আগামী দিনের ইসলাম ইসলামের ভবিষ্যৎ ?

লিখেছেন লিখেছেন হাবীব ১৭ আগস্ট, ২০১৩, ১২:১৯:৫১ রাত

পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি। (ওয়া’ল হামদু লিল্লাহির রাব্বিল আলামিন। ওয়াসালাতু ওয়াসসালামু সাইয়্যেদিল মুরছালিনা নাবিয়্যিল কারিম ওয়ালায়ালিহি ওয়া আসহাবিহি আজমায়িন। রাব্বানা লাতুজেক কুলুবানা বাদায়িদ হাদাইতানা ওয়াহাবলানা মিল্লাদুনকা রাহমা ইন্নাকা আন’তাল ওহ্হাব। আল্লাহুম্মা আরিনাল হাক্কা হাক্কান ওয়ারজুকনা তিবা’য়া ওয়ারিনাল বাতিলা বাতিলান ওয়াজুকনা ইজতিনাবায়া ওয়াবায়ত।)

প্রিয় মুসলিম ভাই ও বোনেরা,

আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ্। এই সময়ে আপনাদের সাথে থাকতে পেরে আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি। আজকের অনুষ্ঠানের আয়োজক FAMSY-র ভাইদের এবং লেবাননের সংগঠন ও আপনারা যারা এই চমৎকার মসজিদে উপস্থিত আছেন সকলের প্রতি আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। মাশা’আল্লাহ অস্ট্রেলিয়ায় এত বড় মসজিদ দেখব কল্পনাও করিনি। আমি আজকে সহ চার দিন অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থান করছি। আমি মেলবোর্নে ছিলাম এবং সিডনিতে আজকেই প্রথম। এটা আমার প্রথম অস্ট্রেলিয়া সফর।

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর। এ দেশে ইসলামী কার্যক্রম এবং ইসলামের প্রতি দায়বদ্ধ মুসলমানের সংখ্যা দেখে আমি অভিভূত। আজকের রাতে আপনাদের উপস্থিতি তা প্রমাণ করছে।

রাসূল (সা) একটি প্রসিদ্ধ হাদিস বলেছেন, আল্লাহিল লা তাকুমুসসায়া হাত্তা ইয়াবলুগা হাজাদ্বিন মা বালাগাল লাইলু ওয়ান নাহার। রাসূল (সা) বলেছেন, আল্লাহর নামে শপথ করছি বিচার দিবস ততদিন আসবে না যতদিন না এই দ্বীন (ইসলাম) দিন ও রাতের দূরত্ব পর্যন্ত পৌছবে না।

আপনারা মক্কা থেকে দূর প্রাচ্যে রয়েছেন, যা এত দূরে যে যাওয়ার জন্য এক রাত সময় লাগে। আমি যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমার স্নাতক শেষ করার পর বেশ কয়েকবার সেখানে গিয়েছি যা মক্কা থেকে অন্য আর এক দিকে অবস্থিত। বর্তমানে আরও দূরে হাওয়াইতেও কিছু মুসলমান আছেন। ওয়াসাদাকা রাসূলুল্লাহ্ (সা) – রাসূল (সা) সত্য বলেছেন।

আজকে এই দ্বীনের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে, ইসলামের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কিছু সত্য বাস্তবতা আপনাদের সাথে আলোচনা করতে চাই। বিশেষ করে ইসলাম ও মুসলমানদের উপর যে নিপীড়ন আমারা লক্ষ্য করছি এবং ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনা এবং ঐ ঘটনার পর এই মহাদেশ সহ সবখানে মুসলমানদের যা মোকাবেলা করতে হচ্ছে।

এসব আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে ?

এই দ্বীনের (ইসলাম) ভবিষ্যৎ কি ?

এ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমি ইতিহাসের উপর ব্যাপক গবেষণা করেছি। আমি পেট্রোলিয়াম ইঞ্জিনিয়ারিং এর পাশাপাশি অনৈচ্ছিক হিসেবে ম্যানেজমেন্টের উপর পি এইচ ডি করেছি। আমি শরিয়াহ্’র পাশাপাশি অনেক কিছুর মধ্যে ইতিহাস ভালোবাসি। সুতরাং আমি ইতিহাসের উপর ব্যাপক গবেষণা করেছি। আমি ইতিহাসের মধ্যে একটি গতিধারা লক্ষ্য করেছি। যেখানে একটি ধারাবাহিক প্রবণতা রয়েছে, যা সময়ের ব্যবধানে পুনরাবৃত্ত হয়। আপনাদের সামনে এই বিষয়ে আমার কিছু চিন্তাভাবনা তুলে ধরতে চাই।

সভ্যতাসমূহ গড়ে ওঠে একটি নির্দিষ্ট ধারায়। প্রতিটি সভ্যতা প্রথমে দুর্বল অর্থাৎ নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় অক্ষম থাকে। তারপর তারা ক্রমান্বয়ে বিকশিত হতে থাকে এবং তাদের সর্বোচ্চ শিখরে পৌছতে অনেক সময় লাগে সাধারণত শত শত বছর সময় লাগে। ইসলামের আগে পারস্য সভ্যতা তার একটি উদাহরণ। সেটা প্রথমে দুর্বল ছিল। ক্রমাগত ভাবে বিকশিত হতে হতে দুই হাজার বছর পর তারা সভ্যতার সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে। এরপর বাইজেনটাইনস বা রোমান সভ্যতার এক হাজার দুই’শ বছর সময় লাগে ক্রমাগত ভাবে বিকশিত হয়ে সভ্যতার সর্বোচ্চ শিখরে পৌছতে। আপনারা খেয়াল করলে দেখতে পাবেন অন্যান্য সভ্যতা সমূহেরও বিকশিত হতে একই ধরনের সময় লেগেছে। কিন্তু অনেকে এটা খেয়াল করেন না যে, একটি সভ্যতার পতন কত দ্রুত হয়ে থাকে।

কিছু উদাহরণ দেয়া যাক। পারস্য সম্রাজ্যের কথা বলি। আমরা জানি তাদের দুই হাজার বছর সময় লেগেছিল পৃথিবীর সর্বোচ্চ শিখরে পৌছতে। সভ্যতার বিবেচনায় তারা পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা ছিল। শুধু মাত্র রোমানরা তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। তাদের অধীনে ছিল বিশাল অঞ্চল যা ভারত, তুরস্ক, ইরাক ও আরব বিশ্বের অংশ বিশেষ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। আরব উপদ্বীপের অংশ বিশেষ ছিল তাদের মিত্র এবং ইরাকের মাদায়েন ছিল তাদের রাজধানী। সে এক বিশাল সভ্যতা !

সামরিক দিক থেকে তাদের সেনাবাহিনী ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী। মুসলমানদের সাথে তাদের যতগুলো যুদ্ধ হয়েছে প্রতিটি যুদ্ধে তাদের সৈন্য সংখ্যা ছিল সাধারণত আড়াই লক্ষ, তিন লক্ষ কিংবা সাড়ে তিন লক্ষ। আমরা ১৪’শ বছর আগের কথা বলছি। ১৪’শ বছর আগের এত সংখ্যক সৈন্য আজকের দিনে অনেক বেশি। বর্তমান বিশ্বে কতগুলো সেনাবাহিনীতে এত সংখ্যক সৈন্য আছে ? আর এটা তাদের পুরো সৈন্য সংখ্যা নয় ! এটা তাদের সেনাবাহিনীর একটি শাখা মাত্র। সেনাবাহিনীর একটি অংশ মাত্র। এত বিশাল ছিল তাদের সৈন্যবাহিনী। অত্যন্ত শক্তিশালী সভ্যতা।

সামরিক সরঞ্জামাদি ব্যবহারের দিক থেকে তাদের সৈন্যরা ছিল সবচেয়ে দক্ষ এবং পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত সমরাস্ত্র তারা ব্যবহার করত। তারা শুধু পারস্যের প্রযুক্তিই ব্যবহার করত না বরং রোমান এবং ভারতীয় প্রযুক্তিও ব্যবহার করত। আমরা বিজ্ঞান, দর্শন, কলা যে বিষয়ে বলি না কেন তারা ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ। শুধুমাত্র রোমানদের সাথে তাদের তুলনা করা যায়।

সুতরাং মুসলমানরা যখন তাদের বিরুদ্ধে প্রথম অভিযান পরিচালনা করে সে সময় তারা কোন দুর্বল দেশ ছিল না। অর্থাৎ মুসলমানরা কোন দুর্বল দেশের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেনি। তারা বিভক্ত ছিল না। তারা একজন রাজার অধীনে ঐক্যবদ্ধ ছিল। পারস্য সম্রাজ্য যা ছিল বিশাল। অত্যন্ত শক্তিশালী, জগত সেরা, ঐক্যবদ্ধ এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে উৎকর্ষ সাধন করেছিল। এক কথায় পরাশক্তি।

পারস্য সভ্যতা ধ্বংস হতে কত সময় লেগেছিল ?

আবু বকর সিদ্দিক (রা) যখন খলিফা ছিলেন। ১২ হিজরি সালে মুসলমানরা পারস্য সম্রাজ্যে প্রথম অভিযান পরিচালনা করে। তিনি দুইটি সৈন্যদল পাঠিয়েছিলেন। খালিদ ইবনে ওয়ালিদ আল মাখজুমি (রা)-র নেতৃত্বে একটি দল ইরাকের দক্ষিণাংশে অভিযান চালায় এবং আর একটি সৈন্যদল মুসান্না ইবনে হারিসা আসশাইবানি (রা)-র নেতৃত্বে ইরাকের উত্তরাংশে অভিযান চালায়। উভয় সৈন্যবাহিনী ১২ হিজরি সালে অভিযান শুরু করে।

খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা) দুর্বার গতিতে দক্ষিণ ইরাক দিয়ে রাজধানী মাদায়েনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন। আল মুসান্না ইবনে হারিসা (রা) খালিদের মত এগিয়ে যেতে পারছিলেন না। তিনি তীব্র প্রতিরোধের সম্মুখীন হন। সামরিক দিক থেকে তিনি খালিদের মত শক্তিশালী ছিলেন না। তাই তিনি এগিয়ে যেতে পারছিলেন না। খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা) উত্তর দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন। আল মুসান্না ইবনে হারিসা (রা) একই স্থানে থেকে যান; তিনি দক্ষিণে এগিয়ে যেতে পারছিলেন না।

খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা) যখন দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, আবু বকর সিদ্দিক (রা) তাকে ফিলিস্তিনে পাঠানোর প্রয়োজন বোধ করলেন। তাই তিনি তাকে ইরাক ত্যাগ করে ফিলিস্তিনের দিকে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। আমি এই ঘটনা পরে বলব। তিনি ঐ অভিযান চালিয়ে যাওয়ার জন্য অন্য আর একজনকে সেনাপতির দায়িত্ব দিলেন। আর তিনি হলেন রাসূল (সা) এর চাচা সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা)। তিনি অভিযান চালিয়ে গেলেন। তার নেতৃত্বে উভয় সৈন্যদলকে একত্রিত করলেন এবং তারা বিখ্যাত আল কাদেসিয়ার যুদ্ধে পারস্যের মোকাবেলা করলেন।

আল কাদেসিয়া ইসলামের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ।

১৫ হিজরি সালে তারা পারস্যের মেরুদণ্ড ভেঙে দেন। মাত্র তিন বছরে পারস্য সম্রাজ্যের পতন হয়। একটি সম্রাজ্য যা দুই হাজারেরও বেশি বছর সময় ধরে গড়ে উঠেছিল, তার পতন হতে সময় লাগে মাত্র তিন বছর ! কেন ? এটা কিভাবে সম্ভব হয়েছিল ? তারা তো দুর্বল ছিল না। তাদের প্রযুক্তি এবং সেনাবাহিনী ছিল সবচেয়ে উন্নত, তারা রাজনৈতিক ভাবে শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ ছিল, কলা, বিজ্ঞান, দর্শন, যুক্তিবিদ্যা, কাব্য ইত্যাদি সব কিছুতে তারা ছিল সবচেয়ে উন্নত। এক কথায় একটি অন্যতম উঁচু মাপের সভ্যতা। তাহলে, কি কারণে ঐ সভ্যতা ধ্বংস হয়েছিল ?

প্রশ্নটির উত্তর দেয়ার আগে, অন্য আর একটি সভ্যতার কথা বলি। আর তা হল সিজারের নেতৃত্বে রোমান সভ্যতা। সামরিক শক্তির দিক থেকে তারা ছিল পৃথিবীর দ্বিতীয় পরাশক্তি। কিন্তু পারস্যের সাথে তাদের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। তাদের রাজধানী ছিল তিনটি, যথা- উত্তরে কনস্টান্টিনোপল বর্তমানে ইস্তাম্বুল, পূর্বে জেরুজালেম বা আল কুদ্দস এবং উত্তর আফ্রিকার জন্য আলেক্সজান্দ্রিয়া। পুরো উত্তর আফ্রিকা, পূর্বাঞ্চল, তুরস্ক এবং তাদের আশপাশের অঞ্চল তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। বিশাল সম্রাজ্য ! একজন নেতার অধীনে আর তিনি হলেন সিজার। তিনি মূলত ইস্তাম্বুলে থাকতেন কিন্তু মাঝে মাঝে শাসনকার্য পরিচালনার জন্য জেরুজালেমে যেতেন।

যখন রাসূল (সা) সিজারের কাছে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে চিঠি পাঠিয়েছিলেন, সে সময় সিজার তার রাজধানী জেরুজালেমে অবস্থান করছিলেন। যা হোক, আবারো শক্তিশালী অদম্য এক সভ্যতা, বিশাল সৈন্যবাহিনী। ইয়ারমুকের যুদ্ধে রোমানদের সৈন্য সংখ্যা ছিল তিন লক্ষ চল্লিশ হাজার। সেটা ছিল তাদের সৈন্যবাহিনীর একটা অংশ মাত্র। একবার কল্পনা করেন তারা কত শক্তিশালী ছিল। তাদের দর্শন, কাব্য, যুক্তিবিদ্যা এবং বিশাল সভ্যতা সম্পর্কে আমরা সবাই জানি। পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সভ্যতা। সামরিক, রাজনৈতিক এছাড়া অন্যান্য দিক থেকেও শক্তিশালী এক সম্রাজ্য।

১২ হিজরি সালে আবু বক্কর সিদ্দিক (রা) যখন খলিফা সে সময় সর্বপ্রথম রোমানদের বিরুদ্ধেও মুসলমানরা অভিযান পরিচালনা করে। তিনি সেখানে চারটি সৈন্যদল পাঠিয়েছিলেন। আমর ইবনে আ’স ফিলিস্তিন ও জর্ডান দখলের উদ্দেশ্যে, জিহাদ ইবনে আবি কে সিরিয়ায়, সারাবিল ইবনে হাসানা কে ফিলিস্তিন ও লেবাননে এবং আবু উবাইদা আমর ইবনে আবু জাররাহ্ কে ফিলিস্তিনের উত্তরাংশ এবং সিরিয়ার বাকি অংশে প্রেরণ করা হয়। এই চার জন মহাবীরের নেতৃত্বে চারটি সৈন্যদল। তারা অভিযানে বেরিয়ে পরলেন।

সিজার মুসলিম বাহিনীর আগমনের কথা জানতে পেরে অতি দ্রুত জেরুজালেম ত্যাগ করে দামেস্কে পালিয়ে যান। যখন মুসলিম সৈন্যবাহিনী আরও এগিয়ে যেতে লাগলো, তিনি দামেস্ক ছেড়ে ইস্তাম্বুলে পালিয়ে গেলেন। তিনি এই উদীয়মান শক্তি সম্পর্কে ভালভাবেই জানতেন।

যা হোক, এই চারটি সৈন্যদলে সর্বমোট সৈন্য ছিল মাত্র চৌত্রিশ হাজার। অন্যদিকে রোমান সৈন্যবাহিনীর এক একটি অংশে সৈন্য ছিল তিন লক্ষ চল্লিশ হাজার করে।

সিজার ছিলেন বেশ চতুর।

সিরিয়া থেকে চলে যাওয়ার সময় তিনি বলেছিলেন, ‘চির বিদায় সিরিয়া’।

তিনি জানতেন কি হতে যাচ্ছে।

মুসলিম বাহিনী অগ্রসর হতে থাকে। তারা ফিলিস্তিন ও আশপাশের এলাকা দখল করতে থাকে। এ অবস্থায় সিজার তার সবচেয়ে শক্তিশালী সৈন্যদল প্রেরণ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি তিন লক্ষ চল্লিশ হাজার সৈন্য পাঠালেন। অন্যদিকে মুসলিম সৈন্যবাহিনীর এক একটি সৈন্যদলে মাত্র আট থেকে দশ হাজার করে সৈন্য ছিল। এই অবস্থায়, আবু উবাইদা (রা) চারটি সৈন্যদলকে একত্রিত হওয়ার আহবান জানালেন। তারা একত্রিত হয়ে চারটি আলাদা ভাগে অবস্থান গ্রহণ করলেন।

আবু বকর সিদ্দিক (রা) যখন বিশাল শত্রু বাহিনী আগমনের সংবাদ পেলেন, তিনি অনেক বড় বিপদ আন্দাজ করলেন। কারণ মুসলিমরা এত বিশাল শত্রু বাহিনীর মুখোমুখি হয়নি কখনো। তিনি দ্রুত খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা) কে ইরাক ত্যাগ করে ফিলিস্তিনে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা) ঝড়ের গতিতে ফিলিস্তিন পৌঁছলেন।

খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা) ইয়ারমুকে গিয়ে দেখতে পেলেন চার জনের নেতৃত্বে চারটি সৈন্যদল আলাদা আলাদা ভাবে অবস্থান নিয়েছে। তিনি তাদেরকে বললেন এভাবে যুদ্ধ করা সম্ভব নয়। আপনাদের অবশ্যই এক জন সেনাপতির নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। তিনি চিন্তায় পড়ে গেলেন। এত বড় যুদ্ধের সেনাপতির দায়িত্ব নিয়ে বিবাদ দেখা দিতে পারে, যেমনটি দুর্ভাগ্যজনক ভাবে মুসলমানরা বর্তমানে সব জায়গায় নেতৃত্বের দ্বন্দ্বে লিপ্ত। তিনি এটা বুঝতে পেরে সবাইকে ডেকে বললেন আমরা একদিন একজনের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হব। সবাই একমত পোষণ করলেন।

এভাবে চারটি সৈন্যদল খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা)-র নেতৃত্বে প্রথম দিন ঐক্যবদ্ধ হয়। প্রথম দিন অতিবাহিত হওয়ার পর তারা সিদ্ধান্ত নিলেন খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা)-র নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ ভাবে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার। কারণ তার মত সৈন্যবাহিনী পরিচালনা করতে অন্যরা পারদর্শী নন।

১৪ হিজরি সালে যুদ্ধটি সংগঠিত হয়। মাত্র দুই বছরের মধ্যে তারা পূর্ব দিকে রোমান সম্রাজ্যের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে ফেলে। বাকিটা ধুয়ে মুছে সাফ করার মত সহজ ছিল। ইয়ারমুকের পর বলতে গেলে তেমন কোন যুদ্ধই হয়নি। একটি মহা প্রতাপশালী সভ্যতার মাত্র দুই বছরে পতন হল। সেটা কিভাবে সম্ভব ?

