লিগ্যাসী...

লিখেছেন লিখেছেন egypt12 ২৬ নভেম্বর, ২০১৬, ০৬:১৯:৩০ সন্ধ্যা



১. একটি সন্তানের জন্ম...

নব দম্পতির সংসারে খুশির ফোয়ারা। নতুন মানব শিশুর জন্ম পৃথিবীর সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ঘটনা। কথায় আছে জন্ম হোক যথা তথা কর্ম হোক ভালো। তাই পৃথিবীর কোন নব জাতক যে-কোন বিস্ময় হয়ে উঠে, তা কেউ জানে না। আবার তেমনি কেউ নিজের পরিবার, সমাজ, ধর্ম ও পিতা-মাতার সম্মান ধুলায় লুটায়,এমনকি জন্মদাতা/দাত্রীর কোন কাজে আসেনা,উল্টো কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

আসলাম মাহমুদ একটি বেসরকারী এনজিও’র টাইপিষ্ট। তার বাবা অশিক্ষিত ও গরিব হলেও বহু কষ্টে তাকে ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত পড়াশুনা করিয়েছেন। আসলামের বিয়ের কিছুদিন পরেই তার মা পরকালে পাড়ি জমান,আর মায়ের মৃত্যুর পর হতে পিতাও অসুস্থ। প্রতিদিনই ঔষধের প্রয়োজন পড়ে।

সেই ২০০৭ থেকে দ্রব্য-মূল্যের উপর যে খড়ার ঘা পড়েছে তা আসলামের মত প্রান্তিক পেশাজীবীদের জীবনকে দূর্বিসহ করতে করতে বর্তমানে সন্ধিক্ষণের প্রান্তিক রেখায় এনে দাঁড় করিয়েছে;এর মাঝে গেছে শেয়ার বাজার ধ্বস, ফটকা এম.এল.এম এর প্রতারণা ইত্যাদি। যা অন্যান্য বাংলাদেশীদের মত আসলামের জীবনেও প্রাণঘাতী হয়ে দেখা দিয়েছে। এই বিষয় গুলোই হয়তো তাকে এমন জঘণ্য সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছে।

আসলামের মনে পড়ে তারা দুই বোন, এক ভাই। তাদের নিয়ে মা-বাবার কঠোর শ্রমও নিজের চোখে ভেসে উঠে। তার মা ঘরের সবাইকে খাইয়ে কত বেলা যে উপোষ করেছে তার ইয়াত্তা নেই। আসলে মায়েরাই পারে সংসারের জন্য এমন ত্যাগ স্বীকার করতে। আসলাম মা-বাবার ছোট সন্তান ও একমাত্র পুত্র সন্তান হওয়ার সুবাদে একটু বেশী বায়না প্রবণ ও জেদী ছিল। তার প্রায় সকল চাওয়াই গরীব চাষা বাবা পুরণ করতে চেষ্টা করত। বিশেষ করে একদিনের স্মৃতি তার চোখে বেশী ভাসে। তার এস.এস.সি. পাশের পর তার বাবা নিজের রক্ত বিক্রয় করে প্রতিবেশীদের মন ভরে মিষ্টি খাইয়েছিলেন! যা পরে সে তার মায়ের কাছ থেকে শুনেছিল। এই স্মৃতি মনে পড়তেই সব সময় তার চোখ অশ্রু সজল হয়ে উঠে। এভাবেই পৃথিবীর সকল আসলামেরা মা-বাবার আন্তরিক ত্যাগ, তিতিক্ষা ও ঘামের বদৌলতে বেড়ে উঠে।

