"পাপ"

লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মাদ আবু মুছা ১৪ জানুয়ারি, ২০১৭, ১১:১৪:১০ সকাল



".....আছছালাতু খাইরুম মিনান নাঊম।....." মধুমাখা আযানের সম্মোহনী সুর যেনো কর্ণকুহর থেকে প্রবেশ করে হৃদয়ের গভীরে নাড়া দিলো রফিক সাহেবের।অনেক দিন হয়ে গেছে ফজরের নামাজ পড়া হয় না তার। সারাদিন সরকারী চাকুরীতে ডুবে থেকে বৈধ- অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়তে পেরেছেন তিনি। দিন শেষে ক্লান্ত হয়েও অধীর আগ্রহে ঘরে ফিরেছেন একটি মুখে হাসি দেখার নেশায়। বুঝতেই পারেননি যে গর্ত তিনি পুরণ করতে চেয়েছেন তা পুরণ হবার নয়। একে একে জীবনের সোনালী দিনগুলো ঝরে গেছে তার। অস্তাচলে এসে যে বিদঘুটে বাস্তবতার শিকার হয়েছেন তিনি তা ঘুণাক্ষরেও যদি তিনি আন্দাজ করতে পারতেন তাহলে এ মরিচীকায় পা মাড়াতেন না।দু'ফোঁটা তপ্ত অশ্রু বেয়ে পড়লো কানের পাশ দিয়ে। আজ কেন এতটা অসহায় মনে হচ্ছে তাকে ? তার তো অনেক কিছুই ছিলো। আজ তিনি কি নিঃস্ব ? কিছুই নেই তার ? হ্যা, সত্যিই রফিক সাহেব আজ সহায়হীন। নেই স্ত্রী-পুত্র-পরিজন, নেই কেউ নেই। না, নেই বললে ভুল হবে। তারা আছে, কিন্তু তার আর তাদের মাঝে দাঁড়িয়ে গেছে পাপের দেয়াল। যা ভাঙ্গার নয়। নয় অতিক্রম করার। স্মৃতির শর্পিল কাচগুলো রফিক সাহেবের হৃদয়কে ঝাঝরা করছে শুধু। চোঁখ সর্বরাহ করছে নোনা জল যা কৃতকর্মে প্রত্যেক পাপীকেই পরিশোধ করতে হয়।

রেণু। তখন সবে মাত্র ইন্টারমেডিয়েট পড়ছে। উচ্চবিত্ত পরিবারের মেয়ে। চলা ফেরায় বেপরওয়া। দেখতেও বেশ। সেদিন মাস্টার্স ফাইনাল ইয়ার পরীক্ষার সময় প্রথম রেণুর সাথে সাক্ষাত হয়েছিলো রফিক সাহেবের। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হলেও রফিক সাহেবের চাল চলনে ছিলো বাবার ঘাম ঝরানো উপার্জনের যাচ্ছেতাই ব্যবহার। একটি সরকারী অফিসে কেরাণীর চাকুরী করতেন বাবা। অবসরে গেছেন আজ বছর পাঁচেক হলো।একমাত্র পুত্রধনের জন্য নিজের সর্বস্ব উৎসর্গ তার। বাবার পেনশনের টাকায় রফিক সাহেবের ভালোই দিনকাল যাচ্ছিলো। মাস্টার্স শেষে ল্যান্ড সার্ভে তে ভালো পদে সরকারী চাকুরীও ঝুটে, কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে যায় বেশ। ছেলেকে নিয়ে যে বাবা গর্ব করবেন, একমাত্র সন্তানের উপার্জণ দেখে যে বাবার চোঁখে আনন্দাশ্রু বয়ে যাবার কথা। সে বাবা নিভৃতেই বিদায় নিয়ে নেন ইহলোক থেকে। না, জননীও বেশিদিন রফিক সাহেবের বোঝা হয়ে থাকননি। মহান প্রভুর সান্নিধ্য পেতে তিনিও বিলম্ব করেন নি বেশি। চিরতরে চোঁখ বুজেছিলেন তারা।না , রফিক সাহেবের কাছে এটা প্রকৃতির বিধান। স্রষ্টার অামোঘ নীতি । এখানে তার কি ই বা করার আছে। গ্রামের অজঁপাড়া গায়ে জীর্ণ কুটিরে থেকে একসময় যে জনক রফিক সাহেব কে আকাশ ছোয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। জীবনের পরতে পরতে বটবৃক্ষের ন্যায় আগলে রেখেছিলেন। যে জননী তার হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসায় তার পুষ্পিত ভবিষ্যত নিশ্চিত করেতে ব্যকুল ছিলেন। সেই তাদের মহা প্রস্থানও আজ রফিক সাহেবের কাছে নিছক প্রকৃতির আইন। হায় নিষ্টুর পৃথিবী! এদিকে রেণুর সাথে সম্পর্কের গভীরতা বাড়ছিলো। শহরের নামিদামি রেস্টুরেন্টে প্রায়ই দেখা মিলতো তাদের। রফিক সাহেব বিয়ের প্রস্থাব দেন রেণুর পরিবারে। রেণুর বাবা আপত্তি তুলেছিলেন, কিন্তু ছেলে সরকারী চাকুরীজীবি। মেয়ে সুখে থাকবে। সেক্ষেত্রে রেণুর মায়ের সিদ্ধান্তে বাঁধ সাধতে পারলেন না রেণুর বাবা। দিনক্ষণ ঠিক হলো। রফিক সাহেবের অভিভাবক বলতে তার কয়েকজন বন্ধুবান্ধব। নির্ধারিত দিনে বিয়ে হলো রফিক সাহেবের। নববধূর সাজে রেণুর আগমন ঘটলো। হুম ভালোই চলছিলো তাদের দিনকাল।

