কবর-৭৬ (সত্য ঘটনা অবলম্বনে)

লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ১৪ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:১৮:২০ দুপুর

সালাম পৃথিবী

২৭ জুলাই, ২০০৬ সাল। যমুনা এক্সপ্রেস ট্রেন। টয়লেটের সামনে মেঝেতে একটা পাগল কাঁথামুড়ি দিয়ে পরে আছে। প্রায় জটাধরা উসকু খুসকু লম্বা চুল, গোফ দাড়িতে নাক মুখ ঢেকে আছে। পাগলটা হয় ঘুমিয়ে আছে অথবা বেহুশ হয়ে পরে আছে। তার পাশের স্থানটুকুতে কফ কাশ ও দলা দলা রক্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ঘেন্নায় মানুষ সেখান থেকে সরে গেছে। পাগলের সাথের বাচ্চাটা দাঁড়িয়ে ফাঁকা স্থান পেয়ে হাঁটাহাঁটি শুরু করেছে। সে কখনো পাশের বগিতে যাওয়ার দরজায় চলে যাচ্ছে কিন্তু সেখানে থাকা লোকজন তাকে আটকে দিচ্ছে। আবার কখনো উঠানামার দরজায় চলে যাচ্ছে কিন্তু সেখানে থাকা লোকজন তাকে আটকে দিচ্ছে আর হায় হায় করছে, কী সর্বনাশ বাচ্চাটা যেভাবে দৌড়াদৌড়ি করছে নীচে পরে যাবে তো। তারা বুঝতে পারছে না বাচ্চাটা কার, পাগলের নাকি অন্য কারো। কয়েকজন যাত্রী ‘বাচ্চাটা কার, বাচ্চাটা কার’ বলে ডাকাডাকি করল, কিন্তু কেউ সাড়া দিল না। কেউ কেউ বলল বাচ্চাটা সম্ভবত এই পাগলের। কেউ বলল, হ্যাঁ পাগলটারই হবে। দেখেন না বাচ্চার কাপড়েও পায়খানা ও কফ কাশ রক্ত লেগে আছে আর কেমন মলিন রোগা দেখা যাচ্ছে, পাগলের অবস্থা ও বাচ্চার অবস্থার মধ্যে মিল আছে।

কেউ বলল, ‘কিন্তু পাগলা বাচ্চা কোথায় পেল, পাগলের আবার বাচ্চা থাকে নাকি’। একজন চুটকি কাটল, ‘আরে ভাই এসব পাগল হল ভাবের পাগল, আসল কাজে সবাই কাজী। একজন বলল, ‘এত কাজী হলে তার কাজিনী (বউ) কোথায়, বাচ্চা এভাবে কেন’? আরেকজন বলল, ‘সেও হয়ত আরেক পাগলের সাথে ভাব জোড়েছে। কেন, মানিক বন্দোপধ্যায়ের ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পটা পড়েননি, পাগল বলেন আর ছাগল বলেন এ খেলায় সবাই কিন্তু ভাবের ভাবী’ সবাই হাসতে লাগল। কয়েকটা যুবক ছেলে দাঁড়িয়ে ছিল, একজন বন্ধুকে খোচা দিয়ে বলল, ‘হায়রে শালার কপাল, জীবনে ভাবও করলাম না, ভাবীও হতে পারলাম না। একটা পাগলেরও বাচ্চা আছে আর আমাদের কিছুই নাই’ বলে সে হাসতে লাগল। একজন পৌঢ় ভদ্রলোক বললেন, ‘সবাই হাসাহাসি করলে তো চলবে না বাচ্চাটার তো একটা গতি করতে হবে। ওকে কিছু খেতে দেন না।

