ইসলামে নারী নেতৃত্ব নাজায়েয তা যুক্তিসহকারে আলোচনা

লিখেছেন লিখেছেন হারানো সুর ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৩, ১২:৪০:৪২ দুপুর

আল্লাহ পাক বলেন,

“যে সৎকর্ম সম্পাদন করে এবং সে ঈমাণদার, পুরুষ হোক কিংবা নারী আমি তাকে পবিত্র জীবন দান করব” [নহলঃ৯৭]

আল্লাহ পাক এই মানব জাতি তথা নর-নারীকে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ পাক মর্যাদার দিক থেকে তাদের ভিতর কোন ধরনের পার্থক্য সৃষ্টি করেন নাই।আল্লাহর হুকুম মান্য করলে একজন পুরুষ যেমন তার প্রতিদান পাবেন তদ্রুপ একজন নারীও সেরকম পুরষ্কার লাভ করতে পারবেন।আবার যারা আল্লাহর অবাধ্য তাদের শাস্তি সমভাবে পূর্বনির্ধারিত।আল্লাহ পাক যেমন একজন পুরুষকে কোন সম্প্রদায়ে নেতৃত্ব দানের সুযোগ প্রদান করেছেন তদ্রুপ আল্লাহ পাক একজন নারীকেও কোন সম্প্রদায়ে নেতৃত্ব প্রদানের সুযোগ প্রদান করেছেন।এখন বর্তমান এই মুসলিম বিশ্বে নারী নেতৃত্ব কি জায়েয না নাজায়েয তা নিয়ে চলছে নানা আলোচনা,গবেষণ এবং পর্যালোচনা। ইসলামে নারী নেতৃত্ব জায়েয কি নাজায়েয এ ব্যাপারে বিভিন্ন মতামতসমূহ নিম্নে উপস্থাপন করা হলঃ

অন্যান্য ধর্মে নারীর অবস্থা

নারী নেতৃত্ব জায়েয কি নাজায়েয তা আলোচনা করার পূর্বে এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা দরকার যে ইসলাম ধর্ম এবং অন্যান্য ধর্মে নারীদেরকে কীভাবে মূল্যায়ন করা হয়েছে? এই পৃথিবীতে নারীগণ পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীগণ বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছে।বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে নারীদের ব্যাপারে যেসকল কথা বলা হয়েছে তাতে নারীদের প্রতি তেমন কোন সম্মান দেখানো হয় নাই।যদিও সেসকল গ্রন্থসমূহ ছিল বিকৃত।

ইয়াহূদী ধর্মে নারীঃ ইয়াহূদীগণ মনে করে থাকে যে সর্বপ্রথম নারী জাতি শয়তানের প্ররোচনায় লিপ্ত হয়ে পুরুষদেরকে পথভ্রষ্ট করেছে আর সেই থেকে নারীদের উপর পুরুষেরা সর্বদা কর্তৃত্বশীল হবে এবং নারীদের এর দ্বারা প্রসবের কষ্ট দেওয়া হয়েছে।তাই তারা নারী জাতিকে এভাবে করে হেয় প্রতিপন্ন করেছে।

খ্রিষ্টন ধর্মে নারীঃ খ্রিষ্টানগণ তাদের ধর্মগ্রন্থের মতামত দিয়ে বলে,আদম এবং হাওয়া যখন নিষিদ্ব ফল ভক্ষণ করল তখন আল্লাহ পাক আদমকে ক্ষমা করলেও হাওয়াকে করেন নাই।আরবী ভাষার বহুবচনে দুইজনকে ক্ষমা করা হয়েছে এমনটা বলা হয় নাই,বরং বলা হয়েছে যে,একজনকে ক্ষমা করা হয়েছে।আর হাওয়াকে ক্ষমা করা হয় নাই আর সেখানে থেকে সকল পাপাচারী নারী এই পৃথিবীতে এসেছে।তারা এই কথাও বলে যে,সঙ্গী হিসেবে শয়তানকে নিতে চাইলে নাও,কিন্তু কোন নারীকে নিও না।তারা একথাও বলে যে, নারী হল দুঃখের প্রস্রবন।

