ক্রিকেটের মর্যাদা যখন সালাত থেকেও বেশি।
লিখেছেন লিখেছেন ঘুম ভাঙাতে চাই ১৮ জুন, ২০১৭, ০৬:০৬:১৮ সন্ধ্যা
একটি দেশের মানুষের প্রধান পরিচয়ই যখন ক্রিকেট নামক খেলা হয়ে যায় এবং হাসি-কান্না, মান-সন্মান, গৌরব-মর্যাদা সবকিছুই যখন ক্রিকেটকে ঘীরে আবর্তিত হয় আবার শত্রু-মিত্রও নির্ধারিত হয়ে যায়, তখন সাদাচোখে সেই দেশ ও জাতির চিন্তাধারা-কর্মকান্ড আসলেই আশ্চর্যজনক, প্রশ্নবোধক হয়ে ওঠে। জনৈক বাঙ্গাল ক্রিকেট ধর্মাবলম্বী তরুণের লেখায় এটাও দেখলাম, ইসলামে যদি খেলা হারাম হয় তবে সেই ইসলাম আমার দরকার নেই, ক্রিকেটই আমার ধর্ম। ক্রিকেট খেলা নিয়ে আমাদের আবেগ আমাদের চিন্তা-ভাবনাকে কি রকম বিকৃত করে ফেলেছে, কতখানি উন্মাদে পরিণত করেছে তা গত কয়েকদিনের বাঙ্গালী ক্রিকেট পাগল তরুণ তরুণী ফেসবুক ইউজারদের দিক তাকালেই বোঝা যায়। যখন দেখেছি ফেসবুকে নিজেকে ইসলামীক দায়ী ( যিনি মানুষকে ইসলামের পথে আহবান করেন) বলে পরিচয় দানকারী বা ইসলাম মেনে চলা ছেলে মেয়েরা পর্যন্ত রমাদানে জামাতে এশা ও তারাবীহ, কুরআন পাঠ, কিয়ামুল লাইল সহ অন্যান্য নফল ইবাদাহ বাদ দিয়ে টিভি সেটের সামনে বসে ক্রিকেট নিয়ে ফেসবুক পোস্ট দিচ্ছে, অন্যদের মত তর্ক বিতর্কে জড়াচ্ছে তখন খুব অবাক হয়েছি। সবচেয়ে বিরক্তিকর সময়টা ছিল বাংলাদেশ বনাম ভারতের খেলার সময়। সবার পোস্ট দেখে মনে হচ্ছিল বাংলাদেশ ভারতের বিরুদ্ধে কোন ক্রিকেট খেলা না, বরং একদল নির্যাতিত, অত্যাচারিত, অবহেলিত, অসহায় বাংলাদেশী ক্রিকেটার অত্যাচারী ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড ও জালিম সেনাবাহিনী ভারতীয় ক্রিকেটারদের শাসন-শোষণ, অন্যায়ের বিরুদ্ধে স্বাধিকারের কোন যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে যার মর্যাদা জিহাদের কাছাকাছি তাই ইমানী দায়িত্ব হল, দোয়া করে আল্লাহকে রাজি খুশি করানো আর আল্লাহরও দায় পরে গেছে এই অসহায় মুমিন ক্রিকেটারদের ন্যায়ের যুদ্ধে বিজয়দান করা। জায়োনিস্ট গোষ্ঠী ক্রিকেট নামক আবেগ কাজে লাগিয়ে এই জাতিকে চিন্তাগত দিক থেকে পঙ্গু করতে ভালভাবেই সক্ষম হয়েছে। কদিন পর হয়ত দেখা যাবে ইসলাম বিদ্বেষী গোষ্ঠী ইসলাম বিরোধীতা ও জনগণকে বিভ্রান্ত করার মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে ক্রিকেটিয় আবেগকে কাজে লাগাচ্ছে!! কারণ তারা এতদিন ১৯৭১ সালের আবেগকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে ব্যর্থ হয়েছে। তারা এতদিন এদেশের মানুষকে অনেক করে বোঝাতে চেয়েছে যে, শোন, ১৯৭১ সালে আমরা মূলত পাকিস্তান না, পাকিস্তানের ধর্মের বিরুদ্ধে লড়েছি তাই পাকিস্তানের বিরোধীতা করতে হলে ইসলামের বিরোধীতা করতে হবে কিন্তু এমন প্রচারে মানুষ উল্টা তাদের প্রতি আরো বিদ্বেষী হয়ে উঠেছে। তাই আরো আধুনিক উন্নত অস্ত্র হিসেবে যদি তারা ক্রিকেট ব্যবহার করে, আমি মোটেও অবাক হবনা।