২. আসলাম বাবার পছন্দের মেয়েকেই বিয়ে করে। বিয়ে পরবর্তী জীবনও ভালোই চলছিল, আর বৌ রূপী মেয়েটিও খারাপ নয়, তাদের সংসারের সাথে ধীরে ধীরে নিজেকে মানিয়ে নিচ্ছে। মাঝে দীর্ঘদিন কিডনীর সমস্যা জনিত রোগে ভোগা মা পরকালের বাসিন্দা হয়ে গেলেন। পরিবারের কারো মৃত্যু জীবনের ছন্দকে সাময়িক থামিয়ে দিলেও জীবনের আমোঘ নিয়মে তা আবার নতুন ছন্দে চলা শুরু করে, এটাই বিধির নিয়ম। তাই স্বেহময়ী মা’কে হারিয়েও আসলামের জীবন আস্তে আস্তে ছন্দে ফিরে আসে... কিন্তু তার বাবা আমজাদ আলীর মনে ঐ মৃত্যুর গভীর দাগ ঠিকই রয়ে যায়। যদিও তিনি নাতি-নাতনীর মুখ দেখে দিনগুলো কাটিয়ে দিচ্ছেন। আসলে স্বামী-স্ত্রী’র সম্পর্কে থাকে বেহেস্তী আবেশ,দিনে দিনে দু’টি প্রাণ কিভাবে যে একে অপরের প্রয়োজনে পরিণত হয়, তার ব্যাখ্যা শুধু ভাগ্যের লিখকই ভালো দিতে পারবেন। মানুষের সীমাবদ্ধ চিন্তাশক্তি এর ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম নয়।

ধীরে ধীরে আসলামের সংসার বড় হয়ে উঠে... সাথে বাড়ে আয়-ব্যয়ের অসঞ্জস্যতা ও সংসারের টানাটানি। আজকাল সংসার সামাল দিতে হিমসিম খেয়ে আসলামের স্ত্রী সুলতানার ধৈর্য চ্যুতি ঘটেছে... সে এখন বৃদ্ধ শ্বশুরকে বোঝা ভাবতে শুরু করেছে। তাই সে স্বামীকে বাবার বিরুদ্ধে প্রায়ই কান পড়া দেয়, ফলে, সে (আসলাম) ইদানিং বাবার সাথে তার ব্যবহার কর্কশ থেকে কর্কশ করছে। বৃদ্ধ ও অসুস্থ আমজাদ আলীর যাওয়ার কোন জায়গা নেই, কারণ মেয়েদের অনেক ইচ্ছা থাকলেও তাদের সংসারও অভাব-অনটনের সংসার। তা ছাড়া বাড়ী ছেড়ে যেতে ও সুদের মায়া অর্থাৎ নাতী-নাতনী’র মায়ার বাধাও কম বড় নয়। তাই, স্ত্রীর কথা মনে পরার কারণে তাঁর মন খারাপ হলে তিনি নাতী-নাতনীদের জড়িয়ে ধরে অশ্রু ঝরান, স্মৃতি রোমন্থন করেন ও নফল নামাজ পড়েন। তাঁর চোখে ভাসে জীবনের শত ভুলভ্রান্তি ও সুখের স্মৃতি। যে ভুল আজ শোধরানোর সুযোগ নেই, যে সুখ গুলোও আজ ফিরে পাবার পথ নেই; আজ আছে শুধু প্রস্থানের নিরব প্রতীক্ষা।

আমজাদ আলীর ইনহেলার শেষ হয়ে গেছে, সাথে উঠেছে হাঁপানির টান। সন্ধ্যায় ছেলে বাড়ী আসলে তাকে তা জানাতেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে এবং শারিরিক ভাবেও লাঞ্ছিত করে। এভাবেই চলতে থাকে কিছুদিন... আর এই খবর পৌঁছে যায় মেয়েদের শ্বশুরবাড়ি এবং তারা বাবার পক্ষে বাড়ি আসে ফলে ঘটনা পারিবারিক সালিশ হয়ে গ্রাম্য সালিশে গড়ায়। কিন্তু আসলাম স্ত্রী’র প্ররোচণায় শালিসের রায় মানলো না, তবুও আমজাদ আলী যথারীতি ছেলের কাছেই থেকে যায়। যেখানে তাঁর কাছে মেয়ে জামাইদের কাছে থাকার পথও খোলা ছিল, তবুও আত্মমর্যাদা ও নাতি-নাতনির টানে সে নিজ বাড়ীতেই রয়ে যায়।

পরদিন সকাল...

