খেয়ালী শঙ্খচিল
লিখেছেন লিখেছেন সুমাইয়া হাবীবা ১১ এপ্রিল, ২০১৪, ০৮:১৫:৩২ রাত
-খালিদ সাহেব বাড়ি যাবেননা!
-হ্যা যাবো। এইতো হয়ে গেছে।
-আপনার ছেলেটা কেমন আছে?
-আছে আলহামদুলিল্লাহ। বলেই কাজে মন দিল খালিদ। সোহাগ সাহেব প্রতিদিন প্রায় নিয়ম করে নিয়েছেন আজওয়াদের খোজ নেয়া। এই স্বার্থপর বাস্তবতার দিনে এটুকু আন্তরিকতা খালিদের কাছে সুপেয় শীতল জল মনে হয়। যদিও ও জানে কেন এই আন্তরিকতা তবুও লাগে। ওইজন্যই লাগে। ছেলেটা অসুস্থ জেনেও তাকে দত্তক নিতে চেয়েছে। বলেছে যেমনই হোক, বোবা কালা, জড়ভড়ত যাই হোক তার স্ত্রী একটা সন্তান চায়! সেটাতো সম্ভব নয় জানিয়ে দিয়েছে তবুও খোজখবর রাখে। খালিদের অপজিটের চেয়ারটায় সোহাগ সাহেব বসেন। এখানে টীচারদের চেয়ার নির্দিষ্ট। একটা ব্যাংকে কাজ করতো আগে। কিন্তু ছেলেটার দেখাশোনার জন্য সম্ভাবনাময়ী ব্যংকার এখন হয়ে গেল কলেজ টীচার। সোহাগ সাহেবের পাঁচ বছরের সংসার। ছেলেপুলে নেই। কত কিই না করেছে বাট লাভ হয়নি কোন। ডাক্তার বলেছে কোন সমস্যা নেই। তাহলে! তাহলে টা কেউ জানে না। ওপরওয়ালার কি ইচ্ছা!
আজওয়াদের তখন দু’মাস। এ বয়সে যখন বাচ্চারা খিদে পেলে কাঁদে, আওয়াজ শুনলে তাকায়, সেসব কিছুই করলোনা। তখনই শীলার মনে ভয়টা ঢুকলো। একদিন বললোও সে কথা।
-শোন! বাবু না.. ডাকলে আমার দিকে তাকায় না।
-খুব বেয়াদব ছেলে তো! খালিদ খুব সিরিয়াস মুখ করে বললো।
-ধ্যাততেরি! ফাইজলামী করোনা তো!
সেদিনের মত ব্যপারটা চাপা পড়ে গেলেও কয়েকমাস পর আবার একদিন উঠলো। খালা এলেন নাতি দেখতে। দেখেই মাকে বললেন ডাক্তার দেখাতে। সেদিন আবার শীলা কথা তুললো।
-অ্যাই! বাবুতো কানে শোনে না মনে হয়! প্রমিরা আজ অনেক জোরে গান ছেড়েছিল। আমি ঘুমাতে পারলাম না কিন্তু বাবুর ঘুমই ভাঙ্গলোনা!