হিজরী ১৯, পরাক্রমশালী পারস্যরাজ ১,৫০,০০০ সৈন্যের বিশাল পারসিয়ান সেনাবাহিনী প্রস্তুত করল মুসলিমদের চিরতরে নিঃচিহ্ন করে দেয়ার জন্য। মুসলিম সেনাপতি সাদ বিন আবী ওয়াক্কাস (রাঃ) নামমাত্র ক্ষুদ্র এক মুসলিম সেনাবাহিনী নিয়ে অগ্রসর হলেন এই বিশাল পারস্য বাহিনীর সাথে এক অসম যুদ্ধে অবতীর্ণ হবার জন্য। আল্লাহর উপর আস্হা, অসীম ধৈর্য ও সুদীর্ঘ সময় আর ক্ষয়ক্ষতির পর মুসলিম সেনাবাহিনী অবশেষে বিশাল পারস্য বাহিনীকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়। মুসলিম সৈন্যরা আনন্দে আত্নহারা, অনেক ত্যাগের ফসল এই বিজয় কিন্তু ব্যতিক্রম দেখা গেল একজনকে, মুসলিম সেনাপতি সাদ বিন আবী ওয়াক্কাস, তিনি অঝোরে কাঁদছেন। মুসলিম সৈন্যরা অবাক হলেন, তাকে জিঙ্গেস করলেন, হে আবী ওয়াক্কাস আমরা আপনার নেতৃত্বে বিজয়ী হয়েছি, পারস্য মুসলিমদের পদানত হয়েছে আর আপনি এমন খুশির সময় কাঁদছেন? আবী ওয়াক্কাস (রাঃ) জবাব দিলেন, হে মুসলিম সৈন্যরা! তোমরা কি ভুলে যাচ্ছ পারস্য জয় করতে গিয়ে আমাদের কত ওয়াক্ত নামাজ কাজা হয়ে গেছে? কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ, দেশ জয়, নাকি নামাজ? মুসলিমদের আনন্দ থেমে গেল, তাদের আনন্দ রূপ নিল বিষাদে।
নবী মুহাম্মাদ (সাঃ) মক্কার একজন ধনী ব্যবসায়ী ছিলেন, বংশে অভিজাত কুরাইশ ছিলেন, সমস্ত আরবে বিশ্বাসী, সত্যবাদী বলে পরিচিত ছিলেন অথচ নবুয়ত প্রাপ্তির পর আল্লাহর রাসূলকে অসীম নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে, পাথর মেরে তাকে রক্তাক্ত করা হয়েছে, শেবে আবি তালিবে ৩ বছর অবরুদ্ধ করে খাবার-পানি, সমাজহীন থাকতে বাধ্য করা হয়েছে, তাকে নিজ ভূমি, সহায় সম্পদ, ঘর বাড়ি সব ছেড়ে মদিনায় আশ্রয় নিতে হয়েছে, চরম দারিদ্রতার কষ্ট ভোগ করতে হয়েছে, মক্কাবাসীরা একের পর এক অন্যায়ভাবে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে- যুদ্ধে তিনি ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন এবং তার নিজ চাচা, তার কাজিন সহ অনেক সাহাবী এসব যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছেন- কিন্তু কেন? কিসের জন্য? শুধুমাত্র এই জন্যই যে, তিনি আরববাসীকে নামাজের দাওয়াত দিয়েছিলেন, নানা গোত্র আর অহমিকায় বিভক্ত সমস্ত আরববাসীকে মসজিদে একই কাতারে এনে দাড় করাতে চেয়েছিলেন। হ্যা! এটিই ছিল একমাত্র অপরাধ। এই নামাজই একজন মুসলিমের সাথে একজন অমুসলিমের পার্থক্য গড়ে দেয়।
নিজেকে কখনো প্রশ্ন করেছেন, পৃথিবীতে ক্ষমতাপ্রাপ্ত মুমিনদের প্রধান দায়িত্ব কি?
