পরিকল্পিতভাবে খুন হন মাওলানা ফারুকী ॥ সন্দেহের তীর উগ্র ও কট্টর ইসলামপন্থীদের দিকে

লিখেছেন লিখেছেন হারানো সুর ২৯ আগস্ট, ২০১৪, ০৮:৩১:১১ রাত

রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজারের ভাড়া বাসায় জনপ্রিয় টিভি উপস্থাপক শাইখ মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকীর হত্যাকা-কে পূর্বপরিকল্পিত হত্যাকান্ড হিসেবে উল্লেখ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, মাওলানা ফারুকীর হত্যাকান্ডের সাথে আরও চারটি হত্যাকান্ডর মিল রয়েছে। ফারুকী হত্যাকা-সহ পাঁচটি হত্যাকান্ডের প্রেক্ষাপট এক ও অভিন্ন। এর আগে যে চারটি হত্যাকা- ঘটেছিল, সেগুলোর পুনরাবৃত্তিই ঘটেছে মাওলানা ফারুকীর বেলাতেও। তাদের ধারণা, ইসলামের নামে উগ্র ও কট্টরপন্থী গ্রুপের হাতেই তার মৃত্যু ঘটেছে। তবে এ ধারণাই চূড়ান্ত নয়। তদন্তে আরও অনেক কিছু বের হয়ে আসতে পারে।

আর মাওলানা ফারুকীর পরিবারের সদস্যসহ স্বজনরা বলছেন, তার রাজনৈতিক কোন শত্রু ছিল না। কোন রাজনৈতিক দলকেও তাদের সন্দেহ নয়। ঘটনাকে ভিন্নখাতে নেয়ার উদ্দেশেই কোন কোন মহল রাজনৈতিক দলকে জড়িয়ে অপপ্রচার চালাতে পারে।

এদিকে মাওলানা ফারুকীর হত্যাকা-ের ঘটনায় তার দ্বিতীয় সংসারের ছেলে বাদী হয়ে রাজধানীর শের-ই-বাংলা নগর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছে। মামলায় ৮ থেকে ৯ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামী হিসেবে উল্লেখ করেছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে মাওলানা ফারুকীর লাশের ময়না তদন্ত হয়েছে। এরপর তার প্রথম নামাযে জানাযা হয় চ্যানেল আই অফিসের সামনে। এরপর সন্ধ্যায় দ্বিতীয় জানাযা হয় বাসার কাছেই পূর্ব রাজাবাজার জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে। এরপর তার লাশ রাখা হয়েছে বারডেম হাসপাতালের হিমঘরে। আজ তার লাশ চট্টগ্রামে নিয়ে যাওয়ার কর্মসূচি রয়েছে। সেখান থেকে লাশটি আনার পর জুমার নামায শেষে জাতীয় ঈদগাহে চতুর্থ পর্যায়ে নামাযে জানাযা হবে। এরপর তার লাশ নিয়ে যাওয়া হবে জন্মস্থান পঞ্চগড়ের বোদায়। সেখানেই তার দাফন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে বলে পারিবারিক সূত্রে জানানো হয়।

মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকী ছিলেন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের প্রেসিডিয়াম সদস্য, মোফাসসিরে কুরআন, পূর্ব রাজাবাজার জামে মসজিদের সাবেক খতিব, ইসলামিক মিডিয়া জনকল্যাণ সংস্থার চেয়ারম্যান, মেঘনা ট্রাভেলস (লাইসেন্স নং-২৯১) ম্যানেজিং পার্টনার, বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আই-এর ধর্মীয় অনুষ্ঠান কাফেলার উপস্থাপক ও পরিচালক, রেডিও বাংলাদেশের ধারা ভাষ্যকার, সুপ্রিম কোর্ট জামে মসজিদের খতিব ও ফারুকী ট্যুরস এন্ড ট্রাভেলস-এর এমডি। তাছাড়া তিনি বিভিন্ন সামাজিক ও ইসলামিক সংগঠনের সাথেও জড়িত ছিলেন ।

