পাকিস্তান নির্বাচন ২০১৩ দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি প্রক্রিয়ায় ভূমিকা

লিখেছেন লিখেছেন হাবীব ১১ জুন, ২০১৩, ০৩:০০:৫২ দুপুর

১১ মে ২০১৩ পাকিস্তানের ইতিহাসে একটি ব্যাতিক্রমি ঘটনার জন্ম দেয় । সমস্ত আশংকা পেছনে ফেলে দেশটির ইতিহাসে সর্বোচ্চ সংখ্যক ভোটারের উপস্থিতিতে একটি গ্রহণযোগ্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধিনে সফল জাতিয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় । ফলে ৬৬ বছরের ইতিহাসে প্রথম বারের মত একটি নির্বাচিত সরকার মেয়াদ শেষ করে আর একটি নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এসেছে । এই নির্বাচন পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, উন্নতি ও স্থিতিশীলতার জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ ঠিক তেমনি দক্ষিণ এশিয়া, এশিয়া অঞ্চল ও বৈশ্বিক নিরাপত্তা ও শান্তির ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ।

পাকিস্তান দক্ষিণ এশিয়ার একটি দেশ এবং দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা ও শান্তি দেশটির উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল । দক্ষিণ এশিয়া ভৌগলিকভাবে আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভারত, নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ অনেকের মতে মায়ানমার ও চীনের তিব্বত অঞ্চলের সমন্বয় । ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ-অর্থনৈতিকভাবে দক্ষিণ এশিয়া বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বৈশ্বিক রাজনীতিতে এবং সাথে সাথে বৈশ্বিক জ্বালানি নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য একক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ । এই অঞ্চলটি মধ্যপ্রাচ্য (ইরান, ইরাক) মধ্য এশিয়া, রাশিয়া, চীন, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া এবং ভারত মহাসাগরের মাঝে অবস্থিত ।

দক্ষিণ এশিয়া প্রাকৃতিক সম্পদ এবং মানব সম্পদে সমৃদ্ধ । দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভৌগলিক আকার, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক সামর্থ্য ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে পরস্পরের মধ্যে অনেক অমিল রয়েছে । সাথে সাথে দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ সমস্যা, পারস্পারিক কোন্দল এবং সুসম্পর্কের ঘাটতি আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও শান্তির জন্য হুমকি হিসেবে কাজ করেছে এবং করছে । যেমন – মাওবাদী আন্দোলন, তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদ, ভারতের সেভেন সিস্টারে স্বাধীনতা আন্দোলন, বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা ইত্যাদির আঞ্চলিক প্রভাব রয়েছে । মায়ানমারের রোহিঙ্গা সমস্যা, আফগানিস্তানের শরণার্থী সমস্যা পুরো অঞ্চলের জন্য মানবিক বিপর্যয় । আফগানিস্তানের জঙ্গি সংগঠনগুলো পাকিস্তানকে অনেক আগে থেকে ব্যবহার করে আসছে এবং তাদের কার্যক্রম ক্রমে পাকিস্তান হয়ে ভারত, বাংলাদেশ, চীনের তিব্বত সহ পুরো অঞ্চলে বিস্তৃত হচ্ছে । পাশাপাশি আঞ্চলিক বানিজ্য ঘাটতি, বানিজ্য বাঁধা, নদী ও পানি সমস্যা, সীমান্ত সমস্যা, জ্বালানি ও খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য সমস্যা, দারিদ্রতা, মৌলিক মানবাধিকার বঞ্চিত জনজীবন ইত্যাদি বহুবিধ সমস্যায় জর্জরিত দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো । তাছাড়া কাশ্মীর ইস্যু এবং পারমানবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা ভারত-পাকিস্তানকে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ মুখি করে রেখেছে ।

দক্ষিণ এশিয়া আরো কয়েকটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ, যেমন –ভারতের আঞ্চলিক পরাশক্তি হওয়ার স্বপ্ন, ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব ও পারমানবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা, চীনের এশিয়া অঞ্চলে পরাশক্তি হওয়ার স্বপ্ন, আফগান সমস্যা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চীন ভীতি, ভারত-পাকিস্তানের সাথে কৌশলগত সম্পর্ক । এছাড়াও মধ্যপ্রাচ্য ও মধ্য এশিয়ার তেলসহ প্রাকৃতিক সম্পদের নিয়ন্ত্রণ ও ভারত মহাসাগরের বানিজ্য নিরাপত্তা এবং বাজার দখলের প্রয়োজনে এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের একক আধিপত্য প্রয়োজন । এ জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারত ও মিয়ানমারের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বৃদ্ধি এবং পাকিস্তানকে কাজে লাগিয়ে অন্যান্য দেশগুলোকে ব্যবহার করে আফগানিস্তানে স্থায়ী নিয়ন্ত্রণের কাজটি প্রায় শেষ করে ফেলেছে । কোন অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার ও স্থায়ী করতে হলে সে অঞ্চলে স্থায়ী অবস্থান এবং ঘনিষ্ঠ মিত্রের প্রয়োজন । এই অঞ্চলে যা পাকিস্তানকে বাদ দিয়ে ভারত ও মিয়ানমারের মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পেতে চাইছে । চারটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশ (রাশিয়া, চীন, ভারত, পাকিস্তান), ইরানের উত্থান, মধ্যপ্রাচ্যের সহ মুসলিম বিশ্বের রাজনৈতিক পরিবর্তন, উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার ইত্যাদি যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও চীনের প্রভাব বিস্তারের জন্য বড় বাঁধা । আবার পাকিস্তানের নিরাপত্তা, আফগানিস্তানের পুনর্গঠন এবং কম শক্তিশালী দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর নিরাপত্তা ও উন্নতির জন্য এই জটিল ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ-অর্থনৈতিক পরিবেশ সব মিলিয়ে কৌশলগত কারণে স্বার্থের দ্বন্দ্বে জটিল থেকে জটিল আকার ধারণ করেছে ।

এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তানে সরকার পরিবর্তন কি আদৌ শান্তির বার্তা বাহক নাকি সমস্যা আরও জটিল হবে ? নিশ্চয়ই বিশ্লেষণের দাবি রাখে । উল্লেখিত জটিল পরিবেশের কেন্দ্রে রয়েছে পাকিস্তান । পাকিস্তান মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র পারমাণবিক অস্ত্র সমৃদ্ধ দেশ । দেশটির জনসংখ্যা প্রায় ১৯ কোটি যার দুই তৃতীয়াংশের বয়স ৩০ এর নিচে ।

দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি প্রক্রিয়ায় পাকিস্তানের নির্বাচনের ভূমিকা বুঝার আগে শান্তি ও নিরাপত্তার ধারণা একটু হলেও আলোচনার দাবি রাখে । বিশ্বায়নের এই যুগে একটি দেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনা প্রবাহ খুব সহজেই প্রতিবেশী সহ অন্যান্য দেশে প্রভাব বিস্তার করবে স্বাভাবিক । জোহান গ্যালটাং শান্তিকে সংজ্ঞায়িত করেছেন – Peace is absence of violence. আর এই Violence হতে পারে বিভিন্ন ভাবে । যেমন –শারীরিক আক্রমণ কিংবা মানসিক আক্রমণ তা আবার গোপন মদদে বা প্রকাশ্য সাহায্য সহযোগিতার মাধ্যমে হতে পারে । অশান্তি ছরিয়ে যেতে পারে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ আক্রমণের মাধ্যমে যা ইচ্ছাকৃত হোক আর অনিচ্ছাকৃত । অশান্তি ছড়িয়ে যেতে পারে রাষ্ট্রীয় কিংবা ব্যাক্তিগত কাঠামোগত বিপর্যয়ের মাধ্যমে ।

সুতরাং শান্তি কে আমরা নিরাপত্তা ও উন্নতির সাথে মিলিয়ে চিন্তা করতে পারি । নিরাপত্তা ও শান্তির বিষয়গুলো প্রকৃত পক্ষে একটি বহুমাত্রিক বিষয় যার সাথে কখন, কিভাবে, কোথায়, কেন, কার জন্য ইত্যাদি প্রশ্নগুলো জড়িত । সাথে সাথে কতগুলো সাধারণ বিষয় যেমন –যুদ্ধ, সন্ত্রাসবাদ, গনহত্যা, মানুষ হত্যা, জাতিগত দাঙ্গা বা সংঘর্ষ, বিভিন্ন ধরনের হুমকি, মানব নিরাপত্তা, অস্ত্র প্রতিযোগিতা, আন্ত রাষ্ট্রীয় সংগঠিত অপরাধ যেমন –মাদক, মানব ও অস্ত্র পাচার, দুর্নীতি, মানবাধিকার, ধর্ম, আইনের শাসন, সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ঐক্য ও স্থিতিশীলতা ইত্যাদি বহু বিষয় জড়িত । সুতরাং স্থায়ী এবং চরম শান্তি ও নিরাপত্তা কখনই সম্ভব নয় বরং একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তা উন্নতি লাভ করতে পারে । আর তা হতে পারে যুদ্ধ ও দ্বন্দ্ব কমিয়ে আনার মাধ্যমে, সৃষ্ট সমস্যা সমাধানের যোগ্যতার উপর নির্ভর করে, অহিংস উপায় অবলম্বনের মাধ্যমে, অস্ত্র প্রতিযোগিতা কমিয়ে আন্তরাষ্ট্রীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে (সরকারী বা বেসরকারি) কাজে লাগিয়ে, মানবাধিকার ও মানব উন্নয়নে ব্যয় বাড়িয়ে, সামরিক খাতে ব্যয় কমিয়ে আনার মাধ্যমে । স্বল্প মেয়াদি এবং দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করা সম্ভব ।