আসলাম তার অসুস্থ বাবার ঘুম ভাঙ্গার আগেই তাকে ঘুম থেকে টেনে তুলে বাড়ী থেকে বের হয়ে যাবার জন্য শাসাতে লাগলো। ভোরে এই চিৎকার-চেঁচামেচিতে শিশুদের ঘুমও ভেঙ্গে গেল। তারা দাদার এই অবস্থা দেখে দাদাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। কিন্তু দুনিয়ার মোহে অন্ধ আসলাম হেঁচকা টানে তার বাবাকে তুলে বাড়ির ঘাটার দিকে নিয়ে যেতে লাগলো। যখন তাকে নিয়ে পুরনো আম গাছটি অতিক্রম করলো তখন আমজাদ আলীর কান্না বন্ধ হয়ে গেল, এবং শান্ত কন্ঠে ছেলেকে বললো... দাড়া বাবা- “আমি বুঝেছি, আজ তুই আমাকে বাড়ী থেকে বের করেই ছাড়বি। আমিও তোদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আমার অসুস্থ বাবাকে বাড়ী থেকে বের করে দিতে মারতে মারতে এখান পর্যন্ত এনে ছেড়ে দিয়েছিলাম। সেই শোকে বাবা আর বেশীদিন বাঁচেন নি;আমিও অসুস্থ হয়ত আমার দিনও শেষ হয়ে এসেছে। বাপজান, নাতি-নাতনিদের একটু কাছে আসতে দে,শেষ বার আদর করে যাই। না, দূর হও আর আমাকে হালকা কর... এই বলে সে বাবাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিল। পরদিন সকালে আসলাম গোসল ও নাস্তা সেরে অফিসে চলে গেল এবং সন্ধ্যায় ফিরে এলো।

আজ আসলামের মন খুব খারাপ হলেও সুলতানা আছে খোশ মেজাজে। আজ সারাদিন সে এফ.এম. রেডিও’তে গান শুনে কাটিয়েছে ও সাধ্যমত সেজেছে। তখন রাত আটটা বেজে ত্রিশ মিনিট, আসলাম বারান্দায় বসে মুকসুদুল মুমিনীন পড়ছে, আর সুলতানা তার একমাত্র ক্লাস ফোর পড়ুয়া ছেলেকে বাংলা পড়াচ্ছে, যা তার (আসলামের) কানে আসছে। সে শব্দার্থ পড়ছে... অর্ধচন্দ্র, অর্ধচন্দ্র, অর্ধচন্দ্র, অর্ধচন্দ্র; মা অর্ধচন্দ্র কি? সুলতানাঃ ঘাড় ধাক্কা দেওয়া; ছেলেঃ মানে? সুলতানাঃ মানে এইটা (সে সন্তানের ঘাড়ে হাত দিয়ে হালকা করে অর্ধচন্দ্র দিয়ে দেখালো)।

ও বুঝেছি সকালে আব্বু দাদুজানকে শেষ মুহুর্তে যেভাবে বের করে দিয়েছিল ওটাই কি অর্ধচন্দ্র? চুপ পড় বেয়াদপ... শিশুটি চুপ হয়ে গেল এবং তার চোখ দাদার স্মৃতি কাতরতায় অশ্রুতে ভরে গেল।

কিছুক্ষণ পর... সুলতানা ছোট মেয়েকে দুধ পান করাচ্ছে,ঠিক সে সময় ছেলে উঠে গিয়ে কোন কথা না বলে আসলামের ঘাড়ে জোরে ধাক্কা দিয়ে বসল এবং বললো বাবা “এটা অর্ধচন্দ্র”; বলেই খিল খিল হাসতে লাগলো...

ছোট ছেলে মজা করেছে ঠিকই, এখানে আর কোন বিষয়ের উপস্থিতি না থাকলেও এই ঘটনার আকস্মিকতা তাকে হত বুদ্ধি করে দিল এবং তার পুরো শরীর হঠাৎই শিহরিত হয়ে উঠল... সুলতানা মেয়েকে রেখে দৌড়ে এসে ছেলেকে কঠিন ভাবে শাসন করতে লাগলো। কিন্তু আসলাম শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে... অগ্যতা সে কিছুই না বলে দৌড়ে বাড়ী হতে বেরিয়ে গেল...

৩. রাত থেকে গভীর রাত অতঃপর ভোর; আসলাম তার বাবাকে হন্যে হয়ে খুঁজেছে, কিন্তু পায় নি। কিছুক্ষণ পর খবর এলো চৌধুরীদের পুকুরে একটি লাশ ভাসছে... সে দৌড়াতে দৌড়াতে পুকুর পাড়ে পৌঁছেই পুকুরে ঝাঁপ দেবে এমন সময় মানুষ তাকে ধরে ফেললো এবং বললো পুলিশ আসুক তারাই তুলবে। লাশটি উপুড় হয়ে ভাসছে, পরনে পাতলা স্যান্ড্রু গেঞ্জি ও লুঙ্গি। একটু দেরীও তার সহ্য হলো না, সে সবাইকে ধাক্কা দিয়ে পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ে অনেক কষ্টে লাশটি তুলে আনলো। কিন্তু আনার পর দেখা গেলো এটি মদখোর কেনু পাগলার লাশ!