যেভাবে হত্যার ঘটনা ঘটেছে

নুরুল ইসলাম ফারুকীর ছেলে ফয়সাল ফারুকী জানান, সন্ধ্যার পর বাসায় দুইজন অতিথি আসেন। তারা তার (ফয়সাল) বাবার সঙ্গে হজ্বে যাওয়ার বিষয়ে কথা বলেন। এ সময় তার বাবা ড্রয়িং রুমে বসা ছিলেন। পরনে ছিল লুঙ্গি আর সাদাকালো স্ট্রাইপের পাঞ্জাবি। গলায় ছিল পাগড়ি। এর পর ওই দুইজন জানান, তাদের আরও কয়েকজন বড় ভাই আছেন, যারা হজ্বে যেতে চান। ফয়সাল বলেন, এর কিছুক্ষণ পর তারা দরজায় নক করে। আব্বা দরজা খোলার পর ৭-৮ জন লোক পিস্তল এবং রামদা, চাপাতি নিয়ে ঘরে প্রবেশ করে। ওই সময় পরিবারের ৫ জন সদস্য বাসায় ছিল। প্রথমে সবাইকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে এবং পরে সবার হাত-পা ও চোখ বেঁধে ফেলে। ওই ড্রয়িং রুম থেকে তার বাবাকে পাগড়ি দিয়ে গলা বেঁধে টেনে হিঁচড়ে ডাইনিং রুমে এনে ডাইনিং টেবিলের নিচে গলা কেটে হত্যা করে তারা পালিয়ে যায়। তার রক্তের প্রবাহে গোটা রুম ভেসে যায়। গতকালও ডাইনিং রুমের ফ্রিজ ও মেঝেতে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ দেখা যায়। এ ঘটনার দুইদিন আগেও ওই দুইজন বাসায় এসে কথা বলে গেছেন বলে জানান তিনি।

কী কারণে খুন করা হয়েছে জানতে চাইলে ফয়সাল ফারুকী বলেন, ‘আব্বা ধর্মের কথা বলতেন, সত্যের কথা বলতেন। আব্বার কথা যারা অপছন্দ করতেন তারাই এ হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে।’ তার দাবি, ধর্মীয় কারণেই তার বাবাকে হত্যা করা হয়েছে। হত্যাকান্ডটি পরিকল্পিত দাবি করে তিনি বলেন, ‘এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকা-। সত্যের কথা বলার কারণে আব্বাকে বিভিন্ন সময় মোবাইল ফোনে হুমকিও দেয়া হয়েছে।

ডাকাতদের হাতে হত্যার ঘটনা সাজানোর অপচেষ্টা

হত্যার পর খুনিরা বাড়িতে লুটপাট চালিয়েছে। বাসার আসবাবপত্র তছনছ করেছে। এ সময় বাসার সবার কাছে জানতে চাওয়া হয়, অর্থকড়ি, স্বর্ণালঙ্কার কোথায় আছে। এসব খোঁজার জন্য সবকিছু এলোমেলো করা হয়।

পরিবারের বরাত দিয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) উপ-কমিশনার আশিকুর রহমান বলেন, ঘটনাটি ডাকাতি হিসেবে সাজানোর অপচেষ্টা চালিয়েছিল হত্যাকারীরা। সে লক্ষ্যে তারা হত্যাকা- সম্পন্ন করার পর ডাকাতির নাটক করেছে। ঘরের আসবাবপত্র এলোমেলো করেছে।

ছেলে ফয়সাল ফারুকী বলেন, ‘ঘরের আলমারি ভেঙে লুটপাট করা হয়েছে। ঘরে থাকা স্বর্ণালঙ্কারও তারা নিয়ে গেছে।’ তিনি জানান, নগদ টাকা আড়াই লাখ নিয়ে গেছে। তার মধ্যে নতুন টাকা ছিল দেড় লাখ। এছাড়াও কাফেলার ক্যামেরা, রেকর্ডার, টেপ, তিনটি সোনার চেইন, তিনটি আংটি, কানের দুলও তারা নিয়ে যায়।

কারওয়ানবাজার ট্রেড সেন্টারে ইসলামী অনুষ্ঠান উপস্থাপকদের মধ্যে কী হয়েছিল?