আল ইয়ারমুক যুদ্ধের সময় সংবাদ এলো আবু বকর সিদ্দিক (রা) ইন্তেকাল করেছেন এবং ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা) খলিফা নিযুক্ত হয়েছেন। সুতরাং মদিনা থেকে ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা) পারস্য এবং রোমে সৈন্যবাহিনীকে নির্দেশনা দিচ্ছিলেন।

আমর ইবনুল আ’স (রা) ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা) কে একটি পরামর্শ বার্তা পাঠালেন। তিনি বললেন আমাকে মিশর জয় করার অনুমতি দিন। ওমর (রা) দ্বিধান্বিত হলেন এবং বললেন আপনার সৈন্যবাহিনী নিয়ে মিশরের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন। পরবর্তীতে কি করতে হবে আপনাকে জানাব।

আমর ইবনে আ’স (রা) মুসলমানদের মধ্যে অন্যতম বুদ্ধিমান মানুষ ছিলেন। তিনি মিশরের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন। ১৮ হিজরি সালের ঘটনা। মিশরে প্রবেশ করার পূর্বে ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা)-র কাছ থেকে সংবাদ নিয়ে একজন সংবাদ বাহক আসলেন। আমর ইবনুল আ’স (রা) সংবাদটি গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানালেন। তিনি বললেন, অপেক্ষা করেন। আমি সময় মত আপনার সাথে সাক্ষাৎ করব। সংবাদ বাহক বললেন, এ সংবাদ খলিফা পাঠিয়েছেন। আমর ইবনে আ’স (রা) বললেন, আমি জানি। আপনি অপেক্ষা করেন। আমি আপনার সাথে পরে দেখা করব। তিনি এগিয়ে যেতে থাকলেন। সংবাদ বাহক তার সাথে আবার দেখা করতে চাইলেন। কিন্তু আমর ইবনুল আ’স (রা) মিশরের সীমান্ত অতিক্রম না করা পর্যন্ত তার সাথে দেখা করতে অস্বীকৃতি জানালেন।

মিশর সীমান্ত অতিক্রম করার পর তিনি সংবাদ বাহককে ডাকলেন। এরপর তিনি সংবাদটি গ্রহণ করলেন। ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা) আমর ইবনুল আ’স (রা) কে লিখেছিলেন, আপনি মিশরের সীমান্ত অতিক্রম করে থাকলে এগিয়ে যান আর যদি না করে থাকেন তাহলে ফিরে আসুন। খেয়াল করেন কত বুদ্ধিমান ছিলেন তিনি। সুতরাং আমর ইবনুল আ’স (রা) খলিফাকে লিখলেন আমরা সীমান্ত অতিক্রম করেছি। আমরা মিশর জয় করতে প্রস্তুত। কিন্তু আমার সাথে মাত্র চার হাজার মানুষ আছে।

সে সময় যোদ্ধাদের সংখ্যা আমরা কিভাবে জানতে পারব ? যারা অমুসলিম ছিলেন তাদের কাছ থেকে যাকাতের পরিবর্তে জিজিয়া নেয়া হত (অমুসলিম দেশে)। শুধুমাত্র যোদ্ধাদের জিজিয়া দেয়া হত। মহিলা, বৃদ্ধ ও শিশুদের দেয়া হত না। ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা) আমর ইবনুল আ’স (রা)-র কাছে জিজিয়া প্রাপ্তদের সংখ্যা জানতে চাইলেন। আমর ইবনুল আ’স (রা) উত্তরে জানালেন শুধুমাত্র সিরায় জিজিয়া প্রাপ্ত যোদ্ধাদের সংখ্যা দশ লক্ষ।

তিনি মাত্র চার হাজার সৈন্য নিয়ে দশ লক্ষ সৈন্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেতে যাচ্ছেন। এই অবস্থায় তিনি ওমর (রা) কে লিখলেন, আমার সৈন্য সংখ্যা মাত্র চার হাজার। আমাদের অনেক বেশি সৈন্য প্রয়োজন। ফলে ওমর (রা) কিছু সৈন্য পাঠালেন। তার কাছে পর্যাপ্ত সৈন্য ছিল না। মুসলমানরা ছিল সংখ্যায় খুবই কম। মুসলমানরা ইতোমধ্যে সিরিয়া ও ফিলিস্তিন দখল করে ফেলেছে এবং মুসলিম সৈন্যরা ইতোমধ্যে ভারতের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। তারা এই সকল অঞ্চল জুরে বিস্তৃত হচ্ছিল এবং সকল অঞ্চল মিলে মুসলিম সৈন্য সংখ্যা ছিল সর্বমোট প্রায় ষাট হাজার মাত্র।

ওমর (রা) চিন্তিত হলেন, আমি কোথায় থেকে সৈন্য সংগ্রহ করব। তিনি বেদুঈন এবং অন্যান্যদের কে সংগ্রহ করে মিশরে পাঠালেন, যারা কখনো জিহাদে অংশগ্রহণ করেননি। ওমর (রা) লিখে পাঠালেন আমি আপনার জন্য আট হাজার সৈন্য পাঠালাম।

আমার ইবনুল আ’স (রা) মদিনা থেকে আসা মুসলমানদের সংখ্যা গুনে দেখলেন মাত্র চার হাজার। সুতরাং তিনি ওমর (রা) কে লিখে পাঠালেন, বাকি সৈন্যরা কোথায় ? আপনি তো আট হাজার সৈন্য পাঠাবেন বলেছিলেন।

ওমর (রা) উত্তরে লিখলেন, আমি যে চার হাজার সৈন্য পাঠিয়েছি তাদের মধ্য চারজন ব্যক্তি আছেন যারা এক এক জন এক হাজার মানুষের সমান। তারা হলেন, মুহাম্মদ ইবনু মাসলামা, যাবির ইবনুল আওয়াম, ওবাদা ইবনুল সাবিদ এবং মুগদাদ ইবনুল আসওয়াত (রা)।

আমরা কি বর্তমানে এমন কোন মানুষ দেখাতে পারব যিনি এক হাজার জনের সমান শক্তিশালী ? বেশির ভাগ মানুষই একজনের মোকাবেলা করতে সক্ষম নয়। কিন্তু তাদের প্রত্যেককে তুলনা করা চলে এক হাজার জন মানুষের সাথে ! এখন সব মিলিয়ে মাত্র আট হাজার সৈন্য বিশাল মিশরীয় সভ্যতার মোকাবেলা করছে। এছাড়া রোমান সৈন্যবাহিনীর সাথে রয়েছে আলেকজান্দ্রিয়ায় দ্রুতগামী রণতরীর বহর যাদের ইস্তাম্বুলের সাথে সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে। তারা সামরিক এবং সভ্যতাসহ সকল দিক থেকে অদম্য। সুতরাং তিনি কোন দুর্বল শত্রুর মোকাবেলা করছেন না। মিশর রোমানদের দ্বারা শাসিত এবং পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী জাতি।

আমর ইবনুল আ’স (রা)-র কত সময় লেগেছিল মিশর জয় করে এর রাজধানী আলেকজান্দ্রিয়ায় প্রবেশ করতে ? চার বছর ? না বরং মাত্র চার মাস ! এটা কি হল ? কি হল সেই সভ্যতার, সেই পরাশক্তির যারা ভাবতো গোটা বিশ্ব ব্যবস্থা তাদের হাতের মুঠোয় ? তারা গোটা বিশ্বটাকে নিয়ন্ত্রণ করত। তারা যেখানে খুশি যাকে ইচ্ছা আক্রমণ করতে পারত। তাদের কি এমন হল যে তারা এত দ্রুত পরাজিত হল ! কি কারণে তাদের এমন পরাজয় ?

আপনারা অনেকে হয়ত বলবেন, রসূল (সা) এর সাহাবীদের কারণে অথবা ইসলাম সত্য জীবন ব্যবস্থা এই কারণে রোমানদের পতন হয়েছে ?

না শুধু এজন্য তাদের পতন হয়নি।

আর একটি অবস্থা বর্ণনা করা যাক। যদি তার অনেক বছর পরের কথা চিন্তা করি। মুসলমানরা সর্বপ্রথম ৯২ হিজরি সালে স্পেনীয় সভ্যতার বিরুদ্ধে অভিযান চালায়। তখন কোন সাহাবী ছিলেন না। সে সময় মুসলমানদের নেতৃত্বে ছিলেন একজন অনারব। আর তিনি হলেন তারেক ইবনুল জিহাদ। তিনি কোন আরব ছিলেন না। এবং অবশ্যই কোন সাহাবীও ছিলেন না।

তারা ৯২-তে প্রথম অভিযান পরিচালনা করেন এবং ৯৫-তে ম্পেন এবং পর্তুগাল জয় করে ফ্রান্সে অভিযান শুরু করেন। তার এক বছর পর মুসলমানরা প্যারিস থেকে মাত্র ৬০ কি.মি. দূরে ছিল। এ সভ্যতার কি এমন হল যে মাত্র তিন বছরেই পতন হল ? ফরাসিরা কেন মুসলমানদের থামাতে ব্যর্থ হল ? মুসলমানরা প্রায় তাদের রাজধানী পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। কিভাবে সম্ভব ? এমন কি হল ?

প্রিয় ভাই ও বোনেরা, আমরা শত শত বছর কিংবা কয়েক দশকের কথা বলছি না। আমরা এখানে এক বছর, সেখানে দুই বছর, তো আর একখানে তিন বছর করে সময়ের কথা বলছি। এগুলো কি ?

এর মধ্যে নিশ্চয় কোন রহস্য আছে।

এই সবগুলো সভ্যতার ক্ষেত্রে যা কিছু ঘটেছে নিশ্চয়ই সবক্ষেত্রে একই ধরনের কিছু রহস্য রয়েছে।

সবগুলো সভ্যতা ধ্বংস হয়েছে দু’টি কারণে।

সব সময় দু’টি কারণে তারা ধ্বংস হয়েছে।

প্রথম কারণটি হল, তাদের নৈতিক অধঃপতন।

তাদের কোন নৈতিকতা ছিল না। তারা ছিল দুর্নীতিগ্রস্থ। তারা ছিল নৈতিকভাবে কলুষিত। বস্তুবাদী জগত, ব্যভিচার ছিল তাদের জীবনের উদ্দেশ্য; পারিবারিক কাঠামো ভেঙ্গে পড়েছিল। স্বার্থপরতা, আত্নকেন্দ্রিকতা ইত্যাদি সমাজে ছড়িয়ে পরেছিল। ঠিক যেমনটি আমরা বর্তমান পশ্চিমা সমাজে দেখতে পাচ্ছি। শুধু এগুলোই তাদের ধ্বংসের জন্য যথেষ্ট কারণ হতে পারে না। কারণ তারা তো অনেক বছর থেকেই দুর্নীতিগ্রস্থ ছিল। শুধু এটিই একটি সভ্যতা ধ্বংসের জন্য যথেষ্ট কারণ হতে পারে না।

অবশ্যই আরও কোন কারণ আছে।

দ্বিতীয় কারণটি হল -একটি উন্নত কিংবা দৃঢ় বিশ্বাসী শক্তিশালী সভ্যতা তাদের আক্রমণ করেছে, নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হয়েছে।

হয় তারা অধিকতর ভাল কিংবা বস্তুগত ভাবে শক্তিশালী। যার কারণে আমরা দেখেছি মঙ্গলরা ইউরোপ জয় করেছে। তারা নৈতিকভাবে উৎকৃষ্ট ছিল না। মঙ্গলরাও নিকৃষ্ট ছিল। কিন্তু তারা সামরিকভাবে অত্যন্ত শক্তিশালী ছিল। আর আমরা একই ধরনের বিষয় বার বার দেখে আসছি।

‘লা ইয়া গুররান্নাকা তাকাবুল লাজিনা ইয়া কাফারু ফিল বিলাদ, মাতাউন কালিলা ।’‘পৃথিবীতে অবিশ্বাসীদের ক্ষমতা দেখে বোকার মত আচরণ করো না। তা ক্ষণস্থায়ী। বেশিদিন টিকে থাকে না’।

অন্যান্য সভ্যতাগুলো নিয়ে তো একটা ধারণা পাওয়া গেল। এবার আসুন আমরা ইসলামী সভ্যতা সম্পর্কে ধারণা লাভ করি। পৃথিবীর সমস্ত সভ্যতা একটি ধারাবাহিকতার মধ্যে দিয়ে গড়ে ওঠে। তা হল ক্রমান্বয়ে বিস্তৃত হওয়া, সভ্যতার শিখরে পৌঁছানো, বহি-শক্তিদ্বারা আক্রান্ত হওয়া, খুব দ্রুত পতন। যা ঐতিহাসিকভাবে পুনরাবৃত্ত হয়েছে।

শুধুমাত্র ইসলামী সভ্যতা এর ব্যতিক্রম। ইসলাম এমন একটি সভ্যতা যা এই ধারাবাহিকতার মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠেনি।

আমি আপনাদের সামনে ইসলামী সভ্যতার গতিধারা তুলে ধরতে চাই। সে অনেক কথা। আমি চেষ্টা করব অল্প কথায় সংক্ষেপে বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে।

ইসলামের সূচনা হয় মক্কা থেকে। সভ্যতার বিবেচনায় একটি সভ্যতার সূচনা হয় একটি দেশ শাসনের মাধ্যমে। শাসন করার মত দেশ কিংবা অঞ্চল ছাড়া একটি পরিপূর্ণ সভ্যতা হতে পারে না। তত্ত্ব, পদ্ধতি-বিদ্যা বা মেথডোলজি এবং ভাবাদর্শ সত্ত্বেও সেটা পরিপূর্ণ সভ্যতা হিসেবে গণ্য হবে না, যতক্ষণ না কোন অঞ্চলে তা প্রতিষ্ঠিত হয়।

সুতরাং মক্কায় ইসলামের প্রথম তের বছর ছিল মুসলমানদের জন্য ভাবাদর্শ, বিশ্বাস, নৈতিকতা গঠনের সময়। এজন্য আপনারা খোয়াল করবেন, ইসলামের প্রথম তের বছরে কোন রাজনৈতিক, সামাজিক, বিচার ব্যবস্থাসহ কিছুই ছিল না। এমনকি সে সময় নামাজ ছাড়া অন্য কোন ইবাদতও ছিল না। রোযা, যাকাত, হজ্জ ইত্যাদি সবকিছু মদিনা থেকে শুরু হয়। মক্কার জীবন ছিল ভাবাদর্শ ও নৈতিকতা (ঈমানুন ওয়া আখলাক) প্রতিষ্ঠার সময়।