ট্রেনে খাওয়ার জন্য অনেকেই কলা পাউরুটি বিস্কুট ইত্যাদি কিনে ব্যাগে রাখে। একজন একটা কলা ছিলে এগিয়ে দিল আর বাচ্চাটা খপ করে ধরে তা গপগপ করে খেতে লাগল। যাত্রীরা বুঝল তার ক্ষিধে পেয়েছে। তখন যার কাছে যা ছিল খেতে দিল। কেউ ফেরিওয়ালার কাছ থেকে কিনে কলা বিস্কুট চানাচুর ইত্যাদি যে যা পারল দিতে লাগল। বাচ্চাটা ক্ষুধার তাড়নায় কিছুক্ষণ গোগ্রাসে খেয়ে মাম মাম (পানি) করতে লাগল। লোকেরা বুঝল পানি খেতে চাইছে। একজন বোতল খোলে দূর থেকে হাত বাড়িয়ে বোতলটা বাচ্চার মুখে ধরল সে এক নিঃশ্বাসে অনেকটা পানি পান করল। বাচ্চাটাকে দেখে সকলের মায়া হল, তারা বুঝতে পারছিল মেয়েটা অনেক সময় ধরে কিছু খায়নি। কারো কারো হয়ত একটু আদর করতে বা কোলে নিতে মন চাইছিল কিন্তু তা সম্ভব ছিল না, কারণ তার কাপড় চোপড়ে কফ, কাশ ও রক্ত লেগে আছে এবং শরীরে পায়খানা মেখে শুকিয়ে রয়েছে। যাত্রীরা বাচ্চাকে দেয়া কলা পাউরুটি বিস্কুট মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে আছে। একজন সেগুলি কুড়িয়ে পাগলের কাছে রাখল।

সবাই বলাবলি করতে লাগল, ‘পাগলটাকে তোলেন, বাচ্চাটা এভাবে থাকলে তো নীচে পরে যাবে। আর আমরাও তো সারাক্ষণ থাকছি না, আস্তে আস্তে তো সবাই নেমে যাচ্ছে, তখন বাচ্চাটার কি হবে। সবাই দু’দিক থেকে এই পাগল এই পাগল বলে ডাকতে লাগল কিন্তু কাছে আসছে না। কারণ তার দু’পাশে কফ কাশি ও রক্ত, আবার তার কাঁথা ও গায়ে বাচ্চার পায়খানা লেগে আছে। যাত্রীরা অনেকক্ষণ ডাকাডাকি করল কিন্তু পাগলের সাড়া নাই। একটা যুবক ছেলে ‘নাঃ, এভাবে হবে না’ বলে এগিয়ে গেল, তারপর বুট জুতা দিয়ে পাগলের পায়ে গুতাতে লাগল। তবুও পাগলের হুশ নাই, ছেলেটা একটু চমকে উঠে বলল, ‘আবার মরে গেল নাতো’ তারপর বুট দিয়ে পায়ের উপর পাড়া দিতে লাগল। প্রচণ্ড ব্যথায় পাগলটা ককিয়ে উঠল, তারপর উঠে বসল, এবার যাত্রীরা আশ্বস্ত হল। একজন ধমকে উঠল, ‘এই শালা পাগল, বাচ্চাটাকে এভাবে ছেড়ে রাখছ কেন, যাত্রীরা না থাকলে তো এতক্ষণে ট্রেনের চাকার নীচে থাকত।

পাগলের গায়ে এতক্ষণে চেতনা ফিরল। সে দ্রুত হাত বাড়িয়ে খপ করে বাচ্চাটাকে নিয়ে প্রচণ্ড জোরে বুকে চেপে ধরে ফুফিয়ে কাঁদতে লাগল। যাত্রীদের কেউ বলল, ‘এই পাগলা বাচ্চা কার, তোমার নাকি কোথাও থেকে চুরি করেছ’? একজন ঠাট্টা করল, ‘সম্ভবত চুরি করেছে, নইলে পাগলের আবার বাচ্চা থাকে নাকি’? অন্যজন বলল, ‘সম্ভবত এই হালা শিশু পাচার কারী। পাগলের ভাব ধরেছে। নিজের বাচ্চা না তো এজন্যই এভাবে ছেড়ে রাখছে, বাচলে বাঁচুক মরলে মরুক’। আরেকজন বলল, ‘ঠিকই বলেছেন, নিশ্চয়ই এটা শিশু পাচারকারী। ওকে ছাড়া যাবে না, অবশ্যই পুলিশে দিতে হবে।