খালিদ আশাবাদী মানুষ। তাই শীলার কথায় তেমন কান দিলনা সে। আসলে ওর ধারনা ছিল সব মায়েরাই বাচ্চাদের নিয়ে শুধু শুধুই ভয় পায়। বাবু গতকাল সকালে হাগু করেছে। আজ কেন বিকালে করলো! বাবু জোরে শব্দ করে ঢেকুর দিল কেন! এইসব হাবিজাবি।
আজওয়াদের এক বছর পূর্ণ হলো। সে হাটেনা, দাঁড়ায়না, বসেনা, হামাগুড়িও দেয়না। ডাক্তার চেঞ্জ হতে লাগলো একের পর এক। শুধু আজওয়াদ নয় বিভিন্ন টেষ্ট হলো বাবা-মায়েরও। জানা গেল আজওয়াদের অক্ষমতার কথা। আজওয়াদের ব্রেইনে ব্লাড সার্কুলেশনটা ঠিকমত হয়না। ওর নিউরনগুলো ততটা স্ট্রং নয়। যতটা মেসেজ ওর ব্রেইনে যাবার কথা ততটা যায়না। ব্রেইন নিতে পারেনা। ফলে ও জানে না কিভাবে সাড়া দিতে হয়, ওর ব্রেইন ওকে বলেনা কমিউনিকেট করতে, হাঁটতে, বসতে। আরো ব্যপার স্যাপার। কারন অনেকই থাকতে পারে আবার অনেকের কোন কারন ছাড়াই হতে পারে। ওদের টেষ্ট করে ব্লাডগ্রুপ ম্যাচ ছাড়া আর কোন পয়েন্ট খুজে পাওয়া গেলনা। বাস্তবতা কে মেনে নিল সবাই। যদিও হাল ছাড়তে রাজী নয খালিদ। শুরু হলো অটিজমের চিকিৎসা। খালিদের মার সারাদিন জায়নামাজে কাটে। শীলাও চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু আস্তে আস্তে সংসারটা তার কাছে দুর্বিষহ হয়ে উঠতে লাগলো। হঠাৎ স্বপ্নভঙ্গের যাতনায় পেয়ে বসলো তাকে। সন্তান সংসার সব বিষময় লাগছে। আজওয়াদ কাদলেও তার ভেতরটা নাড়া দেয়না। খাওয়াতেও ভুলে যায়। প্রায়দিনই গোসল হয়না। শীলা আবার কনসিভ করতে চায়। খালিদ অনড় তার অবস্থানে।
-আজওয়াদ আরেকটু বড় হোক। একটু উন্নতি হোক তারপর দেখা যাবে।
-না! আমি এক্ষুনি চাই! এই বোঝাটাকে আর টানতে পারছিনা আমি!
শীলা ক্ষেপে উঠে। খালিদ প্রচন্ড আহত হয় তবে এড়িয়ে যায়। জানে লাভ নেই। দিনের পর দিন সে দেখছে শীলার আচরন। সে বোঝে শীলার কষ্টটা।
ভাইবোনদের মধ্যে শীলা সবার ছোট। সবথেকে চুজি, স্মার্ট, সুন্দর। সবার ফুটফুটে সুন্দর সুস্থসবল বাচ্চা। আর তার কপালটা কেন এমন হলো! শীলার দম বন্ধ হয়ে আসে। ইদানীং আজওয়াদকে দেখলেই তার রাগ হতে শুরু করে।
আরো ছ’মাস কেটে গেলো। আজওয়াদ এখন বাবার সাথে ঘুমায়। রাতে ওর নাক দিয়ে ঘড়ঘড় কেমন একরকম আওয়াজ বের হয়। শীলা সেটা সহ্য করতে পারেনা। কয়েকদিন দাদীর কাছে ঘুমাতে দিলেও দাদী বয়স্ক মানুষ অতটা পারেনা। রাতে যে আবার বারবার বিছানা ভেজায় সে। তাই খালিদ ওকে নিয়ে ড্রয়িংরুমে শোয়।
দু’বছর পূর্ণ হলো। আজওয়াদ এখন হামা দিয়ে ঘুরে বেড়ায়। তবু শীলা সন্তুষ্ট নয়। তার একদম সুস্থসবল বাচ্চা চাই। ইদানীং অধিকাংশ দিনই সে বাপের বাড়ি থাকে। শত বোঝানোতেও যখন কাজ হলোনা খালিদ হাল ছেড়ে দিল। মা শীলার পক্ষ নিল।
-এমন ঝামেলা বাড়িতে রাইখা কি লাভ হইবো ক! তোর অফিস আদালত নাই! তার চেয়ে এনজিওতেই দিয়া দে। ঘরের বউ ঘরে আসুক। আবার পোলাপান হইলে সব ভুইলা যাবি গা!