সংসার আর প্রেম এক জিনিস না। তফাৎ বিস্তর। কিছুটা অর্বাচীনও। রফিক সাহেব স্থির চিত্তে চিন্তা করলে হয়তো দাম্পত্যের প্রথম প্রহরেই সেটা আচ করতে পারতেন। কিন্তু সে চেষ্টা করেননি মোটেও। ঘোরে ছিলেন তিনি। রাঙ্গা প্রভাতের নেশায় বুধ।প্রত্যহ কাজের চাপে ন্যুয অবস্থা, কিন্তু ক্লান্তি নেই। রেণুর মুখ মলিন দেখাবে। এ তিনি হতে দেবেন না। একে একে বসন্তেরা আসে। অবলীলায় সৌন্দয্য বিলায়। অতঃপর নিভৃতে প্রস্থান করে। বসন্তের পরে আসে শীত। ঘন কুয়াশা। শীর্ন প্রকৃতির প্রতিটি বস্তু যেনো কুয়াশার শ্বেত শুভ্র চাদরে ঢেকে নেয় নিজেকে।জীবন তাত্থেকে ব্যতিক্রম নয়। রফিক সাহেবও আচ করতে লাগলেন। তার বসন্ত ফুরিয়ে এসছে। বয়স হয়েছে কিছুটা। রেণুর সাথে দাম্পত্যের পাঁচটি বছর কেটেছে। ইতোমধ্যে তাদের সন্তানটি বছর তিনেকের পার করেছে। ভালোই ছিলো। মূলত, ভালো মন্দ যাচাই করেননি তিনি এতোকাল। যা করেছিলেন এখন মনে হচ্ছে তা ছিলো পাগলামী। বড্ড বোকামী।রেণুর সাঁড়া সেরকম নেই এখন। অনেকটা ইগনোরই করে। রফিক সাহেবও কিছু একটা খোঁজার চিন্তা করেন, কিন্তু জিজ্ঞেস করার সাহস হয় না। মলিন মুখে সকালে কর্মস্থলে যান, সন্ধ্যায় ফেরেন বাসায়। ইদানিং, রেণুকে বাসায় ফিরে পাননা মাঝেমধ্যে। বলে, আত্মীয়ের বাসায় বেড়ানোর কথা। মেনে নেন রফিক। তার বলার কিছুই যেনো নেই।এভাবে আর কত। সমাধান খোঁজতে থাকেন রফিক সাহেব। একদিন সাহস করে বলেই দিলেন নিজের সংশয়ের কথা। তারপর কি হয়েছিলো সেটা নাই বা বললাম। এতটুকু জানা প্রয়োজন যে, রফিক সাহেব বুঝতে পেরেছিলেন তার অস্তিত্বের দৈন্যতা।ভিন্ন গন্তব্যে জীবন। বড় অনাকাঙ্খিত এ যাত্রা। রেণুর জায়গা চলে যাচ্ছে ভিন্ন কোন নন্দিনীর দখলে। তবে, ভুল ছিলো সেখানেও। চিন্তার ভুল। পাপ যেনো পূর্ণতার দিকে ধাবিত হচ্ছে। আপাত উৎফুল্য রফিক সাহেবের জীবনে অমাবশ্যা তিথি আসতে পারে তখনও তা আন্দাজ করা যায়নি।