উল্লেখিত আলোচনা সামনে রেখে যদি প্রশ্ন করি পাকিস্তানের একটি নির্বাচন কিভাবে এতগুলো জটিল জট খুলতে পারবে ? গভির দৃষ্টিতে দেখলে অনেক আশার সাথে নিরাশও হতে হয় । পুরো দক্ষিণ এশিয়া এখন নির্বাচন মুখি । নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপে এ বছরের মাঝামাঝিতে বা শেষের দিকে এবং বাংলাদেশ, আফগানিস্তান ও ভারতে আগামি বছরের শুরুতে জাতিয় নির্বাচন হবে । সুতরাং দেশগুলির অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিবর্তনে পাকিস্তানের এই নির্বাচনের কিছুটা হলেও শিক্ষা ও প্রভাব থাকবে ।

১১ মে নির্বাচনের মাধ্যমে মিয়া নওয়াজ শরিফ ১৪ বছর পর তৃতীয় বার (১৯৯০, ১৯৯৭, ২০১৩) প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন । নওয়াজ শরিফের দল পাকিস্তান মুসলিম লিগ-এন একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা লাভ করে সরকার গঠন করেছে । এই নির্বাচনের বিশেষ চমক হল গত পাঁচ বছরের ক্ষমতাসীন দল পাকিস্তান পিপলস পার্টি প্রত্যাশার চেয়ে ব্যাপক পরাজয় বরণ এবং সাবেক ক্রিকেটার ইমরান খানের দল তেহরিক-ই ইনসাফের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভাব । অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো তেমন কোন সুবিধা করতে পারেনি বিশেষ করে ইসলামি দলগুলো যারা প্রত্যাশার চেয়েও খারাপ করেছে ।

পাকিস্তানের নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে প্রথমে নজরে পড়বে এই নির্বাচনের ফলে পাকিস্তানের চারটি প্রদেশের মধ্যে সুস্পষ্ট বিভক্তির সৃষ্টি হয়েছে । সিন্ধুতে পিপিপি, পাঞ্জাবে মুসলিম লিগ- এন, পাখতুন খাওয়া প্রদেশে ইমরান খানের পিটিআই এবং বেলুচিস্থানে কোন দলেরই সুস্পষ্ট আধিপত্য নেই । ফলে দেশটির জাতিয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা নতুন সরকারের জন্য অবশ্যই বড় চ্যালেঞ্জ । আরও কয়েকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ যেমন – এই নির্বাচনে ৮৬ মিলিয়নের মধ্যে ৫০ মিলিয়ন ভোটার ভোট দিয়েছেন যা পাকিস্তানের ইতিহাসে সর্বোচ্চ । নারীদের অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযোগ্য যাকে অনেকে নারী জাগরণ বলেছেন ।

দক্ষিণ এশিয়া বিশেষ করে পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিবেশে সর্বসম্মত নির্বাচন কমিশন এবং সাবেক বিচারপতি মির হাজার খান খোসোর নেতৃত্বে বাংলাদেশের দেখানো নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যাবস্থার মাধ্যমে গনমানুষেরর অংশগ্রহণে নির্বাচন ব্যাবস্থা ও ভোট প্রক্রিয়া ছিল নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু এবং সামরিক বাহিনী নির্বাচনের ফলাফলের উপর কোন হস্তক্ষেপ করেনি । পাকিস্তান যেহেতু এই ব্যাবস্থাটিকে কাজে লাগিয়ে উন্নতি করতে পেরেছে এবং নেপালও এই ব্যাবস্থাটি কার্যকর করতে যাচ্ছে সুতরাং বিষয়টি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অবিশ্বাস দূর করতে আশার বার্তা হতে পারে । রাজনৈতিক দলগুলোর একে অপরের প্রতি ভদ্রজনোচিত সহনশীল ও সহযোগিতামূলক আচরণ ছিল চোখে পরার মত । আরও আশার দিক হল পরাজিত দলগুলো নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিয়েছে । বিজয়ী দলও সংযত আচরণ দেখিয়ে আসছে । যেমন ইমরান খান নির্বাচনী প্রচারণা মঞ্চ থেকে পড়ে গিয়ে আহত হন । হাসপাতালে ছিলেন কয়েকদিন আগপর্যন্ত । এই ঘটনার পর নওয়াজ শরিফের দল একদিনের জন্য সব নির্বাচনী কার্যক্রম স্থগিত করে, এমনকি নওয়াজ নির্বাচনের পরে ইমরান খানকে হাসপাতালে দেখতে যাওয়ার মত সৌজন্যতা দেখান, যদিও তারা একে অন্যের প্রচণ্ড বিরোধী । নির্বাচনকালিন সময়ে নেতাদের বক্তৃতাও ছিল শালীন এবং অনেকাংশে নীতি ভিত্তিক । যা বাংলাদেশ সহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে । সুতরাং আশার দিক হল সামরিক বাহিনীর বলয় থেকে বেরিয়ে এসে পাকিস্তান গণতন্ত্রের পথে পা বাড়িয়েছে ।

