চলুন মনকে বুঝি-১৫

লিখেছেন লিখেছেন মিশু ১১ জানুয়ারি, ২০১৬, ০৯:২৯:৩২ সকাল

আসসালামু’আলাইকুম

প্রবৃত্তির অনুসারীদের সাথে উঠবসা ও তাদের সাথে বন্ধুত্ব করা

মনে রাখতে হবে, বন্ধু নির্বাচন করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যারা বন্ধু নির্বাচন করতে ভূল করে, তারা তাদের জীবনের নিয়ন্ত্রণ হারায় ফেলে। যার বন্ধু খারাপ বা চরিত্রহীন হয়, তাকে ভালো রাখার জন্য কোন কৌশলই উপকারে আসে না। কারণ, প্রবাদে আছে, মানুষ তার বন্ধুর দ্বীনের উপর ভিত্তি করেই প্রতিষ্ঠিত। তার বন্ধুর দ্বীন যা হবে তার দ্বীনও একই দ্বীন হবে। সুতরাং, আমরা সবসময় সৎ সঙ্গী নির্বাচন করবো, কখনোই অসৎ বন্ধুদের সাথে চলাফেরা করবো না, তাদের এড়িয়ে চলবো। কারণ, কিয়ামতের ভয়াবহ বিপদের দিন আমার বন্ধু আমার কোন উপকারে আসবে না। সেদিন আমার বন্ধু আমার দুশমণে পরিণত হবে। তারা আমাকে চিনতে পারবে না, একমাত্র মুত্তাকী ছাড়া। যারা মুত্তাকী এবং একমাত্র দ্বীনের স্বার্থে একে অপরের সাথে বন্ধুত্ব করে তাদের বন্ধুত্ব কিয়ামতের দিনও কাজে লাগবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যারা দ্বীনের কারণে একে অপরকে ভালোবাসতো তাদের ক্ষমা করে দেবেন।

আবু হুরাইরা (রাযিঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ “কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআ’লা বলবেনঃ আমার মর্যদার (আনুগত্বের) কারণে পরস্পরে বন্ধুত্বকারীরা কোথায়? আজ আমি তাদের আমার ছায়াতলে ছায়া দিব, যেদিন আমার ছায়া ব্যতীত কোন ছায়া নেই।”

(মুসলিম, অধ্যায়, বির ওয়াস্ সিলা, নং ২৫৬৬)

এ ছাড়াও আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানুষকে সত্যবাদীদের সাথে উঠবস করার নির্দেশ দেন। কারণ, কথায় আছে, সৎ সঙ্গ স্বর্গবাস আর অসৎ সঙ্গ সর্বনাশ।

“হে ঈমান-দারগণ, তোমরা নিজদের পিতা ও ভাইদেরকে বন্ধরূপে গ্রহণ করো না, যদি তারা ঈমান অপেক্ষা কুফরিকে প্রিয় মনে করে। তোমাদের মধ্য থেকে যারা তাদেরকে বন্ধরূপে গ্রহণ করে তারাই যালিম”। (সূরা তাওবাহ, আয়াত: ২৩)

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আরও বলেন,

“যারা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান আনে, তুমি পাবে না এমন জাতিকে তাদেরকে পাবে না এমন লোকদের সাথে বন্ধুত্ব করতে, বন্ধু হিসাবে যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরোধিতা করে, যদি সেই বিরুদ্ধবাদীরা তাদের পিতা, পুত্র, ভাই অথবা জ্ঞাতি-গোষ্ঠী হয় তবুও। এদের অন্তরে আল্লাহ ঈমান লিখে দিয়েছেন এবং তাঁর পক্ষ থেকে রূহ দ্বারা তাদের শক্তিশালী করেছেন। তিনি তাদের প্রবেশ করাবেন এমন জান্নাতসমূহে যার নিচে দিয়ে ঝর্ণাধারাসমূহ প্রবাহিত হয়। সেখানে তারা স্থায়ী হবে। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে। এরা হল আল্লাহর দল। জেনে রাখ, নিশ্চয় আল্লাহর দলই সফলকাম”। (সূরা মুজাদালাহ,: ২)