সুতরাং হিজরতের মাধ্যমে ইসলামী সভ্যতার সূচনা হয়। এজন্যই ওমার ইবনুল খাত্তাব (রা) হিজরতকে ইসলামী ক্যালেন্ডারের সূচনা হিসেবে গ্রহণ করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কারণ তা ছিল ইসলামী সভ্যতার সাথে সাথে একটি রাষ্ট্রের সূচনা।

প্রিয় ভই ও বোনেরা, সব কিছুই তার পর থেকে পরিবর্তন হয়ে যায়, এমনকি কোরআনও। মাক্কী সূরাগুলোর রচনাশৈলী মাদানি সূরাগুলো থেকে আলাদা। মক্কা থেকে মদিনা যাওয়ার পর কোরআনের ধরণ পর্যন্ত পাল্টে গেছে। আর এটাই আমাদের অগ্রযাত্রা শুরুর বছর।

কত বড় ছিল ঐ ইসলামী রাষ্ট্রটি ? প্রায় সিডনি শহরের মত একটি ছোট শহর যার নাম ছিল ইয়াসরিফ বর্তমানে মদিনা মনোয়ারা (আলা সাকিয়া আন্দালুস সালাত ওয়া তাসলিম)। খুবই ছোট রাষ্ট্র। আমরা লক্ষ লক্ষ মানুষের রাষ্ট্রের কথা বলছিনা। তা ছিল সর্বোচ্চ প্রায় ত্রিশ হাজার মানুষের ছোট শহর। যার মধ্যে মুসলিম, অমুসলিম, ইহুদি নারী শিশুসহ সবাই ছিল।

সুতরাং ইতিহাসে দ্রুত পট পরিবর্তন হচ্ছে। ২য় হিজরি সালে বদর যুদ্ধ সংগঠিত হয়। বদর যুদ্ধ নিয়ে একটা ছোট ঘটনা আপনাদেরকে জানাতে চাই । যার বিস্তারিত বর্ণনা আছে আমার লেখা ধারাবাহিক বই ‘আল বুম আস শিরা আন নবোইয়ায়’। সেখান থেকে একটি মন্তব্য আপনাদের সামনে তুলে ধরছি।

খেয়াল করেন, বদরে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল তিন’শ চৌদ্দ জন আর কাফেরদের সংখ্যা ছিল নয়’শ পঞ্চাশ জন। যেখানে কাফেরদের ছিল দু’শ অশ্বারোহী বাহিনী অন্যদিকে মুসলমানদের ছিল মাত্র দুইটি ঘোড়া। সুতরাং আমরা সংখ্যা, ক্ষমতা ইত্যাদিতে তাদের চেয়ে বেশি ছিলাম না, বরং আমরা ছিলাম তাদের তুলনায় নগণ্য। আর যুদ্ধটি ছিল খুবই স্বল্পস্থায়ী। সেখানে তিন’শ এর বেশি মানুষ নয়’শ পঞ্চাশ জনের মুখোমুখি হয়েছিল। এ কেমন কথা !

বর্তমান কিংবা অতীতে যে কোন মাত্রায় বিবেচনা করলে সেটা ছিল খুবই ছোট্ট আকারের যুদ্ধ। প্রিয় ভাই ও বোনেরা, আপনারা কি জানেন যুদ্ধটি কত সময় স্থায়ী ছিল? মাত্র দুই ঘণ্টা ! দুই দিন নয় বরং দুই ঘণ্টা।

একজন কাফির পাহাড়ে বসেছিলেন, যিনি কুরাইশদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না এবং যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেননি। যখন যুদ্ধ শুরু হয়, তিনি সিনেমা দেখার মত করে যুদ্ধটি উপভোগ করছিলেন। সুতরাং তিনি দেখছেন। তিনি মুসলিম কিংবা কুরাইশ কারো সাথেই ছিলেন না। তিনি একজন দর্শক ছিলেন মাত্র। আর তিনি হলেন ইবনু আসাম। হঠাৎ দুই ঘণ্টা পর যুদ্ধ শেষ হয়ে গেল ! তিনি ভেবেছিলেন (ইন্ডিয়ান কিংবা অন্যান্য সিনেমা যেমন অনেক সময় ধরে চলতে থাকে) যুদ্ধটি অনেক সময় ধরে চলতে থাকবে। কিন্তু এটা যেন একটা ছোট ডকুমেন্টারি !

এসব দেখে তিনি মনে মনে বলেছিলেন-

ওয়াল্লাহি মারাইতু কারইয়াবি আজাবা ফারহু মিনহু কান্নিসায়া। আমি আমার জীবনে এমন চমক আগে কখনও দেখিনি। তারা (কাফিররা) মহিলাদের মত পালিয়ে গেল।

পাঁচ বছর পর লোকটি মদিনায় বেড়াতে আসেন। তিনি তখনো মুসলিম হননি। রাসূল (সা) তাকে দেখতে পেলেন। রাসূল (সা) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি ইবনু আসাম ? তিনি বললেন, হ্যাঁ। রাসূল (সা) জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি বদরের যুদ্ধ দেখেছেন ? তিনি বললেন, হ্যাঁ দেখেছিলাম। রাসূল (সা) আবার জিজ্ঞেস করলেন, যুদ্ধ শেষে আপনি কি বলেছিলেন ? তিনি বললেন কিছুই বলিনি তো। রাসূল (সা) পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি মনে মনে বলেননি যে – ওয়াল্লাহি মারাইতু কারইয়াবি আজাবা ফারহু মিনহু কান্নিসায়া। আমি আমার জীবনে এমন চমক আগে কখনও দেখিনি। তারা (কাফিররা) মহিলাদের মত পালিয়ে গেল।

ইবনু আসাম সাথে সাথে ঘোষণা করলেন- আসহাদু আল্লাহ ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আসহাদু আন্না মুহাম্মাদুর রাসূল উল্লাহ, ওয়াল্লাহি মা হাদ্দাদতু বিহা আহাদান। তিনি আশ্চর্য হয়ে বললেন, আমি এই কথাগুলো কাউকে কখনো বলিনি। তিনি অবশ্যই আল্লাহর রাসূল।

সে যুদ্ধে সত্তর জন কাফির নিহত হয়েছিল এবং সত্তর জন বন্দি হয়েছিল। মাত্র সত্তর জন মানুষ নিহত হয়েছিল ! আজকে বিভিন্ন স্থানে বোমা হামলায় এর চেয়ে অনেক বেশি মানুষ নিহত হচ্ছে। সত্তর জন মানুষ নিহত হলেও তা ছিল ইসলামের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ। কেন ?

কেন তা ইসলামের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ ? এটি এমন একটি যুদ্ধ যাতে খুব কম মানুষ অংশগ্রহণ করে, খুবই স্বল্পস্থায়ী, একটি নির্দিষ্ট জায়গায় সীমাবদ্ধ ছিল, এমনকি মক্কা বিজয়ও হয়নি তার পরও তা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

আল্লাহ সুবাহানাহু তা’আলা পবিত্র কোরআনে বলেছেন—

‘ইয়াওমাল ফুরকান, ইয়াওমাল তাকাল জাম’য়ান’। এটি হল বিভাজন রেখা। এটি সেই যুদ্ধ যা সত্য মিথ্যার পার্থক্যকারী।

মদিনার একজন যুবকের মন্তব্য থেকে বিষয়টি আমরা বুঝতে পারব। তিনি মুসলিম সৈন্যবাহিনীতে ছিলেন এবং তিনি একজন আনসার। তিনি ঐ যুদ্ধের অংশগ্রহণ করেছিলেন। যখন তারা বিজয়ী হয়ে ফিরে আসলেন। তার পরিবার তাকে যুদ্ধে বিজয়ের জন্য অভিনন্দন জানাচ্ছিল। তখন তিনি কিছু কথা বললেন, যা রাসূল (সা) শুনতে পেলেন।

তিনি বলেছিলেন, আলা মাতু বারিক আন আলা ? তোমরা কেন আমাদের অভিনন্দন জানাচ্ছ ? ইন্নামা আল্লাকিনা আজইজান সুলআন। আমরা তো কিছু বৃদ্ধ নির্লজ্জ মানুষের মোকাবেলা করেছি মাত্র। ফাজা বাহনাহুম কালখিরাফ। আমরা তো তাদের কে ভেড়ার মত তাড়িয়েছি। আমাদের কাছে সেটা সাধারণ ব্যাপার মাত্র। কোন লড়াই বলা চলে না। আর তোমরা তো জানো যুদ্ধ অনেক কঠিন ব্যাপার কিন্তু সেটা ছিল খুবই সহজ।

রাসূল (সা) কথাগুলো শুনে তাকে শুধরিয়ে দিলেন। রাসূল (সা) বললেন, লা তাকুল হাদা ইবনে আখি। প্রিয় ভাতিজা আমার, এমন করে বলেনা। উলা ইকা বালাহ্। আমরা তাদের নেতাদের হত্যা করেছি।

কুরাইশদের মাত্র দুই জন নেতা বেঁচে গিয়েছিল। মাত্র দু’জন ! আবু সুফিয়ান যিনি কাফেলা নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন এবং রাসূল (সা) এর চাচা আবু লাহাব যিনি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি। কিন্তু যুদ্ধে পরাজয়ের খবর শুনে তিনি এত বেশি ক্রোধান্বিত ও মর্মাহত হয়েছিলেন যে মাত্র তিন দিন পর মারা যান। সুতরাং বাকী থাকল একমাত্র আবু সুফিয়ান।

কল্পনা করতে পারেন ! হঠাৎ করে একটি দেশের শাসকবর্গ, সকল গোত্রপতি এক সাথে এত দ্রুত নিহত হল। হ্যাঁ, বদরে সেটাই হয়েছিল। বদরের মাধ্যমে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়।

কুরাইশরা বুঝতে পেরেছিল এটা তাদের জন্য মহাবিপদের কারণ। সুতরাং তারা সৈন্য সংগ্রহ করা শুরু করল এবং অন্যান্য আরবদের সাহায্য নিতে থাকল। এভাবে তারা উহুদের যুদ্ধের জন্য অগ্রসর হয় এবং মুসলমানরা ৩ হিজরি সালে সংঘটিত ঐ যুদ্ধে পরাজিত হয়।

এভাবে আল্লাহ সুবাহানাহু তা’আলা মুসলমানদের বুঝাতে চাইলেন, আশ্চর্যের কিছু নেই; এটা আনুগত্যের ব্যাপার। উহুদ প্রান্তরে আল্লাহ সুবাহানাহু তা’আলার অবাধ্য হওয়ার কারণে তোমাদের পরাজয় হয়েছিল।

আর যখনই তোমরা সঠিক পথে ছিলে তোমরাই বিজয়ী হয়েছিলে।

সব কিছু দ্রুত ঘটে চলেছে। হিজরি পঞ্চম সালে, কুরাইশরা ইহুদী, গাতফান এবং অন্যান্য আরব সম্প্রদায়ের সাহায্য নিয়ে একটি বিশাল শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী গঠন করতে সক্ষম হয়। আল আহযাব বা সম্মিলিত বাহিনী মদিনা অভিমুখে রওয়ানা হলো। এবার দশ হাজার শক্তিশালী সৈন্য নিয়ে আরবেরা মদিনা আক্রমণ করতে আসে।

রাসূল (সা) কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হলেন। তারা মদিনা রক্ষা করার জন্য এর চারপাশে পরিখা খনন করলেন। এই কারণে এ যুদ্ধকে সম্মিলিত বাহিনী বা আল আহযাব অথবা পরিখা বা খন্দকের যুদ্ধ বলা হয়। তারা এক মাস ধরে মুসলমানদের অবরোধ করে রেখেছিল। মদিনা পূর্ব ও পশ্চিমে পাথরিয় জায়গা দ্বারা সুরক্ষিত ছিল, ফলে শত্রুবাহিনী অগ্রসর হতে পারছিল না। দক্ষিণ-পশ্চিম দিকটি পাহাড় দ্বারা সুরক্ষিত ছিল। উত্তরে ছিল পরিখা, আর মদিনার দক্ষিণ-পূর্ব দিক সুরক্ষার জন্য রাসূল (সা) ইহুদি বনু কোরায়যা গোত্রের সাথে চুক্তি করেন। ইহুদিরা তাদের স্বভাবজাত ভাবে যুদ্ধকালীন সময়ে তাদের চুক্তি ভঙ্গ করে। এবং তারা দক্ষিণ দিক থেকে মুসলমানদের আক্রমণ করতে এবং কাফেরদের সাহায্য করতে কাফেরদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়।

অতএব, মুসলিমরা উত্তর দিকে দশ হাজার শক্তিশালী শত্রুবাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করতে প্রস্তুত। কিন্তু মদিনার ভিতরে নিজেদের শিশু ও নারীদের রক্ষা করতে তাদের অন্য আর একটি শত্রুবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়তে হচ্ছে। এবং সেখানে কোন নিরাপত্তা বলয় নেই।

সে এক কঠিন পরীক্ষা !

আল্লাহ সুবাহানাহু তা’আলা সে অবস্থার কথা এভাবে বর্ণনা করেছেন—ইজাউকুম মিন ফাওকিকুম ওয়া মিন আসফালা মিনকুম। যখন (হামলা করার জন্য) তোমাদের বিরুদ্ধে সমাগত হয়েছিল উচ্চ অঞ্চল ও নিম্ন অঞ্চল থেকে।

ওয়া বালাগাতিল কুলুবুল হানাজির ওয়া তাদাননুকুম বিল্লাহি জুনুনা। যখন (ভয়ে) তোমাদের চক্ষু বিস্ফারিত হয়ে পড়েছিল, তোমাদের প্রাণ হয়ে পড়েছিল কন্ঠাগত। (বর্তমানে কিছু মুসলিমকে ভীষণ ভীত দেখতে পাবেন। সে সময় মুসলমানরা কতটা ভীত ছিল তা আল্লাহ সুবাহানাহু তা’আলা আমাদের জানিয়ে দিচ্ছেন। কত বেশি ভীত ছিল এটা তার একটা উদাহরণ।)

হুনালিকাব তালিয়াল মুমিনুন ওয়াজুল জিলু জিলজালান সাদিদা। এবং (আল্লাহর সাহায্যে বিলম্ব দেখে) তোমরা আল্লাহ তা’আলা সম্বন্ধে নানাবিধ বিরূপ ধারনা পোষণ করছিলে। তখন মু’মিনরা পরীক্ষিত এবং তারা ভীষণভাবে প্রকম্পিত হয়েছিল। (সুরা আহযাব, আয়াত: ১০-১১)

এটা ছিল পরীক্ষা, যারা ভীষণভাবে ভীত তারা মসজিদ, ইসলামী কার্যক্রম, ইসলামী আন্দোলন অথবা সংগঠন থেকে বহুদূরে থাকতে চায়, তারা সন্ত্রাসবাদ আইনের ভয়ে ভীত। যেন তাদেরকে কেউ বন্দি করে নিয়ে যাবে। এমন ভয়ে কাতর !

