মিথ্যা বলা মহা পাপ

লিখেছেন লিখেছেন আলোর আভা ১৯ অক্টোবর, ২০১৩, ০৩:১৬:১০ দুপুর

আমাদের রোজকার জীবনে এমন অনেক মিথ্যে কথাই বলে থাকি যার তেমন কোনো প্রয়োজন নেই। অহেতুক এমন মিথ্যা উচ্চারণ আজকাল যেন দোষের কোনো বিষয়ই নয়। অথচ বলাবাহুল্য, মিথ্যা তো মিথ্যাই। তেমনি কেবল ইয়ার্কি করে বা লোক হাসানোর জন্যও অনেকে মিথ্যা বলে মজা পান। এটাও কিন্তু মিথ্যাই। খেয়ালি মনে কিংবা ফাজলামো করে কেউ যেমন কাউকে খুন করলে বা কোনো জিনিস ভেঙ্গে ফেললে তা অক্ষত থাকে না। ক্ষতি যা হবার তা হয়েই যায়। তেমনি মিথ্যাও যদি কেউ ঠাট্টাচ্ছলে বা ফাজলামো করে বলেন তিনিও ঠিক সে মিথ্যার গুনাহগার হন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের জন্য সদা অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব। তিনি ঘুণাক্ষরেও মিথ্যা বলেন নি। তাঁর হাসি-কৌতুকও ছিল নির্মল ও অনিন্দ্য সত্যনির্ভর। এ প্রসঙ্গে সীরাতে রাসূল থেকে একটি চমৎকার ঘটনা উল্লেখের লোভ সংবরণ করতে পারছি না। হাদীসটি আমরা প্রায়ই আলোচনা করে থাকি। ঘটনাটি এমন :

‘একবার এক বুড়ি মা তাঁর কাছে এসে বললেন, আমার জন্য দো‘আ করুন যাতে আমি জান্নাতে যেতে পারি। (নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্মিত হাসি দিয়ে) বললেন, হে ওমুকের মা! জান্নাতে তো কোনো বুড়ি প্রবেশ করবে না। এ কথা শুনে বৃদ্ধা খুবই উদ্বিগ্ন হলেন, এমনকি কাঁদতে শুরু করলেন। তিনি ভাবলেন কখনোই বুঝি তার জান্নাতে যাওয়া হবে না। বৃদ্ধার অবস্থা দেখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (হেসে) ব্যাখ্যা করে বললেন, কোনো বৃদ্ধ মহিলা বৃদ্ধাবস্থায় জান্নাতে যাবে না। বরং আল্লাহ তাদেরকে নতুন সৃষ্টিতে রূপান্তরিত করবেন। অতঃপর পূর্ণযৌবনা-কুমারী হয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবেন। অতঃপর তিনি তাঁকে আল-কুরআনুল কারীমের (নিম্নোক্ত) আয়াত তিলাওয়াত করে শোনালেন,

‘নিশ্চয় আমি তাদেরকে বিশেষভাবে সৃষ্টি করব। অতঃপর তাদেরকে বানাব কুমারী, সোহাগিনী ও সমবয়সী।’ {সূরা আল-ওয়াকিয়া, আয়াত : ৩৫-৩৭} [গায়াতুল মারাম : ৩৭৫][1]

ঠাট্টা-মজাক করেও মিথ্যা বলার অবকাশ নেই। একটি হাদীসে এসেছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাবধান করে বলেছেন,

‘ওই ব্যক্তির জন্য কঠিন শাস্তি, কঠিন শাস্তি এবং কঠিন শাস্তি যে কেবল লোক হাসাতে মিথ্যে বলে।’ [আবূ দাউদ : ৪৯৯০][2]