মানুষের সাথে বন্ধুত্ব ও তাদের সাথে উঠবস করার ফলে মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষা ও চাহিদা বৃদ্ধি পেতে থাকে। যারা প্রবৃত্তির অনুসারীদের সাথে উঠবস এবং তাদের সাথে বন্ধুত্ব করে, তারা অবশ্যই তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়। বিশেষ করে যখন সে তাদের চেয়ে দুর্বল হয় এবং তার মধ্যে প্রভাব সৃষ্টি করার মত যোগ্যতা থাকে, তখন সে কোন প্রকার হিসাব-নিকাশ ছাড়াই তার বন্ধুদের দ্বারা প্রভাবিত হয় এবং তাদের প্রবৃত্তির অনুসারী হয়ে থাকে। এই অবস্থা একজন পূর্ণবয়স্ক লোকের চরিত্রেও দেখা যায়।

কাউকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করার পূর্বে তার সম্পর্কে জানা উচিৎ, যে আমরা কার সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করতে চলেছি। সাধারণত: জুয়াড়ির বন্ধু জুয়াড়ী হয়, চোরের বন্ধু চোর হয়, আর নামাযীর বন্ধু হয় নামাযী ।

তাই বন্ধু নির্বচনের ব্যাপারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ

“মানুষ তার বন্ধু স্বভাবী হয়, তাই তাকে লক্ষ্য করা উচিৎ যে, সে কার সাথে বন্ধুত্ব করছে।”

তিরমিযী,নং ২৪৮৪)

একদা এক বেদুইন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে জিজ্ঞাসা করেঃ কিয়ামত কবে হবে? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উত্তরে বলেনঃ তার জন্য কি প্রস্তুতি নিয়েছো? লোকটি বলেঃ (নফল) নামায, রোযা, সাদাকা হিসাবে বেশী কিছু আমার নেই কিন্তু আমি আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলকে ভালবাসি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ “তাহলে তুমি তার সাথে হবে যাকে তুমি ভালবাসো।

(মুসলিম, নং ২৬৩৯)

প্রিয় নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পেশ করেছেন, যেন আমরা জানতে পারি যে আমাদের কী ধরণের বন্ধু চয়ন করা প্রয়োজন।

নবী স. বলেন:

‘‘সৎ সঙ্গী এবং অসৎ সঙ্গীর উদাহরণ হচ্ছে আতর বিক্রয়কারী এবং কামারের হাপরের ন্যায়। আতর ওয়ালা তোমাকে নীরাশ করবে না; হয় তুমি তার কাছ থেকে ক্রয় করবে কিংবা তার নিকট সুঘ্রাণ পাবে। আর কামারের হাপর, হয় তোমার বাড়ি জ্বালিয়ে দিবে, নচেৎ তোমার কাপড় পুড়িয়ে দিবে আর নাহলে দুর্গন্ধ পাবে।”

বুখারী, অধ্যায়, ক্রয়-বিক্রয়, নং২১০১

আলকামাহ (রহঃ) বলেনঃ “বন্ধুত্ব কর তার সাথে, যার সাহচর্য তোমাকে সুন্দর করে, তুমি অভাব গ্রস্থ হলে তোমাকে সাহায্য করে, ভুল বললে তোমার ভুল সংশোধন করে, যদি তোমার মধ্যে কোন মঙ্গল দেখে, তো গুণে গুণে রাখে, যদি তোমার মধ্যে কোন ত্রুটি দেখে তো শুধরে দেয়, যদি তার কাছে চাও তো সে দেয়, কঠিন সময়ে তোমাকে সান্তনা দেয়।”

আউযায়ী (রাহঃ) বলেনঃ ‘ বন্ধু বন্ধুর জন্য তালির (কাপড়ের টুকরার) ন্যায়, যদি আসল কাপড়ের মত না হয়, তো অশোভনীয় করে দেয়’।

কতিপয় আলেম বলেনঃ বন্ধুত্ব কর কেবল নিম্নোক্ত দু শ্রেণীর মানুষের সাথে।

এক: তার সাথে যে তোমাকে দ্বীনের শিক্ষা দেয়, যার দ্বারা তুমি উপকৃত হও।

দুই: তার সাথে যাকে তুমি দ্বীনের শিক্ষা দাও আর সে তা গ্রহণ করে।

উক্ত প্রকার ছাড়া তৃতীয় প্রকার হতে দূরে থাক।”

এ কারণেই আমাদের মনীষীরা আমাদেরকে প্রবৃত্তির অনুসারী ও বিদআতিদের সাথে উঠবস করতে নিষেধ করেন এবং তাদের থেকে সতর্ক থাকতে বলেন।

