জিহাদ বনাম জঙ্গিবাদ

লিখেছেন লিখেছেন ডব্লিওজামান ১৯ জুলাই, ২০১৬, ০২:২৫:৪৬ রাত

জিহাদ বনাম জঙ্গিবাদ

ঘটনা ১.

জিহাদের ময়দান। এক কাফিরের বুকে চড়ে বসেছেন শেরে খোদা আলী (রা.)। তলোয়ার উঁচু করলেন। উপায়ান্তর না দেখে কাফির লোকটি শেষ প্রতিবাদ হিসেবে হযরত আলীর (রা.) মুখে থু থু নিক্ষেপ করল। মজার ব্যাপার, হযরত আলী (রা.) তলোয়ার নামিয়ে লোকটিকে ছেড়ে দিলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় কাফিরও হতম্ভম্ব। কারণ জানতে চাইলে হযরত আলী (রা.) বললেন, আমি তোমাকে হত্যা করছিলাম আল্লাহর জন্য। তোমার প্রতি আমার ব্যক্তিগত কোন বিদ্বেষ ছিল না। থু থু দেওয়ার পর তোমার প্রতি আমার রাগ জন্মালো। এবার আমি যদি তোমাকে হত্যা করি তবে নিজের কিছুটা আক্রোশও তাতে মিশে থাকবে, তা শুধু আল্লাহর জন্য হবে না।

মন্তব্যঃ এমতাবস্থায় কাফিরকে হত্যা করাও জিহাদের শামিল, ইসলামে জায়েজ। তবে হযরত আলী (রা.) যা করলেন এটা হচ্ছে ইসলামের সর্বোচ্চ শিক্ষা। এর ফল, কাফিরের ইসলাম গ্রহণ।

ঘটনা ২.

কোন এক জিহাদে জনৈক সাহাবী এক কাফিরকে হত্যা করতে উদ্যত। ভয়ে লোকটি ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর স্বীকারোক্তি উচ্চারণ করল। তারপরও সাহাবী তাঁকে হত্যা করলেন। জিহাদের পর রাসূলুল্লাহ ﷺ এর নিকট এই সংবাদ পৌঁছালে তিনি সাহাবীকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলেন। উত্তরে সাহাবে বললেন, লোকটি প্রাণ বাঁচাতে ঈমান এনেছিল। রাসূলুল্লাহ ﷺ তখন সাহাবীকে তিরস্কার করলেন।

মন্তব্যঃ কারণ ঈমানের অবস্থা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই জানেন। শরী‘আত শুধু বাহ্যিক স্বীকারোক্তির ভিত্তিতেই একজন মানুষকে মুসলিম হিসেবে পরিগণিত করে যদি না সে কোনরূপ কফ্‌রী কাজ করে। অন্তরের বিচার পরকালে নির্ধারিত।

ঘটনা ৩.

রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সময়কাল। উহুদের পরবর্তীতে মুনাফিকরাও চিহ্নিত। মুসলিমগণ সকলকেই চিনেন। রাসূলুল্লাহ ﷺ নিজেও সবার পরিচয় জানেন। প্রিয় সাহাবী হুজাইফা ইবন ইয়ামানকেও জানিয়েছেন। কিন্তু এরপরও মুনাফিকদের ব্যাপারে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অথচ পরকালে তাদের নিশ্চিত ও ভয়ঙ্কর শাস্তির কথা কুর’আনেই ঘোষিত হয়েছে। কারণ, মানুষ বলবে আল্লাহর রাসূল ﷺ নিজ সাথীদেরই হত্যা বা শাস্তি দিয়েছেন।

মন্তব্যঃ শুধু ঈমানের, বাহ্যিক ঈমানের, বদৌলতে মুনাফিকরা মুসলিমদের জামা‘আতেই স্থান পায়। আর মুনাফিকদের ব্যাপারে হলেও মুসলিমদের মধ্যে ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টি কিংবা ভুল বোঝবুঝির অবকাশ সৃষ্টিকর কাজ নিঃসন্দেহে পরিত্যাজ্য।