হত্যাকা-টি পূর্বপরিকল্পিত দাবি করে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসেনার ঢাকা মহানগরীর সাধারণ সম্পাদক ইমরান হোসেন তুষার জানান, ২১ আগস্ট ঢাকার কারওয়ানবাজার ট্রেড সেন্টারে ইসলামী অনুষ্ঠান উপস্থাপকদের একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে বাংলাদেশের সব টিভি চ্যানেলের ধর্মভিত্তিক অনুষ্ঠানের উপস্থাপক ও আলোচকগণ উপস্থিত হন, যার সংখ্যা ছিল ২২। আলোচনা চলাকালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ইসলামী অনুষ্ঠান উপস্থাপক শহীদুল্লাহ প্রস্তাব করেন, যারা ইসলামী অনুষ্ঠান করেন তাদের নিয়ে একটি সংগঠন করার জন্য। তিনি বলেন, ‘মুফতি ইব্রাহীম ও ফারুকী সাহেব অনুষ্ঠানে একে অপরের বিরুদ্ধে যেভাবে কথা বলেন, সংগঠন করা হলে আমরা হয়ত তাদের একটি প্ল্যাটফর্মে আনতে পারবো।’

এ সময় তারেক মনোয়ার (এটিএন ও এনটিভির উপস্থাপক) বাধা দিয়ে বলেন, ‘ফারুকীর পক্ষে দালালি করবি না। এখানে ফারুকীর শেরেকী-বেদাতী চলবে না। তাকে প্রতিহত করার জন্য আমরা সবাই একত্রিত থাকলে তাকে (ফারুকী) মেরে ফেলা যাবে। এগুলোকে বাদ দিয়ে কীভাবে কমিটি করা যায়, তা করো।’ এতে এটিএন বাংলার ইসলামী অনুষ্ঠানের পরিচালক আরাকান উল্লাহ হারুনী, রেডিও টুডে ও আরটিভির খালেদ সাইফুল্লাহ বকশি, এনটিভির পিএইচপি কুরআনের আলোর মোক্তার আহমেদ, এসএ টিভির মোস্তাফিজুর রহমান, কারবালার পথের কেফায়েত উল্লাহ, এটিএন বাংলার আবুল কালাম আজাদ তাকে সমর্থন দেন।’

তিনি বলেন, ‘পরবর্তীতে ফারুকীকে বাদ দিয়ে কামাল উদ্দিন জাফরীকে প্রধান উপদেষ্টা, আরাকান উল্লাহ হারুনী এবং খালেদ সাইফুল্লাহ বকশিকে সদস্য সচিব করে ৩৪ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। ফারুকী সাহেবকে কার্যনির্বাহীতে রাখার প্রস্তাব উঠলেও রাখা হয়নি। গতকাল বৃহস্পতিবার (২৮ আগস্ট) কমিটির পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত থাকলেও তা জামেয়া কাসেমিয়ার প্রিন্সিপাল কামাল উদ্দিন জাফরীর হজ্বে যাওয়ার কারণে স্থগিত করা হয়। হজ্ব শেষে আনুষ্ঠানিক সাংবাদিক সম্মেলন করে পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হবে বলে আমরা জানতে পারি।’

বেসরকারি স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল আইয়ের উপস্থাপক শাইখ নুরুল ইসলাম ফারুকী ১৯৫৯ সালের ২৪ নবেম্বর পঞ্চগড় জেলার বড়শ্বশী ইউনিয়নের নাউতারী নবাবগঞ্জ গ্রামে আলহাজ্ব মাওলানা জামশেদ আলীর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। মাওলানা ফারুকী সংসার জীবনে দুই বিয়ে করেন। তার দুই সংসারে ২ মেয়ে ও ৪ ছেলে রয়েছে। মাসুদ এবং দুই মেয়ে আগের সংসারের। তার প্রথম স্ত্রী রাজধানীর মালিবাগ এলাকায় থাকেন বলে জানা গেছে। ঘটনার সময় তিনি দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে রাজবাজারের বাসায় ছিলেন।

