ইংরেজি পরিভাষায় সিমটম)-এর কারণে, খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বাধীন অভ্যুত্থানটি রাজনৈতিক অঙ্গনে, সচেতন জনগণের ও সৈনিকদের মনের ভেতরে ভারতপন্থী অভ্যুত্থান হিসেবে রং পায়। সচেতন জনগণ ও সৈনিকেরা এটা পছন্দ করেনি। পরবর্তীতে বিষয়টি মোটামুটি স্পষ্ট হয়েছিল; কিন্তু তত দিনে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ, কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা, লে. কর্নেল এ টি এম হায়দার বীর উত্তমের মতো মুক্তিযোদ্ধারা বিগত হয়ে গেছেন।

গোপন সৈনিক সংস্থা ও জাসদ

৩ নভেম্বর ১৯৭৫-এর ঘটনার পর আরেকটা গোপন গোষ্ঠী সক্রিয় হয়। তৎকালীন জাসদের অনুপ্রেরণায়, পৃষ্ঠপোষকতায়, আগ্রহে এবং প্রয়োজনে (১৯৭৩-এর শেষাংশ থেকে) তদানীন্তন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে একটি গোপন সংগঠন কাজ করত। সংগঠনটির নাম ছিল বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা। এই সংস্থার সাথে যোগাযোগ ছিল সেনাবাহিনীর বাইরের একটি সংগঠন, সেটি ছিল জাসদ নামক রাজনৈতিক দলের গোপন অঙ্গ সংগঠন (নাম : গণবাহিনী)। জাসদ নামক দলের আনুষ্ঠানিক নেতৃত্ব ছাড়াও আরো একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি এই প্রক্রিয়ায় জড়িত ছিলেন। তিনি ছিলেন জাসদের গণবাহিনীর প্রধান, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার, অন্যতম মেধাবী সাহসী সেনা কর্মকর্তা, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল মোহাম্মদ আবু তাহের বীর উত্তম। জাসদ, জাসদের গণবাহিনী এবং বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা চাচ্ছিল একটা বড় রকমের বিপ্লব হোক। এই লক্ষ্যে তারা কাজ করছিলেন অনেক দিন ধরেই। ৩ নভেম্বরের ঘটনা ঘটে যাওয়ায় তারা সবাই অস্থির হয়ে পড়লেন এবং মনে করলেন ‘আবার কোন অপরিকল্পিত ঘটনা এসে তাদের বিপ্লবের পক্ষে বাধার সৃষ্টি করে।’ তাই, তারা স্থির করলেন ৭ নভেম্বর তারিখে কাজটি করবেন। তাদের মধ্যে যারা চরমপন্থী ছিলেন বা উগ্রপন্থী তারা সিদ্ধান্ত নিলেন, সেনাবাহিনী হতে হবে অফিসারমুক্ত। তারা ঘোষণা দিলেন ‘সিপাহি সিপাহি ভাই ভাই, অফিসারের রক্ত চাই।’