আপনারা কি জানেন, ভীতদের সংখ্যা কত ছিল যারা রাসূল (সা) কে ছেড়ে চলে যায় ? রাসূল (সা) এর সাথে মাত্র তিন’শ জন অবশিষ্ট ছিল। বাকী সবাই পালিয়ে যায়। সর্বশক্তিমান আল্লাহ সুবাহানাহু তা’আলা একদল ফেরেশতা ও ঝড়ো বাতাস পাঠালেন। কাফেরদের অন্তর ভয়ে কেঁপে উঠলো এবং তারা পালিয়ে যেতে বাধ্য হলো। তারপর রাসূল (সা) ইহুদীদের বিরুদ্ধে বনি কুরাইযার যুদ্ধ পরিচালনা করলেন এবং প্রায় সাত’শ বিশ্বাসঘাতককে হত্যা করলেন। এরপর তারা মদিনা থেকে চিরদিনের জন্য বিতাড়িত হয় এবং খাইবারে আশ্রয় নেয়। এটা ছিল হিজরি পঞ্চম সালের ঘটনা।

খেয়াল করেন, ইসলাম কি কোন শক্তিশালী সভ্যতা ছিল ? না। বিজ্ঞান, গণিত, অট্টালিকা ইত্যাদি কিছুই ছিল না। যে মসজিদটি ছিল, সেটা ছিল খুবই সাধারণ। কোন কার্পেট বা ভালো ছাদও ছিল না। শুধুমাত্র কিছু খেজুর পাতা উপরে বিছানো ছিল। যখন বৃষ্টি হতো স্বয়ং রাসূল (সা) ভিজে যেতেন, কর্দমাক্ত হতেন।

বস্তুগত দিক থেকে সেটা কি কোন বিশাল সভ্যতা ? না। তাদের কি বিশাল শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী ছিল ? না। সেটা কোন সুসজ্জিত সভ্যতা ছিল ? না। তাহলে সেই সভ্যতার এমন কি ছিল যার সাহায্যে গোটা পৃথিবী জয় করতে পেরেছে ? একবার ভাবুন তো প্রিয় ভাই ও বোনেরা। এভাবে চলতে থাকে, সে বিষয়ে পরে বলছি।

সপ্তম হিজরি সালে রাসূল (সা) জানতে পারলেন, ইহুদীরা খাইবারে আরেকটি সম্মিলিত সৈন্যবাহিনী সমাবেশ করতে যাচ্ছে। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন আর অপেক্ষা নয়। এবার তিনি খাইবারে অভিযান চালিয়ে দখল করে নিলেন। এভাবে আরব উপদ্বীপ থেকে ইহুদীরা বিতাড়িত হয়। তারা রাসূল (সা) এর বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা এবং ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখে। সেটা কখনো ভুললে চলবে না।

খাইবারের যুদ্ধ শেষে একজন ইহুদী মহিলা রাসূল (সা) এর কাছে কিছু খাবার নিয়ে আসে ! কারণ রাসূল (সা) তার পরিবারকে হত্যা না করে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। খাইবারে যারা আত্মসমর্পণ করেছিল, তিনি তাদের সবাইকে হত্যা না করে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন।

কিন্তু ইহুদীরা আজকে আমাদের সাথে তার বিপরীত আচরণ করছে।

এর দ্বারা প্রমাণিত হয়, রাসূল (সা) কত শান্তিপ্রিয় ছিলেন।

যা হোক, মহিলাটি রাসূল (সা) এর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে ভেড়ার মাংস নিয়ে আসলো যা ছিল বিষে ভরা ! রাসূল (সা) এবং সাহাবীরা খাওয়া শুরু করলেন। বিশর নামে একজন সাহাবী খাওয়ার পর মৃত্যুবরণ করেন। রাসূল (সা) একটু মাংস খেয়ে খাওয়া বন্ধ করলেন। তিনি সকলকে বললেন, থামো ! খেয়ো না। এই রান্না করা ভেড়ার মাংস থেকে আওয়াজ আসছে এটা বিষে ভরা। কিন্তু বিশর ইতোমধ্যে খেয়েই ফেলেছেন এবং তিনি মৃত্যু বরণ করেন।

রাসূল (সা) বলেছেন, ‘মাজিলতু আজিজু মিন আকলাতি ইস্’সায়াতি ফি খাইবার, হাত্তা কাতায়াতিল আবহারা মিন্নিহ্।’ আমি আমার বাকি জীবনে খাইবারের সেই বিষক্রিয়ার ব্যথা অনুভব করতে থাকি, যতদিন না আমার হৃদপিণ্ড থেমে যায়।

ইমাম ইবনুল কাইয়্যূম বলেছেন, রাসূল (সা) ওই বিষক্রিয়ার কারণে ইন্তেকাল করেছেন। ওই ব্যথার কারণে, তিনি উল্লেখ করেন। রাসূল (সা) বলেছেন, ‘হাত্তা কাতায়াতিল আবর হুয়াল কলব’। রাসূল (সা) বলেছেন, এই বিষের ফলে আমার হৃদযন্ত্র বন্ধ হয়েছে। আল ইমাম ইবনুল কাইয়্যূম বলেছেন, রাসূল (সা) শহীদ হয়েছেন, কারণ তাকে একটি যুদ্ধে বিষ প্রয়োগ করা হয়। যদিও তিনি তার কয়েক বছর পর ইন্তেকাল করেছেন কিন্তু মূলত মৃত্যুর কারণ ছিল সেই বিষক্রিয়া। এ বিষয়ে সমস্ত বিশেষজ্ঞরা ঐকমত পোষণ করেন যে, যদি কেউ কোন যুদ্ধে আহত হন এবং দশ বছর পরেও সে আঘাতের কারণে মৃত্যুবরণ করেন তারপরও তিনি শহীদ হিসেবে গণ্য হবেন।

ইবনুল কাইয়্যূম মুসলমানদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, মনে রাখবেন কারা আপনাদের রাসূল (সা) কে হত্যা করেছিল। তাদের বিষয়ে সতর্ক থাকবেন কারণ তারা আপনাদের রাসূল (সা) কে হত্যা করেছে।

যা হোক, খাইবারের ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছিল হিজরি সপ্তম সালে। এর অনেক ঘটনা ‘আন নবইয়া’ সিরিজে বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে। হিজরি অষ্টম সালে মুসলমানরা মক্কা বিজয় করেন। মক্কা বিজয়ের সেই মহান অভিযানের পর রাসূল (সা) এর বিরুদ্ধে কোরাইশদের থেকেও শক্তিশালী একটি গোত্র তায়েফে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিলো। মক্কা বিজয়ের দুই মাস পরে তায়েফের যুদ্ধ সংঘটিত হলো। তায়েফ বাসীদের সাথে হুনাইনের যুদ্ধের শুরুতে মুসলমানরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল।

‘ইয়াওমা হুনাইন ইন আজাবাতকুম কাসরাতুকুম ফালাম তুগনি মিনাল্লাহি শাইয়া।’ এই প্রথম বারের মতো কোন যুদ্ধে মুসলমানরা তাদের শত্রু বাহিনী থেকে সংখ্যায় বেশি। আর তাহলো হুনাইনের যুদ্ধ। মুসলমানদের সংখ্যা ছিল বার হাজার অন্যদিকে কাফিরদের সংখ্যা ছিল দশ হাজার।

মুসলিম বাহিনী সাময়িক পরাজিত হয়েছিল।

কারণ তারা গর্ব করতে থাকে এই বলে যে, যখন আমরা সংখ্যায় খুব নগণ্য ছিলাম তখন কাফিরদের পরাজিত করেছি। আর এখন আমরা সংখ্যায় অনেক বেশি। আমরা অবশ্যই বিজয়ী হবো।

কিন্তু আপনারা কখনো তাদেরকে সংখ্যা কিংবা শক্তির জোরে পরাজিত করেননি। আপনারা তাদেরকে পরাজিত করতে পেরেছিলেন, কারণ আপনারা আল্লাহর সৈনিক। আনুগত্যই আপনাদের পাথেয়।

সে অবস্থায় মাত্র এক’শ জন রাসূল (সা) এর সাথে ছিলেন। মাত্র এক’শ জন ! এবং তিনি দশ হাজার হাওয়াজিন শত্রু বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে গেলেন। যারা পালিয়ে গেছে তারা জানতে পারলো, রাসূল (সা) এখনো যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি যুদ্ধের ময়দান ত্যাগ করেননি। এ খবর পেয়ে তারা ফেরত আসতে শুরু করলেন। তারা যুদ্ধের ময়দানে ফেরত আসার আগেই মুসলিম একশত বীর দশ হাজার কাফেরদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করেন।

পবিত্র হাদিসে আছে, ‘ওয়াল্লাহি মা ওয়াসালা মিন্না আহাদিল্লাহ, ওয়াল মুসলিমুনা ইয়াজমায়ুনা আল গানিয়ান।’ হাদিসে আছে, ‘আমরা পৌঁছার আগেই দেখি মুসলমানরা গণিমতের মাল সংগ্রহ করছে।’

স্মরণ করুন, কোথায় আমাদের শক্তির উৎস।

নবম হিজরি সালে আরবরা দলে দলে মদিনায় এসে ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে। দশম হিজরি সালে তাবুক যুদ্ধে রোমান সাম্রাজ্যে অভিযান পরিচালনার জন্য প্রথম বারের মতো মুসলিম বাহিনীর নেতৃত্ব দিলেন হযরত মুহাম্মদ (সা)। এটা শুধু আরবদের জন্যই নয় বরং গোটা বিশ্বের জন্য একটি বার্তা।

হযরত মুহাম্মদ (সা) এর নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী সম্পর্কে সিজার জানতে পারলেন। সিজার স্তব্ধ হয়ে গেলেন কারণ তিনি পবিত্র ধর্মগ্রন্থগুলো সম্পর্কে জানতেন। তিনি তার মন্ত্রী পরিষদকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি আমার উপদেশ গ্রহণ করবে ? তরা উত্তরে বলল, আপনি আমাদের নেতা, প্রশান্তি দাতা এবং আমাদের মধ্যে সবচেয়ে জ্ঞানী। দয়া করে বলবেন কি আমাদের জন্য কি উপদেশ রয়েছে ? তিনি বললেন, চলো আমরা ইসলামের অনুসরণ করি, কারণ ইসলাম গোটা পৃথিবী জয় করবে। হযরত মুহাম্মদ (সা) একজন রাসূল, যা পবিত্র গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে। তারা উত্তরে বলল, তা কখনোই সম্ভব না। আমরা কখনোই আমাদের ধর্ম ত্যাগ করব না।

তিনি বললেন, যদি ইসলামের অনুসরণ না করো, তাহলে আমার আর একটি উপদেশ শোনো। তারা জানতে চাইলেন, কি আপনার উপদেশ ? তিনি বললেন, তোমরা মুহাম্মদ (সা) এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে যেও না। তোমাদের সৈন্য সংখ্যা যত বেশিই হোক না কেন, তিনি তোমাদের ধ্বংস করে দিবেন। তারা বলল, হ্যাঁ আমরা আপনার এই উপদেশ অনুসরণ করব।

সুতরাং রোমান বাহিনী মুসলিম বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সাহস পেলনা। মুসলিম বাহিনী তাবুক প্রান্তে রোমান বাহিনীর জন্য এক মাস ধরে অপেক্ষা করতে থাকে কিন্তু তারা আসেনি।

সুতরাং পঞ্চম হিজরি সাল থেকে যখন মদিনায় মাত্র তিন’শ মানুষের একটি ছোট সভ্যতা ছিল ইসলাম। আমি আপনাদের বলেছিলাম, বলতে গেলে তেমন কোন সভ্যতা ছিল না, ছিল না কোন অট্টালিকা। দশম হিজরি সালে মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে মুসলমানরা পুরো আরব অঞ্চল জয় করে এবং ইতোমধ্যে রোমানদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করতে চাইলে তারা মুসলমানদের সম্মুখীন হতে ভয়ে অস্বীকৃতি জানায়।

এসব কি ! কোন ধারাবাহিক অগ্রগতি নাকি দ্রুত সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছানো ? একটু গভীর দৃষ্টি দিয়ে চিন্তা করবেন।

হিজরি ১১ সালের শুরুতে রাসূল (সা) ইন্তেকাল করলেন। এরপর আরবরা ইসলাম থেকে দূরে সরে যেতে থাকল। আবু বকর সিদ্দিক (রা) তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিলেন। দৃঢ় প্রত্যয়ী হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা) দ্বিধান্বিত হলেন। তিনি বললেন, কিভাবে আপনি সমগ্র আরবের মোকাবেলা করবেন ! মাত্র তিনটি শহর মদিনা, মক্কা, এবং তায়েফ মুসলমানদের দখলে রয়েছে। মক্কা ইসলামী শাসন থেকে বেরিয়ে আসার চিন্তা করছিল। আরবে শুধুমাত্র তায়েফ নগরী ইসলামের অধীনে থাকতে প্রস্তুত ছিল। সুতরাং মুসলমানরা মদিনা ছাড়া অন্য কারো উপর আস্থা রাখতে পারছিল না। এভাবে ইসলাম আবার মদিনার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে গেল।

আবু বকর সিদ্দিক (রা) ঘোষণা করলেন, আমি তাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাব। প্রয়োজনে আমি একাই তাদের বিরুদ্ধে লড়ব। তিনি সকল মুসলমানদের আহবান জানালেন। সমগ্র আরবে তখনো অনেক মুসলিম ছিলেন যারা ছিল অসংগঠিত। তিনি তাদেরকে মদিনায় আসতে আহবান জানালেন। যখনই কয়েক’শ মানুষ সংগঠিত হতেন, তিনি তাদেরকে কোন একটি গোত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পাঠাতেন। তিনি কয়েক মাসের মধ্যে বারটি সৈন্যদল গঠন করলেন। বারটি বিশাল সৈন্যদল মনে করার কোন কারণ নেই। এই বারটি সৈন্যদলে সর্বমোট যোদ্ধার সংখ্যা ছিল মাত্র দশ হাজার। সুতরাং কোন কোন সৈন্যদলে এক হাজারেরও কম সৈন্য ছিল এবং তারা সমগ্র আরবের মোকাবেলা করে। তাদেরকে অনেক বিশাল বিশাল শত্রুবাহিনীর মোকাবেলা করতে হয়।

ইয়ামামার যুদ্ধে সেনাপতি ছিলেন খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা)। ইয়ামামায় মুসলমানদের সংখ্যা ছিল মাত্র তিন হাজার। অন্যদিকে আবু মুসাইলামা আল কাজ্জাবের ছিল এক লক্ষ সৈন্যের বিশাল বাহিনী। কিন্তু মাত্র এক বছরেরও কম সময়ে সমগ্র আরব আবার ইসলামের অধীনে চলে আসে।

ইতিহাসে এসব কি কারণে সংগঠিত হয়েছিল ? কোন সভ্যতা পতনের পর মাত্র এক বছরের মধ্যে প্রত্যাবর্তন করেছে এমন কি কখনও হয়েছে ? ইতিহাসে এমন নজির আছে কি ?

প্রিয় ভাই ও বোনেরা, আমরা অসাধারণ কিংবা ভিন্নতর একটা বিষয়ে আলোচনা করছি। আর তা হল ইসলাম। এটা কোন মামুলি জীবন ব্যবস্থা, মামুলি সৈন্যবাহিনী কিংবা মামুলি সভ্যতা নয়। এটা ইসলাম।

যা হোক, তার পরের বছর ১২ হিজরি সালে, আমি আপনাদেরকে ইতোমধ্যে বলেছি তারা পৃথিবীর সর্ববৃহৎ জাতির বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। ব্যপারটা এমন যেন দুই বছরের মধ্যে মদিনার মত একটি ছোট শহর রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রকে আক্রমণ করছে। হ্যাঁ, আমরা এরকম ব্যবধানের কথাই বলছি। এটাই ইতিহাস। এটা চরম সত্য ইতিহাস, যা সবার জানা।

সুতরাং ঝঞ্ঝার গতিতে অগ্রসরমান মুসলমানরা ১২ হিজরিতে অভিযান শুরু করে, ১৪ হিজরিতে পারস্য সম্রাজ্যের পতন হয়, ১৫ হিজরিতে রোমান সম্রাজ্যের পতন, এভাবে ৯২ হিজরিতে স্পেন এবং মুসলমানরা ৯৫ হিজরি সালে ফ্রান্সে প্রবেশ করে।

আব্দুর রহমান আল গাফেকি (রাহেমাতুল্লাহি তা’আলা) একটি পরিকল্পনা করলেন। আব্দুর রহমান আল গাফেকি হলেন ফ্রান্সে অভিযান পরিচালনাকারীদের মধ্যে একজন। খুব অসাধারণ পরিকল্পনা। খুব কম মানুষই এটা সম্পর্কে জানেন। আমি আমার লেখা বই ‘তারিকুল আন্দালুজ’, আন্দালুজের ইতিহাসে এই সম্পর্কে আলোচনা করেছি।

খেয়াল করেন, মুসলমানরা পূর্ব এবং পশ্চিম-উত্তর দিক অগ্রসর হতে সক্ষম হয়েছিল। যখন তারা উত্তরে অগ্রসর হতে লাগল, তারা ইস্তাম্বুলে বাধার মুখে পড়ল। দুই’শ বছরেও তারা ইস্তাম্বুল জয় করতে পারেননি। সুতরাং উত্তরে মুসলমানরা এগিয়ে যেতে পারছিল না এবং কনস্টান্টিনোপলের কারণে তারা ইউরোপ জয় করতে পারছিলনা। এই অবস্থায় আব্দুর রহমান আল গাফেকি ঘোষণা করলেন, আমি পশ্চিম দিক দিয়ে ইউরোপ জয় করব। সুতরাং ইউরোপ আক্রমণ করতে হবে পশ্চিমে স্পেন, ফ্রান্সের দিক দিয়ে।

উমাইয়া খলিফা তাকে নিষেধ না করা পর্যন্ত তিনি অগ্রসর হতেই থাকলেন, কারণ তিনি মাত্র দুই হাজার চার’শ সৈন্য নিয়ে পুরো ইউরোপ বিজয় করতে যাচ্ছিলেন। যেখানে ইউরোপের সৈন্য সংখ্যা সত্তর লাখের কম নয়। তিনি এই অবস্থায় ইউরোপ জয় করতে বেরিয়েছিলেন। কিন্তু খলিফা তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন এটা করতে যাবেন না, এটা খুবই বিপদজনক।

আমি জানিনা যদি তিনি তাকে ইউরোপ বিজয়ের অনুমতি দিতেন, অন্য কিছুও হতে পারত।

যাহোক, মাত্র এক’শ বছরেরও কম সময়ে কোন জাতি পৃথিবীর সর্বাধিক অঞ্চল নিজেদের দখলে নেয়? -নিশ্চয়ই মুসলমানরা।