নওয়াজের জয় এবং পিপিপির প্রত্যাশার চেয়েও খারাপ করার পেছনে কয়েকটি কারণ উল্লেখযোগ্য যেমন– বিভিন্ন জাতিয় ইস্যুতে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজ করতে পিপিপির ব্যর্থতা; দুর্নীতি; ভয়াবহ বিদ্যুৎ ঘাটতি; শান্তি; শৃঙ্খলা ও নাগরিক নিরাপত্তার অভাব; প্রচণ্ড বেকারত্ব, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, জ্বালানি সঙ্কট মোকাবেলায় ব্যর্থতা; সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নিয়ে অতি প্রীতি রক্ষণশীল সমাজকে নাখোশ করেছিল; দেশটির সার্বভৌমত্বে বহিঃ শক্তির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব; মার্কিন ড্রোন বিমান হামলা বন্ধে ব্যর্থতা; নওয়াজের প্রতি তালেবানের আস্থা; পিপিপির নেতাদের প্রচার প্রচারনার জন্য নির্বাচনী এলাকায় প্রবেশে জনগনের বাঁধা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য । উক্ত বিষয়গুলি এই অঞ্চলের সরকারগুলোর জন্য সতর্ক বার্তা হতে পারে ।

এবার যদি নওয়াজ শরিফের দল পাকিস্তান মুসলিম লিগ-এন এর নির্বাচনী ইশতেহার বিশ্লেষণ করি তাহলে উল্লেখযোগ্য অংশগুলো নিম্নোক্তভাবে সারসংক্ষেপ করা যায় । নির্বাচনী ইশতেহারে দলটি প্রথমে মানবতার কথা কোরআনের আয়াতের মাধ্যমে উল্লেখ করে অর্থাৎ “If anyone kills one person, it would be as if he killed humanity. And if anyone saved a life, it would be as if he saved humanity.” Surah Al-Ma’eda, Verse 32, এর পর সহনশীলতা, সহাবস্থান, সাম্য, সাংবাদিকদের নিরাপত্তা, মতামত ও বাক স্বাধীনতা ইত্যাদি বিষয় নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে । এরপর ব্যাবসা বানিজ্যের উন্নতি, ইসলাম ও ইসলামী ঐতিহ্যের লালন, শক্তিশালী গণতন্ত্রের কথা, জাতিয় ঐক্য, ভিন্নমত ও ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয় । জাতিয় ও আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য অনেকগুলো বিষয়ের অবতরণ করা হয় । যেমন –উন্নত সামরিক বাহিনী, মানুষের জীবন মানের উন্নতি, মানবাধিকার, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, শিক্ষা, মিডিয়া, আইন বিভাগের স্বাধীনতা, শক্তিশালী সুশিলসমাজ, সার্বভৌম সংসদ, আইনের শাসন, উপজাতিদের নিরাপত্তা ও উন্নয়ন ইত্যাদি বিষয় উল্লেখযোগ্য । এছাড়া শান্তিপূর্ণ বৈদেশিক নীতি যা হবে গনমানুষের আকাঙ্খার প্রতিফলন । পারমাণবিক অস্ত্রের নিরাপত্তা, বৈদেশিক প্রভাব মুক্ত পাকিস্তান এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের কথা ঘোষণা করা হয় । ইস্তেহারে চীনের সাথে ঐতিহ্যগত বন্ধুত্ব মজবুত করার মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্য এশিয়ায় শান্তি বিস্তার করা, পশ্চিমা শক্তি, মুসলিম উম্মাহ এবং আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীগুলোর সাথে শক্তিশালী ও শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয় । জম্মু ও কাশ্মীর সমস্যা জাতিসংঘের মাধ্যমে সমাধান এবং সেখানে মানবিক ও কল্যাণমূলক সহায়তা বৃদ্ধি করা, ভারতের সাথে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক বৃদ্ধি করা, ফিলিস্তিনের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ও সহযোগিতার আশ্বাস দেয়া হয় । ইরাক যুদ্ধের বিরোধিতা করে সেখানে শান্তিপূর্ণভাবে পুনর্গঠন করতে এবং যুদ্ধ বিধস্ত আফগানিস্তানে সহায়তা বৃদ্ধির মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ আফগানিস্তান পুনর্গঠন ও সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয় । তাছাড়া ইরানের শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক প্রকল্পে সমর্থন, OIC কে কার্যকর করার ইচ্ছা এবং স্বচ্ছ আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও শান্তি প্রক্রিয়ার কথা উল্লেখ আছে দলটির নির্বাচনী ইস্তেহারে । বিষয়গুলো কতটুকু বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে? বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলেও কি স্থিতিশীল পাকিস্তান সম্ভব কি না ? প্রশ্ন থেকে যায় ।