জিয়াকে মুক্ত করার প্রেক্ষাপট

ঠিক একই সময়ে, অর্থাৎ ৩ নভেম্বরের পরপর দিনগুলোতে অন্যান্য স্তরে প্রকাশ্যে এবং অপ্রকাশ্যে আলোচনা ও চিন্তাভাবনা চলছিল, জিয়াউর রহমান বীর উত্তমকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করতে হবে। ইংরেজি পরিভাষায় বলা যেতে পারে, রাইটলি অর রংলি, অর্থাৎ সঠিক হোক বা বেঠিক হোক, ৪ ও ৫ নভেম্বরের মধ্যেই ধারণা জন্মে গিয়েছিল, যদি জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করা না যায়, তাহলে দেশ বিপ্লবীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। অতএব তাকে মুক্ত করতেই হবে। বলাই বাহুল্য, জিয়াউর রহমান দেশবাসীর নিকট সুপরিচিত ছিলেন প্রথমে নিজের নামে ও পরে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার কারণে। জিয়া সুপরিচিত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের অন্যতম জ্যেষ্ঠ সেনাপতি হিসেবে। তিনি সুপরিচিত হয়ে উঠেছিলেন একজন ডায়নামিক ও ক্যারিশমেটিক সেনাবাহিনী উপ-প্রধান এবং পরবর্তীতে প্রধান হিসেবে। ১৯৭২-এর এপ্রিলে সবাই আশা করেছিল জিয়াউর রহমানই সেনাবাহিনীর প্রধান হবেন। কিন্তু যেকোনো কারণেই তখনকার সরকার তাকে সেনাবাহিনী প্রধান বানাননি। বানিয়েছিলেন তারই ব্যাচমেট বা কোর্সমেট কিন্তু জ্যেষ্ঠতার তালিকায় জুনিয়র, তুলনামূলকভাবে কম পরিচিত ও তুলনামূলকভাবে কম ক্যারিশমেটিক তৎকালীন ব্রিগেডিয়ার কে এম সফিউল্লাহকে। জিয়াউর রহমানকে বানানো হয়েছিল উপ-সেনাবাহিনী প্রধান। কিছু দিন পর সফিউল্লাহ এবং জিয়াউর রহমান উভয়েই মেজর জেনারেল হন। সৈনিকদের এরূপ মানসিক প্রেক্ষাপটে, ৩ নভেম্বরের প্রথম প্রহর থেকে নিজ বাসভবনে গৃহবন্দী জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করার কাজটি গুরুত্বপূর্ণ মনে করছিলেন সাধারণ সৈনিকেরা।

৭ নভেম্বরের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড

খ্রিষ্টীয় ক্যালেন্ডারের নিয়ম মোতাবেক, ৬ নভেম্বর দিনের শেষে রাত ১২টায় তারিখ বদলে যায়; ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ শুরু হয়। সৈনিকদের বিপ্লব শুরু হয়ে গেল। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই সৈনিকদের বিপ্লবটি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। বড় অংশ ছিল অরাজনৈতিক মনোভাবসম্পন্ন নিখাঁদ জিয়াপ্রেমিক সৈনিকেরা। ছোট অংশ ছিল জাসদের প্রভাবান্বিত বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যরা ও অনুসারীরা। ঘণ্টা তিনেকের মধ্যেই ঢাকা মহানগরের জনগণ জড়িত হতে থাকেন। সূর্য উদয়ের ঘণ্টা দুয়েকের আগে থেকেই, ক্যান্টনমেন্ট থেকে সৈনিকেরা মহানগরে ছড়িয়ে পড়ে। রাতের মধ্যেই ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের বিভিন্ন অংশে, একাধিক অফিসার ও অফিসারের পতœী বিদ্রোহী সৈনিকদের হাতে নিহত হন। তবে কেউ কাউকে চিহ্নিত করতে পারেননি। আমি ব্যক্তিগতভাবে, এই পর্যায়ে আমার মুক্তিযুদ্ধকালীন ব্যাটালিয়ন, দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে উপস্থিত থেকে ঘটনাগুলোর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলাম। দ্বিতীয় বেঙ্গলের সৈনিকরা কোনো কিছুর সাথে-পাছে ছিলেন না, কিন্তু একটা দেড়টা থেকে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থাপন্থী অর্থাৎ বিপ্লবী সৈনিকেরা, শান্তিপ্রিয় শৃঙ্খলাপন্থী দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের ব্যাপারে তিন দিক থেকে বৈরী প্রচারণা এবং আক্রমণাত্মক কর্মকাণ্ড প্রকাশ্যে শুরু করে। উপস্থিত জ্যেষ্ঠতম অফিসার হিসেবে আমি পুরো ব্যাটালিয়নকে নিয়ন্ত্রণে রাখি। বিপ্লবীরা যেন অনুপ্রবেশ করতে না পারে সেটা নিশ্চিত করি। কোনো অবস্থাতেই যেন, যে যেই পন্থীই হোক না কেন, সৈনিকে সৈনিকে গোলাগুলি বিনিময় না হয়, সেটা নিশ্চিত করার জন্য পন্থা আবিষ্কার করি। অতঃপর দ্বিতীয় বেঙ্গলের সৈনিকগণকে সিপাহ-জনতার বিপ্লবে যোগদানে সহায়তা করি। ৭ নভেম্বর তারিখ সকালবেলা কোনো এক সময় শেরেবাংলা নগরে ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আওতায় থাকা অবস্থায়, ৩ নভেম্বরের ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত তিনজন জ্যেষ্ঠ অফিসার নিহত হন। তাদের নিহত হওয়ার পরিস্থিতি বা পরিবেশ, আজ পর্যন্ত বিতর্কিত অথবা অন্য ভাষায়, শতভাগ নিশ্চিত নয়।

