দুর্ঘটনার ১০ বছর : মৃত্যুর কাছ থেকে ফিরে আসা

লিখেছেন লিখেছেন ডক্টর সালেহ মতীন ২৯ নভেম্বর, ২০১৬, ০২:৩১:৫২ দুপুর





২০০৬ সালের ২৮ নভেম্বর। এ দিনে আমার জীবনের অভাবনীয় ও মারাত্মক ভয়াবহ একটি দুর্ঘটনার দুঃসহ স্মৃতি রচিত হয়। এ দুর্ঘটনার কয়েকটি জীবন্ত চিহ্ন আজও আমি সচেতনভাবে বহন করি। ক্রিকেট মাঠে কোন ফিল্ডার ক্যাচ ফেলে দিলে ব্যাট্সম্যান যেমন বোনাস লাইফ পান ঠিক তেমনি আমিও আলহামদুলিল্লাহ মৃত্যুর কাছে থেকে ফিরে এসে বোনাস লাইফ নির্বাহ করছি। সে দিনের সে ঘটনার কথা ভাবতেই গা শিউরে ওঠে !

অফিস শেষ করে বিকেল ৫টার দিকে দিলকুশা থেকে মহাখালীর উদ্দেশ্যে বেরিয়েছি সেখানে আমার একমাত্র শ্যালক (পৃথিবীর আর কোথাও আমার কোন শ্যালক নেই) ইঞ্জিঃ নাজমুল হাসান টিপু সনি র‌্যাংগ্স মেইন অফিসে ইন্টার্নশিপ করছিল। মতিঝিল শাপলা চত্বর থেকে গাজীপুর পরিবহনের বাসে উঠেছি। মগবাজার পর্যন্ত এসে টিপুকে একটা কলও দিয়েছি যে, আমি মগবাজার পর্যন্ত এসেছি। ক্লান্তিজনিত কারণে বাসের মধ্যে একটু ঘুমের ভাব হচ্ছিল। এরপর আমার স্মৃতিতে আর কিছুই নেই। মহাখালী বাস স্ট্যান্ডে ৬টার দিকে ঘটে দুর্ঘটনা। আজও মনে করতি পারি না কিভাবে সেই ভয়াবহ দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল। রাত সাড়ে এগারোটার দিকে নিজেকে আবিষ্কার করি শাহজাহানপুরস্থ প্যানপ্যাসিফিক হাসপাতালের বিছানায়। তখন আমার বাম পা, বাম হাত, মুখ ও বাম কাঁধসহ শরীরে আরো কয়েক জায়গায় ব্যান্ডেজ। তার মানে প্রায় ৬ ঘণ্টা অজ্ঞান থাকার পর এইমাত্র আমার জ্ঞান ফিরে সবাইকে অবাক বিষ্ময়ে দেখতে আরম্ভ করেছি। ‘আমি এখানে কেন ?’ প্রশ্নের জবাবে সবাই বলতে থাকল আমি নাকি এক্সিডেন্ট করেছিলাম। কী অবাক কাণ্ড! হাত-পা, মাথা, মুখ এত ব্যান্ডেজ ! মারাত্মক দুর্ঘটনা বলেই তো মনে হচ্ছে ! কিন্তু কীভাবে ঘটল কিছুই মনে করতে পারছি না। আজও পারি না।

রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তা থেকে আমায় উদ্ধার করে বিবিএ অধ্যায়নরত স্বল্পবয়সী ও ক্ষীণদেহী সজিব নামের এক সুদর্শন ছেলে। তাকে আমি আল্লাহর পক্ষ থেকে পাঠানো উদ্ধারকারী বলে মনে করি। তার কাছ থেকেই পরে দুর্ঘটনার আগ-পাছ বিবরণ উদ্ধার করেছি। মহাখালী বাস স্ট্যান্ডের কাছে বাস থেকে নেমে রাস্তার এক পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ পেছন থেকে এক মাইক্রো বেপরোয়া গতিতে এসে আমায় এলোপাতাড়ি আঘাত করে। আমি রক্তাক্ত হয়ে ছিটকে পড়ে যাই পাশে। হৈ-চৈ পড়ে যায় ঘটনাস্থলে। এরই মধ্যে পথচারীরা জড়ো হয়েছে কিন্তু কেউ আমাকে ধরছে না। শক্তিশালী ও সামর্থ্যবান মানুষগুলো দর্শকের ভূমিকায় দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু কেউ জীবনটা বাঁচানোর ক্ষেত্রে সচেষ্ট হচ্ছে না।

