কারবালার শাহাদাত যদি আশুরার দিবসে না ঘটতোঃ এক ভাইয়ের প্রশ্নের প্রেক্ষিতে

লিখেছেন লিখেছেন শাহাদাত মাহমুদ সিদ্দিকী ১২ অক্টোবর, ২০১৬, ১১:০৬:২৬ রাত



"যদি হোসাইন (রাঃ) এর শাহাদাৎ ১০ মুহররম ছাড়া অন্য কোনদিন হত, তাহলে কোন দিন আশুরা পালন করা হত বা রোযা রাখা হত? ১০ মুহররম নাকি হোসাইন (রাঃ) এর শাহাদাৎ দিবসে?"

-ভাই একটি চমৎকার প্রশ্ন তুলেছেন। আমরা সবাই জানি, আল্লাহ তা'লা কিছু বিশেষ স্থান(যেমন- মাসজিদে হারাম, নববী, আকসা ইত্যাদি ) বিশেষ কিছু সময়(যেমন- আশুরা, লাইলাতুল ক্বদর, দুই ঈদের দিন, জুম্মা বার ইত্যাদি ), কিছু বিশেষ মাস(যেমন- রমযান, মহররম, সা'বান ইত্যাদি)'কে নিগুঢ় মহাজাগতিক কোন কারণে বৈশিষ্টমন্ডিত করে রেখেছেন।

ইমাম হোসাইনের শাহাদাত আশুরার দিনে না হলেও সুন্নাহ অনুসারে আমরা আশুরা পালন করতাম। এবং সুন্নাহ অনুসরণ করেই বিরোধীতা করতাম ইহুদীদের- আশুরার সাথে তার আগে বা পরে সিয়াম পালনের মাধ্যমে। (কারণ আল্লাহর সমস্ত নবী অন্য যে কারো চেয়ে, এবংকি ইহুদী খৃষ্টানদের কাছে তাদের নবীদের চেয়েও আমাদের বেশী কাছের, প্রিয় নবী স. আমাদের তা'ই শিখিয়েছেন।)

কিন্তু কারবালায় ইমাম হোসাইনের শাহাদাতের ঘটনা আশুরার দিনে সংঘটিত হওয়ায়, সেটি ত্রিমাত্রিক রুপ লাভ করেছে, এবং আশুরার প্রকৃতিও তার ঐতিহাসিক ধারায় অধিকতর বৈশিষ্টমন্ডিত হয়েছে, আমরা মনে করি। ত্রিমাত্রিক রুপ লাভ করলো কিভাবে?-

প্রথমত, আশুরার দিনে সংঘটিত হওয়ায় কারবালা নিঃসন্দেহে একটি বৈশ্বিক, কালাতিক্রমী স্তরে উপনীত হয়েছে।

দ্বিতীয়ত, মানবজাতির ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক প্রবাহের অনন্য সম্মিলন ঘটিয়েছে।

তৃতীয়ত, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো- আশুরার দিনে সংঘটনের ভেতর দিয়ে কারবালার শাহাদাতের ঘটনাকে আল্লাহ তা’লা মানব ইতিহাসের সেই চিরন্তন হক ও বাতিলের দ্বন্দ্বের ধারায়(যা নানাভাবে এদিক-সেদিক করে প্রথমে হেগেল এবং তারপর মার্ক্স গ্রহণ করেছেন) উপস্থাপন করেছেন। এবং সেই দ্বন্দ্বের সবচেয়ে ট্রাজিক(tragic) মানবিক রুপায়ন আমরা কারবালায় এসে পাই।

দেখুন, ইমাম হোসাইন নবী নন। কোন সেনাদলের আজ সেনাপতি নন। জীবিত অন্যান্য সাহাবীরা বলছেন- ‘এখন কথা বলার সময় নয়’।

সাথে ভক্ত-অনুরক্তের বিপুল কোনো বহরও নেই। কোনো প্রদেশের গভর্ণরও নন যে, দুই-চার জন অধঃস্তন তার নির্দেশ অনুসরণ করবে। নানা ফন্দী-ফিকির করে বিপুল অর্থের মালিকও হতে পারেননি যে- টাকা ছিটিয়ে সমর্থক জোগাড় করবেন। তিনি আজ একা। অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে একা।