এবার পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জগুলো আলচনার মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠায় পাকিস্তানের জাতিয় নির্বাচন ২০১৩ –র ভূমিকা বুঝার চেষ্টা করি । প্রথমে আসা যাক দেশটির অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জগুলোর বিষয়ে ।

ঐতিহাসিক ভাবে দেশটি সামরিক বাহিনী দ্বারা শাসিত হয়ে আসছে । মাঝে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আসলেও টিকে থাকতে পারেনি । তিনি তার আগের দুই মেয়াদ শেষ করতে পারেননি । এই উদাহরণকে সামনে রেখে আগামি বছর নতুন সরকারকে নতুন প্রেসিডেন্ট, সেনা প্রধান ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করতে হবে, কারণ বর্তমান যারা আছেন তাদের চাকুরীর মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে । আর এই বিষয়টির উপর নির্ভর করছে পাকিস্তানে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ । সেনা বাহিনী পাকিস্তানের জন্য ঘুমন্ত বাঘ, তাকে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ খোঁচাবেন না সেটাই সবার প্রত্যাশা । নতুন সরকারকে একটা বড় ধরণের অর্থনৈতিক সঙ্কট মোকাবেলা করতে হবে । সাথে সাথে রয়েছে পিপিপি যেসব কারণে গো হারা হেরেছে সেগুলো থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করা ।

বেলুচিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন এখন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য বড় মাথা ব্যাথার কারণ । বেলুচরা স্বাধীন বেলুচিস্তানের জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম করছে । সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেলুচিস্তানের ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ-অর্থনৈতিক গুরুত্ব অনেক বেড়েছে । বেলুচিস্তানের সাথে রয়েছে ইরানি প্রদেশ সিস্তান বেলুচিস্তান । অন্য দিকে বেলুচিস্তানের গাদওয়ারে রয়েছে চীন নির্মিত গভীর সমুদ্র বন্দর । ভারত মহাসাগরে চীনা নৌ বাহিনীর তৎপরতা বৃদ্ধি পাওয়ায় বেলুচিস্তানের গুরুত্ব আরও বেড়েছে । সিস্তান বেলুচিস্তানের সাথে একত্রিত হয়ে ভবিষ্যতে একটি বৃহত্তর বেলুচিস্তান রাষ্ট্র গঠন বিচিত্র কিছু নয় । ভারত মহাসাগরে জ্বালানি সরবরাহ লাইন নিশ্চিত ও নিরাপদ রাখা কিংবা ইরানকে চাপে রাখতে বেলুচিস্তান পশ্চিমা শক্তিগুলো বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ । মনে রাখা উচিত বেলুচিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিমান ঘাঁটি ছিল । ২০১২ সালে পাকিস্তানের আপত্তির মুখে যুক্তরাষ্ট্র ঘাঁটিটি বন্ধ করে দেয় । সুতরাং নতুন সরকার বেলুচিস্তানের ব্যাপারে কি নীতি গ্রহন করবে দেখার বিষয় ।

পাকিস্তানে জঙ্গি তৎপরতা বৃদ্ধি পাওয়ায় বিদেশি বিনিয়োগ নেই বললেই চলে । সরকারের আয়ও কমে গেছে । বিদেশিদের আস্থা ফিরিয়ে আনার কাজটি নিশ্চিয়ই সহজ নয় । সাথে একটি তরুন প্রজন্ম হয়েছে পাকিস্তানে যাদেরকে নিয়ে কাজ করতে হবে নতুন সরকারকে । সুতরাং এই সব সমস্যা সামনে রেখে পাকিস্তানে আদৌ গুণগত পরিবর্তন হবে কিনা সন্ধেহ ।

অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলো মোকাবেলা সহ আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক অনেক চ্যালেঞ্জ পাকিস্তানের নতুন এই সরকারের সামনে । নওয়াজ সরকারের স্থিতি, জঙ্গিবাদ নিরসন, ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন, আফগান শান্তি প্রক্রিয়া ও পুনর্গঠন, চীন রাশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের সাথে সম্পর্ক সহ বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলার কৌশলগত সাফল্যের উপর দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শান্তি প্রক্রিয়া ও নিরাপত্তা অনেকাংশে নির্ভরশীল । বিষয়গুলো নিচে সংক্ষেপে আলোচনা করা যেতে পারে ।