এবার মূল আলোচনায় যাওয়া যাক -

জঙ্গিবাদ ও জিহাদ, এ দুটো শব্দের বহুল ব্যবহার বর্তমান সময়ে লক্ষণীয়। তবে আমার সন্দেহ, জোর সন্দেহ, যারা ব্যবহার করছেন তাদের অধিকাংশই এ শব্দদ্বয়ের পার্থক্য ভালভাবে জানেন না। সহজ ভাষায়, শব্দদ্বয় সমার্থক তো নয়ই, আদর্শ ও চেতনাগত দিক থেকে বলতে গেলে বিপরীতই বলা চলে।

‘জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহ, সংক্ষেপে জিহাদ, ইসলামেরই একটি মৌলিক অংশ। সোজা কথায় আল্লাহর কালিমা বা দীনকে সমুন্নত রাখার জন্য মুসলিমদের যাবতীয় প্রচেষ্টাই জিহাদ। সেখানে আত্মিক পরিশুদ্ধির জন্য নিজের প্রবৃত্তির সাথে লড়াই যেমন জিহাদ, তেমনই জান-মাল, অসি-মসী ইত্যাদি দ্বারা যে কোন ধরণের চেষ্টাই জিহাদ। তবে শর্ত হচ্ছে এসব জিহাদের উদ্দেশ্য ও পদ্ধতি ইসলাম অনুযায়ী হতে হবে।

জিহাদের উদ্দেশ্য বা পদ্ধতি কী? বিস্তারিত বা গবেষণাধর্মী আলোচনায় না গিয়ে সাধারণভাবে বলা চলে, জিহাদের উদ্দেশ্য ও পদ্ধতি এর পরিচয়েই স্পষ্ট। জিহাদ হবে ফী সাবিলিল্লাহ, আর “لاعلاء كلمة الله“ বা আল্লাহর দীনকে সমুন্নত রাখার জন্য। দীনের প্রচার, দীনের বিরুদ্ধে যে কোন ধরণের অপতৎপরতা রোধ, মজলুমের সাহায্য এসব দীনকে সমুন্নত রাখারই অংশ। এসব ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্যে যা-ই করা হোক, যেভাবেই করা হোক না কেন তা জিহাদ হবে না। আর পদ্ধতি ? তা-ও বলা আছে; সাবিলিল্লাহ বা আল্লাহর রাস্তায়। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশনা অনুসারে। কেননা আল্লাহর হুক্‌ম অনুযায়ী না হলে কোন কিছুই আল্লাহর জন্য হয় না।

আর জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ (الإرهاب, Terrorism) বলতে সাধারণ কথায় ভীতিপ্রদর্শন দ্বারা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যলাভের চেষ্টাকেই বুঝায়। যদিও ইদানিং শব্দটি ধর্মীয়, বিশেষ করে ইসলামী, স্বার্থ হাসিলের ক্ষেত্রেই বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে। কেন ও কাদের দ্বারা শব্দটা মুসলিমদের সাথে লেগে গেছে বা লাগানো হয়েছে সে আলোচনায় যাচ্ছি না। আজ শুধু জঙ্গিবাদ ও জিহাদের বাস্তবতাই বলব।

সংক্ষেপে বলা যায়, জিহাদ ও জঙ্গিবাদ এক নয়। এদের উদ্দেশ্য ও কর্মপদ্ধতি ভিন্ন। অনেকেই হয়ত বলবেন, উদেশ্য এক। কিন্তু যদি বাস্তবতার নিরিখে, নিরাসক্তভাবে বিচার করা যায় তাহলে সহজেই চোখে পরবে যে জঙ্গিবাদ যে ইসলাম প্রতিষ্ঠার কথা বলে তা কিসের ইসলাম? আর এর কতটুকু নিজেদের স্বার্থে আর কতটুকু আল্লাহর জন্য? আর জঙ্গিবাদের পদ্ধতি বা কর্মপন্থা ? পাঠকই বিচার করুন –

জিহাদের একটা অংশ হল ক্বিতাল, সধারণ অর্থে লড়াই বা যুদ্ধ। ক্বিতালের সাথে অনেকেই জঙ্গিবাদকে মিলিয়ে ফেলে গোটা জিহাদকেই জঙ্গিবাদের সমর্থক বলে মনে করেন। অথচ ক্বিতালেরও সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। ক্বিতালের কিছু মূলনীতি উল্লেখ করছি –