কার সবচেয়ে বৃহৎ সৈন্যবাহিনী ছিল ? - মুসলমানদের।

কারা জ্ঞান বিজ্ঞানের সকল দিক বিভাগে নব যুগের সূচনা করে ? তারা কারা ? - নিশ্চয় মুসলমানরা।

কারা সুমহান সভ্যতা গড়ে তোলে ? - অবশ্যই মুসলমানরা।

স্মরণ করেন, আমরা যদি রোমান, পারস্য, স্পেনীয় ইত্যাদি সভ্যতার কথা বলি তাদের সভ্যতার সর্বোচ্চ শিখরে পৌছতে শত শত বছর সময় লেগেছিল। কিন্তু মুসলমানদের মাত্র এক শত বছরেরও কম সময় লাগে ! সময় স্বল্পতার কারণে বিস্তারিত আলোচনা করা সম্ভব নয়। আমি দ্রুত বলে যাওয়ার চেষ্টা করব।

ইসলাম এভাবে বিকশিত হতে থাকে। মুসলমানরা পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়েন। ইসলামী সভ্যতার বিস্তৃতি ঘটতে থাকে। যখন ইউরোপ অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল তখন মুসলমানরা এত বেশি সৃজনশীল ছিলেন যে, তারা চিকিৎসা শাস্ত্রের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন। সত্যি মুসলমানরা ছাড়া চিকিৎসা শাস্ত্রের সূচনা কল্পনাও করা যেত না। গণিতের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। ‘০’ শূন্য আবিষ্কারের ফলে গোটা বিশ্বের ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়। এরকম ভাবে জীবনের সকল দিক বিভাগে মুসলমানরা সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে যায়।

আর মুসলমানরা জিহাদ বন্ধ করার আগ পর্যন্ত ছিল অদম্য।

কিন্তু পরবর্তীতে তারা জিহাদ বিমুখ হয়ে পরেছিল। আর মুসলমান শাসকেরা দুনিয়ার চাকচিক্যে মোহগ্রস্ত হয়ে ছিলেন। তারা দাসী, গানবাজনা, বিভিন্ন ধরনের খাবার ইত্যাদিতে মত্ত ছিলেন। তাদের কেউ কেউ এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে মুকুট ক্রয়ে ব্যস্ত ছিলেন। তারা এত বেশি ধনবান এবং ক্ষমতাবান ছিলেন যে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মত কেউ ছিল না। তাদের ছিল শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী এবং সুবিশাল সম্রাজ্য। সুতরাং বিশ্ব শাসন এবং সঠিক পথে পরিচালিত করার পরিবর্তে তারা আরাম আয়েশি জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেল। তারা জিহাদের পরিবর্তে নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

ইসলামের শত্রুরা এসব বিষয় নজরদারীর মধ্যে রেখেছিল। কিভাবে তারা নজরদারী করছিলেন সে বিষয়ে আপনাদের একটি গল্প শোনাই। তারা সতর্ক নজর রাখছিল। স্পেনের একটি বিচিত্র গল্প বলি। স্পেন এবং দক্ষিণ ফ্রান্স মুসলমানদের অধীনে ছিল। ফ্রান্স তখনো শক্তিশালী ছিল। তারা স্পেন ফেরত পাওয়ার জন্য তখনো মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। মুসলমানদের আক্রমণ করা যাবে কিনা জানার জন্য ফরাসি নেতৃবৃন্দ স্পেনে মুসলমানদের অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য গুপ্তচর পাঠালেন।

গুপ্তচরেরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য সীমান্তবর্তী পাহাড় পেড়িয়ে গ্রামগুলোতে যাওয়া আসা করতেন। তারা তাদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতেন।

গল্পটা ছিল এরকম –

ফরাসি নেতৃবৃন্দ কিছু গুপ্তচর প্রেরণ করলেন। তারা সীমান্ত অতিক্রম করে একটি ষোল বছর বয়সের ছেলেকে দেখলেন, ছেলেটি কান্না করছে। ছেলেটি মেয়েদের মত করে কান্না করছিল। তারা ছেলেটির কাছে জানতে চাইলেন, বাবা তুমি কান্না করছ কেন ? ছেলেটি উত্তর দিল, কুরআনের হাফেজ না হওয়া পর্যন্ত আমার মা আমাকে মুসলিম সেনাবাহিনীতে যোগদান করতে দিচ্ছেন না। কিন্তু আমি মুসলিম সেনাবাহিনীতে যোগদান করতে চাই। আমি জিহাদ করতে চাই।

চিন্তা করেন, তারা দামী গাড়ি কিংবা ইন্টারনেটের জন্য কান্না করছে না।

গুপ্তচরেরা ফিরে গেলেন এবং তাদের নেতাদের বিষয়টি জানালেন। তাদের সম্রাট বললেন এই অবস্থায় মুসলমানদের কোন ভাবই আক্রমণ করা সম্ভব নয়। এমন একটি জাতির বিরুদ্ধে লড়াই করে টিকে থাকা সম্ভব নয়।

ত্রিশ বছর পরে তিনি আবার একজন গুপ্তচর পাঠালেন। গুপ্তচর সীমান্ত এলাকায় আবারও ষোল বছরের একটি ছেলেকে কান্না করতে দেখলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, বাবা তুমি কাঁদছ কেন ? ছেলেটি উত্তর দিল, আমার মা আমাকে একটি দাসী কিনতে দিচ্ছেন না। এবার গুপ্তচর তাদের নেতাদের জানালেন। তারা বলল, হ্যাঁ এখন আক্রমণের উপযুক্ত সময়। এবং তারা আক্রমণ চালিয়ে উত্তর স্পেন দখল করে ফেলল।

সুতরাং যুবক ছেলে মেয়েরা কিভাবে বড় হচ্ছে এবং তাদের চাহিদা কি তার উপর নির্ভর করছে সবকিছু। ইসলামের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে তাদের চিন্তাধারার উপর। বৃদ্ধদের উপর নির্ভরশীল নয়। এটা অবশ্যই তরুণ প্রজন্মের উপর নির্ভরশীল যারা আমার ছেলে মেয়ের মত বয়সী।

কিসের প্রতি তোমাদের আকর্ষণ ? তোমরা কি নিয়ে চিন্তা ভাবনা কর ? তোমাদের জীবনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য কি ? তোমাদের আকাঙ্ক্ষা নারী, মেয়ে নাকি জিহাদ ও কোরআন ? এগুলোই সমস্ত কিছুর মধ্যে ব্যবধান সৃষ্টি করবে।

ক্রুসেডাররা যখন লক্ষ্য করল মুসলমানরা নৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে গেছে এবং দুনিয়াবি বিষয়বস্তু নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরেছে। তারা জেরুজালেম পুনর্দখলের জন্য ইউরোপকে একত্রিত করল। সাতটি দেশ সম্মিলিত ভাবে মুসলমানদের আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিলো। তিন জন রাজা অর্থাৎ ফ্রান্স, ব্রিটেন ও জার্মানির রাজারা নিজেরাই সৈন্যবাহিনীর নেতৃত্ব দিলেন।

আপনারা কি জানেন ফিলিস্তিন দখলের জন্য ইউরোপ থেকে কত সৈন্য প্রেরণ করা হয়েছিল? পাঁচ লক্ষ সৈন্য জেরুজালেম দখল করার জন্য পাঠানো হয়েছিল। সাগরের দিক থেকে এবং উত্তর দিক থেকে তারা আক্রমণ চালিয়ে যায়। সে এক দীর্ঘ ইতিহাস। আমি আমার বই ‘তারিখ আল কুদ্দুস ওয়া প্যালেস্টাইনে’ সে বিষয়ে বর্ণনা করেছি।

এভাবে তারা মুসলমানদের উপর বিজয়ী হয়।

কি কারণে আমরা পরাজিত হয়ে ছিলাম সে বিষয়ে একটি ছোট গল্প বলি।

জার্মান সেনাবাহিনী উত্তর দিক দিয়ে তুরস্ক, সিরিয়া হয়ে আনতাকিয়া শহরে পৌঁছে যায়। আনতাকিয়া শহরটি ভূ-ব্যস্টিত ছিল, মাত্র একদিক দিয়ে তাদের সাগরের সাথে সংযোগ ছিল। সে সময়ের শক্তিশালী মুসলমানরা ধীরে ধীরে তাদের মুখোমুখি হতে থাকে। মিশরে তখনও মুসলমানদের আধিপত্য।

আনতাকিয়ার মুসলমানরা মিশরে একটি প্রতিনিধি দল প্রেরণ করলেন। আনতাকিয়া তখনও মুসলমানদের অধীনে ছিল। আনতাকিয়া পরাজিত না হলে জেরুজালেম দখল করতে পারবে না জার্মান সেনাবাহিনী। আনতাকিয়া জেরুজালেম যাওয়ার পথে অবস্থিত। ছয় মাস যাবত মুসলমানরা তীব্র প্রতিরোধ করে যুদ্ধ চালিয়ে গেলেন।

দুঃখের বিষয় মিশর অর্থ, খাদ্য, অস্ত্র ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত রয়ে গেল। সুতরাং সেখানে কেউ সাহায্য নিয়ে গেল না। আনতাকিয়ার মুসলমানরা মিশরে একটি দ্রুতগামী নৌযান প্রেরণ করলেন। তারা মিশরের নেতৃবৃন্দের সাথে দেখা করলেন। তাদের কাছে সহযোগিতা কামনা করলেন। মিশর তাদের সাথে আনতাকিয়ায় একটা প্রতিনিধিদল প্রেরণ করল। তারা আনতাকিয়ার নেতাদের সাথে দেখা করল।

আনতাকিয়ার নেতৃবৃন্দ হতভম্ব হয়ে গেলেন। মিশরের নেতৃবৃন্দের মাঝে অস্ত্র, অর্থ কিংবা খাদ্য সাহায্য দেয়ার চিন্তা পর্যন্ত ছিল না।

মিশর থেকে প্রতিনিধি দলকে দুটি কারণে প্রেরণ করা হয়েছিল।

প্রতিনিধি জানালেন মিশরের অধিপতি বলেছেন, ‘আমি আনতাকিয়ায় একজন অপূর্ব সুন্দরী দাসীর কথা শুনেছিলাম। আমি তাকে কিনতে চাই। এবং আমি একজন বিশ্ব বিখ্যাত অঙ্কন শিল্পীর কথা শুনেছিলাম। আমি তাকে ভারা করতে চাই’। যখন এই সংবাদ আনতাকিয়ায় পাঠ করা হচ্ছিল। আনতাকিয়া পরাজয় বরণ করতে বাধ্য হল। এভাবে আনতাকিয়ায় পতন হয়।

এটা এমন যেন ফিলিস্তিনে মুসলমানরা চিৎকার করে বলছে, আমাদেরকে হত্যা করা হচ্ছে। আর মুসলমানরা যেন মুভি দেখার মত চেয়ে আছেন। তখনও এমনটি হয়েছিল বর্তমানেও হচ্ছে। এভাবে আনতাকিয়ার পতন হয়।

ভিন্ন সময়ে তিন ভাগে নিরানব্বই বছর ফিলিস্তিন তাদের দখলে ছিল। প্রথমবার অষ্টাশি বছর জেরুজালেম তাদের দখলে থাকার পর আবার আমাদের দখলে চলে আসে। তারপর তা আবার দশ বছরের জন্য তারা দখল করে এবং আবার আমরা পুনর্দখল করি। তারা আরও এক বছরের জন্য তা দখল করে নেয় এবং আমরা তা আবারও পুনর্দখল করি। সুতরাং নিরানব্বই বছর ধরে মুসলমানরা লড়াই চালিয়ে যায়। হোটেলে গিয়ে আলোচনা করার পরিবর্তে তারা নিরানব্বই বছর সংগ্রাম চালিয়ে যায়, জিহাদ চালিয়ে যায়।

সুতরাং মুসলমানরা জেরুজালেম এবং ফিলিস্তিন কিভাবে পুনর্দখল করতে সক্ষম হয়েছিল ?

আমরা সবাই সালাউদ্দিনের কথা শুনলেও আমরা জানিনা তিনি কোথাকার মানুষ। সালাউদ্দিনের মত একজন মানুষের আগমনের ফলে পুরো মুসলিম উম্মাহ ভাল হয়ে গিয়েছিল; না এমনটি কখনই ঘটেনি। সালাউদ্দিনেরও এক’শ বছর আগে দু’জন মনিষী ছিলেন।

আবু হামিদ আল গাজ্জালি এবং আবু বক্কর আত তারতুশি দু’জনই ছিলেন অন্যতম বিখ্যাত মুসলিম মনিষী। এই মনিষীগণ শুধুমাত্র বইপত্র নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন না, তারা মুসলিম উম্মাহর সার্বিক অবস্থা নিয়েও ব্যস্ত ছিলেন। তারা মুসলিম উম্মাহর অবনতি লক্ষ্য করলেন এবং অনুধাবন করলেন শত্রুরা হয়তো খুব শীঘ্রই মুসলমানদের আক্রমণ করবে। ক্রসেডাররা আগমনের আগেই তারা এসব চিন্তা করছিলেন।

অবস্থা বিবেচনায় তারা বাগদাদের আব্বাসিয় খলিফার কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। তারা খলিফাকে এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য জিহাদ ঘোষণার অনুরোধ জানালেন। খলিফা জানালেন, আপনারা যথার্থ বলেছেন, আমরা অবশ্যই তা করব। কিন্তু তিনি আবার দাসীদের নিয়ে মত্ত থাকলেন ! আর তিনি কিছুই করলেন না। তারা শুধু এ ধরনের প্রতিশ্রুতিই শুনে আসছিলেন। শুধুমাত্র মিথ্যা বক্তব্য এবং মিথ্যা প্রচারণা।

খলিফা মসজিদে দাড়িয়ে বললেন, আমাদের জিহাদ ঘোষণা করা উচিৎ। কিন্তু কে জিহদের ডাক দিবেন ? তারই তো জিহাদের ডাক দেয়ার কথা। কিন্তু তিনি কিছুই করলেন না !

আবু বক্কর আত তারতুশি এবং আবু হামিদ আল গাজ্জালি বুঝতে পারলেন এসব নেতৃত্বের উপর কোন ভরসা নেই। আমাদের তাদের থেকে ভিন্ন নেতৃত্বের প্রয়োজন।

প্রিয় ভাই ও বোনেরা, আমি দুঃখিত অনেক সময় নিয়ে বলছি। আমি ইতিহাস বলছি যার পুনরাবৃত্তি হয়। আপনারা যদি ইতিহাস বুঝতে ব্যর্থ হন। তাহলে অতীত ও বর্তমানের বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহ বুঝতে ব্যর্থ হবেন।

ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়। তারাই প্রকৃত মনিষী যারা শুধুমাত্র তাদের মর্যাদা, আয়, বই ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত না থেকে বরং পুরো জাতিকে নিয়ে চিন্তা ও কাজ করেন। তারা মুসলিম উম্মাহর বিষয়ে সচেতন। তারা নিজের উদ্যোগে বিভিন্ন বিষয়ে কাজ করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

যা হোক, তারা দু’জনে বিভিন্ন বিষয়ে পণ্ডিত ব্যক্তিদের ঐক্যবদ্ধ করলেন এবং মুসলমানদের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করলেন বিশেষ করে যুবক নারী ও পুরুষদেরকে। আর এই আন্দোলন ‘হারাকাত আহিয়া উদ দ্বীন’ নামে পরিচিত। মুসলমানদের হৃদয়ে ইসলামের পুনর্জাগরণের উদ্দেশ্যেই ‘আহিয়া উদ দ্বীন’ এর সূচনা এবং তারা সফলকাম হয়েছিলেন। দ্রুত এই আন্দোলন বিস্তৃত হতে থাকল। সেটা কিছু কিছু শহরে অন্যান্য শহরের তুলনায় বেশি ফলপ্রসূ হয়েছিল। অনেক ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা অন্যান্যদের তুলনায় ছিলেন খুব বেশি আন্তরিক এবং কঠোর পরিশ্রমী।

খেয়াল করবেন, ইসলাম আল্লাহ সুবাহানাহু তা’আলার যদিও মনোনীত জীবন ব্যবস্থা। আল্লাহ সুবাহানাহু তা’আলা যদি বলেন হয়ে যাও, তাহলে ইসলাম বিজয়ী হয়ে যাবে এবং গোটা বিশ্ব ইসলামের দখলে চলে আসবে। কিন্তু ইসলামের নীতি এটা নয়। ইসলামে কখনই এ নীতির অনুসরণ হয়নি। মুসলমানদের অবশ্যই সংগ্রাম করতে হবে, যুদ্ধ করতে হবে এবং আনুগত্য করতে হবে। খন্দকের মত আপনাকে চতুর্দিক থেকে শত্রুরা ঘিরে ফেলবে অথবা উহুদের মত পরাজয় বরণ করতে হবে তারপরও অদম্য গতিতে এগিয়ে যেতে হবে।

রাসূল (সা) পর্যন্ত আহত হয়েছিলেন, রক্তাক্ত হয়েছিলেন। কিসের জন্য ?