প্রথমে পাকিস্তান ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিষয়ে আসা যাক । দক্ষিণ এশিয়ায় প্রতিযোগী দুই পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্রের মধ্যাকার সম্পর্ক কখনোই খুব একটা ভালো ছিলনা । দেশ দুটির এই অস্বাভাবিক সম্পর্ক এ অঞ্চলে অশান্তি ও নিরাপত্তা হুমকির প্রধান কারণ । বাস্তবতার নিরিখে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ পরিবেশের রাতারাতি পরিবর্তন আশা করা যেমন বোকামি তেমনি দেশ দুটির সম্পর্ক উন্নতি আশা করা বোকামি । নওয়াজ শরিফ নির্বাচন পরবর্তী বক্তৃতায় বলেন, তার সরকারের প্রধান কাজ হবে অর্থনৈতিক পুনর্গঠন । এটা করা সম্ভব হলে সন্ত্রাস ও সহিংসতা আপনা আপনি কমে যাবে, আইন শৃঙ্খলার উন্নতি হবে । তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের দৃঢ় আশাবাদ ব্যাক্ত করেন । মনমোহন সিং নওয়াজ কে অভিনন্দন জানিয়ে আশাবাদ প্রকাশ করেন ভারত পাকিস্তান সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আঞ্চলিক শান্তি প্রক্রিয়া ও নিরাপত্তা দৃঢ় করা সম্ভব হবে । প্রসঙ্গক্রমে মনে রাখা দরকার আফগানিস্তানে ভারতের বড় ধরণের প্রভাব রয়েছে এবং দিন দিন তা বৃদ্ধি পাচ্ছে । যা পাকিস্তানকে মনস্তাত্ত্বিক সঙ্কটে ফেলেছে ।

নওয়াজ শরিফের নেতৃত্বেই পাকিস্তান ১৯৯৮ সালে পারমাণবিক অস্ত্রধর রাষ্ট্রে পরিনত হয়েছিল । তাছাড়া ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে ইতোমধ্যে ৩ বার যুদ্ধ হয়েছে । অসংখ্য ছোট বড় সীমান্ত সংঘাত এবং কাশ্মীর সমস্যা তাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রধান বাঁধা । নওয়াজ শরিফ প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ১৯৯৯ সালে কার্গিল যুদ্ধ হয় । বর্তমান সময়ে দেশ দুটির সম্পর্ক ভয়াবহ ভাবে খারাপ যাচ্ছে ।

ভারত পাকিস্তান সমস্যার মধ্যে রয়েছে সীমান্ত সমস্যা, নদী ও পানি সমস্যা, অর্থনৈতিক ও বানিজ্য সম্পর্কের ব্যাপক ঘাটতি, সন্ত্রাসবাদ, মাদক চোরাচালান সহ বহুবিধ সমস্যা । অবিশ্বাসের এই সম্পর্ক উন্নয়নে শরিফকে আন্তরিকতা এবং ভারতের শরিফের প্রতি আস্থার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ । মনমোহন সিং ইতোমধ্যে পাকিস্তানে বিশেষ দূত পাঠিয়ে নওয়াজকে ভারত সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন । তবে মনে রাখা দরকার নওয়াজ-মনমোহন চাইলেও পরিস্থিতির পরিবর্তন সহজে হবে না । পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি এবং ভারতে আগামি বছরের জাতিয় নির্বাচনের উপর অনেক কিছুই নির্ভর করছে ।

অন্যদিকে নির্বাচনের পরে পাকিস্তানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক বিবেচনা করলে, নতুন সরকারের উপর যুক্তরাষ্ট্রের ৩ টি বিশেষ প্রভাব থাকছে । প্রথমত, পাকিস্তান মুসলিম লিগ-এন বড় ধরণের সংখ্যা গরিষ্ঠতা পেয়েছে । এতে শঙ্খা কমেছে যুক্তরাষ্ট্রের । কেননা অনাস্থা ভোটে সরকার পতনের সুজগ কমে গেছে । দ্বিতীয়ত, সৌদি রাজ পরিবারের সমর্থন আছে নওয়াজের প্রতি । যা যুক্তরাষ্ট্র কাজে লাগাবে । সর্বশেষ, নওয়াজ মুক্ত অর্থনীতিতে বিশ্বাসী । যা আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধি ও যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তান ত্যাগ পরবর্তী দক্ষিণ এশিয়ায় প্রবেশের সহায়ক হবে ।

মনে রাখতে হবে নির্বাচনী প্রচারণায় শরিফ যুক্তরাষ্ট্র বিরোধী বক্তব্য দিয়েছেন । পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সাথে মার্কিনীদের বহুমাত্রিক সমস্যা রয়েছে বিশেষ করে গোয়েন্দা কার্যক্রম এবং ড্রোন বিমান হামলা নিয়ে যা মার্কিন বিরোধী জনমত তৈরি করেছে পাকিস্তানে । পাকিস্তান ইরান গ্যাস পাইপ লাইন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রচণ্ড আপত্তি রয়েছে । এত কিছুর পরেও শরিফ জানেন IMF, WB সহ বিভিন্ন বৈশ্বিক সংস্থাগুলোর সাথে সম্পর্কের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বিকল্প নেই, তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ সহায়তার বিষয়টি তো আছেই । যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য ছাড়া আফগানিস্তান সমস্যা সমাধান এবং ভারতের সাথে শান্তি প্রক্রিয়া তরান্বিত করা কঠিন । সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আপাতত পাকিস্তানকে সুসম্পর্ক বজায় রাখতেই হচ্ছে ।

দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি প্রক্রিয়া পাকিস্তানের সাথে আফগানিস্তানের সম্পর্ক এবং আফগানিস্তানের পুনর্গঠনের উপর অনেকটাই নির্ভরশীল । বিষয়টি বুঝার জন্য আফগানিস্তানের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্কের দিকটা বুঝা দরকার । দেশ দুটির মধ্যে ২,৬৪০ কিমি সীমান্ত সংযোগ রয়েছে । পরিবেশগত এবং কাঠামোগত অনেক কিছুই মিল রয়েছে তাদের মধ্যে । আফগানিস্তান হচ্ছে এশিয়ার শান্তি প্রক্রিয়ায় কেন্দ্র ভূমি । পাকিস্তান আফগানিস্তান সম্পর্কের প্রধান দিকগুলো হল –আফগান শরণার্থী সমস্যা, জঙ্গিবাদ, সীমান্ত সমস্যা, আফগানিস্তানের পুনর্গঠন ইত্যাদি । ২০১৪ সালে আফগানিস্তানে যুদ্ধের সমাপ্তি টানবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র । সে ক্ষেত্রে যুদ্ধ বিধ্বস্ত আফগানিস্তানের পুনর্গঠন ও শান্তি প্রক্রিয়া পাকিস্তানের নতুন সরকারের নীতি ও কৌশলের উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল ।

পাকিস্তান সব সময় আফগানিস্তানে দুর্বল সরকার ব্যাবস্থা কামনা করে । কারণ পাকিস্তানকে ভারতকে নিয়ে বেশি ব্যাস্ত থাকতে হয় এবং উভয় ফ্রন্টে তারা শত্রুর মোকাবেলা করতে চায় না । আফগানিস্তান আফগানিস্তান আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক, কাঠামোগত বিপর্যয় ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে ভয়াবহভাবে খারাপ অবস্থায় আছে । তাদের এই অবস্থার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সাথে পাকিস্তানও কম দায়ী নয় । আবার আফগানিস্তানে ভারতের সক্রিয় উপস্থিতি পাকিস্তানের নিরাপত্তা ও স্বার্থ বিরোধী । পাকিস্তানে অনেকেই মনে করে আফগানিস্তান কে ব্যবহার করে বেলুচিস্তান সমস্যাকে ভারত উস্কে দিচ্ছে । এই সব কারণেও পাকিস্তান আফগানিস্তানের ব্যাপারে সব সময় দ্বৈত নীতি গ্রহণ করে আসছে সুতরাং দেশটির পুনর্গঠনে একান্ত প্রতিবেশী হিসেবে পাকিস্তানের ভূমিকা সবার থেকে বেশি । মৌখিক ভাবে বলা যেতে পারে ভারত-পাকিস্তান উভয়ে যদি আফগানিস্তানে যৌথভাবে কাজ করে তাহলে আফগানিস্তান পুনর্গঠন ও দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হবে । কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এই বিষয়টি এখন ভারত-পাকিস্তানের দ্বন্দ্বের কারণ । বাস্তবতা ভারত পাকিস্তান কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না এবং তা অব্যাহত থাকবে যত দিন এই অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব থাকবে এবং চীনের উথান তার প্রধানতম একটি কারণ ।

ইন্দো-মার্কিন কৌশলগত অংশীদারিত্ব পাকিস্তানকে তার অবস্থান নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছে । পাকিস্তান উদ্বিগ্ন । এটা ধারণা করা যেতে পারে যে ভবিষ্যতে বিভিন্ন কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক খারাপ হয়ে যাবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভারতকে অধিক শক্তিশালী হতে সহায়তা করবে যার অন্যতম উদ্দেশ্য চীনকে দমিয়ে রাখা । ফলে এই অঞ্চলে শক্তি সাম্যে পরিবর্তন আসবে ।

