আবেগের হাতে অন্ধ...

লিখেছেন লিখেছেন প্রহরী ১৭ এপ্রিল, ২০১৩, ০৮:২০:৩৭ রাত



অনেক দিন আগের কথা। তখনও পৃথিবীতে মানুষ আসেনি। জন্ম নেয়নি এলিয়েন- ড্রাগন কিংবা অন্যকোনো দানবও। পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে মাত্র। আর একে একে সৃষ্টি হচ্ছে নানা বস্তু। একপর্যায়ে পৃথিবীতে আসতে আদেশ দেয়া হলো মানব-স্বভাবগুলোকে। একে একে নেমে এলো, আবেগ, ভালোবাসা, মিথ্যা, কৃপণতা, সৃজনশীলতা, অলসতা, হিংসা, লালসাসহ আরো যতকিছু।

নতুন পৃথিবী, নতুন মেহমান। হাতে কাজও নেই, আবার নির্দিষ্ট কোনো ঠিকানাও নেই। ভাবলেশহীন বসে থেকে ভালো লাগছিল না কারোই!

সবাই চিন্তা করলো, এবার ঘুরেফিরে দেখা যাক সারাটা পৃথিবী। তারা দলবেঁধে উড়াল দিল আকাশে। উড়তে লাগলো পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে।

উড়তে উড়তে আবারও ক্লান্তিতে ভর করল। অবসাদে ছেয়ে গেল দেহমন। শরীরটা আর ঠিক যাচ্ছে না। নিজের দেহও যেন বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের কাছে। এবার কিছু একটা করতে চায় তারা। অবসাদ কাটিয়ে উঠতে হবে যে করেই হোক।

প্রথমে মুখ খুলল সৃজনশীলতা। বলল, ‘আসুন! আমরা ক্লান্তি দূর করার চেষ্টা করি। আমি একটি খেলায় অংশগ্রহনের প্রস্তাব করছি।’

নিজে থেকে নামও প্রস্তাব করল, ‘খেলাটির নাম হবে চোরপুলিশ’।

প্রস্তাব পাওয়ামাত্রই যেন সবার প্রাণ সঞ্চার হল। সবাই চনমনে হয়ে উঠল। আর সমস্বরে একাত্বতা প্রকাশ করলো।

আবেগ সবার আগে লাফিয়ে উঠল, চিৎকার করে ঘোষণা দিল, ‘আমি এ খেলার শুরু করতে চাই। আমিই শুরু করতে চাই।’

সে যেন বাধ মানে না। কাউকে সুযোগ না দিয়ে বলতে লাগলো, ‘আমি প্রথমে চোখ বন্ধ করবো। আর গুনতে থাকবো এক, দুই, তিন... একশত। তোমরা ততক্ষণে নিজেদের লুকিয়ে নেবে।’

অতপর সে গাছের দিকে মুখ করে দাঁড়াল। আর দুই হাতে গাছের সাথে ঠেস দিয়ে মাথা ঠেকিয়ে রাখল।

এবার গুণতে লাগল, এক, দুই, তিন... ... ...।

অন্যদিকে মানবপ্রকৃতিগুলো নিজেরদের লুকিয়ে নিতে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল।

কোমলতা উষ্ণ পরশের খুঁজে ছুটলো। আর মায়াবীচাঁদের আঁড়ালে আশ্রয় নিল।

আত্মসাৎ ডুব দিল নোংরা-আবর্জনাস্তুপে।

আসক্তি নিজেকে ঢাকল নিকষ কালো মেঘের চাদরে।

লালসা লুকালো স্যাঁতস্যাঁতে কাঁদামাটির গভীরে।

মিথ্যা সে তো মিথ্যাই। ধোঁকা দেবার মানসে উচ্চস্বরে ঘোষণা করল, ‘আমি গাছের আঁড়ালে দাঁড়াচ্ছি’। পরক্ষণেই ঝাঁপ দিল সমুদ্র গভীরে।

আবেগ গুণেই যাচ্ছে, উনআশি... আশি... একাশি...।

এরই মাঝে সবাই লুকিয়ে পড়েছে। কিন্তু ভালোবাসা নিজেকে লুকানোর জায়গা খুঁজে পাচ্ছে না। বস্তুত ভালোবাসা তো এমনই। যা শত চেষ্টার পরও লুকিয়ে থাকতে পারে না। সে অবিরাম খুঁজাখুঁজি করছে কোথায় লুকাবে।

আমরা ভালো করেই জানি ভালোবাসা গোপন করা কতটা দূরূহ।

এদিকে সময়ও শেষ হয়ে এলো। আবেগ গুণে গুণে একশত পর্যন্ত পৌঁছল। অবশেষে ভালোবাসা একটি ছোট্ট গোলাপের ঝোঁপে ঝাঁপিয়ে পড়ল। মুহূর্তেই নিজেকে লুকিয়ে নিল সুরভিত ফুল ও সবুজ পাতার আচ্ছাদনে।