তিনি বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন বলে তার পরিবার থেকে জানানো হয়। তার বইগুলো সুফিজমভিত্তিক। সবশেষে ‘মারেপুল হারামাই’ নামের বইটি লিখেছেন। বইগুলোতে তিনি ইসলামের আদি বা অবিকৃত রূপ মানুষের কাছে তুলে ধরেছেন বলে তার ভক্তরা জানান।

৩ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ

হত্যাকা-ের ঘটনায় অজ্ঞাতপরিচয় আসামীদের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন তার ছেলে ফয়সাল ফারুকী। এদিকে হত্যা রহস্য উদঘাটনে তিন ‘প্রত্যক্ষদর্শীকে’ থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।

রাজধানীর শেরে বাংলানগর থানার উপ-পরিদর্শক জাহাঙ্গীর আলম জানান, নিহতের মেজ ছেলে ফয়সাল গত বুধবার মধ্যরাতে ৭-৮ জনের বিরুদ্ধে এই মামলা দায়ের করেন। মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, গত বুধবার রাতে এশার নামাযের পর আনুমানিক ৬-৭ জন যুবক পূর্ব রাজাবাজারে ফারুকীর নিজ বাসায় প্রবেশ করে। কিছু সময় পর ফারুকীর স্ত্রী ও এক ছেলেসহ তিন স্বজনকে হাত-পা বেঁধে ফেলে তারা। এরপর পৃথক কক্ষে ফারুকীকে গলা কেটে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রাতেই তিনজনকে আটক করে শেরে বাংলানগর থানায় নিয়ে যাওয়া হয়।

১৭৪ নম্বর পূর্ব রাজাবাজারে চারতলা একটি বাড়ির দ্বিতীয় তলায় পরিবার নিয়ে ভাড়া থাকতেন ফারুকী।

বাসায় তখন মারুফ ছাড়া ছিলেন ফারুকীর স্ত্রী, মা ও গৃহকর্মী। নুরুল ইসলামের তিন ছেলের মধ্যে বড়জন আহমেদ রেজা ফারুকী বর্তমানে সৌদি আরবে রয়েছেন। মেজ ও ছোট ছেলে তখন ঘরে ছিলেন না। গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে ময়না তদন্ত শেষে জানাযা ও দাফনের জন্য ফারুকীর লাশ বাসার কাছাকাছি নাজনীন স্কুল এন্ড কলেজ প্রাঙ্গণে নেয়া হয় ।

গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় ঢামেক হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রভাষক ডা. হোসেন এ ময়না তদন্ত করেন। ডা. হোসেন জানান, ফারুকীর শরীরের কিছু জায়গায় আঘাতের চিহ্ন থাকলেও গলায় ধারালো অস্ত্রের আঘাত রয়েছে। এটি পরিকল্পিত হত্যা।

মৃতদেহের ময়না তদন্তের আগে সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেন শেরে বাংলানগর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মনিরুজ্জামন। তিনি প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, কতিপয় কিছু লোক ফারুকীর বাসায় ডাকাতির উদ্দেশে তাকে গলা কেটে টাকা-পয়সাও স্বর্ণালংকার নিয়ে যায়।

পুলিশের তেজগাঁও অঞ্চলের উপ-কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, ‘আমরা এ ঘটনার অন্তত তিনজন প্রত্যক্ষদর্শীকে থানায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করছি। অপরাধী হিসেবে নয়, রহস্য উদঘাটনে তাদের সহায়তা নেয়া হচ্ছে।’ তবে নিরাপত্তা ও তদন্তের স্বার্থে তাদের নাম বলতে রাজি হননি এই পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘পুলিশ সর্বোচ্চ সামর্থ্য দিয়ে হত্যা রহস্য উদঘাটনে কাজ শুরু করেছে’।

থানার এসআই রাজু আহমেদ জানান, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের জন্য যাদের থানায় আনা হয়েছে তারা হলেন-রফিকুল ইসলাম, মো. শফিক ও মো. বেল্লাল। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত রয়েছে।

সন্দেহের তীর লা মাযহাবির দিকে!