এটাই ইসলামের পথ। ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে আমাদের অবশ্যই সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। আপনা আপনি ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হবে না। দোয়া গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু শুধুমাত্র দোয়া করে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। তার জন্য আমাদের অবশ্যই কঠোর সাধনা এবং কাজ করতে হবে।

ইরাকের কুর্দিস্তানের আল মুসল শহরে ‘হরাকাত আহিয়া উদ দ্বীনের’ ব্যাপক প্রভাব সৃষ্টি হয়। উত্তর ইরাকের ঐ শহরটি এবং আশপাশের এলাকা শাসন করত একটি রাজকীয় পরিবার। সেই রাজকীয় শহরটির শাসক ছিলেন ইমাদ উদ্দিন জাংকি। আপনাদের মধ্যে কত জন ইমাদ উদ্দিন জাংকি সম্পর্কে জানেন ? দয়া করে হাত উঁচু করবেন। প্রিয় ভাই ও বোনেরা খেয়াল করেন।

ইমাদ উদ্দিন জাংকি সালাউদ্দিনের চেয়েও বিখ্যাত ছিলেন। ইমাদ উদ্দিন জাংকি জিহাদ ঘোষণা করলেন। তৎকালীন প্রথম মুসলিম শাসক হিসেবে তিনি জিহাদের ঘোষণা দিলেন। তার সৈন্য সংখ্যা ছিল খুবই কম। সে সময়ে বাগদাদে আব্বাসি সম্রাজ্যে এবং কায়রোতে ফাতেমি সম্রাজ্যের সুবিশাল সৈন্যবাহিনী ছিল।

ইমাদ উদ্দিন জাংকির শহরটি ছিল খুবই ছোট। যা আমাদের কে মদিনার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

তিনি জিহাদ ঘোষণা করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়েছিলেন। এবং তাই করলেন। তিনি তার ঘনিষ্ঠ মুসলিম শাসকদের সাথে যোগাযোগ করলেন। আহবান জানালেন ফিলিস্তিনে ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করার। তিনি তাদের কাছে প্রতিনিধি দল প্রেরণ করলেন। তারাও আশ্বস্ত হওয়ার মত প্রতিশ্রুতি দিলেন। কিন্তু বাস্তবে কিছুই করলেন না। তিনি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর দামেস্কে প্রতিনিধি দল প্রেরণ করলেন। যদি দামেস্ক আল মুসলের সাথে যোগদান করে তাহলে খুব শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী নিয়ে ক্রুসেডারদের প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে।

তিনি দামেস্কের শাসকের কাছে বার্তা পাঠালেন তার সাথে যোগদান করতে। কিন্তু দামেস্কের শাসক ইমাদ উদ্দিন জাংকিকে তাদের জন্য হুমকি মনে করলেন ! এই চিন্তা থেকে তিনি খ্রিষ্টান ক্রুসেডারদেরকে তার সাথে শান্তি চুক্তি এবং ইমাদ উদ্দিনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য আহবান জানালেন।

দামেস্কের মুসলিম জনতা ক্ষেপে ফুসে উঠতে শুরু করল। তারা তাদের শাসকের কার্যক্রম মেনে নিতে পারল না। কিন্তু তিনি ছিলেন স্বৈরশাসক। তিনি তাদের দমিয়ে রাখলেন এবং তারা কিছুই করতে পারছিল না। এই অবস্থায় তারা ইমাদ উদ্দিনকে গোপনে জানিয়ে দিল আমরা আপনার সাথে আছি।

খেয়াল করবেন, প্রকৃত মুসলমানদেরকে তাদের শাসকেরা কখনই দমিয়ে রাখতে পারে না।

ইমাদ উদ্দিন বুঝতে পারলেন ক্রুসেডারদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার আগে তিনি এই বিশ্বাসঘাতকদের দ্বারা আক্রান্ত হতে পারেন। অবস্থা বিবেচনায়, তিনি দামেস্ক আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিলেন। দামেস্কের লোকজন সেখানে ইমাদ উদ্দিনকে সহায়তা করে এবং দামেস্ক তার দখলে চলে আসল। তিনি আক্রমণ চালিয়ে যেতে থাকলেন। আর এভাবে হালাত, হেমস সহ অন্যান্য অঞ্চল তার দখলে চলে আসতে থাকল। এভাবে তিনি উত্তর ফিলিস্তিন থেকে ইরাকের বৈরুত পর্যন্ত মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ করলেন। পুরো অঞ্চল তার শাসনের অধীনে চলে আসল।

লেবাননে তার একজন সেনাপতি অবস্থান করছিলেন। তার নাম আসাদ উদ্দিন শারকু। তিনি লেবাননের আল বাকে ছিলেন। তিনি জাংকি পরিবারের মত কোন রাজকীয় পরিবারের সন্তান ছিলেন না। কিন্তু তিনি ছিলেন অন্যতম একজন শাসক। ইমাদ উদ্দিন জাংকি আসাদ উদ্দিন শারকুকে মিশরে প্রতিনিধি হিসেবে প্রেরণ করলেন। ইমাদ উদ্দিনের মৃত্যুর পরে নুর উদ্দিন ক্ষমতা গ্রহণ করলেন।

নুর উদ্দিন হল আর একজন বিখ্যাত ব্যক্তি যিনি সালাউদ্দিনের চেয়েও বিখ্যাত ছিলেন। তারা দুজনেই সালাউদ্দিনের চেয়ে বিখ্যাত ছিলেন। আসাদ উদ্দিন শারকু একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে মিশরে গেলেন। তার ভাতিজাও সেই প্রতিনিধি দলের সদস্য ছিলেন। তিনি হলেন ইউসুফ। তার উপাধি ছিল সালাউদ্দিন। তিনি আসাদ উদ্দিনের মিশরে প্রেরিত প্রতিনিধি দলের একজন ছিলেন।

কি কারণে সেই প্রতিনিধি দল প্রেরণ করা হয়েছিল ?

ফাতেমি সম্রাজ্য আপনারা ক্রসেডারদের দক্ষিণ দিক থেকে আক্রমণ করলে আমরা উত্তর দিক থেকে আক্রমণ করতে পারব। এভাবে আমরা ঐক্যবদ্ধ ভাবে তাদেরকে ধুলায় মিশিয়ে দিতে পারব। ফাতেমি সম্রাট বললেন, ঠিক আছে। শুনতে ভালই শোনায় ! কিন্তু আসাদ উদ্দিন শারকু চলে যাওয়ার পর তিনি ক্রুসেডারদের সাথে শান্তিচুক্তি এবং নুর উদ্দিনের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ হওয়ার আহবান জানালেন। যা আজকের দিনেও সত্য, এটা কোন নতুন ঘটনা নয়। যা হোক, সে এক দীর্ঘ ইতিহাস।

প্রতিনিধি দল আবার সেখানে গেলেন। এবার ফাতেমি সম্রাট বললেন, আপনারা ভুল শুনেছেন। তাদের সাথে আমাদের কোন চুক্তিই হয়নি। আমি আপনাদের সাথেই আছি। প্রতিনিধি দল আবার ফিরে গেল। ফাতেমি এবং খ্রিষ্টানদের মধ্যে চুক্তির বিষয়টি একেবারে সত্য ছিল।

নুর উদ্দিন জাংকি বিস্ময়কর ঘটনা ঘটালেন। তিনি একটি সৈন্যবাহিনী গঠন করলেন এবং ফিলিস্তিনে ক্রুসেডারদের সাথে যুদ্ধ না করে ফাতেমি সম্রাজ্য আক্রমণ করলেন। আপনারা যদি আমাদের সাথে যোগদান না করেন তাহলে আমরা আপনাদের আক্রমণ করতে বাধ্য হব। ফাতেমি সম্রাট বললেন, আমরা তো আপনাদের সাথেই আছি। আমি সৈন্যবাহিনী প্রস্তুত করছি। এভাবে আসাদ উদ্দিনের নেতৃত্বে সৈন্যবাহিনী ফিলিস্তিন অভিমুখে রওয়ানা হলো।

ইতিমধ্যে আসাদ উদ্দিন জানতে পারলেন, তার সাথে চাতুরী করা হয়েছে। ফাতেমি সম্রাট নুর উদ্দিনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। তিনি খ্রিষ্টানদেরকে মুসলিম সৈন্যবাহিনীর গতিবিধি গোপনে জানিয়ে দিয়েছেন। এটা জানতে পেরে আসাদ উদ্দিন ফিলিস্তিনে অভিযান স্থগিত করে কায়রো দখল করে ফেললেন। তিনি জানালেন আমাদের একত্রে এগিয়ে যেতে হবে। আমি আপনার সাথে যুদ্ধ করতে চাচ্ছি না। আপনি আমার সাথে আছেন আমি এটা নিশ্চিত করতে চাই।

আবার ফাতেমী সম্রাট আশার বাণী শোনাতে লাগলেন। সালাউদ্দিন পুরো ঘটনা প্রবাহ গভীর পর্যবেক্ষণে রেখেছিলেন। তিনি তার চাচাকে গিয়ে বললেন, এই নেতাদের উপর কোন ভরসা নেই। তাদেরকে আক্রমণ করে হটিয়ে দেয়া দরকার। আসাদ উদ্দিন বললেন, সালাউদ্দিন আমরা চাই না মুসলমানদের মধ্যে বিবাদ সৃষ্টি হোক। সালাউদ্দিন বললেন এতে কোন ভরসা পাচ্ছিনা। আমরা ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ না থাকলে জয়লাভ করা সম্ভব নয়। আর এসব নেতারা বিশ্বাস ঘাতক যাদের কারণে আমরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারছি না। আসাদ উদ্দিন সালাউদ্দিনের পরিকল্পনা নিয়ে দ্বিধান্বিত হলেন।

সালাউদ্দিন তার চাচার অনুমতি ছাড়াই কিছু সৈন্য নিয়ে রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করলেন এবং সম্রাটকে হত্যা করলেন। এভাবে নুর উদ্দিন সিরিয়া, মিশর এবং আশপাশের এলাকায় রাজত্ব কায়েম করলেন। এর দুই মাস পরে আসাদ উদ্দিন মৃত্যুবরণ করেন। এরপর নুর উদ্দিন সালাউদ্দিনকে মিশরের গভর্নর নিযুক্ত করলেন।

এবার তারা ক্রুসেডারদের আক্রমণ করতে প্রস্তুত। কিন্তু ইতোমধ্যে নুর উদ্দিনও ইন্তেকাল করলেন। নুর উদ্দিনের মৃত্যুর পর সম্রাট কে হবেন তা নিয়ে পুরো পরিবারে ভয়াবহ দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হলে সালাউদ্দিন তাদের কাছে বার্তা প্রেরণ করলেন যে, নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকলে জিহাদ পরিচালনা সম্ভব নয়। কিন্তু তারা এই কথায় কর্ণপাত করলেন না। তারা আবারো নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলেন।

সালাউদ্দিন বিষয়টি সমাধান করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি ফিলিস্তিনের উপর দিয়ে তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে গেলেন এবং নুর উদ্দিন জাংকি শাসিত অঞ্চল দখল করে নিলেন। এভাবে তিনি পুরো অঞ্চল নিজের দখলে নিলেন।

এবার ঐক্যবদ্ধ মুসলিম উম্মাহকে নিয়ে তিনি খ্রিস্টানদের পরাজিত করলেন। হাত্তিনের যুদ্ধে তিনি তাদেরকে করুণভাবে পরাজিত করলেন। তার সৈন্য সংখ্যা ছিল মাত্র বার হাজার। তারপরও তিনি তাদেরকে পরাজিত করতে সক্ষম হন।

ক্রুসেডাররা এই ঘটনায় মহা ক্ষিপ্ত হলেন। ক্রুসেডাররা আক্কায় দুই লক্ষ পঞ্চাশ হাজার সৈন্য সমবেত করলেন। সালাউদ্দিন মাত্র বার হাজার সৈন্য নিয়ে তাদের গতিরোধ করে গেলেন। সে অনেক দীর্ঘ ইতিহাস। এভাবে আমরা আবার আমাদের হারানো ক্ষমতা ফিরে পেয়েছিলাম।

কয়েক বছরের মধ্যে ক্রুসেডাররা চিরতরে ফিলিস্তিন থেকে বিতাড়িত হল।

মুসলিমদের বিজয়ের পেছনে এটাই ছিল মূল কাহিনী।

সালাউদ্দিন হঠাৎ করে ক্ষমতায় আসেননি। মনিষীগণ ইসলামের জন্যে অনেক কাজ করে গেছেন। তারা অনেক কঠোর পরিশ্রম করে মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ করেছেন। আর এভাবেই তারা শত্রুদের পরাজিত করতে পেরেছেন।

কয়েক বছর পর মঙ্গলরা আক্রমণ শুরু করে। তারা তাদের সামনে যাদেরকেই পেয়েছেন ধ্বংস করে দিয়েছে। এভাবে তারা আব্বাসি সম্রাজ্য সহ ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, জর্ডানে মুসলমানদের বিধ্বস্ত করে ফিলিস্তিনে প্রবেশ করে। তারা ইউরোপ এবং উত্তর আফ্রিকা পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিল। কেউ তাদেরকে প্রতিরোধ করতে পারছিল না।

সে সময় একজন বিখ্যাত মনিষীর আবির্ভাব হয়, তিনি হলেন আল আ’স ইবনু আবদুস সালাম। আমি আমাদের সন্তানদের উদ্দেশ্যেই এই দীর্ঘ ইতিহাস বলছি যাতে করে তারা অনুসরণের জন্যে কিছু অনুকরণীয় চরিত্র সম্পর্কে ধারণা রাখতে পারে।

প্রিয় তরুণ ভাই ও বোনেরা, কিছু মহান মানুষের কারণেই ইসলাম এত উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন হয়েছে। ইসলাম এমনি এমনি উচ্চ মর্যাদার অধিকারী হয়নি।

ইসলামের জন্যে আমাদেরকে সক্রিয়ভাবে কাজ করতে হবে।

আল আ’স ইবনু আবদুস সালাম মিশরীয় নন বরং তিনি ছিলেন সিরিয়ার অধিবাসী। তিনি দামেস্কের সম্রাটকে মঙ্গলদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণার অনুরোধ জানালেন। কিন্তু এর উত্তর সিরিয়ার সম্রাট আল আ’স ইবনু আবদুস সালামকে দেশ থেকে বহিষ্কার করলেন। আল আ’স ইবনু আবদুস সালাম মিশরে চলে গেলেন এবং মিশরের সম্রাট তাকে স্বাদরে গ্রহণ করলেন।

তিনি একজন সিরিয় নাগরিক হলেও মিশরে তিনি সঠিকভাবে মূল্যায়িত হলেন। খেয়াল করবেন, ইসলামে জাতীয়তা বলতে কিছুই নেই।

এভাবে তিনি মিশরের বুদ্ধিজীবীদের নেতৃত্ব পেলেন। সকল বুদ্ধিজীবীদেরকে তার অধীনে দেয়া হল, যে কারণে তকে বলা হয় সুলতান আল উলেমা। তিনি মনিষীদের সরদার হয়ে গেলেন।

খেয়াল করবেন, যদি আমরা প্রকৃত মুসলমান হয়ে থাকি তাহলে জাতীয়তা আমাদের কাছে কিছুই না। আমি, আপনি আমাদের কারো সে বিষয়ে মাথা ব্যথা নেই, কারণ আমারা ইসলামের ব্যাপারে আগ্রহী, নিজেদের নয়।

সুতরাং আল আ’স ইবনু আবদুস সালাম জিহাদের বাণী ছড়িয়ে দিতে থাকলেন এবং তার কথায় মামলুক সম্রাজ্যের নেতৃবৃন্দ প্রভাবিত হয়ে জিহাদ ঘোষণা করলেন। কাদের বিরুদ্ধে সেই জিহাদ ? সে জিহাদ ছিল মঙ্গলদের বিরুদ্ধে যাদেরকে কেউ প্রতিরোধ করতে পারছিলনা। মিশরে একটি খুব ছোট সৈন্যদল সাইফুদ্দিন কুদ্দুসের নেতৃত্বে গঠন করা হল। এই বিখ্যাত মানুষটির কথা সবসময় মনে রাখা দরকার।

সাইফুদ্দিন কুদ্দুস ঘোষণা করলেন ‘ওয়া ইসলামা’, এই সংগ্রাম ইসলামের জন্য’। এটা কোন জাতির যুদ্ধ নয় কিংবা সম্পদ, তেল ইত্যাদির জন্য যুদ্ধ নয়। এটা শুধু মাত্র ইসলামের জন্য।

আর তার সৈন্য বাহিনীর প্রথম যোদ্ধা ছিলেন সেই বৃদ্ধ মনিষী আল আ’স ইবনু আবদুস সালাম। শুধু ভাষণ দেয়া নয় কিংবা বসে বসে তামাশা দেখার মত মনিষী তিনি ছিলেন না। তিনি এমন মনিষী ছিলেন যিনি সৈন্যবাহিনীতেও যোগদান করেছিলেন। যিনি মনিষীদের জন্য অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন।

ইসলামী পূনর্জাগরণের জন্য আমরা আবার মনিষীদেরকেই সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করতে দেখলাম।

আলহামদুলিল্লাহ মুসলমানরা আয়েন’জালুতের যুদ্ধে বিজয়ী হয়েছিলেন। এভাবে মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চল থেকে মঙ্গলদের বিতাড়িত করা হয়েছিল। এভাবে তারা পরাজিত হয়ে পালিয়ে যায়।

যা হোক, আমরা আবার আন্দোলন লক্ষ্য করলাম। এজন্যই ইসলাম অন্যান্য সভ্যতার মত দুই-তিন বছরের মধ্যে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি। ইসলাম কখনো নিশ্চিহ্ন হয়নি।

মুসলমানদের অধঃপতন হতে শত শত বছর সময় লেগেছিল। কিসের জন্য ?

