বিভাজন ও জ্ঞানপাপী আমরা

লিখেছেন লিখেছেন বিদ্যালো১ ২৩ নভেম্বর, ২০১৩, ১২:৫৮:৪৪ দুপুর

প্রাথমিক থেকে কলেজ-ভার্সিটি পাশ করতে সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যবশত পাঠ্য বইয়ের অনেক গল্প-কবিতা-উপন্যাস পড়তে হয়েছে। এগুলোর কিছু ছিল প্রচণ্ড শিক্ষণীয় আর কিছু আনন্দদায়ক। দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় এর কিছু কিছু মনে আছে, আর অধিক সংখ্যকই আমাদের মেমোরিতে স্থান করতে ব্যর্থ হয়েছে। পাশ করা যেখানে মুখ্য, মনে রাখা শেখানে দূরহ। তাই এসব পাঠ্য কিছু শেখাতে ব্যর্থ হলেও সফলভাবেই ভুলে যাওয়ায় সফল হয়েছে। আমাদের কিছু কিছু আচরণ ও সেই সব গল্প-কবিতার কথা খুব মনে পরছে।

‘সিংহ ও ইঁদুর’ গল্পটি ক্লাস ওয়ানের বইয়ে ছিল। (ছিল লিখছি এই কারনে যে বইয়ের ব্যা পক ‘প্রগতিশিলতার’, আধুনিকতার ও ডিজিটালাইজড এর কারনে এই সেকেলে গল্পটি স্থান পেয়েছে কিনা জানা নেই। গল্পটি আমাদের ছোটদের প্রতি দয়ার শিক্ষা দেয়ার পাশাপাশি ছোটরাও যে বড়দের বিপদে সাহায্য করতে পারে সেই শিক্ষা দেয়। ‘কচ্ছপ ও খরগোশ’-এর গল্পও প্রথম শ্রেনীতেই পড়া। এটি আমাদের কচ্ছপের মত ধীর কিন্তু পরিশ্রমী হওয়ার শিক্ষাই শুদু দেয় না, খরগশের মত অহংকারী হতেও বারণ করে। একইভাবে দ্বিতীয় শ্রেণীর বাংলা বইয়ের ‘পিঁপড়ে ও ঘুঘু’ গল্পটি একে অন্যের বিপদে-আপদে সাহায্য সহযোগিতা করার শিক্ষা দেয়। ‘আমি হব’, ‘সবার সুখে’, বা ‘কাজের লোক’ কবিতাগুলোর কোনো আবেদন আমাদের জীবনে আজ অনুপস্থিত। তৃতীয় শ্রেণীর ‘স্বাধীনতার সুখ’, ‘আদর্শ ছেলে’ বা ‘আমাদের গ্রাম’ কবিতাগুলো ভুলার অযোগ্য হলেও এদের শিক্ষাটা বোধহয় বহু আগেই ভুলে বসে আছি। এমন লিস্ট তৈরি করলে সেটা অনেক বড় হবে।

নজরুল ব্যর্থ হয়েছেন আমাদের জাগাতে। তাইত আর এই জাতির রাত পোহায় না। জসীমউদ্দিনও আজ সেকেলে কবিতে পরিণত হয়েছেন যিনি চেয়েছিলেন দুঃখী, অনাহারীর পাশে থেকে “আমার বাড়ি সবার বাড়ি”র দূরত্ব গোছাতে। নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্য তার ‘কাজের লোক’র মাধ্যমে আমাদের অলসতা দূর করাতে পারেনি। একইভাবে রজনীকান্ত নিজের গড়া “কাঁচা ঘর” ব্যাবহার করতে উদ্বুদ্ধ করতে ছেয়েও সফল হননি তার ‘স্বাধীনতার সুখ’এ।

এমন আরও অনেক কবিতা ও গল্প আমাদের স্মৃতি থেকে হারিয়ে গেছে; যেমন করে “মহানবীর ভালবাসা”, “সবাই মিলে করি কাজ”, “খলিফা হযরত আবু বকর (রা)”, “খলিফা হযরত উমর (রা) ও “বিদায় হজ” প্রাথমিকের বাংলা বই থেকে প্রগতিশীলদের প্রগতির চাপে হারিয়ে গেছে। বিভিন্ন গল্প কবিতা আমাদের স্মৃতি থেকে হারানোর অনেক কারন থাকলেও ঐ গল্পগুলো মধ্যযুগীয় ‘বর্বর’ ধর্মের কিছু ‘বর্বরতার’ বহিঃপ্রকাশের কারনেই হয়ত বই থেকে আজ নিশ্চিহ্ন। এই হারানো বা নিশ্চিহ্নের দল আরও ভারি হয় যখন আমাদের বিবেক, জ্ঞান, সহমর্মিতা, সহানুভূতি, সহনশীলতা, ধৈর্য সহ আরও অনেক কিছু এর সাথে যোগ দেয়।