সজিব কাছেই একটি কোম্পানীতে পার্ট টাইম ডাটা এন্ট্রির কাজ করত। সে দিনের কাজ শেষ করে আরো অনেকের মতোই ঐ পথে ঘরে ফিরছিল। আমি নাকি প্রথমে তার পেছনেই ছিলাম, কিন্তু দ্রুত গতিতে হাঁটার কারণেেএক সময় তার সামনে কিছুটা এগিয়ে থাকি। এর একটু পরেই ঘটে দুর্ঘটনা। পাতলা স্বাস্থ্যের সজিব ভিড় ঠেলে কাছে এসে আরো একজনকে উপর্যূপুরি অনুরোধ করে দুজনে মিলে আমাকে নিকটের মেট্রোপলিটন হাসপাতালে নেয়। এই অনাকাঙ্ক্ষিত নাজুক মুহূর্তেও ছিটকে যাওয়া আমার অফিস ব্যাগ, ভাঙা চশমা, কয়েকটি কয়েন, রক্তে ভিজে যাওয়া দৈনন্দিন কর্মসূচির নিয়মিত স্লিপ এইগুলো কুড়িয়ে নিতেও সে ভুল করে না। হাসপাতালে নেয়ার পর সমস্যা বাঁধে আরেক জায়গায়, কর্তৃপক্ষ অভিভাবকের সন্ধান না পাওয়া পর্যন্ত আহতের চিকিৎসা শুরু করতে অস্বীকৃতি জানায়। আমার পকেটের মোবাইলের লাস্ট কলের সূত্র ধরে সজিব ফোন করে টিপুকে। সে তার আরো দুই সহপাঠীকে সাথে নিয়ে দ্রুত হাসপাতালে এসে পরিচয় দেয়ার পর ডাক্তাররা চিকিৎসা শুরু করে। তার আরো কিছুক্ষণ পর সংবাদ পেয়ে নিজ অফিসস্থল বিমান বন্দর সংলগ্ন ‘বলাকা ভবন’ থেকে সেখানে আমার শ্রদ্ধেয় শ্বশুর এসে হাজির হন। তাঁর অভিভাবকত্য সত্যিই তুলনাহীন।

মাথা ও হাত-পা সহ বিভিন্ন জায়গার এক্স-রে সম্পন্ন করে ব্যান্ডেজ ও জরুরি চিকিৎসা চলতে থাকে। মাথার আঘাতে ডাক্তাররা আশঙ্কা করেছিলেন যে, আমার স্মৃতিশক্তিতে কোন সমস্যা হতে পারে কিনা। কিন্তু পরদিন সকালে আমার এক সহকর্মীর কাছে অফিসে ব্যবহৃত আমার কম্পিউটারের পাসওয়ার্ড সঠিকভাবে বলতে পারার পর তাদের আশংকা নিম্ন গতি লাভ করে। যাই হোক, পারিবারিক সিদ্ধান্তে হাসপাতাল পরিবর্তন করে রাত সাড়ে এগারোটার দিকে আমাকে নিয়ে আসা হয় শাহজাহানপুরস্থ প্যান-প্যাসিফিক হাসপাতালে। হাত ও পা ভেঙেছে, মুখের বাম পাশে ৪টি সেলাই, কপালে কয়েকটি, বাম কাঁধে ৮টির মতো সেলাই নিয়ে অসহায় আমি হাসপাতালের বিছানায়। পরদিন আমার অফিস থেকে প্রিয় সহকর্মীরা দেখতে আসেন তাদের মধ্যে আতাউরসহ আরো কয়েকজন সহকর্মী আমায় দেখতে ছুটে আসেন এই সংবাদ শুনে যে, আমি হয়ত বেঁচে নেই। সত্যিকার অর্থে এ ঘটনাটি মৃত্যুর খুব কাছ থেকে আমার ফিরে আসার শামিল। মহান আল্লাহর কাছে কোটি শুকরিয়া তিনি আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন।

দুর্ঘটনার ৫দিন পর আবিষ্কার করি আমার মুখের ভেতর ২টি দাঁত সম্পূর্ণ ও ১টি আংশিক ভেঙেছে। জরুরি ভিত্তিতে ভাঙা দাঁত দুটিকে উচ্ছেদ করা হয় আর মুখের সামনের আংশিক ভাঙা দাঁতটি ঐ অবস্থায় এখনো বসবাস করছে। কিঞ্চিৎ হাসলেই সকলের সামনে উম্মুক্ত হয়ে যায় ভয়াবহ দুর্ঘটনার সরেজমিন স্মৃতি চিহ্ন। অনেকে আমায় পরামর্শ দিয়েছেন দাঁতটি বদলে কৃত্রিম আরেকটি দাঁত লাগাতে অথবা ক্যাপ পরিয়ে ভাঙ্গা চিহ্ন ঢাকতে। আমি সবিনয়ে ওদের বলেছি থাক না- ওর পাশের দুই ভাইকে তো বিদায় দিয়েছি , এ দাঁতটি তো তার দায়িত্ব পালনে পূর্ণ সক্ষম- সুতরাং বাইরের রূপটি না হয় একটু তেমন হলো তাতে অসুবিধা কী ?