খালিদ কোন উত্তর দেয়না। ভাবে। কিন্তু নিজের বিবেকের কাছে নিজের সুখচিন্তা হেরে যায়। আজওয়াদের নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকায় সে। হুইল চেয়ারে বসে আপনমনে খেলছে। তার আত্মজ। তার থেকে একটু একটু করে সেল নিয়ে কত যত্ন নিয়ে এই শরীরটা তৈরী করেছেন সৃষ্টিকর্তা। ওর দিকে তাকালে খালিদ যেন নিজেকেই দেখতে পায়। ছেলেটা পেয়েছেও বাপের চেহারা। মনে হয় যেন মুখখানা কেটে বসিয়ে দেওয়া। মাথা ভর্তি কোঁকরানো চুল। অপূর্ব এই সৃষ্টিকে বুকে না টেনে ছুড়ে ফেলে দেব! কিভাবে!
খালিদ পারেনি। শীলা আর ফেরেনি। ডিভোর্সের আবেদনে বলেছিল ব্লাড গ্রুপের মিলই নাকি দায়ী। খালিদ আর্গুমেন্টে যায়নি। ব্যাংক ছেড়ে একটা কলেজে এলো। দুপুরের মধ্যেই ফিরতে পারে। সেই থেকে আজওয়াদের সমস্ত দায়িত্ব নিজে পালন করে। সাথে চিকিৎসাতো চলছেই। ধীরে ধীরে আজওয়াদ অনেক আপগ্রেড হলো। আজওয়াদের সাত বছর হয়ে গেল। কানে একটা মেশিন লাগানো হয়েছে। অনেককিছুই শুনতে পায়। শুনলে বুঝতেও পারে। আবার একটু পরেই সেন্সটা হারিয়ে যায়। হেসে খেলে বেড়ায়। দৌড়ায়। তবে নিজে নিজে আপনমনে। খালিদ হাল ছাড়েনা। ওর শিক্ষাদান চলতেই থাকে। কখনো সাড়া দেয়া শেখায়, কখনো খেলা করা, কখনো মানুষ চেনা, কখনোবা অনুভূতি প্রকাশ। আজওয়াদ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। ইদানীং খালিদের খুব বাবা ডাক শুনতে ইচ্ছে করে। অন্য কারো কাছ থেকে নয় শুধু আজওয়াদের মুখ থেকে। তবে কথা বলার ব্যপারটায় ডাক্তাররা কোন আশা দেয় না। খালিদের যে এটাই বেশি দরকার। একটু বাবা শুনার জন্য তৃষ্ণায় বুকটা চৌচির হয়। তবে সে ফাটল কাউকে দেখাতে চায়না সে। যদিও সে জানে সেটা কোনদিন হবেনা। তাতে কি। এটুকু তৃপ্তি থাকবে সে শিখিয়েছে। নিজের দিকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো-
-এটা কে জানো? বাবা। বলো বা.. বা.. বা.. বা.. বাবা..। আজওয়াদ হাসে। খিলখিল করে হাসে। খালিদ আবার শেখায়। আবার..আবার..
মার সামনে শেখায়না। কি বলে! মা ওকে এখনও মেনে নিতে পারেনি। তার ধারনা আজওয়াদ নামক আপদটার জন্যই তার ছেলের জীবনটা নষ্ট হয়ে গেল।
২)
সোহাগ সাহেব দাওয়াত দিয়েছেন। ঈদের পর সবাই সবার বাসায় দাওয়াত দেয়। ওদের কলেজের এটা একটা অলিখিত নিয়ম হয়ে দাড়িয়েছে। খালিদ এখন আজওয়াদকে নিয়ে বেরোয়। বিকেলে পার্কে যায়। তবে কারো বাসায় যায় না। কিন্তু সোহাগ সাহেব খুব করে ধরেছেন, আজওয়াদ কে নিয়ে যেতে হবে। সোহাগ সাহেব আসলে মন থেকেই আজওয়াদ কে খুব ভালোবাসেন। খালিদ পৌঁছে দেখলো কেউ এখনো আসেনি। সোহাগ সাহেব আজওয়াদকে টান দিয়ে কোলে তুলে নিলেন। চোখ দু’টো জলে টলটল করছে। খালিদ ওনার চোখে যেন নিজেকেই আবিষ্কার করলো আজ। আচ্ছা সব পিতার ভেতরের চেহারা কি একই হয়! সোহাগ সাহেব চোখ মুছে বললো-