নাবিলা রফিক সাহেবের অফিসে জয়েন করেছে ক'দিন হলো। পদবী সহকারী। নাবিলা সুন্দরী, স্মার্ট। দৃষ্টি কাড়তে সময় বেশি লাগেনি। রফিক সাহেব বিবাহিত সে তা জানতো না। কথা-বার্তা, কফি ব্রেক, এই সেই করতে করতে সম্পর্কের গভীরতা বাড়লো। হুম, আবারো রফিক সাহেব সেই বন্ধুর, দূর্গম ও উদ্দেশ্যহীন পথে। ভাবলেশহীন জীবন। তার মনোজগত এখন কিছু হারানোর ভয় করে না। আছে কি ? আর যাবেই বা কি ? নৈতিকতা, আত্মসম্মান, সংসার কোন কিছুই তো পূর্ণতা পায়নি তার জীবনে। এবার নাবিলার জীবনে যতদিন টিকা যায় ততদিনই চলুক অনাকাঙ্খিত জীবনের গদ্যময় যাত্রা।দ্বি-মেরু সম্পর্কে রফিক সাহেবের সংসারে তেমন প্রভাব পড়েনি। সবাই যার যার মতো চলছে। রেণুও কোন ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলায় না। রফিক সাহেব রাত করে বাসায় ফেরেন, রেণুও। দুজনের স্থান কাল ও পাত্রে ভিন্নতা থাকলেও গন্তব্যে নেই। একেবারেই একাকার।বছর খানেক পর, নাবিলার পরিবার থেকে বিয়ের চাপ বাড়ছে। রফিক সাহেবও তাকে আশ্বস্থ করতে নিজের উপার্জন করা সম্পদের বিশাল একটি অংশ নাবিলার নামে গিফ্ট করে দিয়েছেন। দিন গড়াচ্ছে দ্রুত। পাপ অনেকটাই ষোল কলায় পূর্ণ। এবার দেখা যাক রফিক, রেনু, নাবিলাদের জীবনের গল্প কোন দিকে মোড় নিয়ে পরিণতি প্রাপ্ত হয়।

নাবিলার সাথে কোর্ট ম্যারেজের সিদ্ধান্ত নিলেন রফিক সাহেব। দিনক্ষণ ও নির্ধারিত। উচ্ছাসে উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটলেন তিনি। অফিস ছুটি। গন্তব্যে রফিক - নাবিলার স্বপ্ন। সিএনজির ভাড়াটা পরিশোধ করে দ্রুত পায়ে হাটলেন পার্কের দিকে। ওখানটায় নাবিলার অপেক্ষমাণ থাকার কথা। মনে হয় বেচারী বিরক্ত হয়ে গোমরা মুখে বসে আছে।না, নাবিলা আসেনি এখনও। রফিক সাহেব এদিক ওদিক খোঁজ করতে লাগলেন। নাহ, কোথাও তো দেখা যাচ্ছে না। তারপর কিছুক্ষণ কাটলো নিরবতায়। অপেক্ষার প্রহর। নাবিলা আসবে। তারপর দু'জনের জীবনে বিকশিত হবে অনন্য এক জগতের প্রত্যাশা।একে একে ঘন্টা পেরুলো। সেই বসেই রয়েছেন। খানিকটা চিন্তার রেখা। ধীরে ধীরে চিন্তার গভীরতা যেমন বাড়ছে তেমনি তা রুপ নিচ্ছে দুশ্চিন্তায়। তারপর অন্ধকার। হায়, গাড় কালো অন্ধকার। পালিয়েছে নাবিলা। নাবিলার ফোন সুইচড অফ। হুম, সে নিরুদ্দেশ হয়েছে। এবার আফসুস করেন, আর বিলাপ করেন কি লাভ তাতে ? যেখানে জীবনের স্মারাংশ বিশ্বাসে, সেখানে সম্পদ কেবল লোভই বৃদ্ধি করে। এ সত্য রুঢ় বাস্তব অমাবশ্যায় রুপান্তরিত হলো।না, পাপের প্রায়শ্চিত্ত এখানেই হয়ে যায়নি। রেণুও পাড়ি জমিয়েছে ভিন্ন গন্তব্যে। ভিন পুরুষের হাত ধরে নিরুদ্দেশ হয়েছে সে ও। ছেলেটা মাদকাসক্ত হয়ে নিকটিনে ভরপুর করছে ঘর। এবার ভাড়া করা বাসাটি কেবল ই মানুষ নামের কিছু কলঙ্কিত মুখাবয়বের স্মৃতি হয়ে রয়েছে। রফিক সাহেব আজ সত্যিই নিঃস্ব। বড় অসহায়।কানের পাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়া তপ্ত অশ্রু শীতল হয়ে শুকিয়ে গেছে বালিসের সাথে। স্মৃতির কলঙ্কিত পাতা থেকে সম্বিত ফিরে পেলেন রফিক সাহেব। নাহ, ইহজগতে নয়। এ যাত্রা দূর্গম, একেবারেই না ফেরার।লাশ জানাজার জন্য নেয়া হলো আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের তদারকিতে। কফিনের এক পাশে ধরেছে ছেলে। রফিক সাহেব চলছেন শেষ গন্তব্যে। পাপের পরিণাম কি এখানেই শেষ ? নাকি পরজগতে অপেক্ষমাণ আরো জঘন্য পরিণতি কে জানে।

.

লাশ বহনকারীদের মুখ থেকে আওয়াজ শুনা যাচ্ছে "আফাহাসিবতুম আন্নামা খালাকনা কুম আবাছাও ওয়া আন্নাকুম ইলাইনা লা তুরজাঊন......."

বিষয়: সাহিত্য

১১৫৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File