পবিত্র কুরআনের সূরা নুর চোখের সামনে মেলে ধরুন, ৫৬ নাম্বার আয়াতে যান এবার পড়ুন-
(হে মুমিনগণ) তোমরা যথাযথভাবে নামায আদায় কর, যাকাত দাও এবং রসূলের আনুগত্য কর; যাতে তোমরা করুণাভাজন হতে পার।
রাসূল (সাঃ) সাহাবীদের দাজ্জালের ভয়াবহতার ব্যাপারে বলছিলেন যার ১ম দিনটি হবে এক বছরের সমান, ২য় দিনটি হবে এক মাসের সমান এবং ৩য় দিনটি হবে ১ সপ্তাহ এর সমান। সাহাবীরা ভীত ছিলেন, উদ্বিগ্ন ছিলেন তারা হয়ত প্রশ্ন করতে পারতেন: হে আল্লাহর রাসূল! দাজ্জালকে আমরা কিভাবে হত্যা করব? কিভাবে তার সাথে লড়াই করব? কিন্তু তারা প্রশ্ন করলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু!! তারা প্রশ্ন করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! দাজ্জালের দিন যদি এত দীর্ঘ হয় আমরা নামাজের সময় কিভাবে নির্ধারণ করব? কিভাবে ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়ব? সুবহানআল্লাহ! সাহাবীদের প্রধান চিন্তা ছিল নামাজ নিয়ে, ভালবাসা ছিল নামাজকে ঘীরে। দাজ্জাল তাদের হত্যা করবে, ভূমি কেড়ে নিবে, পরিবার ও স্ত্রী কণ্যাদের তার অনুসারী বানিয়ে ছাড়বে এসব নিয়ে তারা উদ্বিগ্নতা দেখান নি বরং তাদের প্রধান চিন্তাই ছিল দাজ্জাল তাদের নামাজে বিঘ্ন ঘটাবে কিভাবে তারা নামাজ পড়বে??
কোথায় ছুটে চলেছেন আপনারা? খেলার পেছনে? আপনাদের খেল-তামাশা আপনাদের এমন হাল করবে নাতো?
# এ লোকালয়ের মানুষগুলো কি এতই নির্ভয় হয়ে গেছে (তারা মনে করে নিয়েছে) যে, আমার আযাব (নিঝুম) রাতে তাদের কাছে আসবে না, যখন তারা (গভীর) ঘুমে (বিভোর হয়ে) থাকবে? অথবা জনপদের মানুষগুলো কি নির্ভয় হয়ে ধরে নিয়েছে যে, আমার আযাব তাদের উপর মধ্য দিনে এসে পড়বে না- তখন তারা খেল-তামাশায় মত্ত থাকবে। কিংবা তারা কি আল্লাহ তাআলার কলা-কৌশল থেকেও নির্ভয় হয়ে গেছে, অথচ আল্লাহ তাআলার কলা-কৌশল থেকে ক্ষতিগ্রস্থ জাতি ছাড়া অন্য কেউই নিশ্চিত হতে পারে না।” (সূরা আল আ’রাফ, আয়াত: ৯৭-৯৯)
বিষয়: বিবিধ
১৬৮৭ বার পঠিত, ১৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
অনেক দিন পর লিখলেন। চমৎকার লেখা।
নিশ্চয়ই ভালো আছেন আপু।
আমি ফেবুতে একটি স্ট্যটাস এভাবে দিয়েছিলাম,
"রমাদানের মহত্ব বিনষ্টকারী কওমী/নন কওমী ক্রিকেটান্দ্ধরা আমাকে আন-ফ্রেন্ড করুন!
প্লিজ, করুন!!"
এদের জন্য আফসোস হয়, রামাদানের মত মাস পেয়েও এরা গাফেল।
'ক্রিকেট আমার ধর্ম' - এই স্ট্রেইন্জ বাক্যটি আমি প্রথম শুনেছিলাম ২০০৪ সালে অস্ট্রেলিয়ায়।
সোবহানাল্লাহ, আপনার লিখার বদৌলতে এখন জানলাম বাংলার কিছু মানুষের ধর্ম ও ক্রিকেট এ পরিনত হয়েছে।
সুন্দর লিখাটির জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
আপনার লেখার শিরোনাম দেখে ঢুকে পড়লাম কারণ এই বিষয়টিতে আমি খুবই বিরক্ত।
সত্যিই যারা ক্রিকেট উন্মাদ, তারা নামাজের সময়ে খেলাটাকেই বেশি প্রাধান্য দেয় বিশেষ করে যদি তা হয় টান উত্তেজনাকর কোনো মুহুর্ত।
ভালো বলেছেন। জাযাকাল্লাহ খাইর
মন্তব্য করতে লগইন করুন