আজকাল প্রায়শই মোবাইলে কথা বলার সময়ও দেখা যায় অনেককে অহেতুক মিথ্যা বলতে। বাসায় কথা বলার সময় অনেকে নিজের অবস্থান থেকে একটু বাড়িয়ে আরেকটু সামনের কথা বলেন। অথচ সঠিক জায়গার কথা বললে তার তেমন কোনো ক্ষতি বৃদ্ধি হয় না। যানবাহনে প্রায়ই দেখি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে অনেক ভদ্রলোক দিব্যি সবার সামনে মিথ্যা বলে যাচ্ছেন। অফিসের কর্তাকে ধোঁকা দিয়ে জনারণ্যে অসত্য বলছেন! আছেন এক জায়গায় আর বলছেন তার থেকে কয়েক মাইল এগিয়ে।

শিশুদের সঙ্গেও আমরা মাঝেমধ্যে অকারণে মিথ্যে বলি। যেমন হাতে কিছু না নিয়েও কিছু আছে বলে সোনামনিকে কাছে টানার চেষ্টা করা ইত্যাদি। অথচ এটিও মিথ্যার অন্তর্ভুক্ত। আবদুল্লাহ ইবন ‘আমের রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

‘একদা আমার মা আমাকে ডাকতে লাগলেন, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের বাসায় বসা ছিলেন। (তিনি আমাকে কোলে নিতে চাইছিলেন আর আমি যেতে চাইছিলাম না।) এমতাবস্থায় তিনি বললেন, কাছে এসো, তোমাকে একটি জিনিস দেব। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথা শুনে বললেন, সত্যিই কি তুমি তাকে কিছু দেবে নাকি এমনিই তাকে কাছে নেবার জন্য বলছ? মা বললেন, আমার খেজুর দেবার ইচ্ছা আছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যদি তোমার খেজুর দেবার ইচ্ছা না থাকত এবং শুধুমাত্র তাকে আহ্বান করাই উদ্দেশ্য হত তাহলে তোমার আমলনামায় একটি মিথ্যা বলার গুনাহ লেখা হত। [আবূ দাঊদ : ৪৯৯১]

পবিত্র ধর্ম ইসলামে সর্বদা সত্য বলা এবং মিথ্যা বর্জনের শিক্ষা দেয়া হয়েছে। মিথ্যার নিন্দা করা হয়েছে বহু আয়াত এবং হাদীসে। বিভিন্নভাবে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে মিথ্যা বলতে। উৎসাহিত করা হয়েছে সত্য উচ্চারণে। বাংলাই প্রবাদই রয়েছে মিথ্যা মানুষের বিপদ ডেকে আনে। আমাদের মহান রব ইরশাদ করেন,

‘সেদিন ধ্বংস মিথ্যাবাদীদের (সত্য তথা ইসলামকে অস্বীকারকারীদের) জন্য।’ {সূরা আল-মুতাফফিফীন, আয়াত : ১০}

মিথ্যাবাদীদের তীব্র ভর্ৎসনা করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,

‘একমাত্র তারাই মিথ্যা রটায়, যারা আল্লাহর আয়াতসমূহে বিশ্বাস করে না। আর তারাই মিথ্যাবাদী।’ {সূরা আন-নাহল, আয়াত : ১০৫}

যাচ্ছে তাই সত্য-মিথ্যা বলতে আল্লাহ বারণ করেছেন। যেমন ইরশাদ হয়েছে,

‘আর তোমাদের জিহ্বা দ্বারা বানানো মিথ্যার উপর নির্ভর করে বলো না যে, এটা হালাল এবং এটা হারাম, আল্লাহর উপর মিথ্যা রটানোর জন্য। নিশ্চয় যারা আল্লাহর উপর মিথ্যা রটায়, তারা সফল হবে না।’ {সূরা আন-নাহল, আয়াত : ১১৬}

হাদীসে মিথ্যা বলার স্বভাবকে মুনাফিকের আলামত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যেমন আবদুল্লাহ ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

চারটি দোষ যার ভিতর থাকবে সে হবে পূর্ণাংগ মোনাফেক ।আর যার ভিতর এই চারটার কোন একটা দোষ থাকবে,সে যতক্ষন তা বর্জন না করবে ততক্ষণ তার ভিতরে একটা মোনাফেকীর লক্ষন থাকবে। দোষ গুলো হল :যখন কথা বলে মিথ্যা বলে, আমানত রাখলে খেয়ানত করে ,প্রতিশ্রুতি দিলে তা ভঙ্গ করে এবং কারো সাথে ঝগড়া হলে গালাগালি করে।