চীন দক্ষিণ এশিয়ায় তার প্রভাব ধিরে ধিরে বৃদ্ধি করছে বিশেষ করে soft power, প্রযুক্তি, অর্থ সহায়তা, সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ, সামরিক যন্ত্রপাতি ও বানিজ্য বৃদ্ধির মাধ্যমে । ভারতের সাথে প্রতিযোগিতা, যুক্তরাষ্ট্র ভারত সম্পর্ক এবং পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্র ক্ষয়িষ্ণু সম্পর্কের ফলে পাকিস্তান-চীন সম্পর্ক অদূর ভবিষ্যতে আরও জোরদার করবে । চীন ইতোমধ্যে আফগানিস্তানে অন্যতম বৈদেশিক বিনিয়োগকারী এবং পাকিস্তান, ইরান ও মধ্য এশিয়ায় চীনের প্রভাব বেড়েই চলছে সাথে কৌশলগত সম্পর্ক তো আছেই । ভারতের সাথে প্রতিযোগিতায় চীনের যেমন পাকিস্তান কে প্রয়োজন পাকিস্তানেরও চীন কে প্রয়োজন । চীন যেমন পাকিস্তানের বন্ধুত্ব আশা করে সাথে সাথে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ পরিবেশ নিয়েও শঙ্কিত । কারণ পাকিস্তানের পরিবেশ কাজে লাগিয়ে চীনের জিংজিয়াং প্রদেশে মুসলিমরা আরও শক্তিশালী হতে পারে । সুতরাং অনেক কিছুই নির্ভর করছে শরিফের জাতিয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা এবং বৈদেশিক নীতির উপর । চীনের প্রধানমন্ত্রি লি কেকিয়াং পাকিস্তানের সাথে শক্তিশালী সম্পর্ক গড়ার অঙ্গীকার করেন । তিনি বলেন আন্তর্জাতিক পরিবেশ পরিস্থিতি যাই হোকনা কেন আমাদের কৌশলগত সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হবে । অন্য দিকে ভারতও চীনের সাথে কৌশলগত কারণে সরাসরি দ্বন্দ্বে জড়াতে চায় না । সব দিক থেকে যাতে শত্রুর মোকাবেলা করতে না হয় সেজন্য চীন ভিতিকে সামনে রেখে ভারত সব সময় দুর্বল পাকিস্তান কামনা করে ।

২১ শতকে দাড়িয়ে দক্ষিণ এশিয়া রয়ে গেছে অনুন্নত; দুর্নীতি, বেকারত্ব, দারিদ্রতা, নিরক্ষরতা, স্বাস্থ্য সমস্যা, ভঙ্গুর অর্থনীতি, রাজনৈতিক অস্থিতশিলতা এ অঞ্চলের জন্য যেন বরাদ্য রাখা হয়েছে । এরকম একটি জটিল পরিস্থিতিতে দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি প্রক্রিয়া এগিয়ে নেয়া সম্ভব যদি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো পারস্পারিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করে, নিজেদের নিরাপত্তা ও উন্নয়নের জন্য অতিতের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে আগ্রহি হয় । এক্ষেত্রে সুশীল সমাজেরও ভূমিকা রাখতে হবে । কিভাবে এই অঞ্চলের শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে মানুষের জীবন মান উন্নত করা সম্ভব তা নিয়ে আরও বেশি বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ করা দরকার । আর একটি বিষয়, দেশগুলোর মধ্যে বানিজ্য ঘাটতি কমিয়ে বানিজ্যের প্রসার, জনগনের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে আন্ত যোগাযোগ বৃদ্ধি, SAARC কে কার্যকর করা এবং সহযোগিতামূলক মনোভাব, পারস্পারিক আস্থার পরিবেশ ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে দেশগুলো শান্তির পথে এগিয়ে যেতে পারে । আগামির বিশ্বে দক্ষিণ এশিয়াকে এগিয়ে নিতে শক্তিশালী ও স্থিতিশীল পাকিস্তান এবং শান্তিপূর্ণ আফগান সমস্যা সমাধান, ভারত পাকিস্তান সম্পর্কের উন্নয়ন, বাংলাদেশের স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশের কোন বিকল্প নেই । যেহেতু সমস্যা দীর্ঘ দিনের সেহেতু শক্তিশালী আঞ্চলিক সহযোগিতার কোন বিকল্প নেই । সুতরাং ভৌগলিক অবস্থান, আঞ্চলিক শক্তি সাম্য, জঙ্গিবাদ, পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা ইত্যাদি সবগুলো কারণে পরিস্থিতি ও পরিবেশ বিবেচনায় একুশ শতকে এই অঞ্চলকে নিরাপদ ও শান্তিময় করার মাধ্যমে উন্নত দক্ষিণ এশিয়ার জন্য পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ, অর্থনৈতিক উন্নতি এবং নিরাপত্তা দক্ষিণ এশিয়া, এশিয়া অঞ্চল ও বৈশ্বিক নিরাপত্তা ও শান্তির ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । পাকিস্তানের নতুন সরকারকে বুদ্ধিদীপ্ত ও কার্যকর পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণের সাথে সাথে জাতিয় ঐক্য প্রতিষ্ঠায় খুব বেশি জোড় দিতে না পারলে শান্তি প্রক্রিয়া ব্যাহত হতে বাধ্য । দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো যদি ঐক্যবদ্ধ হতে পারে তাহলে নিজেদের আগ্রগতির সাথে সাথে বৈশ্বিক জ্বালানি নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন সহ শান্তিপূর্ণ বিশ্ব গড়তে বড় ধরণের ভূমিকা রাখতে পারে তারা । সবার শেষে স্মরণ করতে হয় মিখাইল গরবাচেভের একটি উক্তি - ‘Today, peace means the ascent from simple coexistence to cooperation and common creativity among countries and nations.’

২ জুন, ২০১৩ মোঃ হাবিবুর রাহমান হাবীব

বিষয়: বিবিধ

১৬৬১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File