সেই পৌঢ় ভদ্র লোকটা এতক্ষন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে পাগলটাকে পর্যবেক্ষন করছেন। তিনি ধমকে উঠলেন, ‘আরে থামেন, আসলে আপনারাই পাগল হয়ে গেছেন, কোন পাচার কারী এভাবে পরে থাকে না। আর লোকটাকে ভাল করে দেখেন, ওর হাতের ঘড়িটা দেখেন, ওটা অনেক দামী ঘড়ি। ওর জামা, পাজামা দেখেন ওগুলো দামী কাপড়ের। কোন পাগলের গায়ে এমন দামী ঘড়ি আর জামা কাপড় থাকে না। আর বাচ্চাটা ওরই, নইলে এমন খপ করে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে এভাবে কাঁদত না। কত সম্ভ্রান্ত মানুষ বিপদে পরে নিঃস্ব সর্বহারা হয়ে যায়, লাঞ্চনার গভিরে পতিত হয় কে রাখে তার হিসাব। আল্লাহই জানে, কে এই বেচারা, কোত্থেকে এল, আর কিইবা তার হয়েছে, তবে এটা নিশ্চিত এই ব্যক্তি পাগল নয়। ভদ্রলোকের কথায় সকলের যেন চোখের পর্দা খুলল। তারা সবাই ভাল করে পর্যবেক্ষন করে বলাবলি করতে লাগল, ‘আসলে ঠিকই লোকটা পাগল নয়, আলামতে বুঝা যাচ্ছে সে গরীবও নয়, অশিক্ষিতও নয়। কোন হুযুর টাইপের লোক বলে মনে হচ্ছে’।

তখন তারা বাচনভঙ্গি পরিবর্তন করে জিজ্ঞেস করতে লাগল, ‘এই যে ভাই আপনি কোত্থেকে এসেছেন, কোথায় যাবেন। আপনার কি হয়েছে, এভাবে পরে আছেন কেন? আপনার তো হাসপাতালে যাওয়া দরকার’। কিন্তু পাগলটা বাচ্চার মাথায় চিবুক ঠেকিয়ে মাথা নিচু করে কেঁদেই চলেছে সে কোন উত্তর দিল না। কিন্তু মানুষ মানুষের বিপদে এগিয়ে আসে। তখন তারা বলতে লাগল, ‘আপনার বাড়ি কোথায়, আপনার কি আত্মীয়স্বজন নেই, এই বাচ্চা আপনার হলে এত ছোট বাচ্চা আপনার কাছে কেন, বাচ্চার মা কোথায়’? এই শেষ বাক্যটা শুনে হাসানের যেটুকু বা চেতনা ছিল তাও বিলুপ্ত হবার উপক্রম হল। তার মধ্যে কথা বলার মত শক্তি থাকল না আর কথাও বলল না। লোকেরা প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতে লাগল কিন্তু হাসান উত্তর দিল না। কারণ তার মধ্যে তেমন চেতনা ছিল না।

অবশেষে একজন এগিয়ে এসে বলল, আপনার সাথে মোবাইল থাকলে দেন আমি আপনার আত্মীয় স্বজনের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেই। পাগলটা বলল, নাই। আসলে সেটা পটেটো নিয়ে গিয়েছিল। তাহলে কোন নাম্বার বলতে পারবেন কি? সে দু’দিকে মাথা ঝাকাল। কারণ নাম্বার মুখস্ত থাকলেও বলার মত হুশ বা চেতনা তার মধ্যে ছিল না। যাত্রীরা অনেক চেষ্টা করে এটুকু উদ্ধার করতে সক্ষম হল যে, লোকটার বাড়ি ময়মনসিংহ, জামালপুর থেকে এসেছে, বাড়ি যাবে। তারা বলাবলি করতে লাগল কিন্তু ট্রেন তো বিমান বন্দর ছাড়িয়ে গেছে, এখন উপায়? বিমান বন্দর নামলেও তো হয়ত বাসে চলে যেতে পারত। একজন বলল, ‘এখন উপায় একটাই, চলতি ট্রেন থেকে তো আর নামতে পারবে না, তাই কমলাপুর গিয়ে অন্য ট্রেন ধরে ময়মনসিংস চলে যাবে। সবাই এই প্রস্তাব সমর্থন করল এবং পাগলকে জানিয়ে দিল কিন্তু হাসানের সেদিকে খেয়ালও ছিল না, তেমন চেতনাও ছিল না।