বৌদ্ব ধর্মে নারীঃ আবার বৌদ্ব ধর্মের অনুসারীগণ মনে করে নারীসংগ নির্বান লাভে অন্তরায়।বৌদ্ব ধর্মের প্রবক্তা গৌতম বুদ্ব বলেছেন, “নারীদের সাথে কোনরুপ মেলামেশা কর না এবং তাদের প্রতি অনুরাগ রেখ না।তাদের সাথে কথা-বার্তাও বলবে না।কারণ পুরুষের পক্ষে নারী ভয়ংকস্বরুপ।নারী থেকে বাঁচার চেষ্টা কর।”

প্রাক ইসলামী যুগে নারীঃ এভাবে অন্য সকল প্রাচীন সভ্যতায় নারীদের অধিকারকে চরমভাবে ক্ষুন্ন করা হত।প্রাচীন আরব সমাজে নারীদের প্রতি চরম অবমাননা করা হত।কুরআনে এ প্রসংগে বলা হয়েছে যে,যখনই কোন নারী জন্ম নিত তাদের মুখ কালো হয়ে যেত।তাদের কাউকে কাউকে জীবিত কবরে পুঁতে ফেলা হত।নারীদের বাজারে পণ্য-দ্রব্যের ন্যায় কেনা-বেচা করা হত।একই নারীর সাথে বহু পুরুষ সঙ্গম করতে পারত।তাদের উপর প্রায় সময় চলত অকথ্য নির্যাতন।

তাহলে যেসকল ধর্ম এবং সমাজে এভাবে যুগ যুগ ধরে চলে আসছে এক অকথ্য যুলুম,অত্যাচার,নির্যাতন আর পুরুষের একক আধিপত্য সেই সমাজে কোনভাবে নারী নেতৃত্বের কথা কেউ কোনদিন চিন্তাও করে নাই।

ইসলাম ধর্মে নারীর অবস্থানঃ পৃথিবীতে যত ধর্ম আছে তার ভিতর ইসলাম ধর্ম নারী জাতিকে সবচেয়ে বেশী মর্যাদা প্রদান করেছে।ইসলাম আবির্ভাবে পূর্বে নারী জাতিকে অতি তুচ্ছ বলে মনে করা হত। কিন্তু ইসলাম ধর্মে নারী জাতিকে যে পূর্ণ সম্মান এবং মর্যাদা দেওয়া হয়েছে তা অন্য কোন ধর্মে দেওয়া হয় নাই।ইসলাম নারীকে বিশেষভাবে মর্যাদা প্রদান করেছে।আল্লাহ বলেন,

“আর পুরুষদের যেমন স্ত্রীদের উপর অধিকার রয়েছে, তেমনি ভাবে স্ত্রীদেরও অধিকার রয়েছে পুরুষদের উপর নিয়ম অনুযায়ী”।

ইসলাম একজন নারীকে একজন কণ্যা হিসেবে বিশেষভাবে মর্যাদা দিয়েছে।রাসূল(সাঃ)বলেন,

“আমার উম্মাতের ভিতর যে তিন কণ্যা বা তিন বোনের লালন-পালন করবে তারা ঐ ব্যক্তির জাহান্নামের প্রতিবন্ধক।”

শুধুমাত্র কণ্যা হিসেবে নয় বরং মা হিসেবে ইসলাম ধর্ম একজন নারীকে যথেষ্ঠ মর্যাদা দিয়েছে।রাসূল(সাঃ)বলেন,

“মায়ের পায়ের নীচে সন্তানের বেহেশ্ত।”

অন্যদিকে স্ত্রী হিসেবে ইসলাম একজন নারীকে মর্যাদা প্রদান করেছে।রাসূল(সাঃ)বলেন,

“তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি সর্বোত্তম যে তার স্ত্রীর সাথে ভাল ব্যবহার করে।”

উমর(রাঃ)বলেন, “আল্লাহর কসম জাহিলিয়াতের যুগে নারীদের কিছুই মনে করতাম না।কিন্তু যখন নারীদের অধিকার এবং মর্যাদার ব্যাপারে বিভিন্ন ওয়াহী নাযিল হতে থাকে এবং তাদের পরিত্যক্ত সম্পত্তির ব্যাপারে ওয়াহী নাযিল হতে থাকে তখন হতে তাদের ব্যাপারে আমার মনোভাব পরিবর্তিত হতে থাকে।”