ফারুকী হত্যার ঘটনায় ধর্মীয় মতবাদের ভিন্নতাকেই মূল কারণ হিসেবে বিবেচনা করে তদন্তে নেমেছেন গোয়েন্দারা। এই হত্যাকা-কে আগের আরো চারটি হত্যাকা-ের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ বলে মনে করছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারাও। তবে এ হত্যাকা-ের সঙ্গে ধর্মীয় সংগঠন লা মাযহাবির সম্পৃক্ততার কথাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না গোয়েন্দারা।

একই সঙ্গে এ হত্যাকা-ের সঙ্গে উত্তরায় ফল ব্যবসায়ী এক জঙ্গি হত্যাকা-, বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে জঙ্গি হত্যাকা-, রাজধানীর গোপীবাগে ছয় খুন ও ব্লগার রাজীব হায়দার শোভন হত্যাকা- একই সূত্রে গাঁথা বলে মনে করছেন তারা। এসব হত্যাকা-ের ধরণ ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা প্রায় একই রকম হওয়ায় হত্যার কারণও প্রায় একই বলে মনে করছেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

এ বিষয়ে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)-এর অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান এ বিষয়ে বলেন, ধর্মীয় মতবিরোধ থেকে এই হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটতে পারে। তিনি বলেন, এ হত্যাকা-ের সঙ্গে আগের আরো চারটি হত্যাকা-ের মিল রয়েছে। এসব হত্যাকা-েই হত্যাকারীদের সঙ্গে নিহত ব্যক্তির যোগসূত্রতা ছিল। তারা একই কায়দায় এসব বাসায় যাতায়াত করতেন। একই স্টাইলে হত্যার আগে বাসায় প্রবেশ করে অন্যান্য বাসিন্দাদের অন্য রুমে আটকে রেখে কাপড়-চোপড় দিয়ে হাত-পা বেঁধে গলা কেটে ও কুপিয়ে হত্যা করেছে।

কর্নেল জিয়া বলেন, একই কায়দায় হত্যাকারীরা হত্যার আলামত নষ্ট করেছে। তিনি বলেন, রাজধানীর উত্তরায় একব্যক্তি জঙ্গি সংগঠন থেকে চলে এসে ভালো হওয়ার চেষ্টা করেন এবং ফলের ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু জঙ্গি সংগঠনের অন্য সদস্যরা তাকে হত্যা করে। একই ঘটনা ঘটে বগুড়ার সারিয়াকান্দিতেও। সেখানেও পুরনো জঙ্গি সদস্যকে একই কায়দায় নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। মিরপুরের কালশীতে ব্লগার রাজীব হায়দার শোভন ধর্মীয় মতবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ায় তাকে হত্যা করে জঙ্গিরা। ঠিক একই ধরনের হত্যাকা- হয় রাজধানীর গোপীবাগে। ভিন্ন ধর্মীয় মতবাদ প্রকাশ করে নিজেকে ‘ইমাম গাজ্জালী’র প্রতিনিধি দাবি করায় এই ছয় খুনের ঘটনা ঘটানো হয়।

জিয়া বলেন, প্রাথমিকভাবে আমরা ধারণা করছি, ফারুকী হত্যাকা-ে লা মাযহাবি, শিয়া-সুন্নী মতবাদের ভিন্নমতের কারণে এই হত্যাকা- ঘটতে পারে। এটাকে সামনে রেখেই আমাদের গোয়েন্দারা তদন্ত শুরু করেছে। তিনি বলেন, আমরা আশা করছি, শিগগিরই এ হত্যাকা-ের রহস্য উন্মোচন করতে সক্ষম হবো।

সূত্র জানায়, ইসলামী ফ্রন্ট নেতা ও উপস্থাপক নুরুল ইসলাম ফারুকী হত্যার ঘটনার পর নড়েচড়ে বসেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাদের সামনে দর্পণ হয়ে দাঁড়িয়েছে গোপীবাগের ৬ খুনের ঘটনা। গোপীবাগে মুরিদ সেজে বাসায় ঢুকে ১০-১২ জন মিলে কথিত পীর লুৎফর রহমানসহ (৬০) ৬ জনকে হত্যা করে। এ সময় বাসায় স্ত্রীসহ পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। সবার হাত-পা বেঁধে একে একে হত্যা করা হয়। ফারুকীর মতো গলা কেটে। ওই ঘটনা ছিল ঠিক মাগরিবের আযানের সময়।