ব্যস্ত দুনিয়ার ব্যস্ত মানুষ, বিভিন্ন স্থানে একে একে যাত্রীরা নেমে যেতে লাগল। এর মধ্যে বাচ্চাটা বাবার কোল থেকে উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটতে চাইল। একজন ধমক দিয়ে উঠল, ‘আরে মিয়াঁ আপনি তো বাচ্চাটা রাখতে পারবেন না, মেয়েটা নীচে পরে যাবে। আরেকজন এগিয়ে এসে বলল, ‘এক কাজ করেন, বাচ্চার জামা আর আপনার কাঁথার কোণায় গিড়া দেন, তাহলে সে আর দুরে যেতে পারবে না’। তার চেতনা ফিরল ভালভাবে, তখন সে বাচ্চার জামা ও কাঁথায় গিড়া দিল। আর তখনই নজরে পরল তার পাশে কিছু কলা পাউরুটি ও বিস্কুট পরে আছে। সে বুঝতে পারল যাত্রীরা তার মেয়েকে দিয়েছে, দান করেছে, ভিক্ষে দিয়েছে। সাথে সাথে সে নিজের মাথাটা কোলে বসা মেয়ের মাথার পিছনে লুকিয়ে ফেলল। হায় অদৃষ্ট, সকালের আমির সন্ধ্যায় ফকির। এই দয়ালু যাত্রীরা জানল না, তারা কাকে ভিক্ষে দিল কেন দিল। এক অসহায় বাবার অসহায় অশ্রু গড়িয়ে পরে সন্তানের পিঠের উপর।

স্বরণ হল তার পরিবারের কথা- যে পরিবারের প্রধান বৈশিষ্টই হল অসহায় দীন দরীদ্রের দান খয়রাত করা। মনে পরল তার বাবার কথা, যে ব্যক্তিটা সারা জীবন দানের উপরই কাটিয়ে গেছেন। যার দানে ধন্য হয়ে কবরের পথযাত্রী অসংখ্য মানুষ আজো পৃথিবীর পথে হাঁটছে, যিনি অগনিত মানুষের জীবন বাঁচিয়েছেন, আজ তারই রক্তের উত্তর ধারক, তারই পৌত্রি মানুষের দান খাচ্ছে, ভিক্ষে খাচ্ছে। তার শরীরটা থড় থড় করে কাঁপতে থাকে, ফুফিয়ে কান্নার শব্দ গোঙ্গানিতে রুপান্তরিত হয়। সে পাগলের মত আবৃত্তি করতে থাকে, ‘আল্লাহুম্মা মালিকাল মুলকি, তু’তিল মুলকা মাং তাশাউ, ওয়া তাংযিয়ুল মুলকা মিম্মাং তাশাউ, ওয়া তুয়িযযু মাং তাশাউ ওয়া তুযিল্লু মাং তাশাউ, বিয়াদিকাল খাইর, ইন্নাকা আলা কুল্লি শায়্যিং কাদির- বলুন ইয়া আল্লাহ! তুমিই সার্বভৌম শক্তির অধিকারী। তুমি যাকে ইচ্ছা রাজ্য দান কর এবং যার কাছ থেকে ইচ্ছা রাজ্য ছিনিয়ে নাও এবং যাকে ইচ্ছা সম্মান দান কর আর যাকে ইচ্ছা অপমানে পতিত কর। তোমারই হাতে রয়েছে যাবতীয় কল্যাণ। নিশ্চয়ই তুমি সর্ব বিষয়ে ক্ষমতাশীল। (৩: ২৬)