ইসলামে নারী অধিকার ও মর্যাদাকে ছোট করার কোন অবকাশ নেই

এখন এখানে প্রশ্ন হল এই যে, ধর্মে নারীকে একটি নীচু অবস্থা থেকে এত উপরে নিয়ে যাওয়া হল সেই ধর্মে কি কোন নারীর জন্য সকল জাতির জন্য নেতৃত্ব দেওয়া কি বৈধ না অবৈধ তা একটি বিবেচ্য বিষয়।

নারী নেতৃত্ব প্রদানে ইসলামী চিন্তাবিদদের মনোভাব

নারী নেতৃত্ব কি ইসলামে জায়ায নাকি নাজায়েয সেই ব্যাপারে দুই ধরনের মতামত পাওয়া যায়।কেউ বলেছেন তা জায়েয আবার কেউ বলেছেন তা একেবারেই নাজায়েয।যারা বলে থাকেন ইসলামে নারী নেতৃত্ব নাজায়েয তাদের মতামতসমূহ নিম্নে তুলে ধরা হলঃ

নারী নেতৃত্ব বৈধ বলার বিপক্ষ দলের মতামত

যারা বলে থাকে যে ইসলামে নারী নেতৃত্ব সম্পূর্ণরুপে হারাম তারা যুক্তি হিসেবে নিম্নোক্ত কিছু কুরআনের আয়াত,হাদীস,ইজাম এবং যুক্তির সাহায্যে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন।তারা যেসকল দলীলের দ্বারা নারী নেতৃত্বকে হারাম ঘোষণা করেছে তা নিম্নরুপঃ

কুরআনিক দলীল

যারা নারী নেতৃত্বকে অবৈধ বলে তারা যুক্তি দেন কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াত দ্বারা,“পুরুষ নারীর উপর কর্তৃত্বশীল।এ জন্য যে, আল্লাহ একের উপর অন্যের বৈশিষ্ট্য দান করেছেন এবং এ জন্য যে, তারা তাদের অর্থ ব্যয় করে।” [নিসাঃ৩৪]

এ আয়াতের দ্বারা এটি প্রমাণ করে যে, পুরুষেরা সর্বদা নারীর উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করবে।তাই তারা কোন অবস্থাতে নারী-পুরুষ সকলের উপর নেতৃত্ব দিতে পারবে না।এই আয়াতের পরিপ্রক্ষিতে মুফাসসিরীনগণ ব্যখ্যা দিয়েছেন,

১. নারীরা শাসক হতে পারে না।

২. নারীরা নবী বা রাসূল হতে পারে না।

৩. নারীগণ ইমামতি করতে পারবে না।

৪. নারীদের উপর জিহাদ ফরয নয়

৫. নারীদের ব্যাপারে কিসাসের রায় দেওয়া জায়েয নয়

৬. নারীদের জন্য জিহাদ ফরয নয়।

৭. তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদ শুধুমাত্র নারীদের উপর নির্ভর করে না। [তাফসীরে ইবনে কাসীর,রুহুল মাআনী,বায়যাবী]

হাদীসভিত্তিক দলীল

বিভিন্ন হাদীসে বলা হয়েছে নারী নেতৃত্ব হারাম।যেমন বুখারী শরীফের কিতাবুল ফিকানে বলা হয়েছে যে,

“যে জাতির নেতৃত্ব কোন নারী দিবে সে জাতি কখনও কল্যাণ বয়ে আনবে না।”

অন্যত্র বলা হয়েছে, “যখন নারীরা নেতৃত্ব দেওয়া শুরু করবে তখন মাটির উপরের চেয়ে নীচের অংশ ভাল হবে।” [তিরমযীঃকিতাবুল ফিকান]

তিরমিযী শরীফে আরেকটি হাদীস রয়েছে, “পুরুষেরা তখন ধংস্ব হয়ে যাবে যখন তারা নারী নেতৃত্ব মেনে নিবে।” [তিরমিযি]

কেউ যদি এসকল হাদীস সরাসরি এর অর্থ নিয়ে আলোচনা করে তাহলে তা স্পষ্ট হয় যে নারী নেতৃত্ব ইসলামে হারাম।

প্রথম হাদীসেটিতে নারী জাতির জন্য নেতৃত্ব দেওয়ার যেই অভিশাপ আসবে তা তুলে ধরা হয়েছে আর পরের দুইটি হাদীসে নারী নেতৃত্বের ফলে পুরুষ জাতির জন্য যেই অবমাননাকর অবস্থার সৃষ্টি হবে তা তুলে ধরা হয়েছে।