১. মুসলিমদের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা দিতে হবে; কার বিপক্ষে হবে তাও পরিষ্কার করতে হবে। অকস্মাৎ আক্রমণ ইসলাম সমর্থন করে না।

২. মুসলিমদের যথাযথ কর্তৃপক্ষই এই ঘোষণা দেওয়ার অধিকারী। এমন লোক বা সরকার বা গোষ্ঠী যাদেরকে সব মুসলিম নিজেদের প্রশাসক হিসেবে মেনে নেন। কিংবা উলুল আমর যারা তাঁরাই শুধু ক্বিতালের ঘোষণা দিতে পারবেন।

৩. ক্বিতাল ঘোষণার পূর্বে ন্যূনতম তিনটি প্রস্তাব পেশ করতে হবে –

ক. ইসলাম গ্রহণ

খ. সন্ধি

গ. জিযিয়া প্রদান

এর কোন একটি অন্য পক্ষ গ্রহণ করলে ক্বিতাল জায়েজ নেই।

৪. শুধু ইসলাম সম্মত কারণেই ক্বিতালের ঘোষণা দেওয়া যাবে; যেমন- আত্মরক্ষায়, মুসলিমদের উপর কোন অবিচারের প্রতিশোধ নিতে, ইসলাম প্রচার কার্যে বাঁধা সৃষ্টি করলে ইত্যাদি।

৫. কিছু মানুষ ক্বিতালের আওতামুক্ত থাকবে; নারী, শিশু, বয়স্ক, বেসামরিক লোক, ধর্মগুরু বা ধর্মীয় উপাসনালয়ে আশ্রিত ব্যক্তি, অক্ষম, অসুস্থ, সেসব সামরিক লোক যারা অস্ত্র ত্যাগ করেছে বা যুদ্ধে জড়িত নয়, মুসলিম- নামমাত্র হলেও।

উল্লেখ্য যে, এসব শ্রেণির মানুষ যদি যুদ্ধ বা গুপ্তচর বৃত্তি কিংবা কাফিরদে সাহায্য সহযোগিতায় জড়িত থাকে তবে তাদের জন্য ইসলাম প্রদত্ত এ ছাড় বাতিল বলে হয়ে যেতে পারে।

৬. ক্বিতালে কিছু কাজ নিষিদ্ধ; যেমন,

ক. ফল-ফসল, গবাদিপশু, বাগান, উপাসনালয়, গ্রাম-শহর কিছুই নষ্ট করা যাবে না।

খ. আগুনে পুড়িয়ে মারা কিংবা মুখমণ্ডলে আঘাত করে বিকৃত করে মারা যাবে না; মৃতদেহের বিকৃতি করা যাবে না।

গ. হারাম মাসসমূহের সম্মান রক্ষা করতে হবে।

৭. ক্বিতালরত অবস্থাতেও ইসলামের আহকাম, বিশেষ করে সালাত, ত্যাগ করা যাবে না।

এই মূলনীতিগুলো হচ্ছে ক্বিতাল প্রসঙ্গে শরী‘আতের সীমানা বা জায়েজের শেষ পর্যায়। অর্থাৎ কোনভাবেই এর অন্যথা করা যাবে না। ইসলামের প্রকৃত যুদ্ধনীতি তো আরো সুন্দর। উপরের ঘটনা তিনটিতে সে সৌন্দর্যের কিছু পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। বস্তুত মানবিক আর যৌক্তিকতার আদর্শ বলা যায় ইসলামের ক্বিতাল বিধিমালাকে।