অপরদিকে ফারুকী হত্যার ঘটনাও একই কৌশলে ঘটানো হয়েছে। হজ্ব পালন ও ওয়াজ মাহফিলের দাওয়াত নিয়ে দুই দুর্বৃত্ত বাসায় প্রবেশ করে। পরে আরও ৫ জন প্রবেশ করে। একপর্যায়ে সবার হাত-পা বেঁধে শুধু ফারুকীকে গলা কেটে হত্যা করা হয়। এ ঘটনা ঘটে এশার আযানের পর। অবশ্য নুরুল ইসলাম ফারুকীর ইসলামী আদর্শ আহলে সুন্নি। অন্যদিকে কথিত পীর লুৎফর রহমান নিজেকে আল্লাহবাবা দাবি করতেন।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্তি উপ-কমিশনার আশিকুর রহমান বলেন, গোপীবাগের হত্যার রহস্য ও পরিকল্পনার সঙ্গে রাজাবাজারের হত্যার ঘটনার মিল পাওয়া যাচ্ছে। বাসায় প্রবেশ, বাসার লোকজনের সঙ্গে কথা বলা এবং হাত-পা বাঁধার কৌশলও এক। এ বিষয়টি মাথায় রেখে তদন্ত করা হচ্ছে। তবে তদন্তাধীন বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা সমীচীন নয় বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

গোপীবাগ ও রাজাবাজারের ঘটনাস্থল পরিদর্শনকারী এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, গোপীবাগের ৬ জনকে গলা কেটে হত্যা, ধারালো ছুরি, বাসার সবাইকে বেঁধে রাখা, মুখে স্কচটেপ লাগানোর ধরনের সঙ্গে মিলে ফারুকী হত্যাকা-। এই গোয়েন্দা কর্মকর্তার ধারণা, ধর্মীয় আদর্শগত বিরোধ অথবা পুরনো শত্রুতা থেকেই এ দুটি হত্যাকা- ঘটে থাকতে পারে। ঘটনার সঙ্গে ফারুকীর অনুসারী, জঙ্গি ও ইসলামী উগ্রপন্থীদের দিকে আঙ্গুল তুলে এ গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, হত্যাকারীরা জ্ঞানসম্পন্ন। হত্যার পর ডিবি পুলিশ মোবাইলের একটি সূত্র ধরে তদন্ড চালায়, সেটা হত্যাকারীরা জানে। ফলে গোপীবাগ ও রাজাবাজারের হত্যার ঘটনার সময় কেউ মোবাইল ফোন সঙ্গে আনেনি।

জানা গেছে, ফারুকী হিযবুত তাওহীদের বিরোধিতা করতেন। তিনি হযরত মুহম্মদ (সা.)-এর শানে মিলাদ ও মাজার জিয়ারতের পক্ষে মত পোষণ করতেন। একইসঙ্গে তিনি সুন্নিভিত্তিক সংগঠন আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতেরও নেতা ছিলেন। হাইকোর্ট মাজার মসজিদের খতিব থাকা অবস্থায় মিলাদ ও মাজার জিয়ারতের পক্ষে বক্তব্য দিতেন ফারুকী। ওই সময় তিনি ৫ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে বলেন, ‘যারা মিলাদ মাহফিল ও মাজার জিয়ারতের বিরোধিতা করেন এবং এ কাজকে বেদাত বলেন, তারা যদি এর দলিল দেখাতে পারেন তাহলে পুরস্কৃত করা হবে।’

র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (এডিজি) কর্নেল জিয়াউল আহসান ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে জানান, হত্যার ঘটনা রহস্যজনক। ইসলামী আদর্শ থেকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে। ফারুকীর পরিবারের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, এশার নামাযের পর আনুমানিক ৬-৭ জন যুবক তার কক্ষে প্রবেশ করে। কিছু সময় পর ফারুকীর স্ত্রী, ছেলে, গৃহপরিচারিকাসহ সবার হাত-পা বেঁধে ফেলা হয়। এরপর পৃথক কক্ষে ফারুকীকে গলা কেটে হত্যা করা হয়।

বিষয়: বিবিধ

১৫৪৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File