[সহীহ বুখারী ও মুসলিম)

রাসুল (সাঃ)বলেছেন,"সব চেয়ে বড় মিথ্যাচার এই যে কোন ব্যক্তি যা আদৌ দেখেনি তা নিজের চোখ দুটোকে দেখায়।(বুখারী)

মিথ্যা হল জঘন্যতম বিশ্বাসঘাতকতা।হযরত সুফিয়ান বিন আ সীদ হারামী (রাঃ) বলেন,আমি রাসুল (সাঃ)কে বলতে শুনেছি যে এটা অত্যান্ত জঘন্য ধরনের খিয়ানত তথা বিশ্বাসঘাতকতা যে তুমি তোমার ভাইকে একটা কথা বলছ এবং ষে তোমাকে সত্যবাদী মনে করে তা বিশ্বাস করেছে।অথচ তুমি যে কথাটা তাকে বলেছ তা ছিল মিথ্যা। (আবু দাউদ)

মিথ্যা বলা শুধু মন্দ স্বভাবই নয়; বরং তা গুনাহ ও অশ্লীলতার দিকে নিয়ে যায়। যেমন আবদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

‘সত্য বলাকে নিজের ওপর অপরিহার্য করে নাও। কেননা সত্যবাদীতা নেকীর দিকে আর নেকী জান্নাতের দিকে নিয়ে যায়। যে মানুষ সত্য বলে আর এ জন্যে চেষ্টা করতে থাকে, এতে সে আল্লাহ তা‘আলার কাছে সত্যবাদীদের তালিকায় লিপিবদ্ধ হয়ে যায়। আর মিথ্যা থেকে বিরত থাক, কেননা মিথ্যা গুনাহ ও অশ্লীলতার দিকে আর গুনাহ এবং অশ্লীলতা জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়। যে মানুষ মিথ্যা বলতে থাকে আর এ দিকে আল্লাহ্’র কাছে তার নাম মিথ্যাবাদীদের তালিকায় লিপিবদ্ধ হয়ে যায়। [বুখারী : ৬০৯৪; মুসলিম : ২৬০৭]

মিথ্যা সাক্ষ্য কত বড় পাপের কাজ তালক্ষ করার ব্যাপার ।কিন্তু এখন মুসলমানের মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান একটা সাধারন বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।তারা এটাকে গুনাহের কাজ বলেই গন্যই করে না।

খুরাইম ইবনে ফাতেক(রাঃ) হতে বর্ণিত।তিনি বলেন একবার রাসুল (সাঃ) ফজরের নামাজ পড়ালেন।মানুষের দিকে মুখ ফিরিয়ে বসার পরিবর্তে তিনি সোজা উঠে দাড়ালেন এবং তিনবার ঘোষনা দিলেন। মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া এবং শিরক করা উভয়ই সমপর্যায়ের পাপ। এর পার তিনি সুরা হজ্জ এর ৩০-৩১ আয়াত পাঠ করেন"তোমরা অপবিত্রতা অর্থাত মূর্তিপূজা হতে বেচে থাক ।মিথ্যা বলা থেকে বেছে থাক এবং আল্লাহর জন্য নিবিষ্টচিত্ত হয়ে যাও।শিরক পরিহার করে তাওহীদকে আকড়ে ধর।"(আবু দাউদ)

রাসুল (সাঃ) আরো বলেছেন,"কিয়ামতের দিন মিথ্যা সাক্ষ্যদাতার জন্য জাহান্নামের ফায়সালা না হওয়া পর্যন্ত সে পা নাড়াতে পারবে না"।(ইবনে মাজা )