পরিশেষে, বলতে চাই, জঙ্গিবাদ কি এই মুলনীতিগুলোর কোন একটিও মেনে চলছে? যেখানে একটিমাত্র নীতি লঙ্ঘিত হলেও ইসলামী শরী‘আতে যা ক্বিতাল হিসেবে গণ্য হয় না সেখানে কোন একটি মূলনীতি না মেনেই জিহাদের দোহাই দেওয়া কতটুকু যুক্তিসঙ্গত তা বুঝাই যায়। উল্লেখ্য, মূলনীতি গুলো শুধু ক্বিতালের, জিহাদের নয়। জিহাদের মূলনীতি আরো মানবিক ও সুন্দর। কেননা জিহাদের লক্ষ্য- লড়াই যুদ্ধ এড়িয়ে শান্তির মাধ্যমে ইসলাম প্রচার। স্বাভাবিকভাবেই এর মূলনীতিতে কোমলতা ও সহনশীলতার আদর্শ প্রতিফলিত হয়। সুতরাং জিহাদ ও ক্বিতালের ধারণাকে জঙ্গিবাদের সাথে মিলিয়ে ফেললে আপাত ইসলাম ও মুসলিমেরই ক্ষতি। নিজেদের স্বার্থেই জঙ্গিবাদের প্রতিকার ও প্রতিরোধে আমাদের এগিয়ে আসতে হবে।

সূত্র : Mustafa Monjur

বিষয়: বিবিধ

১৩৮৪ বার পঠিত, ১৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

374913
১৯ জুলাই ২০১৬ রাত ০৩:১৭
কুয়েত থেকে লিখেছেন : অন্তরের বিচার পরকালে নির্ধারিত। ভালো লাগলো ধন্যবাদ
২০ জুলাই ২০১৬ দুপুর ১২:৫৬
311024
ডব্লিওজামান লিখেছেন : পিলাচ !!!
০৫ আগস্ট ২০১৬ রাত ০৩:১৮
311684
কুয়েত থেকে লিখেছেন : مرحبا بك اخي العزيز وشكرا Good Luck Good Luck
374921
১৯ জুলাই ২০১৬ সকাল ০৭:৪৪
শেখের পোলা লিখেছেন : বিশ্লেষন ভাল লাগল।
২০ জুলাই ২০১৬ দুপুর ১২:৫৮
311025
ডব্লিওজামান লিখেছেন : বেশ তো ! আসেন মাঠে প্রয়োগ করি
374923
১৯ জুলাই ২০১৬ সকাল ০৮:৪১
হতভাগা লিখেছেন : ইসলাম ও মুসলমানদের দমিয়ে রাখতে ইহুদী নাসারারাই মোটা মাথার, বিপথে যেতে ইচ্ছুক, তারছিড়া, মুসলমান নামধারী পোলাপানদের ব্রেইন ওয়াশ করছে । সেটা তাদের স্বার্থ হাসিলের জন্যই।

আজ পর্যন্ত এসব মোটা মাথাওয়ালারা যেসব কাজ করেছে তার সবকটিই ইহুদী নাসারাদের লুটপাটের ক্ষত্রে বানিয়ে দিয়েছে , লুটপাটকে জায়েজ করতে সাহায্য করেছে ।

অপরাধ সংগঠিত হবার পর যে বেশী লাভবান হয় সন্দেহের তালিকায় সেই সবার আগে চলে আসে।

২০ জুলাই ২০১৬ দুপুর ০১:০০
311026
ডব্লিওজামান লিখেছেন : ইউ আর কারেক্ট ডিয়ার
374926
১৯ জুলাই ২০১৬ সকাল ০৯:৪৪
মোঃ ওহিদুল ইসলাম লিখেছেন : সুন্দর ও দারুণ দারুণ উদাহরণসমৃদ্ধ বিশ্লেষণ।
২০ জুলাই ২০১৬ দুপুর ০১:১৭
311027
ডব্লিওজামান লিখেছেন : আপনিও পীলাচ পা ই ছে ন
374931
১৯ জুলাই ২০১৬ সকাল ১১:৩৬
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ
আসলে এই সন্ত্রাসবাদ এর সাথে ইসলামের কোন সম্পর্কই নাই।
374990
২০ জুলাই ২০১৬ দুপুর ০১:১৯
ডব্লিওজামান লিখেছেন : জী ভাই, এই সন্ত্রাসবাদ এর সাথে ইসলামের কোন সম্পর্কই নাই।
375090
২২ জুলাই ২০১৬ বিকাল ০৫:৫৫
মনসুর আহামেদ লিখেছেন : Excellent
০৩ আগস্ট ২০১৬ সকাল ১১:৫৪
311577
ডব্লিওজামান লিখেছেন : সাথে থাকবেন
378137
৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৬ রাত ০৯:১৫
মনসুর আহামেদ লিখেছেন :

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File