জাসদীয় বিপ্লবের অপমৃত্যু

৭ নভেম্বর ১৯৭৫। জাসদপন্থী সৈনিকদের ও জাসদ কর্মীদের বিপ্লব সূর্য উদয়ের ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই, পানিতে যেমন চিনি গলে যায় তেমনি বিলীন হয়ে যায়। এ দিকে শক্তিশালী হয়ে ওঠে জিয়া অনুরাগী হাজার হাজার সৈনিকেরা এবং শুরু হয় হাজার হাজার মানুষের সম্মিলিত বিপ্লব। তখন থেকে এই দিনের নাম হয়েছে সিপাহি জনতার বিপ্লব ও সংহতি দিবস। প্রায় দুই-আড়াই মাসের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির শেষে এক অগ্নিগর্ভ মুহূর্তে, জিয়াউর রহমান বীর উত্তম সেনাবাহিনীর দায়িত্বের অতিরিক্ত, কিন্তু অবশ্যই পরোক্ষভাবে, পুরো দেশ ও জাতির নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন। বিভক্ত জাতিকে সংহত করার কঠিন প্রক্রিয়া শুরু করেন।

মূল্যায়ন ও তুলনা

৪০ বছর পর, ওই ঘটনাগুলো সম্বন্ধে অতি সংক্ষিপ্ত মূল্যায়ন রাখলাম। উদ্দেশ্য একটি। জাতিকে সুসংহত করার কাজে অতীতের অভিজ্ঞতা যেন সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী উচ্চপদের ব্যক্তিত্বগণের কাজে লাগে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নদীতে দু’টি স্রোত। দৃশ্যমান স্রোত, সরকারের অনুকূলে; ঢেউবিহীন; ধীর গতির; অভিজাত গতির স্রোত। দৃশ্যমান স্রোতের নিচে অদৃশ্য যেই স্রোত, সেই স্রোতটি সরকারের অনুকূলে নয়; প্রতিকূলে। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন, সম্ভবত, বাকশাল বা একদলীয় শাসনের মাধ্যমে দেশকে স্থিতিশীল করতে এবং দেশের ওপর পূর্ণ রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে। বঙ্গবন্ধু কন্যা চাচ্ছেন, সম্ভবত আনুষ্ঠানিক একদলীয় শাসন কায়েম না করে সহমতের বহুদলীয় শাসন কায়েম করে দেশকে স্থিতিশীল করতে এবং দেশের ওপর পূর্ণ রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে। বঙ্গবন্ধুর আমলে বিদেশী রাষ্ট্রের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শুভাকাক্সক্ষী যেরকম ছিল এবং বঙ্গবন্ধুর প্রতি বৈরী অশুভাকাক্সক্ষী যেমন ছিল, তেমনি বঙ্গবন্ধুকন্যার ক্ষেত্রেও আছে। তবে বঙ্গবন্ধুকন্যার ক্ষেত্রে, বন্ধুভাবাপন্ন বিদেশী রাষ্ট্রগুলো এবং বৈরীভাবাপন্ন বিদেশী রাষ্ট্রগুলো, প্রত্যেকেই নিজ নিজ নিয়মে অনেক বেশি সচেতন, সজাগ, সতর্ক এবং গোছানো। বঙ্গবন্ধুর আমলে রাজনৈতিক ময়দান ছিল সীমিত। তার কন্যার আমলে রাজনৈতিক ময়দান অনেক বেশি বিস্তৃত। খেলার মাঠ বড় হলে অনেক টিম মাঠের একেক অংশে খেলতে পারে। অনেক লোক একসাথে খেললে বা অনেক টিম এক মাঠে খেললে, পর্যবেক্ষণপ্রক্রিয়া কঠিন হয়ে যায়। বেশি সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন পড়ে।