কারণ মুসলমান নেতৃত্ব এবং মনিষীদের মধ্যে অনেকেই পথভ্রষ্ট হয়েছিল। কিন্তু ইসলামের মতাদর্শ অক্ষত ও অবিকৃত রয়েছে। কারণ কোরআন সম্পূর্ণ অবিকৃত রয়েছে। আর যত দিন পর্যন্ত কোরআন অবিকৃত থাকবে, মুসলমানরা তা অধ্যয়ন করবে এবং পূর্ণ অনুসরণ করবে ততদিন পর্যন্ত ইসলামের পূনর্জাগরণ অব্যাহত থাকবে। যা হোক, এভাবে বিংশ শতাব্দীর প্রথমাংশ পর্যন্ত চলতে থাকে। আমি দ্রুত ইতিহাস বলে জাওয়ার চেষ্টা করব। আমি বেশ কিছু ঘটনা বাদ দিয়ে যাচ্ছি।

১৯০৮ সাল, সে সময় মুসলমান জাতীর মধ্যে অটোম্যান সম্রাজ্য ছিল সবচেয়ে উন্নত। তারা ধীরে ধীরে দুর্বল হতে থাকে। যা শুরুতে ছিল খুবই শক্তিশালী কিন্তু বিংশ শতাব্দীতে খুবই দুর্বল হতে থাকে।

সুলতান আব্দুল হামিদ ছিলেন অটোম্যান সম্রাজ্যের অধিপতি। থিয়োডর হার্জলের নেতৃত্বে ইহুদিরা ফিলিস্তিনকে তাদের কাছে বিক্রি করে দেয়ার জন্য তার সাথে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু তিনি বললেন আমরা জীবন থাকতে সেটা সম্ভব নয়। সুইজারল্যান্ডের বাসেল (Basel) শহরে ইহুদি সম্মেলনে হার্জল ফিরে গিয়ে বললেন, যতদিন মুসলমানদের নেতৃত্বে থাকবেন আবদুল হামিদ ততদিন ফিলিস্তিনে আমরা কোন অংশই পাব না। তাকে অবশ্যই ক্ষমতাচ্যুত করতে হবে।

এজন্য ইহুদিরা অব্যাহত ভাবে বছরের পর বছর চেষ্টা চালিয়ে তুরস্কে মুসলমানদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করল। তাদের সাথে বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি যোগদান করে। তদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মুস্তফা কামাল যিনি সেনা বাহিনীর একটি অংশের নেতৃত্বে ছিলেন। পরবর্তীতে তার উপাধি দেয়া হয় আতা’তুর্ক, তুর্কিদের জাতির পিতা। এটা তার আসল নাম নয়। এটা তার উপাধি।

যা হোক, ব্যাপক ষড়যন্ত্র চলতে থাকে।

১৯০৮ সালে তারা খলিফা আবদুল হামিদকে নির্বাসনে পাঠাতে সক্ষম হয়। তখন পর্যন্ত সেখানে খিলাফত টিকে ছিল। সুলতান আব্দুল হামিদের পর ক্ষমতায় আসেন সুলতান মুহাম্মদ রাশেদ এবং তার পরে ক্ষমতায় আসেন সুলতান আব্দুল মাজিদ। এভাবে সেখানে নামে মাত্র খিলাফত টিকে থাকল। ইহুদিদের দালালরাই মূলত শাসনকার্য পরিচালনা করতো।

সে সময় ব্রিটেন, ফ্রান্স সহ ইউরোপীয়রা অনেক শক্তিশালী ছিল। তারা এই দুর্বল সম্রাজ্যটি দখল করার সিদ্ধান্ত নিলেন। এই লক্ষ্যে তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়ে পরিকল্পনা অনুযায়ী আক্রমণ পরিচালনা করলেন। এভাবে তারা মিশর দখল করতে সক্ষম হলেন এবং ফিলিস্তিন দখলের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখলেন।

কিন্তু অটোম্যান সেনাবাহিনী দক্ষিণ জর্ডানের আকাবা অঞ্চলে তদেরকে প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়। সুতরাং লরেঞ্জ অব অ্যারাবিয়া এবং তার সেনাবাহিনী আর এগিয়ে যেতে পারছিল না। ব্রিটিশ সেনাবাহিনী আকাবার কারণে ফিলিস্তিনে প্রবেশ করতে পারছিল না। সুতরাং ব্রিটিশরা অটোমানদের প্রতিরোধ বূহ্য ভেঙ্গে দেয়ার জন্য অন্য দিকে গুপ্তচর প্রেরণ করল।

সেই গুপ্তচর ছিলেন বিখ্যাত লরেঞ্জ অব অ্যারাবিয়া। তার বিষয়ে আমরা সবাই জানি। এটা প্রামাণ্য দলিল। তিনি ছিলেন ব্রিটিশ গুপ্তচর। তিনি আল হিজাজে গিয়ে আরবদের নেতা আল শরিফ হোসেনের ছেলে ফয়সালের সাথে দেখা করলেন এবং তাকে বুঝাতে সক্ষম হলেন যে আপনারা তুর্কি নন বরং আরব। যেহেতু আপনারা কোন ভাবেই তুর্কি নন সুতরাং আপনারা কিভাবে তুর্কিদের শাসন মেনে নিতে পারেন। আমরা তুর্কিদের বিরুদ্ধে লড়তে আপনাদের সহায়তা করব।

আরবরা এভাবে প্রতারণার ফাঁদে পড়ল এবং ব্রিটিশরা কথা দিল, যদি আপনারা তুর্কিদের বিরুদ্ধে আমাদেরকে সহায়তা করেন তাহলে আমরা পুরো আরব অঞ্চল নিয়ে স্বাধীন আরব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে দিব। এভাবে আরবরা তাদের মিথ্যা প্রতিশ্রুতির ফাঁদে আটকা পড়ে। তারা ব্রিটিশদের পক্ষে যোগদান করল। শরিফ হোসাইনের সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন তার ছেলে ফয়সাল। লরেঞ্জের পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা আল আকাবার পূর্ব দিকে আক্রমণ করল। অটোম্যানরা পশ্চিম দিক থেকে এবং সাগরের দিক থেকে আক্রমণ মোকাবেলা করতে হবে চিন্তাও করেননি।

এভাবে হঠাৎ করে আকাবা ব্রিটিশ নয় বরং আরবদের মাধ্যমে পরাজিত হল ! এরপর ব্রিটিশ এবং আরবরা সম্মিলিতভাবে সিরিয়া এবং ফিলিস্তিন আক্রমণ করে তুর্কিদেরকে বিতাড়িত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল। এভাবে ফয়সালের নেতৃত্বে আরব ও লরেঞ্জের নেতৃত্বে ব্রিটিশ বাহিনীর মধ্যে বিভিন্ন অঞ্চল দখলের প্রতিযোগিতা শুরু হয়।

লরেঞ্জ অব অ্যারাবিয়া দ্রুত বিভিন্ন স্থান দখল করে জেরুজালেমে সালাউদ্দিনের সমাধি স্থানে গেলেন এবং তাতে লাথি মারলেন। তিরস্কার করে বললেন, আমরা আবার জেরুজালেম দখল করেছি সালাউদ্দিন ! আমরা সেই আরবের সহায়তা নিয়েই আরবে এসেছি যারা আমাদের বিতাড়িত করেছিল।

ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস !

তারপর দামেস্ক দখলের প্রতিযোগিতা চলতে থাকে। উভয় সৈন্যদল একই দিনে দামেস্কে প্রবেশ করে। এভাবে অদ্ভুত সব রাজনৈতিক সংঘাত চলছিল। সব শেষে ব্রিটিশরা নামে মাত্র আল হুসাইন পরিবারের হাতে আরবের শাসন ক্ষমতা তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। এভাবে ফয়সাল দামেস্কে আর রাজি ইরাকের নামে মাত্র শাসনভার গ্রহণ করলেন। এগুলো ১৯১৭ সালের ঘটনা। ১৯১৬ সালে একটি চুক্তি হয়।

খেয়াল করেন, এগুলো হলো আরব জাতীয়তাবাদের ফল। তখন যে ষড়যন্ত্র তারা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিল তা আমাদের কাছে এখন পরিষ্কার।

যখন ব্রিটিশ ডকুমেন্টারি ফাঁস হয়ে গেল, দেখা গেল ১৯১৬ সালে ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের মধ্যে ‘সিস পিকো (Sykes Picot, ৮ মে, ১৯১৬)’ নামের একটি চুক্তি হয়েছিল। চুক্তিতে ছিল আরব দখল করার পর ব্রিটেন সিরিয়া ও লেবানন বাদে বাকী অঞ্চলের দখল নিবে আর বাকী গুলো ফ্রান্সের অধীনে দেওয়া হবে। যেহেতু ইতালি ক্ষুব্ধ হয়েছিল তাদের অধীনে লিবিয়াকে দেয়া হয়।

‘ইয়া ক্বুলু (সা) তুশিকু আন তাদায়া আলাইকুমুল হুমাম কামাম তাদআলাল ইলা কাসাতিহা’। রাসূল (সা) বলেছেন, শীঘ্রই বিরোধীরা পরস্পরকে তোমাদের বিরুদ্ধে ডাকবে যেমন ভাবে মানুষ একে অন্যকে খাবারের জন্য ডাকে।

ক্বালু আমিন বিল্লাতিল নাহনু ইয়া রাসূল আল্লাহ (সা) ? আমরা কি সে সময় সংখ্যায় খুব কম হব যে কারণে তারা আমাদের উপর বিজয়ী হবে ?

ক্বালা (সা), কাল লা বাল আনতুম কাছির ওয়ালা কিন্নাকুম কাউসুত উসসাঈর। না, তোমরা সংখ্যায় অনেক বেশি হবে কিন্তু অবস্থা হবে এমন যেন জলে ভাসা খড়কুটোর মতো অন্তঃসার শূন্য।

ক্বালা মিম্মা জালিকা ইয়া রাসূল আল্লাহ (সা) ? কি করণে সে সময় আমাদের অবস্থা এ রকম হবে ইয়া রাসূল আল্লাহ (সা) ?

ক্বালা লাম্মা আসাবাকুমুল ওয়া’হান। কারণ তোমরা হবে দুর্বল।

ক্বালু ওয়া’মান ইয়া রাসূল আল্লাহ (সা) ? কেন সে সময় আমরা এত দুর্বল হব ইয়া রাসূল আল্লাহ (সা) ?

ক্বালা হুব্বুত দুনিয়া ওয়া কারাহিয়াতুল মাউত। যখন তোমরা দুনিয়ার ভালবাসায় মত্ত হবে আর মৃত্যুর কথা ভুলে যাবে তখন তোমরা দুর্বল হয়ে যাবে।

মুসলিম উম্মার জন্য আখিরাতের ভয় এবং জিহাদ করে মৃত্যু বরণের জন্য প্রস্তুত হওয়ার কোন বিকল্প নেই।

যা হোক, এভাবেই শত্রুরা আমাদের বোকা বানিয়েছিল। তারা আমাদের বিভিন্ন অঞ্চল দখল করে পুতুল সরকার বসিয়ে মুসলমান এবং আরবদের বিভক্ত করে ফেলেছে। আর এভাবে আরবরা তুর্কিদের ঘৃণা করছে আর তুর্কিরা আরবদের ঘৃণা করছে এবং অন্যরাও তাই।

১৯২৪ সালে আতা’তুর্ক খিলাফত ব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘোষণা করেন। তিনি ঘোষণা করেন, আমরা খিলাফতের তকমা চাইনা, তুরস্ক মুসলিম উম্মার অন্তর্ভুক্ত নয়। আমরা ইউরোপের অংশ। আমরা আরবি ভাষা এবং আরবি বর্ণমালা ব্যবহার করতে চাইনা।

এমনি ভাবে আযান পর্যন্ত তুর্কি ভাষায় দেওয়ার ব্যবস্থা হল। আর এভাবে চুয়ান্ন বছর পর্যন্ত চলতে থাকে। চুয়ান্ন বছর ধরে আযান তুর্কি ভাষায় দেওয়া হয় !

এর থেকে নিকৃষ্ট আর কি হতে পারে ? আমরা নিকৃষ্টতার সর্বনিম্ন পর্যায়ে চলে গিয়েছিলাম। দুর্ভাগ্য আমাদের ! আর কি বা বাকী থাকল !

যা হোক, তারা ষড়যন্ত্র করে আর আল্লাহ্ সুবাহানাহু তা’আলা ও পরিকল্পনা করেন নিশ্চয়ই আল্লাহর পরিকল্পনা সর্বোত্তম।

‘ওয়া ইয়াম কুরুনা ওয়া ইয়াম কারুনা মাকারুল্লাহ আল্লাহু খাইরুল মাকেরিন’।

১৯২৪ সালে এভাবে ইসলামের আর কোন প্রতিনিধি অবশিষ্ট রইল না। মুসলমানরা চরমভাবে দুর্বল হয়ে গেল। মাঝে মাঝে দু’একজন ছাড়া মনিষীগণ ইসলামের জন্য কেউ অবদান রাখছিলেন না। জামাল উদ্দিন আফগানি, মোহাম্মদ আবদুহ্, মোহাম্মদ রাশিদ রিদা তারা কয়েক জন ব্যক্তিগতভাবে প্রচেষ্টা চালাতে থাকলেন। কিন্তু সম্মিলিত ভাবে কোন কাজ হচ্ছিল না। কেউ মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ করতে এগিয়ে আসছিল না। ইসলামের জন্য কিছু করি এমনটি বলার মত লোক পাওয়া যাচ্ছিল না।

হঠাৎ, মনিষীদের জন্য আবার সুসংবাদ আসল।

খেয়াল করবেন অনেকেই রাজনীতিবিদ ও নেতৃত্বের অপেক্ষায় ছিলেন কিন্তু এভাবে তো হয় না। অতীতেও কখনো এরকম হয়নি যে কেউ একজন এসে সবকিছু পরিবর্তন করে দিবেন।

ইসলামী পুনর্জাগরণের উদ্যোগ মনিষীদের দ্বারা সূচনা হয়ে ধীরে ধীরে সাধারণ জনগণের মাধ্যমে এগিয়ে যায় এবং পর্যায়ক্রমে নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।

‘কামা তাকুনু উল্লাহ্ আলাইকুম’। এমন হলে সেটা অবশ্যই দেরি হয়ে যাবে। সুতরাং গণ আন্দোলন অবশ্যই প্রয়োজন আছে।

এভাবেই প্রথমে শুরু করতে হবে।

কিন্তু কে গণ-মানুষের আন্দোলনের সূচনা করবেন ?

এটা মনিষীগণের কাজ।

বিংশ শতাব্দীতে আবার মুসলমানদেরকে সর্বপ্রথম ঐক্যবদ্ধ করার কাজ শুরু করেন একজন বিখ্যাত ব্যক্তি। সেই মহান ব্যক্তিটি হলেন আল ইমাম হাসান আল বান্না (রহঃ)। খিলাফত ব্যবস্থার সাথে সাথে ইসলামের পতনের মাত্র চার বছর পর ১৯২৮ সালে তিনি তার আন্দোলন শুরু করেন। অনেকেই তাকে অনুসরণ করা শুরু করেন। মিশরে আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াত তার অনুসরণ করতে শুরু করে। আরব উপদ্বীপ এবং মরক্কোতে অনেকেই তার এই আন্দোলনে শামিল হতে থাকেন। ফিলিস্তিনেও এই আন্দোলন গড়ে উঠতে থাকে। সিরিয়ার মুস্তফা সিবা’য়া, আমিনুল হোসেইনীসহ এ ধরনের অনেকেই বিভিন্ন স্থানে সক্রিয়ভাবে কাজ শুরু করলেন।

হঠাৎ কোথায় থেকে কোন একজন যার কখনো হাসান আল বান্নার সাথে দেখা হয়নি তিনি হলেন আল ইমাম আবুল আ’লা মাওদূদী (রহঃ)। তিনি পাকিস্তানে একই চিন্তা থেকে আন্দোলন শুরু করলেন।

তারা সবাই কি বার্তা বহন করেছেন ?