আমরা পোস্ট মডার্নরা শুধু মাত্রাতিরিক্ত অধৈর্যশীলই নই, অসহনশীলও। এই অসহনশীলতা যে কত তুচ্ছ কারনে হতে পারে, তা আমরা কল্পনাও করতে পারি না। একে অন্যের মতকে সহ্য করাতো দূরের কথা, যেন শুনতেও নারাজ। একটা সাধারণ ব্যাপারে মত পার্থক্য বিভেদ থেকে বিভাজনে রূপ নেয়। কেউ যেন ছাড় দিলে অন্যজনের কাছে মুখ দেখাতে পারবে না। 'sacrifice’ শব্দটি যেন কারো অভিদানেই আর অবশিষ্ট নেই। এই বিভেদের কারন খুঁজতে গেলে ব্রিটিশ আমলে ফিরে যেতে হবে। তারা তাদের শাসনের সুবিধার্থে আমাদের বিভাজিত করে রেখেছিল; আর যাওয়ার সময় বিভাজনের শেষ পেরেকটা জায়গা বরাবরই মেরেছে। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর আজকের বিভাজনের পটভূমি সেখানেই রচিত। তারা আজ বুঝে বা নাবুঝে সেই ফাটলে কুরাল চালাচ্ছে। আর আমরা আবেগপ্রবন বিবেকহীন জনগন তাদের সাথে সুর মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি।

তবু আমরা ‘এগিয়ে’ যাচ্ছি। দেশ ৭১ থেকে বর্তমানে অনেক বেশি উন্নত। অনেক অনেক বহুতল বিল্ডিং, রাস্তাঘাট, ব্রিজ, ফ্লাইওভারের মত উন্নতির ভারে দেশ আজ নুয়ে পরার দশা। শুধুমাত্র নীতি-নৈতিকতা, সততা, আদর্শের পারদই নিম্নমুখী। তাই দেশ দুর্নীতির দিকেও বার বার উন্নতি করে ১ম হয়। ‘১০,০০০ মেগাওয়াট’ (আসলে নিট উৎপাদন প্রায় ৬৪০০ মেঃওয়াঃ) বিদ্যুৎ উৎপাদনের উন্নতিতে আমরা ভাসিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি মাথা পিছু ঋণের Complain খাওয়ার খবর কেও রাখিনা।

আর একটি উন্নতির কথা না বললেই নয়’ অপরের দোষ খোঁজা; এই যেমন আমি করে যাচ্ছি। তাই আশা করতে পারিযে “ঐক্য” কিছুদিন পর জাদুঘরে স্থান করে নিবে। বিভেদই একমাত্র পন্থাঃ যৌক্তিক বা অযৌক্তিক যাই হোক না কেন। ক্লাস সেভেনের “Quarrelling” বা “The Old Man and His Sons” আমাদের আজো ঐক্যবদ্ধ করতে পারেনি। দেশের শীর্ষ মহল থেকে স্কুল, কলেজ, ভার্সিটির সিনিওর-জুনিওররা পর্যন্ত আজ বিভাজিত, খণ্ড-বিখণ্ডিত, বিভক্ত হয়ে আছি। শীর্ষমহলকে বিভাজিত করে রেখেছে ধরলেও আমাদের বিভাজনের কারন কিছু ক্ষেত্রে আমাদের egoism, অসহনশীলতা ও অন্যের মতের প্রতি অশ্রদ্ধাশীল থাকা। আমরা ভুলে যাইযে সব কিছু আকাশের মত নয়; কিছু কিছু জিনিস গিরগিটির মত। তাই আমাদের ছোটখাটো অমিল গুলো এড়িয়ে চলার মাধ্যমেই আমরা সেরা জীবের বিশেষত্ব তুলে ধরতে পারি। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমরা আজো ব্রিটিশদের “devided & Rule”র স্বীকার। আর ফলাফল? যা হওয়ার তাই হচ্ছেঃ “we are ruled.”

বিষয়: বিবিধ

১৪৪২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File