এছাড়া হাদীসে বলা হয়েছে যে নারীদের কম জ্ঞান দেওয়া হয়েছে তাই সেই পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে,ইসলামে নারী নেতৃত্ব সম্পূর্ণরুপে অবৈধ।

ইজমাভিত্তিক দলীল

কুরআন-হাদীস ছাড়াও ইজমাতে ইবনে হাযম মারাফিতুল ইজমা(পৃঃ১২৬) গ্রন্থে বলেছেন, “তারা একথায় একমত হয়েছে নারী নেতৃত্ব বৈধ নয়।” ইমাম তাইমিয়া বলেছেন, “নারী নেতৃত্ব বৈধ নয়।” [নাকালু মারাফিয়া ইজমা] অতঃপর আল্লামা মাওয়ার্দী যাকে ইসলামী রাজনীতির প্রবক্তা বলা হয়ে তিনি বলেন, “নারী নেতৃত্ব বৈধ নয়।এ ব্যাপারে আলেমগণ একমত হয়েছেন।” [আহকামুস সুলতানিয়া] আল্লামা আবুল ইয়ালা হাম্বলী তার এ আহকামুস সুলতানিয়া গ্রন্থে বলছেন, “নারী নেতৃত্ব বৈধ নয়।” ইমামুল হারামায় আল্লামা জুরাইন বলেছেন, “নারী নেতৃত্ব বৈধ নয়।” ইবনুল আরাবী বলছেন, “নারী খলীফা কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান হতে পারে না।” ইমাম কুরতুবী এই ইজমা উল্লেখ করেছেন যে, “নারী নেতৃত্ব বৈধ নয়।” ইমাম গাযযালী(রঃ) খলীফা হওয়ার জন্য পুরুষ শর্ত উল্লেখ করেছেন।আল্লামা শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী(রঃ) তার হুজ্জাতুল বালিগা তে বলেছেন, “নারী নেতৃত্ব বৈধ নয়।নেতৃত্ব হওয়ার জন্য তাকে অবশ্যই পুরুষ হতে হবে।” আল্লামা ইবনুল কাসীর বলেন, “নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য পুরুষ হওয়া ফরয।” ইমাম কুরতুবী আহকামুল কুরআনে নারী নেতৃত্বকে নাজায়েয বলেছেন। ইমাম যামাখখাশারী তার কাশশাফ এ লিখেছেন যে, “নারী নেতৃত্ব হারাম।” ইমাম বায়যভী তার তাফসীরে বায়যাভীতে বলেছেন যে, “নারী নেতৃত্ব বৈধ নয়।”ইমাম শাওকানী একই কথা বলেছেন।ইমাম বদরুদ্দিন আইনী লিখেছেন যে, তা বৈধ নয়।মোল্লা আলী কারী(রঃ) ফাতহুল বারীতে লিখেছেন যে, নারী নেতৃত্ব জায়েয নয়।আল্লামা মওদূদী ইসলামী শাসনতন্ত্রের ৮১ নম্বর পৃষ্ঠায় লিখেছেন, “রাজনীতি এবং দেশশাসনে নারীদের কর্মসীমার বহির্ভূত।” আশরাফ আলী থানবী (রঃ) বলেন, “নারী নেতৃত্ব বৈধ নয়।” সৌদি আরবের মুফতি আযম,আব্দুল্লাহ বিন বার,আযমীর নারী নেতৃত্ব নাজায়েয বলেছেন।বিখ্যাত ফিকাহ গ্রন্থ ফাতওয়া শামীতে বলে হয়েছে, “নারী নেতৃত্ব কোনভাবেই জায়েয নয়।কারণ আল্লাহ পাকের নির্দেশ হল নারীরা ঘরে পর্দার সাথে জীবন যাপন করবে।তাদের জন্য পর্দা করা ফরয।তাই কোনভাবেই তাদের জন্য নারী নেতৃত্ব জায়েয নয়।”

অর্থাৎ, এখানে গোটা উম্মাতের ভিতর এই ইজমা সঙ্ঘটিত হয়েছে যে,নারী নেতৃত্ব ইসলামে মোটেও জায়েয নয়।

বিষয়: বিবিধ

২৩৭৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File