- আমাদের একমাত্র ভরসা হলো ইসলাম।

ইসলাম শুধুমাত্র ইবাদত করা নয়, ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। ইসলাম বলতে রাজনীতি, অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক আইন, বিচার ব্যবস্থা, সামাজিক জীবন, ইত্যাদি সব কিছু বুঝায়। আমাদেরকে আবার জেগে উঠতে হবে।

আমাদের তরুণ তরুণীদের বিষয়ে সচেতন হতে হবে। তাদেরকে নিয়ে কাজ করতে হবে। নারীরা ঐতিহাসিকভাবে অবহেলার স্বীকার। ইসলামী সভ্যতার পূনর্জাগরণ করতে হলে তাদের বিষয়ে অবশ্যই আমাদের সচেতন হতে হবে।

প্রিয় ভাই ও বোনেরা, ছয়’শ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মত ইসলামী পূনর্জাগরণ সর্বত্র শুরু হয়েছে। অতীতে ইসলামী পূনর্জাগরণের প্রচেষ্টা আমরা লিবিয়ায় দেখেছি এবং তা ব্যর্থ হয়েছে, এভাবে সুদান কিংবা বাংলাদেশে শুরু হয়েছিল এবং ব্যর্থ হয়েছে, ইত্যাদি।

কিন্তু ছয়’শ বছরের মধ্যে এটাই প্রথম আপনি মুসলিম অধ্যুষিত কিংবা অমুসলিম অধ্যুষিত যে জায়গায় যান না কেন মুসলমানরা তাদের জীবন ব্যবস্থার দিকে ফেরত আসছে তা দেখতে পাবেন। তরুণ তরুণীদেরকে ইসলামের প্রতি দায়বদ্ধ দেখতে পাবেন।

এই যখন অবস্থা, আমরা জানি আমরা আবার জেগে উঠতে পারব।

আমি যেমনটি আপনাদেরকে দেখছি এরকম সর্বত্র মানুষেরা কাজ করছে।

প্রিয় ভাই ও বোনেরা, বেশিরভাগ মানুষ কিছু কিছু ঘটনা প্রবাহ নিয়ে বেশি চিন্তিত। যেমন ১১ই সেপ্টেম্বরের ঘটনাসহ এধরনের আরও বেশ কিছু ঘটনা। তারা এর বাইরে আরও বিশাল কিছু আছে সেটা দেখতে পাচ্ছে না। খুব কম মানুষই এই বিশালতা লক্ষ করছেন।

এসব বুঝতে হলে আপনাকে ইতিহাস এবং সভ্যতার গতিধারা বুঝতে হবে।

ইসলাম খুব দ্রুত ক্ষমতায় আসে, বিস্তৃত হতে থাকে প্রায় আট’শ বছর ধরে তারপর প্রায় ছয়’শ বছর ধরে অধঃপতনের ফলে সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছে যায়। ১৯৪৮ সালে সর্বনিম্ন স্তরে পৌঁছে এবং ১৯৬৭ সালে আর একবার পতন হয় যখন আমরা আল্লাহ সুবাহানাহু তা’আলার শত্রু ইহুদিদের কাছে পরাজিত হই। তারা আমাদের হৃদয় ইসলামের কেন্দ্রভূমি ফিলিস্তিন দখল করে ফেলে।

ফিলিস্তিন তাদের দখলে চলে যায়।

যদি আপনারা ইতিহাস অধ্যয়ন করেন দেখতে পাবেন আবার শক্তিশালী পূর্নজাগরণ শুরু হয় ১৯৬৭ সালের পর থেকে।

১৯৬৭ সালের আগে আরব জাতীয়তাবাদ, তার্কি জাতীয়তাবাদ ইত্যাদির ব্যাপক প্রভাব ছিল। কিন্তু ১৯৬৭ সালের পর আমরা আবার জেগে উঠি এবং আবার কাজ শুরু করি। প্রথমবারের মত এখন মুসলমানদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিকসহ নারী ও শিশু সংগঠন রয়েছে, মুসলিম ব্যাংক, মিডিয়া, সংবাদপত্র, স্যাটেলাইট টিভি ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে মুসলমানদের অংশগ্রহণ রয়েছে।

এ এক নব জোয়ারের সূচনা।

আমরা কোন পথে এগিয়ে চলছি ?

ইসলামের ভবিষ্যৎ কি হতে পারে ?

আমি হযরত মুহাম্মদ (সা) এর একটি হাদিসের মাধ্যমে আলোচনা শেষ করব। একটি প্রসিদ্ধ হাদিসের মাধ্যমে রাসূল (সা) আমাদের কে যেন ইতিহাসের গতিধারা জানিয়ে দিয়েছেন।

হাদিসটি ইমাম আবু আহমদ সহ অনেকেই বর্ণনা করেছেন।

হাদিসটি অনেক প্রসিদ্ধ যা আলবানি, সহি গ্রন্থগুলো সহ অনেক জায়গায় আছে।

এটি একটি নির্ভুল হাদিস।

ইয়া ক্কুল (সা) তাকুনুন নাবিয়াতু ফিকুম মাশাআল্লাহু লাহা আনতাকুন। তোমাদের মাঝে নবুয়ত ততো দিন থাকবে যতো দিন আল্লাহ সুবাহানাহু তা’আলা চাইবেন।

ছুম্মা ইয়ারফাহু আল্লাহু ইযা শা’আ আন ইয়ারফাহ। অতঃপর আল্লাহ যখন চাইবেন তার সমাপ্তি হবে। (তিনি যখন ইচ্ছা হয়েছে নবুয়তের সমাপ্তি ঘোষণা করেছেন এবং নবুয়াত জীবন ছিল মাত্র ২৩ বছর।)

ছুম্মা তাকুনু খিলাফা আলা মিন হাজিন নাবুয়া। অতঃপর ইসলামের পূর্ণ অনুশীলনে নবুয়তের অনুসরণে খিলাফত ব্যবস্থা আসবে।

ফাতাকুনু ফিকুম মাশাআল্লাহু লাহা আনতাকুন, ছুম্মা ইয়ারফাহু আল্লাহু ইযা শা’আ আন ইয়ারফাহ। অতঃপর আল্লাহ্ চাইলে তার সমাপ্ত হয়ে যাবে। (খিলাফত ব্যবস্থা ৩০ বছর বিদ্যমান ছিল এবং তার পরিসমাপ্ত ঘটে।)

এরপর কি হতে পারে ইয়া আল্লাহর রাসূল (সা) ?

ছুম্মা ইয়াকুনু মুলকান আদ্দান । অতঃপর বিভিন্ন রাজতন্ত্রের সৃষ্টি হবে। (মুলকান আদ্দান বলতে বুঝায় দীর্ঘ দিন ধরে টিকে থাকবে এ ধরনের রাজতন্ত্র এবং আমরা তার ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণ পেয়েছি। যেমন, উমাইয়া সম্রাজ্য এক’শ ত্রিশ বছর, আব্বাসি চার’শ বছর এবং আরও অনেক যেমন মামলুকি, ফাতেমি, ওসমানি সম্রাজ্য ছয়’শ বছর টিকে ছিল। আমরা জানি এগুলো দীর্ঘদিন ধরে ছিল।)

ফা’ইয়াকুনু ফিকুম মাশাআল্লাহু লাহু আন ইয়াকুন। এ সব সম্রাজ্য আল্লাহ সুবাহানাহু তা’আলা যতদিন চাইবেন ততদিন টিকে থাকবে।

ছুম্মা ইয়ারফাহুল্লাহু ইযা শা’য়া আন ইয়ারফা। অতঃপর আল্লাহ যখন চাইবেন সেগুলোর অবসান ঘটবে। (আর ইতোমধ্যে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল থেকে এসব সম্রাজ্যের অবসান ঘটেছে। কোন সম্রাজ্য আর টিকে নেই।)

এরপর কি হতে পারে ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা) ?

তিনি আমাদেরকে আমাদের অর্থাৎ ইসলামের ভবিষ্যৎ বলে দিচ্ছেন।

ছুম্মা ইয়াকুনু মুলকান জাবরিয়ান (আল জাবর, আল কুয়া, মুলক বিল কুয়া )। অতঃপর সামরিক শাসন আসবে।

(মুলকান জাবরিয়ান, সামরিক শাসন, জাবর, কুয়া, মিলিটারি। বর্তমানে এমন কোন মুসলিম দেশ আছে যাতে সামরিক শাসন নেই ? খেয়াল করবেন; আপনাদের চারপাশে দৃষ্টি রাখেন। কোন দেশটিতে সামরিক শাসন নেই ? খুব বিরল দু’একটি বাদে সবগুলো দেশ সামরিক শাসনের অধীনে রয়েছে।

রাসূল (সঃ) সমস্ত সত্য বলে দিয়েছেন। আর তার প্রমাণ এখন মিলছে। ১৪’শ বছর আগের একটি হাদিস আর আমরা তার সত্যতা আজও দেখতে পাচ্ছি। আরও কতদিন এই সামরিক শাসন চলতে থাকবে ? সেটা কি অনন্তকাল চলবে ? না। কখনো নয়; সামরিক শাসন অনন্তকাল ধরে চলবে না। সামরিক শাসনের পর অবশ্যই অন্য কিছু আসবে।)

ইয়া ক্কুলু (সা) ফাইয়াকুম ফিকুম মাশাআল্লাহু লাহু আন ইয়াকুন। এই সামরিক শাসন তোমদের মাঝে থাকবে ততো দিন যত দিন আল্লাহ চাইবেন।

ছুম্মা ইয়ারফাহুল্লাহু ইযা শা’য়া আন ইয়ারফা। অতঃপর আল্লাহ যখন চাইবেন তার সমাপ্তি ঘটবে।

(এরপর কি আসবে ? আমরা কি আশা করতে পারি? যদি আমি আমার মতামত দেই, কিংবা আমার অনুমান বা ব্যাখ্যা দিই তাহলে আপনাদের সন্দেহ থাকতে পারে। কিন্তু আমি আমার নিজের কথা বলছি না। আমি হযরত মুহাম্মদ (সা) এর কথা বলছি।)

ওয়ামা ইয়ানতিকু আনিল হাওয়া ইনহুয়া ইল্লাহ্ ওয়াহয়ুন ইউহা।(আমি আমার নিজের কথা বলছিনা) এগুলো হলো হযরত মুহাম্মদ( সা) এর বাণী, যিনি নিজের থেকে কোন কথা বলেন না। বরং তিনি ঐশী বাণীর মাধ্যমে কথা বলেন। (সূরা আন নাজম, আয়াত: ৩-৪)

আল মুলক আল জাবর (সামরিক শাসন) এরপর কি আসতে পারে ?

ইয়াক্বুলু (সা) ছুম্মা তাকুনু খিলাফাতান আলা মিনহাজিন নাবুয়া।

আবার সেই ওমর, আবু বকর, আলি, ওসমানের মত খিলাফত ব্যবস্থা কায়েম হবে।

(ওমর, আবু বকর, আলি, ওসমান (রা) খিলাফত ব্যবস্থা সম্পর্কে রাসূল (সা) বলেছিলেন ‘খিলাফা আলা মিন হাজিন নাবুয়া’ এবং আগামীতে যে খিলাফত ব্যবস্থাটি কায়েম হবে সেটা সম্পর্কে একই ভাবে বর্ণনা করেছেন ‘খিলাফা আলা মিন হাজিন নাবুয়া। অর্থাৎ একটি খিলাফত ব্যবস্থা যা আল্লাহর রাসূল (সা) এর পূর্ণ অনুসরণ ও অনুকরণে প্রতিষ্ঠিত হবে।)

ছুম্মা সাকাআতা (সা) ।এরপর তিনি (সা) নীরব হয়ে গেলেন।

তারপর কি হবে আমরা জানি না। কিন্তু প্রিয় ভাই ও বোনেরা, আমরা জানি এতে কোন সন্দেহ নেই ইসলাম আবার বিজয়ী হবে।

আল্লাহ আকবার।

সুতরাং ইসলামের ভবিষ্যৎ কি ?

- ইসলাম আবার গোটা বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত হবে।

এখন আপনাদের সামনে দুইটি সুযোগ- হয় ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে কাজ করবেন এবং পুরস্কৃত হবেন, না হয় পৃথিবীর রঙ্গিন জীবন নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন এবং এই সুবর্ণ সুযোগ হারাবেন।

আল্লাহ সুবাহানাহু তা’আলা মক্কা বিজয় সম্পর্কে বলেছেন, (মক্কা বিজয়ের আগে ও পরে বিভিন্ন বিস্ময়কর আয়াত নাজিল হয়) ইয়া ক্বূল্লা হাজ্জা ওয়া জাল, লা ইয়াজতায়ি মিনকুম মান আমফাকা মিন কাতালিন ফাতাহ ওয়া কাতাল উলা ইকা আলামু দারাজাতাম মিনাল্লাজিনা আনফাকু মীম বাদী ওয়া ফাতি।

আল্লাহ সুবাহানাহু তা’আলা বলেছেন, তারা কখনই সমান হতে পারে না যারা মক্কা বিজয়ের পূর্বে জান ও মাল দিয়ে লড়াই করেছে।(আল ফাতাহ তিনি ফাতাহ না বলে আল ফাতাহ বলেছেন)।

বিজয় আসবেই।

সুতরাং আপনি সংগ্রাম ও যুদ্ধ করতে পারেন এবং মাল ব্যয় করতে পারেন বিজয় আসার পূর্বেই।

আল্লাহ সুবাহানাহু তা’আলা বলেছেন, তারা উত্তম তাদের থেকে যারা মক্কা বিজয়ের পরে সংগ্রাম ও ব্যয় করেছে।

সুতরাং প্রিয় ভাই ও বোনেরা, এটা আমাদের সিদ্ধান্ত।

আমরা যদি নিরন্তর প্রচেষ্টা চালাই ইনশাল্লাহ খুব দ্রুতই ইসলাম আবার বিশ্ব শাসন করবে।

আর যদি আমরা অলস সময় কাটাই তাহলে আরও অনেক দেরি হয়ে যাবে।

সুতরাং আমাদের নিজেদের পরিশুদ্ধ করতে হবে, নিজেদের পরিবারকে পরিশুদ্ধ করতে হবে, তাদেরকে ইসলামের পূর্ণ অনুসরণ করার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালাতে হবে। আমাদের চারপাশের মানুষের মাঝে ইসলামের সুমহান আদর্শ বাস্তবে তুলে ধরতে হবে, তাদেরকে ইসলামের দিকে দাওয়াত দিতে হবে। সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ বা অন্যায় কাজ থেকে মানুষকে বিরত রাখার চেষ্টা করতে হবে। ইসলামী সংগঠন, ইসলামী আর্থিক প্রতিষ্ঠান, মুসলিম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মিডিয়া সংস্থা, রাজনৈতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

দয়া করে এই বিজয়কে এগিয়ে নিতে আপনার সর্বোচ্চ সাধ্য অনুযায়ী কোন না কোন কাজে নিজেকে নিয়োজিত করুন। যাতে আল্লাহর কৃত ওয়াদা অনুযায়ী যে বিজয় আসছে তার অংশীদার হতে পারেন ।

এতে কোন সন্দেহ নেই ইসলাম আবার বিজয়ী হবে।

হাজা ওয়া’সাললাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আ’লা সাইয়্যেদিনা মুহাম্মাদিন ওয়া আ’লা আলি মুহাম্মাদিন আজমাইন। শাকারাল্লাহু লাকুম। এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে শোনার জন্য আপনাদের অনেক ধন্যবাদ। ওয়া বারাকাল্লাহু ফিকুম ওয়া নাসরুল্লাহু তা’আলা লানা ওয়ালানাকুমুল কাবুল। ওয়াসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি বারাকাতুহ্।

মূলঃ The Future of Islam

Dr. Tariq Swaidan

ড. তারিক সোয়াইদান

Presented by- FAMSY, Federation of Australian Muslim Students & Youth, Sydney, Australia 2004.

ভাষান্তর –আগস্ট ০১, ২০১৩

মোঃ হাবিবুর রহমান হাবীব

এম.এস.এস.,আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।

অনুপ্রেরণায়-

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক

সহযোগী অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।

ডিরেক্টর,

সেন্টার ফর সোশ্যাল অ্যান্ড কালচারাল স্টাডিজ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।

Presented by- FAMSY, Federation of Australian Muslim Students & Youth, Sydney, Australia 2004.

বিষয়: বিবিধ

৪৮৮৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File