-খালিদ ভাই ছেলেটাকে তো দিলেন না। মাঝে মাঝে যদি এমন নিয়ে আসেন আপনার ভাবী খুব খুশি হবে। বেচারী একদম ভেঙ্গে পড়েছে। আজওয়াদ ততক্ষনে নেমে ভেতরে হাটা দিয়েছে। হাটতে হাটতে একদম রান্নাঘরে চলে এল। মিসেস সোহাগ থমকে দাঁড়ালো। হার্টবিট কি একটা মিস হয়ে গেল! এ কে! তু..তুমি কে! কার সাথে এসছো! বাচ্চাটা কোন কথা না বলে আপনমনে হাটছে। এ ঘর ও ঘর করছে। মিসেস সোহাগও অজানা টানে বাচ্চাটার পিছু পিছু ঘুরছেন। হাত বাড়িয়ে কোলে নিতে চাইলেন। কিন্তু বাচ্চাটা উঠলোনা। ছাড়িয়ে চলে গেল। বাচ্চাটা ঘুরে ঘুরে ড্রয়িংরুমে রওনা হলো। উনি আবার পিছু নিলেন। বাচ্চাটা বা..বা..বা..বা.. করতে করতে গিয়ে যার কোলে উঠলো তাকে দেখে শীলার মাথা ঘুরে উঠলো। শীলা আর এগোতে পারলোনা। বসে পড়লো মেঝেতে।
খালিদের মুখে তৃপ্তির হাসি অথবা কান্না মিলেমিশে একাকার অবস্থা। সে কি শুনছে! তার ছেলে তাকে বাবা বলে ডাকছে! বাবা! এও কি সম্ভব! ইয়া আল্লাহ! কি মহিমা তোমার! আজ হঠাৎ এমন অজানা অচেনা বাড়িতে এসে ওর ব্রেইন সাড়া দিল! বাবা ডাকতে ইচ্ছে হলো! মহিমাটা না বুঝলেও ওর এতদিনের কষ্ট ত্যাগ শ্রম সবই যে আজ সার্থক। কালই সে সাদকা করে আসবে।
শীলা ডাইনিংয়ের মেঝেতে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। ভাগ্যিস লোকটা ওকে দেখতে পাচ্ছে না। যেন নাই দেখে আল্লাহ! চোখ ফেটে জল গড়াচ্ছে। মনে পড়ে নিজেরই বলা শেষ কথা ‘এই জঞ্জাল আমি ঘাড় থেকে নামাতে চাই!’ কিন্তু ওর তো আর কিছু করার ছিলনা। যে সেদিন বিছানায় বাখরুম করে মাখামাখি হয়ে থাকতো একটা জড় হয়ে, অর্ধমৃত সে ছেলে আজ এমন রাজপুত্র হবে তা কে ভাবতে পেরেছিল! খালিদ তার কথা রেখেছে। সত্যিই সার্থক বাবা ও। লোকটা এদিক ফিরলেই তাকে দেখবে। অতীত সামনে এসে বর্তমানটা নষ্ট হওয়ার ভয়ে উঠে ভেতরে রওনা হলো। কিন্তু ওর ঝাপসা চোখে আর কি কিছুই দেখা যাবে! ওর কানে যে ত্রমাগত বাজছে বা..বা..বা..বা!
বিষয়: Contest_father
১৬১৬ বার পঠিত, ৩৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
সুন্দর হয়েছে গল্পটি।
প্রশ্নাতীতভাবেই একটি স্টিকিযোগ্য পোস্ট! তবে বিজ্ঞ মডুরা কি করেন জানিনাহ...
অসাধারন লিখেছেন আপু!আরো লিখুন যেন আমরা আরো ভাল ভাল লেখা পড়তে পারি ইনশা আল্লাহ
জাযাকাল্লাহ
পোস্ট দেবার পরপরই পড়েছিলাম,
কিন্তু ব্যস্ততার কারণে সময়মত মন্তব্য করতে পারিনি!
আমার মনে হয় জাতি আপনার কাছে অনেক কিছুই দাবী করতে পারে!
আর সে সক্ষচতা যে আপনার আছে তাতো দেখাই যায়!! >-
আর এটা এমন কাজ- করতে চাইলেও সবাই পারেনা!!
মন্তব্য করতে লগইন করুন