অতঃপর আসলাম ক্লান্ত হয়ে বাড়ী ফিরে আসছিল... সে দেখলো গ্রামের কেউ তার সাথে কথা বলছে না,বরং ঘৃণায় তাকে এড়িয়ে যাচ্ছে। সে বাড়ী এসে কিছুই খেলো না, এভাবে দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে এসেছে এবং আজ প্রথমবার সে অতি রাগে স্ত্রী’র গায়ে হাত তুলেছে।

তার স্ত্রী’ও ভুল বুঝতে পেরে দহনে জ্বলছিল...

রাত সাড়ে সাতটা...

বাড়িতে আসলামের মামা, মামাতো ভাই ও বোন জামাইয়েরা উচ্চ কন্ঠে আসলামকে ডাকছে। তাদের সবাই খুব ক্ষুব্ধ এবং হাতে বাঁশের লাঠি এবং তাদের সাথেই এসেছেন আমজাদ আলী; যিনি তাদের রাগ নিবারণের চেষ্টা করছেন। আসলামের কানে অন্যদের হাঁক-ডাকের পাশাপাশি বাবার কণ্ঠও এলো এবং সে দৌড়ে বাড়ী থেকে বের হয়ে, কে কী বলছে তা না শুনেই তীব্র আবেশে বাবার পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো... এই দৃশ্য দেখে অন্যরা কিংকর্তব্যবিমূড় হয়ে চুপ হয়ে গেল। পিতা-পুত্রের এই মিলনের ক্ষণে দুজনের কান্না শান্ত রাতের নিরবতা ভেঙ্গে দিল এবং ইতিমধ্যে সুলতানাও শ্বশুরের পায়ে পড়ে ক্ষমা চাইতে লাগলো। বটবৃক্ষের কাজই হলো ছায়া দেয়া, তাই আমজাদ আলী সবাইকে ক্ষমা করে দিলো আপন অভিভাবকত্বের মহানুভবতায়। এভাবেই তাদের জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু হল।

[নিয়তির লিখন বড়ই নির্মম, সবাই প্রায়শ্চিত্বের সুযোগ পায়না। তাই আমজাদ-আসলাম ও সুলতানা রূপী সকলের উচিত সাবধানে পা ফেলা ও প্রায়শ্চিত্বের সুযোগ এলে তা হাতছাড়া না করা,কারণ... এ সুযোগও বার বার আসে না]

বিষয়: সাহিত্য

১৩৬৬ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

380166
২৬ নভেম্বর ২০১৬ রাত ১০:০২
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ
২৭ ডিসেম্বর ২০১৬ বিকাল ০৫:২৯
315154
egypt12 লিখেছেন : আপনাকেও Love Struck
380172
২৬ নভেম্বর ২০১৬ রাত ১০:১২
সন্ধাতারা লিখেছেন : Salam. Excellent analysis mashallah. Jajakallahu khair.
২৭ ডিসেম্বর ২০১৬ বিকাল ০৫:২৯
315155
egypt12 লিখেছেন : Love Struck Love Struck Love Struck
380199
২৭ নভেম্বর ২০১৬ দুপুর ০১:২৯
মাহবুবা সুলতানা লায়লা লিখেছেন : আস-সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু! শিক্ষনীয় লেখা। আপনার দোয়ার সাথে আমিন॥
২৭ ডিসেম্বর ২০১৬ বিকাল ০৫:৩০
315156
egypt12 লিখেছেন : Thanks apu
380226
২৭ নভেম্বর ২০১৬ রাত ১১:১১
আফরা লিখেছেন : শিক্ষনীয় গল্প খুব ভাল লাগল ধন্যবাদ ।
২৭ ডিসেম্বর ২০১৬ বিকাল ০৫:৩০
315157
egypt12 লিখেছেন : আপনাকেও ধন্যবাদ

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File