নানা নেই, মা নেই, বাবা নেই। ভাই ইমাম হাসানকেও বিষ প্রয়োগে শহীদ করা হলো। কথা বলার মতো, পরামর্শ চাওয়ার মতো, নিজের বেদনা শেয়ার করার মতো, কেউ নেই কোথাও। একদিকে অর্ধ পৃথিবীর সম্রাট ইয়াজীদ ইবনে মুয়াবিয়া, মুসলিম উম্মাহর অর্থে পোষা বিপুল নৃশংস্য সৈন্য-সামন্ত, তাবেদার, মোসাহেব…।

অন্যদিকে ইমাম হোসাইন, সাথে পরিবার পরিজন মিলে একশোরও অনধিক।

কেনো এই তীব্র, তুমুল ও ব্যাপক বৈষম্যের সংগ্রাম! আপোষহীনতা কেনো এতো আবশ্যক অপরিহার্য হয়ে উঠলো?... জোরপূর্বক খিলাফাত কুক্ষিগত করার প্রক্রিয়ায় শেষ্ পর্যন্ত নির্বাচিত খলিফা ইমাম হাসানের সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান তার রাজত্ব চালায়। কিন্তু তার মৃত্যুর পূর্বে ইয়াযীদকে শাসক বানিয়ে যে শাসনধারা মুসলিম উম্মাহর উপর চাপিয়ে গেলো, তা কোনো মুসলমান তো দূরে থাক, বিবেক বুদ্ধিসম্পন্ন সাধারণ কোন মানুষও তা মেনে নেবে না। ইমাম হোসাইন জানতেন- এ শুধু শাসক বদলের ব্যাপার নয়। এটা প্রকারান্তরে ইসলাম তথা আল্লাহর সার্বভৌমত্বের স্থলে মানুষের প্রভূত্বকে স্থলাভিষিক্ত করার শামিল। এজন্যই তিনি প্রায়ই বলতেন-

‘ইয়াযীদও যদি বৈধতা পেয়ে যায় তাহলে ইসলামের এখানেই পরিসমাপ্তি’!

তাই বলা যায়, এখানে এসে কারবালা ইসলাম ও জাহিলিয়াত দ্বন্দ্বের ইতিহাসে একাকার হয়ে গেছে। না, একাকার হয়নি, বিশিষ্ট হয়ে রয়েছে। কারবালায়- মানুষের সাথে অসুরের দ্বান্দ্বিক ইতিহাসের মানবিক রুপায়নের সাথেই বরং আর সব ইতিহাস একাকার হয়ে রয়েছে। দেখুন আশুরার সাথে হযরত আদাম, নূহ, ইব্রাহীম কিংবা মূসা আ.সহ যারাই জড়িত, সবগুলো ঘটনাই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে হক ও বাতিল, শয়তান ও মানুষের দ্বন্দ্বে অনুরণিত। আরো মজার ব্যাপার হলো- সবগুলোই ছিল মুক্তিপ্রাপ্তির, বিপদ-উদ্ধারের! কারবালাই শুধু ব্যতিক্রম! হয়তো এটি তারচেয়েও বড় কোনো মুক্তির, তারচেয়েও বড় বিপদ হতে উদ্ধারের!...

আর্থাৎ,

কারবালার ঘটনাটাই এমন যে-

এর প্রকৃতি ও তাৎপর্যই এমন যে-

এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটই এমন যে-

এর মহাজাগতিক গুরুত্বই এমন যে-

কাকতালীয় নয়,

অনন্য অপরিহার্য সমূহ গুরুত্বপূর্ণ কোনো কিছুই কাকতালীয় হয় না

এটি আশুরার দিনে, এবং শুধু আশুরার দিনেই ঘটার মতো…

কারবালার শাহাদাত আশুরার দিবসেই বাঞ্ছনীয় ছিলো,

ছিলো অপরিহার্য…

যেনো-

সামগ্রিক চেতনায় পাঠ করে আশুরার ইতিহাসে সংঘটিত হক-বাতিলের দ্বন্দ্ব-

সাথে সংযুক্ত লেটেস্ট অধ্যায় ‘কারবালা’-

আশ্বস্ত এবং উদ্দীপ্ত হয় মুসলিম উম্মাহ-

প্রবৃত্ত হয় আগামী দিনের ইতিহাস রচনার সংগ্রামে...

এরপর যে প্রশ্নটি আসে:

..তবে আশুরার দিবসে কারবালা কেন সর্বাগ্রে গুরুত্ব পাবে?...

''তাহলে আপনার মতে কারবালার ঘটনা না ঘটলেও ১০ মুহররম আশুরা পালন করা হত। সেক্ষেত্রে আশুরা দিবসে কারবালার ঘটনা সর্বাগ্রে কেন গুরুত্ব পাবে?"