কমলাপুর রেলওয়ে ষ্টেশন, যমুনা এক্সপ্রেস ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে। যাত্রীরা একে একে সবাই নেমে গেছে, শুন্য বগিগুলি খা খা করছে। পরিচ্ছন্ন কর্মিরা ব্যস্ত হল, এক কর্মি দরজা দিয়ে ঢুকেই চেচিয়ে উঠল, ‘আরে এই পাগল এখানে কোত্থেকে এল, অহঃ হু কি নোংরারে বাবা, এই হালা কাশ রক্ত দিয়ে বগিটার কি অবস্থা করেছিস। এখন তুই সাফ করে দিয়ে যাবি’ বলে পাগলটার পায়ে লাথি মারল। পাগলটা চেতন পেয়ে মাথা তুলল, ‘আপা এটা কোন জায়গা? মহিলাটা আবার চেচিয়ে উঠল, ‘এই হালা জানস না কোন জায়গা, এটা কমলাপুর। মরার আর জায়গা পেলি না, এই ট্রেনে এসে মরতে হয় কেন। এখন নাম, আমি এগুলি সাফ করি’। হাসান পাশের সীটে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল। তার শরীর কাঁপছে। মহিলাকে বলল, ‘আপা আমার মেয়েটাকে ধরে একটু নামিয়ে দেন, আমি যে পারছি না। বিপন্ন মানুষ আরেক দুস্থের ব্যথা বুঝে, মহিলাটার মায়া হল। সে বাচ্চাটাকে নামিয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘এই আসতে নাম, আবার পরে গিয়ে মাথা ফাটাবি। হাসান এক হাতে ট্রেনের হাতল ধরল অন্য হাতে মহিলার হাত ধরে নামল। তারপর মেয়েকে কোলে নিয়ে প্লাটফর্মের ফ্লোরে বসে পরল।

তার পকেটে টাকা ছিল। ফেরিওয়ালার কাছ থেকে রুটি, কলা, বিস্কুট ও পানি কিনে মেয়েকে খাওয়াল। তারপর নিজে খেল কিন্তু কাশির জন্য বেশি খেতে পারল না। একেকটা কাশির সাথে মুখ ভরে রক্ত আসতে থাকে। সেই সাথে প্রচণ্ড জ্বরের দাপটে শরীর থরথর করে কাঁপছে। কাঁপতে কাঁপতে সে মেঝেতে নেতিয়ে পরল। তারপর কাশতে কাশতে এক সময় বেহুশ হয়ে গেল। কাঁথার কোণায় মেয়ের জামা বাধা আছে। সে কিছুক্ষণ বাবার পাশে বসে থাকল, তারপর একটু একটু পাউরুটি বা বিস্কুট মুখে দিতে লাগল। কিছুক্ষণ খেয়ে তার আধমরা শরীরটা একটু চাঙ্গা হল। সে উঠে হাঁটতে চাইল কিন্তু কাঁথার সাথে টান লেগে ধপাস করে মাটিতে পরে গেল। আর সাথে সাথে কান্না শুরু করল। কতক্ষণ আম্মু আম্মু ডেকে কাঁদল, তারপর বাব্বা বাব্বা বলে কাঁদল। কিন্তু কেউ সাড়া দিল না। অবশেষে বাচ্চাটা ক্লান্ত হয়ে মাটিতে শুয়ে ঘুমিয়ে পরল। দুনিয়ার সবচেয়ে ভাগ্যাহত মানুষটি প্লাটফর্মে অচেতন হয়ে পরে আছে আর তারই পাশে তার হতভাগ্য সন্তান মাটির বিছানায় পড়ে ঘুমুচ্ছে।

একজন বাবা কতটুকু বদবখত হলে তার সন্তান খোলা আকাশের নীচে ফুটপাতে মাটির শয্যায় পরে থাকতে পারে। মানুষের হিংস্রতা পশুর হিংস্রতাকে হার মানায়। আবার মানুষের হিংস্রতা মানুষকে পশুত্বের স্তরে নামিয়ে দেয়। আজ হাসান ও তার সন্তান মানুষের মানবাধিকার পেরিয়ে পশুত্বের স্তরে নেমে গেছে। ওরা এখন আর মানুষ নয়, ওরা কীটপতঙ্গ, পোকা মাকড়, যাদের ঠিকানা মাটির বিছানা। কিছুক্ষণ পর মানুষের কোলাহলে মেয়েটা জেগে উঠল। শুয়ে শুয়ে কিছুক্ষণ কাঁদল কিন্তু কেউ তাকে কোলে নিল না। তারপর উঠে বসে বসে কিছুক্ষণ কাঁদল, মাকে ডাকল বাবাকে ডাকল, কিন্তু অবোধ শিশুর আর্তনাদ প্লাটফর্মের পাষাণে পাষাণে প্রত্যাখ্যাত হয়ে তারই বুকে কাটার মত বিধতে লাগল। অবশেষে বাচ্চাটা হামাগুড়ি দিয়ে বাবার কাছে গেল, মাটিতে পরে থাকা বাবার মাথা ও মুখে হাত মারতে লাগল কিন্তু তার বাবা উঠল না।