ধ্বংস করা অসম্ভব

পুরো কলামের প্রেক্ষাপট হচ্ছে গত তিন মাস। অর্থাৎ ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর-নভেম্বর। আজিজ সুপার মার্কেটে নিহত প্রকাশক দীপনের পিতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হকের ভাষায়, ‘এরূপ অনিশ্চয়তা ও আতঙ্কে অতীতে কোনো দিন ছিলাম না।’ প্রচণ্ড রকমের বড় বড় স্কেলের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু নিরাপত্তাজনিত অনিশ্চয়তার কারণে বিদেশী ও দেশী বিনিয়োগ বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। সরকার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা চাচ্ছেন, কিন্তু মাঠের বিরোধী দলকে মার্জিনালাইজড করে। বাস্তবতা হলো, পৃথিবীর কোনো দেশেই শুধু সরকারি দল শতভাগ জনগণের সমর্থন পায় না। তাই রাজনীতির অঙ্গনে ক্রেডিবল বা বিশ্বাসযোগ্য বা অর্থবহ বা কার্যকর বিরোধী দল থাকতেই হয়। সরকারি দলের স্বার্থেই এটা প্রয়োজন। আমরা আশা করি, বর্তমান সরকার এটা বুঝবেন। সরকার পক্ষ অথবা বিরোধী পক্ষ এই উভয় পক্ষ, পারস্পরিকভাবে অপর পক্ষকে কোনো দিন চূড়ান্তভাবে ধ্বংস করতে পারে না; পক্ষগুলো শুভ হোক আর অশুভ হোক। শুভ-পক্ষ অবিরত চেষ্টা করবে অশুভ-পক্ষকে ধ্বংস করতে। চেষ্টা করাটা ফরজ; শতভাগ সাফল্য নাও আসতে পারে, সেটাই বাস্তব। এর মধ্যে জটিলতা বেড়ে যায়, যখন বৈরিতা উভয়পক্ষের মনে শিকড় গাড়ে। এর পরেও বেড়ে যায় যখন বৈরিতা প্রকাশ পায় সশস্ত্র কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। গত ৪৫ বছর ধরে বাংলাদেশে বৈরিতা সৃষ্টি হয়েছে; পক্ষ-বিপক্ষ সৃষ্টি হয়েছে। বৈরিতার অবসান করে সমঝোতার চেষ্টা হয়েছে কিন্তু তা বেগবান চেষ্টা নয়। শুভ ও অশুভ পক্ষ অথবা বৈরী উভয়পক্ষ একাধিক নিয়মে শক্তিশালী হয়েছে। ফলে তাদের বৈরিতার প্রকাশ ক্রমান্বয়ে নগ্ন ও ভয়ঙ্কর হচ্ছে; যেটা বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য দুশ্চিন্তার কারণ।

পরিবর্তন অবশ্যই প্রয়োজন

এই প্রেক্ষাপটে আমরা কী করতে পারি? গত সপ্তাহের কলামের শিরোনাম ছিল ‘সিদ্ধান্ত নিতেই হবে’। সম্মানিত পাঠক, প্রিয় দেশবাসী, সবাই মিলে চিন্তা করতে হবে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় কী? একজন রণাঙ্গনের সৈনিক যেমন ছিলাম, অবসর জীবনে কলম সৈনিকও বটে। মাথার চিন্তা, বুকের সাহস, হাঁটার শক্তি, সাধারণ মানুষকে বুকে টেনে নেয়ার সহজাত অভ্যাস আমাকে শক্তি জোগাচ্ছে রাজনীতির অঙ্গনে। আমি রাজনৈতিক কর্মী। আমি মনে করি, বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের কর্মীদেরকেই এ দায়িত্ব নিতে হবে। আমাদের রাজনীতিতে বহু আঙ্গিকে গুণগত পরিবর্তন খুবই প্রয়োজনীয়। যদি এই পরিবর্তন আনতে আমরা চেষ্টা না করি, দেশের ক্ষতি হবে অপূরণীয়; রাজনীতি নামে শব্দটির সংজ্ঞা অভিধান বা ডিকশনারিতে নতুন করে লিখতে হবে। পরিবর্তন নিয়ে কিছু কথা আগামী সপ্তাহে বলব ইনশাআল্লাহ।

লেখক : মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক

(১১ নভেম্বর ২০১৫ তারিখ নয়া দিগন্ত পত্রিকায় প্রকাশিত)

বিষয়: বিবিধ

১০১৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File