-এটাও অনেক সুন্দর একটি প্রশ্ন। এর অসংখ্য কারণ থাকতে পারে। সব আমরা আসলে জানতে পেরেছি বললে বাড়াবাড়ি হবে। বিষয়টি যতটুকু নিবিড় ঈমানী মনোযোগ দাবী করে- তা থাক, বাঙালী মুসলমান তার স্বাভাবিক বুদ্ধিবৃত্তিক মনোযোগও দিতে পারেনি, হাজারও জটিল কারণে! যাই হোক, আপনি ইচ্ছে করলে উপরের কথা গুলো থেকেই এর খানিকটা জবাব পেতে পারেন।

তারপরও আমরা কিছুটা হেল্প আপনাকে করতে পারি। আসুন কিছু পয়েন্ট আউট করা যাক-

প্রথমত,

এটি অর্থাৎ, কারবালার শাহাদাত আশুরার সাথে উম্মতে মোহাম্মদী(মুসলিম উম্মাহ)’কে সরাসরি সম্পৃক্ত করে।

দ্বিতীয়ত,

কারবালার স্যাকরিফাইস ইসলামের ইতিহাসে(আদম আ. থেকে মুহাম্মাদ স. পর্যন্ত) উম্মতদের মধ্য হতে সর্বোচ্চ স্যাকরিফাইস।

তৃতীয়ত,

কারবালা আশুরার নিগুঢ় তাৎপর্যপূর্ণ সমৃদ্ধ ইতিহাসের লেটেস্ট অধ্যায়।

চতুর্থত,

আশুরার ইতিহাসে(মানবজাতির ইতিহাসেও) সংঘটিত কোনো ঘটনাই আজ কারবালার শাহাদাতের মতো অতোটা প্রাসঙ্গিক নয়। মানবজাতি যেভাবে সাম্রাজ্যবাদী দূষ্টচক্রে আবর্তিত হতে বাধ্য হচ্ছে কিংবা বলতে পারেন- মুসলিম উম্মাহ যেভাবে রাজতান্ত্রিক ও ঔপনিবেশিক দালালদের খপ্পরে পড়েছে, বহুবিদ আন্তঃজালিক ফাঁদে হাঁসফাঁস করছে- সেই অমানবিক দাসত্বের চোরাগলি থেকে কারবালা উম্মাহকে/মানবজাতিকে পথ দেখায়, অটল থাকার পাথেয় জোগাড় করে দেয়। দেখুন- কারবালাঃ মুসলিম উম্মাহর এসিড টেস্ট এবং মানবমুক্তির বিদ্যাপীঠ https://web.facebook.com/shahadat.siddiquee.9/posts/1124155724306554?

পঞ্চমত,

সেই থকে আজ পর্যন্ত সাম্রাজ্যবাদবিরোধী যতো আন্দোলন, মুসলিম নামধারী স্বৈরাচারদের প্রতিপক্ষে যতো কার্যকর সংগ্রামে উম্মাহ অনুপ্রাণিত হয়েছে, তার সবগুলোই মূলত কারবালার অফুরন্ত খুন প্রবাহেরই অসমাপ্ত পরিণতি। এবং অনাগত দিনগুলোতেও বিস্তৃত হবে কারবালা সীমা…।

সেই প্রবাহেরই সর্বোত্তম সংস্করণ হয়ে আসবেন ইমাম মাহদী। একমাত্র 'খিলাফাত মিন হাজিন নবুয়াত'ই হতে পারে কারবালার প্রতিশোধ। সে পর্যন্ত প্রতিটি মুমিন-

কখনও কারবালার শোকে-

কখনও শাহাদাতের আকাঙ্ক্ষায় কিংবা

দ্রোহের আগুনে, জেনে না জেনে-

ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায় জ্বলতে থাকবে…

ভুলে যাবে হয়তো আশুরা কারবালার ভেদ!

জানবে না, হয়তো জানতে চাইবেও না-

কেন আশুরা দিবসে কারবালার ঘটনা এসে যায় সর্বাগ্রে!

পায় সর্বাধিক গুরুত্ব!!...

বিষয়: বিবিধ

১১৬৪ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

378645
১৩ অক্টোবর ২০১৬ রাত ১২:৩৬
স্বপন২ লিখেছেন : ভালো লাগলো / অনেক ধন্যবাদ /

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File