যমুনা এক্সপ্রেস ট্রেন, বাহাদুরাবাদ ঘাটগামী তা ছাড়ার সময় হয়ে গেছে। যাত্রীদের ব্যস্ততা, দৌড়াদৌড়ি হাকাহাকি শুরু হয়ে গেছে। হাসানের সংলগ্ন একটি মাল বগিতে মাল তোলা হচ্ছে। তার কপাট লাগানোর সময় কানফাটা প্রচণ্ড শব্দে সে জেগে উঠল। মেয়ের কথা মনে হতেই ধড়ফড় করে উঠে বসে পাশে তাকাল। মেয়ে কাঁদছে, সে ঝট করে কোলে নিয়ে বুকে চেপে ধরল। তার কিনা কিছু রুটি বিস্কুট পরে আছে। সেখান থেকে কিছু মেয়েকে খাওয়াল, বোতল থেকে পানি খাওয়াল। তারপর গিয়ে আগের বগিতে উঠতে চাইল কিন্তু পারল না, যাকেই সামনে পেল কাতর মিনতি করল, ‘ভাই আমি অসুস্থ, আমার মেয়েটাকে ধরে একটু তুলে দেন, আমি পারছি না। কিন্তু কোন ভদ্র লোক তার দিকে ফিরেও তাকাল না। সে অনেকক্ষণ চেষ্টা করল, অনেককে অনুরোধ করল কিন্তু সভ্য দুনিয়ার মুখোশধারী কোন সভ্য এগিয়ে এল না।

গাড়ি ছেড়ে দিবে, বাঁশি বাজাচ্ছে কিন্তু কেউ তাকে সাহায্য করল না। অবশেষে অসহায় হয়ে সে কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করতে লাগল ‘আমাকে একটু সাহায্য করেন, আল্লাহ্‌র ওয়াস্তে আমাকে একটু ট্রেনে তুলে দেন, আমার মেয়েটাকে ধরেন’ কিন্তু এই আর্তনাদ কোন সভ্যের কানে বাজল না। ট্রেনের অন্ধ একটা ভিক্ষুক পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনছিল, সে তাড়াতাড়ি এসে বলল, দেন বাচ্চাটা আমার কাছে, তারপর ট্রেনে উঠে বাচ্চাকে রেখে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘এবার আপনি উঠুন’ হাসান এক হাতে হাতল অন্য হাতে ভিক্ষুকের হাত ধরে ট্রেনে উঠল, ভিক্ষুক জিজ্ঞেস করল কোথায় যাবেন? সে বলল, ময়মনসিংহ। তারপর মেয়েকে কোলে নিয়ে আগের মত টয়লেটের সামনে ফাঁকা জায়গাটায় গিয়ে বসল। ট্রেন চলতে শুরু করল। ট্রেনে উঠার আগে সে মেয়ের জামার সাথে কাঁথার বাধন খোলে দিয়েছিল, তা আবার ভাল করে বাধল। ঘন্টা খানেক ভালই বসে থাকল। তারপর ফেরিওয়ালা এল, কেক ও পানি কিনল, মেয়েকেও খাওয়াতে লাগল নিজেও খেতে লাগল। কিন্তু যেই পানির বোতলে চুমুক দিল অমনি কাশি শুরু হল। মুখ ভরে রক্ত আসছে। সে কাশতে কাশতে মেঝেতে শুয়ে পরল, এক সময় বেহুশ হয়ে গেল।

বিষয়: সাহিত্য

১২৯৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File