আমাদের দেশে দোকানীরা দামদরের এক পর্যায়ে ক্রেতাকে পটাতে বলেন, ‘এটা আমি ... দিয়ে কিনেছি। আপনাকে এই দামে দিলে আমার কোনো লাভই থাকে না ভাই।’ তারপর দিব্যি তিনি ওই তথাকথিত কেনা দামেই দিয়ে দেন। ক্রেতার মন ভেজাতে কেউ বলেন, ‘আপনাকে এই দামে বেঁচলে কেবল আমার চালানটা উঠবে ভাই’ কিংবা এটা আমার কেনা দাম, এরচে কম বলবেন না ইত্যাদি বাক্যও উচ্চারণ করেন।

আবু যর (রাঃ) থেকে বর্ণিত ।রাসুল(সাঃ) বলেন,"তিন ব্যক্তির সাথে আল্লাহ কিয়ামতের দিন কথা বলবেন না ।তাদেরকে পবিত্র করবেন না এবং তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে ।এ কথা গুলো তিনি তিনবার উচ্চারন করেন।তখন আবু যর (রাঃ) বলেন----ইয়া রাসুলাল্লাহঃ এই চরম হতভাগ্য ও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি কারা।তিনি বলেন,"এরা হ্‌লঃ১,পায়ের গিরার নীচে বস্ত্র পরিধানকারী,২,দান বা উপকার করে খুটাদানকারীনী,৩,মিথ্যা কসম করে দ্রব্যসামগ্রী বিক্রয়কারী।(মুসলিম,তিরমিজি।ইবনে মাজা)

আবু বুরায়দা (রাঃ)থেকে বর্ণিত, রাসুল (সাঃ) বলেন,"যে ব্যক্তি এই খথা বলে শপথ করে যে, আমার কথা যদি মিথ্যা হয় তবে আমি মুসলমান নই।যে মিথ্যাবাদী হবে সে যা বলেছে তাই হবে আর যদি সে সত্যবাদীও হয় তাহলে সে আর কখনো পূর্ণ ইসলামে র পথে ফিরে আসতে পারবে না।(আবু দাউদ,ইবনে মাজা)

সবচে বড় গুনাহ গুলোর অন্যতম হলো মিথ্যা বলা। যেমন আবদুর রহমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

‘আমি কি তোমাকের সবচে বড় কবীরা গুনাহের খবর দেব না?’ তিনি তিনবার উচ্চারণ করলেন প্রশ্নটি। সাহাবীরা বললেন, অবশ্যই হে আল্লাহর রাসূল। তিনি বললেন, আল্লাহর সঙ্গে শরীক করা, পিতা-পাতার অবাধ্য হওয়া –তিনি বসা অবস্থা থেকে হেলান দিয়ে বললেন- এবং মিথ্যা কথা বলা। বর্ণনাকারী বলেন, তিনি কথাটির পুনরাবৃত্তি করতেই থাকলেন, এমনকি মনে মনে বললাম, ইস তিনি যদি নীরব হয়ে যেতেন! [বুখারী : ২৬৫৪; মুসলিম : ৮৮]

শুধু শাস্তির ভয়ই দেখানো হয় নি; ঠাট্টাচ্ছলেও মিথ্যা পরিহার করলে তার জন্য শ্রেষ্ঠ পুরস্কারের ঘোষণাও করা হয়েছে। যেমন আবূ উমামা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বল।

‘আমি ওই ব্যক্তির জন্য জান্নাতের আশপাশে কোনো গৃহের জামিন হব যে উপযুক্ত ও সঠিক হবার পরও (বিপক্ষের) তর্ক ছেড়ে দেয়, আর ওই ব্যক্তির জন্য জান্নাতের মধ্যস্থলে কোনো গৃহের জামিন হব যে ঠাট্টাচ্ছলেও মিথ্যে পরিহার করে এবং জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থানে কোনো গৃহের জামিন হব যে তার চরিত্রকে সুন্দর বানায়।’ [আবূ দাঊদ : ৪৮০০][3]

আল্লাহ তা‘আলা প্রতিটি ঈমানদারকে মিথ্যা থেকে বেঁচে চলার তাওফীক দান করুন। সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করুন সত্যবাদীদের কাতারে। আমীন।

বিষয়: বিবিধ

২৫৯৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File