আল্লামা আবু কালাবাহ রহ. বলেন,

“তোমরা প্রবৃত্তির অনুসারিদের সাথে উঠবস করো না (আব্দুলা আহমদের আস-সুন্নাহ: ৯১) এবং তাদের সাথে কোন প্রকার বিতর্কে জড়াবে না। কারণ, আমরা তোমাদের নিশ্চয়তা দিতে পারছি না যে, তারা তোমাদেরকে গোমরাহীতে ডুবাবে না অথবা দ্বীনের বিষয়ে তাদের নিকট যে অস্পষ্টতা রয়েছে তাতে তোমাদের বিভ্রান্তিতে ফেলবে না”।

আল্লামা মুজাহিদ রহ. বলেন,

“তোমরা প্রবৃত্তির অনুসারীদের সাথে উঠবস করো না।

আজ আমাদের সমাজে ছেলে মেয়েরা তথাকথিত স্মার্টকে প্রাধান্য দিয়ে সঙ্গী নির্বাচন করে থাকে,আবার অনেকে ধনী ও সুন্দর দেখেও নির্বাচন করে থাকে,কিন্তু একবারও চিন্তা করে দেখে না তাদের নৈতিক অবস্থান কোথায়। এমনকি মা বাবারাও খুব সহজেই এই দৃষ্টি ভঙ্গীটাকে মেনে নিচ্ছেন। ফলে দেখা যায় বাসায় হয়তো কোন পরিবারে আখলাক সুন্দর ও ইসলামের অনুশাসন মেনে চলার পরিবেশ থাকে কিন্তু সঙ্গীর বাসায় গিয়ে ভালো অনুশাসনের বিপরীত পরিবেশে প্রবৃত্তির খায়েশ পূরন করার সুযোগ হয়ে উঠে, এইভাবে আস্তে আস্তে সেটাতেই অভ্যস্ত হয়ে যায়। এইভাবেই বন্ধুর আদর্শে নষ্ট হয়ে যেতে থাকে। নেশাগ্রস্ত হয়ে যাওয়া,পর্ণগ্রাফী দেখায় আসক্ত হওয়া,অবৈ্ধ প্রেমে লিপ্ত হওয়া ইত্যাদির মাঝে জড়িয়ে যায়।

অনেক পিতা মাতা ধার্মিক ছেলে মেয়ে থেকে পরিকল্পিতভাবে দূরে রাখেন, যেন সন্তানেরা ইসলামের দিকে ঝুকে না পড়ে বেশী, কারন নিজেরাও দুই নৌকায় পা দিয়ে দুনিয়া ও আখেরাত নষ্ট করছেন-ছেলেমেয়েদের জীবনেও তাই চান।

ইসলামের রাস্তা একটা সহজ সুন্দর সোজা, এখানে কম বেশী বলে কিছু নেই। এই পিতা মাতাই বুড়ো বয়সে যখন সন্তানদের কাছে পান না তখনই বোধোদয় হয় যে কি ভুল করেছেন। ছোটবেলা থেকেই সঙ্গী নির্বাচনে সচেতন থাকা প্রয়োজন।

আল্লামা ইবনে কাসীর রহ. বলেন, আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের বাণী- “যদি তোমরা মুশরিকদের থেকে আলাদা না থাক এবং মুমিনদের সাথে বন্ধুত্ব না কর, তখন মানুষের মধ্যে ফিতনা সৃষ্টি হবে”। আর তা হল, বিশৃঙ্খলার উৎপত্তি হবে, (সমাজের নিয়ম কানুন ঠিক থাকবে না), মুমিনরা কাফেরদের সাথে মিশে যাবে। ফলে মুমিনদের স্বকীয়তা বজায় থাকবে না। তখন সমাজে অনেক ফিতনা ফ্যাসাদ দেখা দেবে, সামাজিক শৃঙ্খলা বিনষ্ট হবে এবং সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে---”।

বর্তমানে সমাজে এ ধরনের ঘটনা অহরহ ঘটছে। আল্লাহ আমাদের সহযোগিতা করুক।

https://www.youtube.com/watch?v=T_DMb8o32c8

https://www.youtube.com/watch?v=kFmr3Nft77E

বিষয়: বিবিধ

১১২১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File