গুনে গুনে দীর্ঘ ৫০দিন ছিলাম বিছানায়। আমার স্ত্রীর অতুলনীয় সেবায় ঘরে শুয়ে অসুস্থতার ভয়াবহতা সে মাত্রায় আমায় উপলব্ধি করতে হয়নি। তবু দূরন্ত শৈশব ও তারুণ্যের ডানপিঠে দিনগুলির স্মৃতি সে সময় সর্বক্ষণ সঙ্গী হয়ে থাকত। গ্রামের সবুজ মাঠে কিংবা বন-বাদাড়ে বাউন্ডুলে দৌঁড়-ঝাপের চিত্র বার বার সামনে ভেসে উঠত। জানালা দিয়ে বাইরের রাস্তায় মানুষের আপন পায়ে ভর দিয়ে হেঁটে যাওয়া দেখতাম আর ভাবতাম আমি কি কোনদিন ওভাবে নিজের পায়ে হাঁটা-চলা করতে পারব ?

মহান আল্লাহর অপার রহমতে ৫০দিন পর দুই ক্র্যাচে ভর করে আস্তে আস্তে চলতে শুরু করি। ধীরে ধীরে আলহামদুলিল্লাহ সুস্থ হয়ে উঠি। তবে ১০টি বছর পেরিয়ে গেলেও কপালের বাম পাশে, মুখের বাম পাশে যেখানে বড় কাঁচের একটি টুকরো ঢুকে গর্ত হয়েছিল এবং আরো কয়েক জায়গায় এখনো হালকা অবশ ও শিরশির ভাব অনুভব করি যা প্রতিনিয়ত আমার ভয়াবহ দুর্ঘটনার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। সজিব ও তার সহযোগীদের ঋণ আমি কোনদিনও শোধ করতে পারব না। চোখে ছলছল অশ্রু নিয়ে যখন এই লেখা তৈরি করছি তখন হৃদয়ের গভীর থেকে তাদের প্রতি কৃজ্ঞতা ও দোয়া উপচে পড়ছে।

বিষয়: বিবিধ

১৫০৬ বার পঠিত, ৭ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

380268
২৯ নভেম্বর ২০১৬ দুপুর ০৩:৩০
রাশেদ বিন জাফর লিখেছেন : ভালো লাগলো
380285
৩০ নভেম্বর ২০১৬ দুপুর ১২:২৯
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : আল্লাহই একমাত্র জিবনমৃত্যুর ফয়সালাকারি।
বাংলাদেশের এই আইনটি যে অভিভাবক বা পুলিশ ছাড়া দুর্ঘটনায় আহতদের চিকিৎসা করা যাবেনা কে সবচেয়ে অমানবিক মনে হয় আমার।
৩০ নভেম্বর ২০১৬ দুপুর ০১:২৫
314747
ডক্টর সালেহ মতীন লিখেছেন : ধন্যবাদ সবুজ ভাই।
380296
৩০ নভেম্বর ২০১৬ দুপুর ০৩:৩৬
ঘুম ভাঙাতে চাই লিখেছেন : স্যার, ইন্টার্ণির সময় আপনি ছিলেন সদা হাস্যজ্বল একজন ব্যক্তি, খুব সাধারণ ব্যাপারকেও আপনি অসাধারণ করে বর্ণনা করতে পারতেন কিন্তু আপনার জীবনে এমন ঘটনা আছে জানতামনা। আল্লাহ আপনাকে সুস্হতা দান করুক।
০১ ডিসেম্বর ২০১৬ সকাল ১১:৩৯
314776
ডক্টর সালেহ মতীন লিখেছেন : আমীন। দোয়া অব্যাহত রাখবেন আশা করি।
380300
৩০ নভেম্বর ২০১৬ বিকাল ০৫:৪২
সন্ধাতারা লিখেছেন : আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতাহু পরম শ্রদ্ধেয় ভাইয়া।


এতবড় দুর্ঘটনা! মহান রবের প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতা যে আপনি সুস্থ আছেন!


সজীব ও সহযোগীদের জন্য অনেক অনেক দোয়া ও শুভকামনা ।

সর্বাবস্থায় ভালো থাকুন ও সুস্থ থাকুন এই প্রার্থনা আপনার জন্য।
০১ ডিসেম্বর ২০১৬ সকাল ১১:৩৮
314775
ডক্টর সালেহ মতীন লিখেছেন : সতত এমন দোয়া কামনা করি।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File