আবেগ চোখ খুললো। ‘আমি তোমাদের দিকে আসছি, আমি আসছি’ বলে উচ্চস্বরে তার আগমনবার্তা জানান দিল। অতপর খুঁজতে উদ্যত হলো।

সবার আগে দেখা পেল অলসতার। বেচারা! একটু আঁড়ালে যেতে হলে তো আবার জায়গা ছেড়ে নড়াচড়া করতে হবে। যতই হোক, শরীরের উপর কিছুটা হলেও দখল যাবে! কত্তোসব ঝক্কি-ঝামেলা। তাছাড়া শরীরটাও কেমন ম্যাঝম্যাঝ করছে; একটু হাই তুলে আবার আগের জায়গাতেই বসে পড়েছিল। কোনোভাবেই লুকানোর চেষ্টা করেনি।

এর পর চাঁদের আঁড়ালে লুকিয়ে থাকা কোমলতার দেখা পেল। মিথ্যাকেও বের করে আনলো সমুদ্র-গভীরতা থেকে। একটু পরেই কাঁদামাটির গভীরে লুকিয়ে থাকা লালসার দিকে আঙুল উঁচিয়ে বেরিয়ে আসতে নির্দেশ করল।

একের পর এক বেরিয়ে এলো সবাই আবেগের কাছে হার মেনে। কিন্তু ভালোবাসা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না! আবেগ অনেক ছোটাছুটি করলো; কোনো লাভ হলো না। অবশেষে উৎসাহ হারিয়ে ফেলল। হতাশায় ছেয়ে গেল মন। ভাবতে লাগল, শেষ পর্যন্ত বুঝি ভালোবাসার কাছে হার মানতে হবে!

ভালোবাসার এই বিজয় হিংসা সয়ে নিতে পারছিল না। এগিয়ে এলো আবেগের কাছে। আর কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘ঐ ছোট্ট গোলাপগাছের আঁড়ালে আছে! যাও, ওখানে খুঁজো! তাড়াতাড়ি!’

ছোট্ট গোলাপগাছটি ফুল আর পাতায় একেবারে ছেয়ে ছিল। খালি চোখে ভিতরের অবস্থা দেখা যাচ্ছিল না। আবেগকে উত্তেজনা পেয়ে বসল। কোনোরূপ বিচার বিবেচনার শক্তি হারিয়ে ফেলল। ততক্ষণাৎ একটি কাঁটা হাতে তুলে নিল। আর অস্থিরভাবে খুঁচিয়ে খুুঁচিয়ে তালাশ করতে লাগল। তার প্রতিটি খুঁচা তীরের ফলার ন্যায় ঝুপের গায়ে আঘাত করতে লাগল। সে থামতেই চাইছিল না। আঘাত করেই যাচ্ছে একাধারে! হঠাৎ ঝোঁপের আঁড়াল থেকে এক হৃদয়বিদারক কান্নার আওয়াজ ভেসে এলো।

বেরিয়ে এলো ভালোবাসা মাথা নিচু করে। দুইহাত দিয়ে চেপে রেখেছে চোখগুলো। আঙুলের ফাঁক গলে টপটপ করে ঝরছে ‘রক্ত’।

আবেগ তার কাজের জন্য যার পর নাই শঙ্কিত হয়ে পড়ল। চিৎকার করে উঠল, ‘হায় আল্লাহ, আমি একি করলাম! আমি কিভাবে এ ভুলের মাশুল দেব! আমি তো তাকে অন্ধ করে দিলাম!’

এবার ভালোবাসা মুখ খুলল। জবাব দিল, বন্ধু! যা হবার হয়ে গেছে। তুমি তো আমার দৃষ্টি ফিরিয়ে দিতে পারবে না। তবে আমার জন্যে যদি কিছু করতে চাও! তাহলে একটি কাজ করতে পারো; তুমি আমার পথচলার সাথী হয়ে যাও! তুমি আমাকে হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে যাবে আর আমি তোমার হাত ধরে পথ চলব। যতদিন আমি ভালোবাসা থাকবো, তোমার হাত ধরেই এগিয়ে যাব। আমরা একে অপরের হয়ে থাকব চিরকাল। ভালোবাসার বেঁচে থাকবে আবেগকে সাথে নিয়ে, আর আবেগ পথ চলবে ভালোবাসাকে টেনে নিয়ে।

সেদিন থেকে আবেগ আর ভালোবাসা একই বৃত্তে বন্দি। ভালোবাসা পথ চলে অন্ধেরমত। আর তাকে টেনে নিয়ে যায় নির্বোধ আবেগ।

কালের পরিক্রমায় আজ স্বভাবেরা খুঁজে পেয়েছে ঠিকানা। আশ্রয় নিয়েছে মানুষের মাঝে। তবু ভালোবাসার চোখ খুলেনি। পথ চলছে অন্ধেরমত। আবেগের হাত ধরেই।



০১৭২৪৭৫৭৬১৫.০১৯১১৫২৭০২৩

বিষয়: Contest_mother

১৪১৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File